Sankars Creation

নীল যেখানে দেদার ছড়িয়ে
তপন বিশ্বাস
।। বারো ।।
গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার নেমে পড়েছে । ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে দেড়টা । সৌরভদা বলল, “চলো, আমরাও নেমে একটু হাত-পা ছাড়িয়ে নিই ।” এতক্ষণ গাড়ির মধ্য থেকে যা দেখছিলাম সে তো ছিল হিমশৈলের চূড়াটুকু ! আবছা আলোয় ঝাপসা চোখে ঠাণ্ডার সাথে নতুন করে পরিচিত হওয়ার সাথে সাথে পরিচিত হলাম প্রকৃতির শ্বেতাম্বরী রূপের সাথে । মেরুপ্রদেশে হাজির হয়েছি যেন ! চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ । আজ বোধহয় কৃষ্ণপক্ষের ষষ্ঠী অথবা সপ্তমী । হিসেব করে বের করব যে মাথা কাজ করছে না । ঠাণ্ডায় শরীরের সাথে মস্তিষ্কও জমে যাচ্ছে । প্রকৃতির এই হিমশীতল রূপ প্রলয়ংকরী না হলেও ভয়ংকরী তো বটেই ! আবার সুন্দরীও ! সিগারেট জ্বালিয়ে ফেললাম সাময়িক উত্তেজনায় ।
কাঁপুনির চোটে সিগারেটটা পড়ে গেল মুখ থেকে । সৌরভদা বলল, “বেশ হয়েছে । কন্ট্রোল করতে পার না ! ওয়ার্ল্ড রেকর্ডটা তো হয়েই গেছে, আবার কেন !”
“সরি সৌরভদা ।” নিজেকে অপরাধী মনে হল । সৌরভদাকে কথা দিয়েছিলাম হাই অল্টিচ্যুডে আর সিগারেট খাব না । ছেড়েও দেব আস্তে আস্তে । কথা রাখতে পারিনি ।
চাঁদের হালকা আলোয় দেখলাম সামনে একটা ফলক । কাছে গিয়ে পড়তে হল । ওয়ার্ল্ড সেকেন্ড হায়েস্ট মোটরেবল রোড বলে উল্লেখ করা আছে টাংলালা’কে । অল্টিচ্যুড ১৭৫৮২ফিট। আশ্চর্য ! চাংলা পাসের উচ্চতা লেখা দেখেছি ১৭৫৮৬ফিট । সৌরভদাকে বললাম, “সৌরভদা, এটা কেমন করে হয় ? টাংলালার উচ্চতা ১৭৫৮২ফিট আর আমার পরিষ্কার মনে আছে চাংলায় দেখেছি লেখা ছিল ১৭৫৮৬ফিট । তাহলে এটা কী করে সেকেন্ড হায়েস্ট হয় !”
সৌরভদা বলল, “ওসব পরে ভাবা যাবে । কিছু একটা গন্ডগোল আছে । হতে পারে এটার সর্বোচ্চ উচ্চতা চাংলার থেকে বেশি । এখন চলো ওই মন্দিরে যাওয়া যায় কিনা দেখি ।”
যাওয়া গেল না । এমনিতেই রাতের বেলা এই পথে চলেছি মৃত্যুর সাথে মোকাবিলা করতে করতে তার উপর পথে এত বরফ যে ওগুলো ডিঙিয়ে মন্দিরে যাওয়া মানে মৃত্যুর হাতে নিজেদের সঁপে দেওয়া ।
ড্রাইভার হাত-পা ছুঁড়ছিল । গাড়ির চালক সে । তাকে তো হাত-পা গরম রাখতেই হবে । হাড়হিম করা ঠাণ্ডায় ফুলহাতা শার্টের উপর সে একটা হাফশ্লিভ সোয়েটার পরে আছে মাত্র । তাই সে শরীর গরম রাখতে মাঝে মাঝে গলায় ঢালছে তরল আগুন !
টাংলালা ক্রমশঃ অশান্ত হয়ে উঠছিল । যে হিমেল বাতাস এতক্ষণ শুধু মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছিল জলকণায়, এখন বরফকুচি ছুঁড়ছে মুখে, মাথায়, সারা শরীরে । ধোঁয়ার মতো মেঘের কুণ্ডলী উঠছে মন্দিরের পেছনে । পর্বতশীর্ষে মেঘ জমাট বেঁধেছে ঠাণ্ডার সাথে জোট বেঁধে ।
নির্জনতা কখনো কখনো ভালো । কিন্তু এই প্রাণহীন নির্জনতা আর শীতলতা দুটোই অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে এখন । ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে যেন । সৌরভদা তাড়া লাগাল, “অনেক হয়েছে । চলো, গাড়িতে উঠি । যা ঠাণ্ডা ! জমে যাব আর কিছুক্ষণ থাকলে ।”
ড্রাইভারও তাড়া দিল । গাড়িতে ওঠার পর সৌম্যশুভ্র বলল, “কী করে বাইরে ছিলে এতক্ষণ ? মনে তো হচ্ছে নর্থপোলে এসেছি !”
সৌরভদা হেসে বলল, “একটু নেমে দেখলে বুঝতে পারতিস ঠাণ্ডা কাকে বলে ! তোর জন্যেই আমরা ড্রয়ার পরিনি ! ভাগ্যিস তলায় থার্মোকটের গেঞ্জি পরে নিয়েছিলাম । তুই তো সেটাও পড়িসনি । নীচে নামলে জমেই যেতিস ।”
তুষার রাজ্যে গোলকধাঁধায় চক্কর কাটছে গাড়িটা । অনেকক্ষণ ধরেই একটা গাড়িও চোখে পড়েনি । এত রাতে এই পথে গাড়ি চালানোর দুঃসাহস সব ড্রাইভার দেখায় না । উচিতও নয় বোধহয় ।
একটু উষ্ণতার খোঁজে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলাম সৌরভদা আর আমি । নৈঃশব্দের এই পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ আমরা । স্নো লেপার্ড মানুষের কাছে ঘেঁসে না শুনেছি । কিন্তু যদি একটা ইয়েতি এসে পথরোধ করে দাঁড়ায় এখন ? কেমন হয় তবে ? ইয়েতি কী সত্যি আছে ?
গাড়ির সামান্য আওয়াজ ছাড়া চাকার নীচে বরফ ভাঙার শব্দ । চারিদিক সুনসান । একটু আগে ইয়েতির কথা মনে হলেও মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে । দুঃসাহসী হতে গেলে একটা কথা মনে রাখতে হয়- ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’ । সৌরভদা বলে “সব সময় এবং সর্বক্ষেত্রে না হলেও কখনো কখনো চ্যালেঞ্জ নিতে হয় ।” আবার ছোট থেকে শুনে আসছি ‘ভাগ্য চিরকালই সাহসীদের সঙ্গে থাকে’ । আমি এটা মানি না । আবার সৌরভদার মতো চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো করেও ভাবতে পারি না । যেখানে যাওয়া যেতে পারে অর্থাৎ যেখানে সম্ভাবনা আছে সেখানে যেতে সব সময়ই প্রস্তুত আমি । ‘জীবন মৃত্যু…………’ ব্যাপারটাও আমার মাথায় আসে না তখন ।
আর একটা বরফে ঢাকা গিরিবর্ত্ম পার হয়ে এলাম রাতের নিঃশব্দতায় । সৌরভদা বলল, “বোধহয় লাচুংলা পাস ।”
ছোট একটা উপত্যকায় পাশাপাশি কয়েকটা তাঁবু । বরফ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে । নুড়ি বিছানো পথের শেষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার নেমে গেল । সৌরভদার সাথে আমিও নামলাম । ড্রাইভার একটা তাঁবুতে ঢুকেছে । তাঁবুর কাছে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়ানো । হয়ত রাত্রিবাস করছে গাড়ির আরোহীরা । প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপট । শেষরাতের কুয়াশাঘেরা চাঁদের ম্রিয়মান আলোয় দেখা গেল ঊষর উপত্যকাকে চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে অনেকগুলো পাহাড় ।
সারচু নালা পেরিয়ে সারচু’তে এসে পৌঁছালাম । হিমাচলের শুরু সারচু থেকে । মানালি-লেহ’র যাত্রীরা অনেকেই রাত্রিবাস করে এখানে । উপত্যকা জুড়ে বড় বড় প্রস্তরখণ্ডের মাঝে সবুজ তৃণভূমি । ছোট ছোট জলের ধারা মিশে যাচ্ছে ছোট নদীর বুকে । প্রকৃতি শীতল চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছে । ঝলসানো রূপ নেই কিন্তু নান্দনিক । এবার ড্রাইভারের পিছু পিছু একটা তাঁবুতে ঢুকলাম । তাঁবুর ভেতরে সারি সারি শয্যা পাতা । মাটি থেকে একটু উঁচু করে করা হলেও রাত কাটানোর উপযুক্ত না । বরফ আর জলকাদায় মাখামাখি তাঁবুর ভেতরটা ।
চা পাওয়া যাবে । সৌরভদা বলল, “দেখি বাবিকে জিজ্ঞেস করে আসি ও চা খাবে কিনা ।”
সৌরভভদা ফিরে এসে বলল, “নাহ্‌ ! চা খাবে না । সেই যে লেহ’তে উঠে বসেছে আর নামেনি ! নামার কোন ইচ্ছেই নেই ! কথা না শুনলে কষ্ট তো করতেই হয় । এত ঠাণ্ডায় কোনদিন কোথাও যায়নি কখনো !” ছেলের জন্য বাবার কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ ।
গাড়িতে ফিরে এসে দেখলাম সৌম্যশুভ্র ক্যাডবেরি খাচ্ছে । সৌরভদা সস্নেহে পিঠে হাত রাখল, “আর একটা ক্যাডবেরি খাস । শরীরটা গরম হবে ওতে ।”
আড়মোড়া ভাঙছে আকাশ । রাতের চেয়ে ভোরে হাওয়ার দাপট বেশি । প্রভাতি আলোর দেখা মিললেও কোন পাখির ডাক শুনতে পেলাম না । একটা মোরগও ডেকে উঠে জানাল না রাত শেষ হয়ে গেছে । মনে হয় জনবসতিও নেই আশেপাশে ।
পেছনের সিটের যাত্রীদের কোন সাড়াশব্দ নেই । ওরা দু’জন দু’জনের শরীরের উষ্ণতা ভাগ করে নিচ্ছে চাদরের আড়ালে । ওদের বয়সী ছেলেমেয়েদের শরীরের উষ্ণতা আগুনের চাইতেও বেশি হয় কখনো কখনো ।
পাহাড়ের শরীরকে বেড় দিয়ে উঠছে গাড়ি । চাকার চাপে মচমচ করে বরফ ভাঙছে । পর্বতচূড়া থেকে তলা অবধি বরফ । ভোরের আকাশ ঘুমিয়ে পড়ছে আবার ! সমুদ্রের মতো পাহাড়ও কখনো কখনো একঘেয়ে লাগে । বরফ থেকে এখন মুক্তি চাইছে মন ।
বারলাচালা পাসের গিরিপথে চক্কর কাটছে গাড়িটা । বাঁদিকে অনেকদূরে একটা নদী দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড়ের মাঝে । ওদিকের পাহাড়ের মাথায় কালচে আকাশে লাল রঙের ছোঁয়া দেখে বুঝলাম ওদিকটা পূর্বদিক ।
দুর্দান্ত সুন্দর একটা হ্রদ । আকাশটার সাথে সাথে হ্রদের জলও নীল হয়ে উঠছে । বরফের ভেলা ভাসছে জলে আর তারই ফাঁকে ফাঁকে স্ফটিকশুভ্র পাহাড়ের চূড়া ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ দেখছে জলের আয়নায় । সৌরভদা বলল, “বাবি, দেখ তো একটা ছবি তুলতে পারিস কিনা সূরজতালের । জলে পাহাড়ের ছায়াটা নিয়ে তুলবি কিন্তু !”
অনেকক্ষণ ধরে সূরজতালকে একই দিকে রেখে দণ্ডি কেটে এগোচ্ছে গাড়িটা । সূর্য উঠে গেল সূরজতালে । সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করতে লাগল হ্রদের জল ।
“সৌরভদা, রাতে যাত্রা করে ভুল করিনি আমরা । মন ভরে উঠছে গো !”
সৌরভদা হাসল, “দায়ে পড়ে রাতের গাড়ি ঠিক করেছিলাম । ৪৭৭কিমির দীর্ঘ পথ বলে প্রায় সবাই একটা ব্রেক নেয় । কিন্তু আমি ব্রেকজার্নি করতে চাইনি । দেখলে তো কেমন বরফ জমে আছে তাঁবুর ভেতরেও ! বাবি এত ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারত না । ভালই করেছি তাহলে ?”
সকালের আলোয় প্রকৃতির সাথে সৌম্যশুভ্রও উজ্জীবিত । “সারাজীবন মনে থাকবে আমার । অ্যাডভেঞ্চারটা অবশ্য ভালোই হল ।”
সৌরভভদা খুব খুশি হয়েছে ছেলে মুখ খুলেছে দেখে । “এবার দেখবি সকালটা কেমন সুন্দর ! কত নতুন নতুন জায়গা দেখবি সকালের আলোয় । গাড়ি থামলে একটু নেমে হাত-পা ছাড়িয়ে নিস । ভালো লাগবে ।”
বারলাচালার বরফমোড়া পাহাড়ে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ । পাহাড়ের শেষপ্রান্তে দড়িতে বাধা নীল, হলুদ, লাল, সাদা কাপড়ের টুকরো উড়ছে পত্ পত্ করে । “এখান থেকে ত্রিমুখী পথ গেছে জাঁসকার, লাহাহুল-স্পীতি আর মানালির দিকে ।” সৌরভদা জানাল ।
দারচা গ্রামের পথে দাঁড়াল গাড়ি । রাস্তার ধারে ছোট বড় তাঁবু । রাত্রিবাসের সুবিধে ছাড়া চা-জলখাবার, লাঞ্চ-ডিনারের ব্যবস্থা আছে পর্যটকদের জন্য । পাহাড়ের পায়ের কাছে সুন্দর পার্বত্য গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নীলাঞ্জনার মতো একটা নদী । ওপারের রাস্তায় বাস চলতে শুরু করেছে । সৌরভদা মোবাইল অফ-অন করতে করতে বলল, “এই জায়গাটা ট্রেকারদের কাছে খুব প্রিয় । জাঁসকার যাওয়া যায় এখান থেকেও । পথ দুর্গম হলেও পাহাড়ের ভিন্ন প্রকৃতি আর অনন্যসাধারণ রূপ পর্বতপ্রেমীদের মুগ্ধ করে । শুনেছিলাম একজনের কাছে –এই মোবাইলে টাওয়ার পেয়েছি !” লাফিয়ে উঠল সৌরভদা । ছেলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আমারটার পাচ্ছি না ।”
সৌরভদা মোবাইল কানে রেখে খুব জোরে জোরে কথা বলছে কারোর সাথে, “আমরা এখন দারচা গ্রামে । আর কিছুক্ষণ পরেই মানালি পৌঁছে যাব । তোমার শরীর কেমন আছে ? আমরা ভাল আছি । এই নাও বাবির সাথে কথা বল ।” শুভ্রাবৌদির সাথে কথা বলছিল সৌরভদা ।
সৌম্যশুভ্র মোবাইলটা কানে লাগিয়ে মায়ের সাথে কথা বলল । শোনাই যায় না । শুধু হ্যাঁ, হ্যাঁ । সেও খুব আস্তে আস্তে । একটু পরেই বলল, “লাইন কেটে গেছে । চার্জ নেই একদম ।”
দীর্ঘপথের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে । সৌরভদা আর আমি একে অন্যের উপর ঢলে পড়ছি । পড়ে জেগে গিয়ে হেসে ফেলছি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে । ছবির মতো সুন্দর একটা শহর বাঁদিকে । সৌরভদা বলল, “কেলং । লাহাহুল-স্পীতির সদর শহর । চন্দ্র আর ভাগা নদী এসে মিশেছে এখানে । এই চন্দ্রভাগাই আবার কাশ্মীরে ঢুকে হয়ে গেছে চিনাব ।” ইতিহাস আর ভূগোল সব জানে সৌরভদা । এমন একজন সঙ্গী ভ্রমণের সাথী হলে বেড়ানোর মজাটাই অনেকগুণ বেড়ে যায় ।
কোকসারে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হল । চেকিং চলছে । পেছনের ছেলেমেয়ে দুটোও নামল । লেহ থেকে রওনা দেবার পর এই প্রথম ।
আমরা ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । বেশ চড়া রোদ । কোকসারে তাই ঠাণ্ডার আধিক্য কম । চারদিকে সুন্দর সুন্দর পাহাড় খাড়া হয়ে উঠে গিয়ে নীল আকাশ ছুঁতে চাইছে । আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছিল আনমনাভাবে । বেলা বাড়তেই মেঘের দল ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে । কোকসারের পাহাড়ের একটা বিশেষত্ব আছে । এখানে একবার এলে জায়গাটাকে মনে থাকবে চিরদিন । ছবিতে দেখলেও কোকসার বলে চিনতে অসুবিধা হবে না কখনও ।
আবার একটা পাহাড়ে উঠছি । উঠতে উঠতে ঘুম ঘুম চোখে পৌঁছে গেলাম রোটাং পাসে । রোটাং পাসে গাড়ি আর পর্যটকের ভীড় । ওপারের গাড়ি আসছে এখন । দাঁড়াতেই হল । নামলাম গাড়ি থেকে । ড্রাইভার জানিয়েছে একঘন্টা দাঁড়াতে হবে ।
রোটাং পাসে প্রচুর বরফ । পর্যটকেরা ছোটাছুটি করছে বরফের উপরে । বরফরাজ্যে এসে উশুল করে নিচ্ছে বেড়ানোর কড়ি । বাঙালির ভ্রমণের তালিকায় প্রথম দার্জিলিং হলে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবশ্যই কাশ্মীর এবং সিমলা-কুলু-মানালি সার্কিট । রোটাং পাস হল বাঙালির শৈশবের মাঠ । এনার্জি জোগায় বরফ । প্রায় সারা বছরই বরফ দেখতে পাওয়া যায় এখানে । আমাদের এনার্জি শেষ হয়ে গেছে রাতের দীর্ঘ যাত্রায় । আমি রোটাং পাসে আগেও এসেছি । সৌরভদাও এসেছে । সৌম্যশুভ্র’র প্রথমবার আসা কিন্তু ওর শরীর আর দিচ্ছে না । বেশি দূরে যাইনি । গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে আছি সিগনালের আশায় ।
কুড়ি-একুশ বছরের একটা মেয়ে সৌম্যশুভ্র’র মুখের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “সৌম্যশুভ্র ! তুই এখানে ?” ওর মতো সৌম্যশুভ্রও বিস্মিত । ভুরু কুঁচকে ভারী গলায় জবাব দিল, “কেন আমার কী এখানে আসতে মানা আছে ?”
লাল টুপীর তলা দিয়ে কয়েক গাছা চুল এসে পড়ছে কপালে । প্লাক্‌ করা ভুরুর নীচে মুখের সঙ্গে মানানসই চোখ-নাক । ছোট্ট নাকের নীচে লাল টুকটুকে ঠোঁট । বেশ ফর্সা মেয়েটি । কমলা রঙের টী শার্টের উপর সাদা জ্যাকেট, ডেনিম ব্লু টাইট জিনস, স্পোর্টস শু । মেয়েটা সৌম্যশুভ্র’র জবাবে আঘাত পেয়েছে মনে হল । অভিমানে ধরে আসা গলায় বলল, “নাহ্‌, তোকে দেখে এত অবাক হয়ে গেছি আর কী বলব ! কবে এসেছিস তুই মানালিতে ? কেমন আছিস ? কতদিন পরে দেখলাম তোকে ! কতবার ভেবেছি তোদের বাড়িতে যাব, যাওয়া হয়নি । তুইও তো খোঁজ নিসনি ।” একসঙ্গে সে অনেকগুলো কথা বললেও সৌম্যশুভ্র নীরব । সে রোটাং পাসের ছবি তোলায় মনোনিবেশ করছে ।
অভিমানাহত মেয়েটা বলল, “রাখ না এখন ছবি তোলা । বল না কবে এলি ?”
সৌম্যশুভ্র ক্যামেরা নামিয়ে অনিচ্ছাসত্বেও উত্তর দিল, “আমি এখনও মানালিতে যাইনি । লেহ থেকে আসছি ।” জবাবটা দেবার আগে অবশ্য বাবার দিকে তাকিয়েছে সে ।
মেয়েটা লাফিয়ে উঠল, “তুই লাদাখ গিয়েছিলি ! তাই তোকে অত ক্লান্ত দেখাচ্ছে । বিধ্বস্ত একেবারে !” সহানুভূতি উগরে দিয়ে বলল, “সরি, কিছু মনে করিস না । রাগ করেছিস আমার উপর ?”
“তোর উপর শুধু শুধু রাগ করতে যাব কেন ! আমার ভাল লাগছে না কথা বলতে ।” সৌম্যশুভ্র খুব বিরক্ত ।
মেয়েটা সৌম্যশুভ্র’র কথায় পাত্তা না দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “দারুণ একটা জায়গা ঘুরে এলি মাইরি !”
“হবে হয়ত ।” নিস্পৃহ জবাব সৌম্যশুভ্রের ।
“আমার লাদাখ যাওয়ার খুব ইচ্ছে রে ! থ্রি ইডিয়েটসের শুটিং হয়েছিল লাদাখে । প্যাং গং লেকের সেই জায়গাটা দেখেছিস ? সেই লাস্ট সিনের জায়গাটা ? জিৎ আর কোয়েলের একটা সিনেমাতেও আছে লেকটা ।” মেয়েটা সিনেমার পোকা !
সৌম্যশুভ্র’র ঠোঁটের বাঁ কোণটা একটু বেঁকে উঠে আবার নেমে গেল । কিছু বলল না । হয়ত কথা বলতে সত্যিই ওর ভাল লাগছে না ।
“ওহ্‌, তুই !” কন্ঠস্বরে পুরুষ না মহিলা বোঝা না গেলেও মহিলাই । কালো জিনসের প্যান্টের উপর নীল মোটা জ্যাকেট । মাথায় ফার দেওয়া নীল টুপী । “তোর মা কোথায় রে ?” ফাটা বাঁশের মধ্য দিয়ে আওয়াজ বের হল যেন ।
“মা আসেনি ।” সৌম্যশুভ্র’র সংক্ষিপ্ত উত্তর ।
“জানো মা, ওরা লাদাখ বেরিয়ে ফিরছে !” মেয়েই জানাল মাকে ।
সৌরভদা সরে পড়ার তাল করছিল । মেয়ের মা পাকড়াও করল, “এই যে মশাই, বউকে ফাঁকি দিয়ে বাপ-বেটায় ঘুরছেন যে ? বউটা ভালো বলে কিছু বলে না, তাই না ?”
সৌরভদা হেসে বলল, “আমার বউ ভালো বলেই তো পারলাম । আপনারা তো ভাল করেই জানেন আমার বউকে !”
একটা ছায়া মহিলার মুখের উপর এসে পড়তে দেখলাম । এক লহমায় সরেও গেল । “এটা কিন্তু ভারি অন্যায় আপনার । শুভ্রাকে একা বাড়িতে রেখে আসা উচিত হয়নি মোটেই ।” ঝাঁঝালো হল বাক্যবাণ ।
সৌরভদা একইরকম । “কী করব বলুন ? ছেলের বায়না । তাছাড়া শুভ্রাই বলল, ওর হাই অল্টিচ্যুডে প্রব্লেম হবে । এতদিনের কষ্টও সহ্য হবে না । তাই ওকে ছাড়াই আসতে হল ।”
“খুব সেলফিস তো আপনি ! যেখানে বউ যেতে পারবে না সেখানে যাবেন না ।” নিদান মহিলার ।
সৌরভদাকে সহজে রাগানো যায় না । সে ছোট্ট করে বলল, “সেটা তো সব সময় সম্ভব না ।”
“পড়তেন আমাদের মতো মেয়ের পাল্লায়”- চোখ নাচিয়ে বললেন তিনি ।
মেয়ে আর মায়ের দুজনেরই রোগাটে গড়ন । মুখ দেখে মনে হয় গায়ের রঙও একই রকম । হাইটটাও একই হবে । পার্থক্য শুধু বয়স আর কন্ঠস্বরে ।
এমনিতেই আমি নীরব দর্শকের ভূমিকায় তার উপর আমার উপস্থিতি নিয়ে ওরাও কোন মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না । ভালই হয়েছে । মানুষকে জানতে গেলে মন দিয়ে দেখতে হয় মানুষের মুখের অভিব্যক্তি । মানুষ চেনা কঠিন । তবু সেই কঠিন কাজটাই করি, দেখি না !
মহিলা আবার সৌম্যশুভ্রকে নিয়ে পড়লেন, “কী রে মাকে ছাড়া বেড়াতে ভাল লাগে ? শুভমিতা তো আমাকে ছাড়া যাওয়ার কথা ভাবতেই পারত না ।”
ক্লান্ত সৌম্যশুভ্র লম্বা হাই তুলল । কিছু বলার ইচ্ছেই দেখা গেল না ওর মধ্যে । মেয়েটা সৌম্যশুভ্র’র দিকে তাকিয়ে রয়েছে । হয়ত শুনতে চাইছে সৌম্যশুভ্র কী বলে ।
কোন উত্তর না পেয়ে খানিকটা নরমস্বরে মহিলার জিজ্ঞাসা, “লাদাখ কেমন লাগল রে ?”
সৌম্যশুভ্র লাদাখের কথায় উজ্জীবিত হল, “দারুণ ! হুন্ডারের কোল্ড ডেজার্ট, তাঁবুতে থাকা, প্যাং গং লেকের নীল জল সবই দারুণ । আর রাতের আকাশটার কথা তো লাইফে ভুলব না !”
“জার্নিটা খুব কঠিন না রে ?” শুভমিতা চোখ বড় বড় করে বলে ।
‘হ্যাঁ, জার্নিটা খুব টাফ । তাহলেও এনজয় করা যায় । লাদাখের প্রায় সব রাস্তাই যেন কার রেসিং-এর জন্য রেডি ।” খোলস ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসছে ছেলেটা ! নাহ্, ওটুকুই । ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে দিল দূরে । শুভমিতা বা ওর মায়ের দিকে তাকাচ্ছে না আর ।
শুভমিতা ওর মাকে জিজ্ঞেস করছে, “মা, সৌম্যশুভ্রকে আজ আমাদের হোটেলে আসতে বলি ?”
মা চোখের ইশারায় মানা করে মুখে বললেন, “না, না, আজ ও ভীষণ টায়ার্ড দেখতেই তো পারছিস ।”
মেয়ে বোধহয় আর মায়ের উপর ভরসা রাখতে পারল না । সে নিজেই সৌম্যশুভ্রকে বলল, “তুই আজ বিকেলে ম্যালে আসবি ? তোকে দারুণ একটা জিনিস খাওয়াব । তারপর তোর কাছে লাদাখের গল্প শুনব । কী রে আসবি তো ?”
সৌম্যশুভ্র একটু চিন্তা করে বলল, “ভেবেছিলাম আজ ঘুমাব সারাদিন । কাল রাত দশটায় গাড়ি ছেড়েছে এখনও মানালিতেই পৌঁছাল না দেখছি । কথা দিতে পারছি না তাই ।”
চোখ কপালে উঠে গেছে শুভমিতার । “রাত দশটায় গাড়ি ছেড়েছে ! সারারাত ধরে গাড়িতে ? আমাকে শুনতেই হবে । দে, তোর মোবাইল নাম্বার দে ।” সে নিজের মোবাইল বের করে ।
“তোর মায়ের মোবাইল নম্বরটা দে তো সৌম্য । শুভ্রার সাথে একটু কথা বলি ।” মেয়ের মা চোখ পাকিয়ে এমন একটা ভাব করছেন যেন তিনি এখনই শুভ্রাবৌদির সঙ্গে কথা বলে বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে নালিশ না হোক একটা বিপ্লবের সূচনা করে দেবেনই ।
ক্লান্ত সৌম্যশুভ্র’র কিছুই ভাল লাগছে না । তবু শুভমিতার মায়ের কথার জবাব দেয়, “মায়ের তো মোবাইল নেই। তুমি ল্যান্ডফোনে ফোন করে নিও ।”
“এখনও মোবাইল নেয়নি তোর মা ! বা-বা ! শুভ্রা একটুও বদলাল না !”
শুভমিতার মায়ের কথা শুনে হাসল সৌরভদা । “কতদিন বলেছি, একটা মোবাইল নাও । ল্যান্ডটা ছেড়ে দিই । ল্যান্ডফোন পোষা মানে এখন হাতি পোষা । মাসের অর্ধেকদিন আবার ডেড থাকে । তবু শুনবে না । বলে, আমার মোবাইলে কথা বলতে ভালো লাগে না । একদিক দিয়ে ও অবশ্য ঠিকই করছে । মোবাইল মানুষের জীবনে যত বেশি ঢুকবে তত বেশি ক্ষতি হবে মানুষের । মানুষ এখন এটা বুঝতে পারছে না । যখন বুঝবে তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে ।”
“সে আপনি যাই বলুন, মোবাইল ছাড়া এখন থাকা অসম্ভব । ওকে বোঝাবেন সেটা । আপনাদের ল্যান্ডফোনের নম্বরটা দিন তো । ছিল ! কোথায় যে রেখেছি !”
সৌরভদা নম্বরটা বলল । মায়ের অপ্রত্যাশিতভাবে ঢুকে পড়ায় শুভমিতা থমকে গিয়েছিল । সে আবার সৌম্যশুভ্রকে ধরল, “কী রে বললি না নাম্বারটা !”
সৌম্যশুভ্র বিরক্তি প্রকাশ করে, “কী হবে আমার নাম্বার দিয়ে ? আমার মোবাইলে চার্জও নেই, টাওয়ারও নেই ।”
“আরে, এখন নেই তো কী আছে ! মানালিতে টাওয়ার পেয়ে যাবি । মানালিতে হোটেলে ঢুকেই চার্জে বসিয়ে দিস । এখন নাম্বারটা বল ।” শুভমিতা মোবাইলে নাম্বার লেখার জন্য তৈরি । সৌম্যশুভ্র এখনও চুপ ।
মানুষের শরীর, মন ও মস্তিষ্ক একসাথে কাজ না করলে মানুষ দোটানায় পড়ে যায় । সৌম্যশুভ্র’র বোধহয় এখন সেই অবস্থা । সৌরভদা গভীরভাবে কিছু ভাবছিল । ওর ভুরু কুঁচকে উঠেছে । মানে সৌরভদার মস্তিষ্কের কোষ সক্রিয় ।
সৌরভদার মন আর মস্তিষ্কের সংযোগ ঘটল মনে হয় । ছেলেকে বলল, “ও এত করে চাইছে, দে না নাম্বারটা ।”
বাবার কথায় নাম্বারটা দিল সৌম্যশুভ্র, সঙ্গে বলেও দিল, “আমি কিন্তু আজ বের হব না । ঘুমাব ।”
“চারটের মধ্যে না এলে আমি ফোন করে করে পাগল করে দেব তোকে ।” চোখ পাকিয়ে বলল শুভমিতা ।
“কী ব্যাপার তোমাদের ? হিমাচলি ড্রেসে ছবি তুলবে বললে যে !” বিরাটবপু মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ভুঁড়ি বাগিয়ে এসে ঢুকে পড়লেন আমাদের মাঝে । সৌম্যশুভ্র’র দিকে চোখ পড়তেই প্রশ্ন, “কীরে ! তুই কোথা থেকে এলি ?”
শুভমিতাই জানাল, “বাপি, ওরা লাদাখ বেরিয়ে এল ।”
“তাই নাকি ! বাহ্, বেশ । ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছিস তো, না ? আমরা কিন্তু ভেবেছিলাম তুই ডাক্তারি পড়বি । চান্স পাসনি না ?” যেন ইচ্ছে করেই খোঁচা দিলেন ভদ্রলোক । “সুপ্রতীক কিন্তু আই আই টিতেই পড়ছে ।”
মানুষটার ভেতরের মানুষটাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম । বিরাট শরীর নয়, মানুষের মনটা বিরাট হলে তার কথা শুনতে ভালো লাগে ।
সৌম্যশুভ্র’র কালো মুখ এমনিতেই ঠাণ্ডায় আর ক্লান্তিতে আরো কালো হয়ে গেছে । এখন মুখের উপর বর্ষার ঘন কালো মেঘ ঘনিয়ে আসতে দেখলাম । চুপ করে থাকতে না পেরে বললাম, “সৌরভদা চলো, ওইদিকে যাবে বলেছিলে না ?”
চক্রব্যূহ থেকে ওদের সহজে নিস্তার নেই মনে হয়েছিল আমার । ওদের সবাইকে হতবাক করে দিয়ে পিতাপুত্রকে উদ্ধার করে নিয়ে চললাম সবাই যেদিকে যাচ্ছে তার ঠিক উল্টোদিকে । শুভমিতার থমথমে মুখটা ছাড়া আর কিছু লক্ষ্যও করিনি । প্রয়োজন বোধও করিনি ।
সৌরভদার অনেক চেনা লোক । সব জায়গাতেই সৌরভদার চেনা লোকের সাথে দেখা হয়ে যায় । চেনা লোক না পেলেও চেনা করে নিতে জানে সৌরভদা । আমার ওসব ঝামেলা কম । খুব বেশি চেনা লোক নেই । মানুষের সাথে মিশতেও পারি না তেমন । দূর থেকে দেখি । মানুষটাকে চেনার চেষ্টা করতে করতেই আরো দূরে চলে যায় মানুষটা ।
বেশিদূরে যাইনি আমরা । শরীর চাইছে না আর বেশি ধকল নিতে । সৌম্যশুভ্র একটা পাথরের উপরে বসে পড়ল । সৌরভদার সঙ্গে একটু এগিয়ে গেলাম । সৌরভদা ছেলেকে দেখে নিয়ে বলল, “একটা সময় আমাদের বাড়িটাতে মায়েদের ভীড় লেগেই থাকত । বাবি’র খাতার সঙ্গে ছেলে বা মেয়ের খাতা না মেলানো পর্যন্ত এদের স্বস্তি হত না । শুভ্রার একটা অহংভাব ছিল বরাবরই । তাছাড়া খুব কমান্ডিং স্বভাব ওর । সবাইকেই উপদেশ দেয় । সবাই কৃতজ্ঞচিত্তে সেটা গ্রহণ না করলেও নিজেদের ছেলে বা মেয়ের কথা ভেবে ওরা খুব তোল্লাই দিত শুভ্রাকে । এখন অবশ্য অনেকেই আর যোগাযোগ করে না । শুভ্রা দিনের অনেকটা সময় পূজোয় আর বোকাবাক্সের মেগাতে কাটায় । সিরিয়াল দেখতে দেখতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে দেখেছি । মন্তব্য করে প্রায়ই । ওর কাছে ওইগুলোই বাস্তব । শিক্ষা-দীক্ষা ভুলে ডুবে যাচ্ছে ওরই মধ্যে । শিক্ষার ড্রেনেজ !” মাথা দোলায় সৌরভদা ।
শুভ্রাবৌদিকে আমার কিন্তু অহংকারী বা কমান্ডিং স্বভাবের মনে হয়নি কখনো । বরং লাজুক মনে হয় শুভ্রাবৌদিকে । কিন্তু সৌরভদা যখন বলছে তখন উড়িয়ে দিতেও পারছি না মন থেকে । বললাম, “বৌদি তো উচ্চশিক্ষিতা, চাকরি করতে দিলে না কেন ? তাহলে তো এই সমস্যা হত না ।”
সৌরভদা হাসল, “আমি চাকরি করতে না দেওয়ার কে বল ? চাকরি ঘরে এসে কেউ দিয়ে যায় না । চাকরি পেলে নিশ্চয়ই করত । পায়নি তাই করেনি । সত্যি কথা কি জানো, বিয়ের পর আমিও উৎসাহ দেইনি । প্রথম থেকেই দেখেছি ও পুরোপুরি সুস্থ নয়, তার উপর আমার প্রয়োজনটাও কম । আমি নিজেও তো কেরিয়ার তৈরি করার কথা ভাবলাম না । ছেলেটা পড়াশুনায় ভালো ছিল বলে ওর মধ্যেই নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা পূর্ণ করতে চেয়েছিলাম । এখন বুঝি ভুল করেছিলাম । সবাই তো আর জিনিয়াস হয় না ! স্টুডিয়াসরা মেরিটোরিয়াসদের পেছনে ফেলে দেয় কখনো কখনো ।” সৌরভদার ব্যথাতুর মনের অজানা দিকটা অনুভব করলাম । ভাবছিলাম সৌরভদা আরো কিছু বলবে হয়ত । বলল না । হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল, “চলো তো দেখি গাড়ি ছাড়বে কিনা । ছেলেটা আর পারছে না ।”
রোটাং পাস থেকে গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে একটা বেজে গেল । সৌম্যশুভ্র এবার আমার পাশে বসেছে । সৌরভদা সামনে । পেছনের সিটে ছেলেমেয়ে দুটো আবার শাল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । সামনের গাড়িগুলোর গতি না বাড়ায় আমাদের গাড়িও আস্তে আস্তে চলছে । বাঁদিকে অতলান্ত খাদ । খাদের ওপারে ঢেউ তুলছে একের পর এক পাহাড় । সবুজ তৃণভূমির চাদরে ঢাকা পাহাড়ে পাইনের সারি । দূরের একটা পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে ঝরণা । গাড়িটা পাহাড়ের গায়ে চক্কর কাটলেও ঝরণাটা সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে না কখনও ।
মাঝের শূন্য আকাশে সোনালি ঈগলের দল উড়ে বেড়াচ্ছে । জায়গাটা তাই শূন্য থাকছে না কখনো । “গোল্ডেন ঈগল বুড়ো হলে গেলে যখন ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন উঁচু কোন পাহাড়ের কোটরে বসে একটা একটা করে পালক খসাতে থাকে শরীর থেকে । এভাবেই মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে এই দুর্ধর্ষ শিকারিরা ।” আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল সৌরভদা ।
ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না । চমৎকৃত ! “সঠিক কাজ করে ওরা । শেষ বয়সে পরের বোঝা হয়ে থেকে কী লাভ ? এই জন্যেই বোধহয় আগেকার দিনে তাই মানুষ বানপ্রস্থে যেত ।”
“যাদের বানপ্রস্থে যাবার কথা তারা অন্তিম সময় পর্যন্ত ভোগ করতে চায়, আর যাদের বেঁচে থাকার কথা তারাই চলে যেতে পৃথিবী ছেড়ে । এটাই এখন মানুষের ভবিতব্য ।” সৌরভদার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারি ।
“ইস ! আমার যদি ওদের মতো একজোড়া পাখা থাকত এই মুহূর্তেই উড়ে যেতাম নীল আকাশটাকে ছুঁতে । তারপর পৃথিবীর মানুষের ঘরগৃহস্থালি দেখতে দেখতে নেমে পড়তাম মানুষের সংসারে ।”
সৌরভদা স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের উপরে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ । মুখে ফুটে ওঠে দুষ্টুমির হাসি । সংকট ঘনীভূত বুঝতে পেরে আমি চোখ বন্ধ করে শরীরটাকে এলিয়ে দিই পেছনে ।
ওড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতেই মানুষ উড়তে শিখেছে । মহাকাশেও পাড়ি দিয়েছে মানুষের তৈরি যান । কিন্তু কী আশ্চর্য ! আর একটা পৃথিবীর সন্ধান মিলল না আজো । সৌরজগতে তবে কী একটাই ঘর মানুষের ? ব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও কী প্রাণ নেই ? তবে তো নীল গ্রহটাকে রক্ষা করতেই হবে আমাদের । একমাত্র মানুষই পারে সেটা যদি না ঈশ্বর রক্ষা করেন । জানি না ঈশ্বর আছেন কিনা বা কোথায় আছেন । থাকলে তিনি নিশ্চয়ই অন্য কোথাও প্রাণের সৃষ্টি করেছেন । হয়ত লোভী মানুষকে সেটা জানাতে চান না বলে মানুষের সীমার বাইরে কোথাও রেখেছেন । স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে বাঁচাবেন না !
পাহাড়-পর্বত, তৃণভূমি, নদ-নদী, মরুভূমি পার হয়ে সাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি । দেদার নীল ছড়িয়ে আছে । নীল সমুদ্রের উপরে নীল আকাশ । আকাশটা কত বড় হয়ে গেছে ! সাদা তুলো মেঘগুলো শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে আলতো করে । শরীরটা কেমন হালকা হয়ে গেছে ! অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে । এভাবে উড়তে পারব কোনদিন ভাবিনি । আকাশ যেখানে সমুদ্রে মিশেছে সেখানে হচ্ছেটা কী ! কী সুন্দর সাতটা রঙ মিলে তৈরি করেছে বিশাল রামধনু ! সৃষ্টির তো সাতটাই রঙ । ওমা ! ওগুলো কী ? পাখি ! অতবড় পাখি ? নাহ্ ! যুদ্ধবিমান ? আকাশের রঙ বদলে গেল ? ধূসর আকাশে যুদ্ধবিমানগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে যে ! কোথায় যুদ্ধ বাঁধল ?
পড়ে যেতে যেতে শুনলাম কে যেন বলছে, “এই তো টাওয়ার এসে গেছে !”সৌম্যশুভ্র’র গলা না !
চোখ খুলে গেল । সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম একটা । ঘরবাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক ওদিকে । রাস্তার ধারে বেশ কয়েকটা দোকান । পাহাড়ের নীচ থেকে সারি দিয়ে পাহাড়শীর্ষে উঠে গেছে পাইনের দল । ফুলে ফুলে ঢাকা ছোট্ট একটা উপত্যকা । এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । টেরই পাইনি । কাছের পাইনের ছুঁচালো পাতা বেয়ে জল ঝরছে এখনও । ছাই রঙের হালকা একদল মেঘ পাইন বনের মাথা ছুঁয়ে সরে যাচ্ছে পাহাড়টা থেকে । সৌরভদা জানলার কাঁচ নামিয়ে দিয়েছে । জানলা খোলা পেয়ে বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা বাতাস এসে মুখ ভিজিয়ে দিল । এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম ! ওড়ার স্বপ্ন ! উড়তেই তো চাই । তবে স্বপ্নের শেষেরটা দেখতে চাই না ।
সৌরভদা হাসল, “বেশ তো একটু ঘুমিয়ে নিলে !”
“হুম, গাড়িতে বসে বসে ভ্রমণ আর ভালো লাগছিল না তাই একটু উড়ে এলাম গোল্ডেন ঈগলদের সাথে ।” মুচকি হাসি দিয়ে জানালাম সৌরভদাকে ।
ছোটবেলায় একটা স্বপ্ন দেখতাম । বয়সটা তো তখন স্বপ্ন দেখারই বয়স । সারা বিকেল ফুটবল খেলে বিশ্রাম নিতাম সম্পূর্ণাদের বিরাট বাড়িটার পাশে । সন্ধ্যা নামত মাঠের ওপারে । ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলে উঠত শাঁখের শব্দের সঙ্গে । সম্পূর্ণাদের বাড়িতে জ্বলে উঠত বিদ্যুতের আলো । ভাবতাম বড় হয়ে ওদের বাড়ির মতো একটা বাড়ি বানাব । অন্ধকার গাঢ় হলে স্বপ্ন পকেটে পুরে ভয়ে ভয়ে বাড়ির পথ ধরতাম । বকুনি শুনতে হত মায়ের কাছে । কখনো কখনো মারও পড়ত পিঠে । তখন মায়েরা পড়া ধরত না । সময় মতো পড়তে বসলেই হল । পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লে মা ডেকে তুলে খাবার খেতে দিত । ঘুম ঘুম চোখে কোন রকমে খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম ।
বড় হয়ে স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছি । এখন ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে হ্যালুসিনেশন হয় । ভয় পেয়ে জেগে উঠি তখন । আর একটা জিনিস হয়- রাতের বেলায় ঘুম ভেঙে গেলে একা একা ঘরের বাইরে বের হতে ভয় করে । মনে হয় কে বা কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারের শরীরে সাদা কাপড় জড়িয়ে ।
চোখের সামনে দেখছি পরিবারগুলো কীভাবে ভেঙে যাচ্ছে । সম্পূর্ণাদের অতবড় পরিবারটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে । কাকারা আলাদা হয়ে গেছে । সম্পূর্ণার একটা ভাই খুনি, একটা ভাই জোচ্চোর, আর একটা ভাই আধপাগলা গোছের । গণসংগীত গেয়ে বেড়ায় সে । সম্পূর্ণার বিয়ে হয়েছিল । খোঁজ রাখিনি । ওর বোনটা হোমে ছিল শুনেছি । সেও এক করুণ কাহিনী ।
বাড়ি বানানোর স্বপ্নটাই ভুলে গেছিলাম । আজ হঠাৎ করে মনে হচ্ছে বিরাট কোন বাড়ি না বানাতে পারলেও একটা কুঁড়েঘরও তো বানাতে পারতাম ! শুধু টিকে থাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না । জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সমাপ্তির মুহূর্ত পর্যন্ত ।
সৌরভদা ছেলেকে ডেকে বলল, “বাবি, আমরা পৌঁছে গেছি রে । ওই দেখ মানালি ।”
গাড়ি লোকালয়ে ঢুকছে । ডানদিকে বিপাশা নদী । বিপাশার স্থানীয় নাম বিয়াস । বিয়াস নাকি প্রেমের নদী । মনু’র গ্রাম থেকে মানালি হয়ে যাওয়া শহরটার হৃদপিন্ডও ।
( শেষ )

এই উপন্যাস এর সর্বস্বত্ত্ব লেখকের।  এর অন্যত্র প্রকাশ বা মুদ্রণ লেখকের অনুমতি স্বাপেক্ষ। যোগাযোগ : E . Mail –  tapan.traveller@gmail.com , Mobile :7595943557,  9433603167

——————————–

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post