নীল যেখানে দেদার ছড়িয়ে
তপন বিশ্বাস
(ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাসের একাদশ পর্ব)
পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি । মুখ শুকিয়ে গেছে সবার । শংকায় বুক কাঁপছে । উত্তপ্ত মেঝেতে খালি পায়ে হেঁটে ফোস্কা পড়ে গেছে । তবু ভরসা পাচ্ছি সেনাবাহিনীর উপস্থিতির জন্যই । পুলিশের উপর মানুষ আস্থা হারালেও সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করে । আস্থা রাখে । সেনাবাহিনীর জওয়ানরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের নাগরিকের জীবন রক্ষা করে প্রমাণ দিয়েছে বারবার ।
খুব কষ্ট করে চাতালে নেমে এলাম । উন্নতমস্তকে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জওয়ানদের একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসেছেন থিকসে পরিদর্শনে । হাই প্রোফাইল সেনানায়কের জন্যই এত সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট ।
থিকসে থেকে বেরিয়ে আবার ছুটছে আমাদের গাড়ি।দুপুর রোদে ধূলো উড়িয়ে চলেছে মিলিটারি কনভয় । সীমান্ত প্রদেশ বলে এমনিতেই মিলিটারি তৎপরতা চোখে পড়ে সর্বত্র তার উপর সেনানায়কের উপস্থিতি । গ্রামের পথে অসংখ্য চোর্তেন । বৌদ্ধ লামাদের সমাধি । মৃত লামার পদ্মাসনে বসা দেহের উপরে নির্মাণ করা হয় এই স্তূপ । প্রদীপ জ্বলে চোর্তেনের অলিন্দে ।
লাদাখের ভূপ্রকৃতির সাথে ভারতবর্ষের অন্য কোন অঞ্চলের মিল নেই । বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন ও নবীন স্থাপত্যে গড়া লাদাখ প্রাচীন তিব্বতের ক্ষুদ্র সংস্করণ । জলবায়ু ও জনজীবনেও তিব্বতী প্রভাব ।
শ্যে প্যালেসের নীচে এক বৃদ্ধা ভিখারিকে দেখে চমক লাগল । ভারতবর্ষের পথে ঘাটে ভিখারি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা কিন্তু লাদাখে আসার পর কোন ভিখারি চোখে পড়েনি । সৌম্যশুভ্র ছবি তুলছে ভিখারির । সৌরভদা বলল, “বৌদ্ধরা এমনিতেই বয়স্কদের খুব সম্মান করে । তাই হয়ত বয়স্কদের পথে ঘাটে পড়ে থাকতে হয় না । আর লাদাখের মানুষ বেঁচে থাকে নির্মম প্রকৃতির সাথে লড়ে, ওদের সমাজে ভিক্ষুকের কোন স্থান নেই অথবা এরা ভিক্ষা করতে শেখেই না হয়ত ।”
সৌরভদার কথায় সায় দেওয়া ছাড়া কিছু বলার নেই । বৃদ্ধা ভিখারিকে দেখার আগে এই নিয়ে কোন প্রশ্নও মাথায় আসেনি । দিব্যজ্যোতি হালদার অমিতকে নিয়ে আগেই এগিয়ে গেছে । বড্ড তাড়া ওদের !
সৌম্যশুভ্র ভিখারির ছবি দেখাল । সাদাকালোয় তুলেছে ছবিটা ! কী ভেবে সাদাকালো করেছে বুঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা সাদাকালোয় তুললে যে !”
সৌম্যশুভ্র হাসল । কিছু বলল না ।
লাদাখের শীতকালীন রাজধানী আর শ্যে প্যালেস এখন অতীতের ধ্বংসাবশেষ হলেও প্যালেসের শীর্ষে সোনায় মোড়া বিজয়স্তূপ সূর্যের আলোয় চমকাচ্ছে এখনও । লাদাখের সর্ববৃহৎ বুদ্ধের মূর্তিটি তিনটে তলা জুড়ে দণ্ডায়মান । উচ্চতা ৭.৫মিটার । সোনারপাতে মোড়া তামার মূর্তির গায়ে মূল্যবান পাথর ও ধাতুর অলংকার । নানা দেবদেবীর মূর্তি, থংকাস, পুঁথি সংরক্ষিত হচ্ছে বিভিন্ন কক্ষে ।
লেহ শহর হয়ে এবার চলছি উল্টোপথে লেহ থেকে ৮কিমি দূরে স্পিটুক গুম্ফায় । মধ্যাহ্ন গড়িয়েও গেলেও রোদ্রের তাপ কমছে না এতটুকু । গাঢ় নীল আকাশে দু’একটা মেঘের পালকও চোখে পড়ে না । চড়চড় করে আওয়াজ হচ্ছে গাড়ির চাকার সঙ্গে গলা পিচের । গরম বাতাস শুষে নিচ্ছে মুখের আর্দ্রতা ।
ছোট্ট এক পাহাড়শীর্ষে অবস্থিত গেলুপ শাখার বৌদ্ধদের সবচেয়ে পুরানো গুম্ফা স্পিটুক । অন্ধকার গৃহে থিকসে গুম্ফার মতো চব্বিশ হাতের বিশালদেহী দেবীমূর্তি । দেবীর পদতলে বজ্রভৈরব । দেবীর পাশে আরও কয়েকটা ভয়াল মূর্তি । দেবীর মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা । বজ্র ভৈরবের মুখও ঢাকা দেওয়া আছে কাপড়ে । সামনের দিকে প্রদীপের সামান্য আলো থাকলেও দেবীর পেছনে ঘন অন্ধকার ।
দিব্যজ্যোতি হালদারের ভক্তি দেখে অবাক হয়ে গেলাম । এর আগে তো এত ভক্তি দেখিনি ! প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করল । ধুপকাঠি জ্বালিয়ে দিল বেশ কয়েকটা । শেষে প্রণাম করে কড়কড়ে দুটো একশ’ টাকার নোট রাখল দানপাত্রে ।
বহু মানুষই নানা সময় নানাভাবে ঈশ্বরের কাছে চেয়ে থাকে । কখনো কখনো বিনিময়ে কিছু দেবার কথাও মনে হয় বোধহয় । “কী ব্যাপার হালদারবাবু, কোন মানত ছিল বুঝি ?” জিজ্ঞেস করলাম । দিব্যজ্যোতি হালদার নির্বাক । দেবীর পায়ের কাছে রাখা সাদা কাপড়ের থেকে একটা টুকরো সংগ্রহ করে দেবীর পায়ে ছুঁইয়ে নিজের মাথায় ছোঁয়াল । ভক্তিভরে আবার একপ্রস্থ প্রণাম করে কাপড়ের টুকরো পকেটে পুরে আমার দিকে ফিরল । “আপনারা বোধহয় জানেন না- অবশ্য অনেকেরই জানা নেই এটা সতীপীঠ ।” দিব্যজ্যোতি হালদারের কথায় চমৎকৃত হলাম । মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিলাম লাদাখের কোন এক পর্বতশীর্ষে সতীর একান্নপীঠের একটা পীঠ আছে ।
“দেবী এখানে শ্রীসুন্দরী যাঁর পদতলে স্বয়ং শিব সুন্দরানন্দ হয়ে অবস্থান করছেন ।” হালদারের মুখে প্রসন্ন হাসি, “অমিত, ভক্তিভরে প্রণাম করে এক টুকরো কাপড় নিয়ে নিস । মা তোর মনস্কামনা পূর্ণ করবেন ।”
সৌরভদা কখন বাইরে চলে গেছে দেখতে পাইনি । সৌরভদার ছায়া হতে পারিনি এখনও । সৌরভদাকে পেলাম মন্দিরের লাইব্রেরিতে । ইলেকট্রিক আলো রয়েছে । প্রচুর দেয়ালচিত্র, থংকাস, প্রাচীন পুঁথি আর প্রচুর মুখোশের সম্ভার । সৌরভদা বলল, “আমি এখানকার একজন সেবককে ধরেছিলাম, তার কাছে শুনলাম এখানে প্রতি বছর জানুয়ারী মাসে একটা বড় উৎসব হয় । তখন দেবীর মুখ উন্মোচিত হয় । অনেক দূর দূর থেকে মানুষ আসে দেবী দর্শনে । এর বেশি সে বলেনি বা বলতে চায়নি । নিজের কাজে চলে গেছে । তখন থেকে এইসব দেখছি । দেখা ছাড়া আর কি করতে পারি ? পড়তে তো পারব না এখানকার পুঁথি । চলো, দেখি ছেলেটা আবার কী করছে !”
পাহাড় থেকে লেহ শহরটাকে একটা ছবির মতো দেখাচ্ছে । নীল আকাশের নীচে সিন্ধুর ওপারে ধূসর পাহাড়, এপারে সবুজ টোপর পরা পপলারের সারি, সবুজ আঁচল বিছিয়ে লাদাখি গ্রাম । তারও এপারে আধুনিক লেহ ।
মন্দিরের সিঁড়িতে একটা বড় শিলাখন্ডের আড়ালে বসেছে বৈকালিক আড্ডা । দিব্যজ্যোতি হালদার গর্বের সাথে বলল, “এটা নিয়ে পঁয়তাল্লিশটা সতীপীঠ দেখা হল । বাংলাদেশে গেছি । শ্রীলংকায়ও গেছি । পাকিস্তান আর চিনে যাওয়া হয়নি এখনও । সামনের বছর মানস সরোবর- কৈলাসে যাওয়ার ইচ্ছে আছে । দেখি ।”
সৌরভদা আশ্বাস দিল, “মনে যখন করেছেন ঠিক যেতে পারবেন । লক্ষ্য স্থির হলে লক্ষ্যভেদ হবেই ।”
দিব্যজ্যোতি আচমকা উঠে দাঁড়াল, “ইস ! একটা ছবি নেওয়া হয়নি । দেখি তুলে আনি । অমিত, ক্যামেরাটা দে তো ।” সৌম্যশুভ্র মুখ ব্যাদান করে বলল, “ছবি নিতে দেবে না । আমি ছবি তুলতে গিয়েছিলাম । একজন বাধা দিয়েছে ।”
দিব্যজ্যোতি হালদার রহস্যময় হাসি হেসে মন্দিরের দিকে গেল ক্যামেরা নিয়ে ।
অমিত সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে বলল, “আমার বেড়াতে খুব ভালো লাগে । দিব্যদার সাথে বাংলাদেশেও গিয়েছিলাম । দিব্যদার অনেক পড়াশুনা । আমি তো মুর্খ !”
সৌরভদা জানতে চায়, “তুমি কী কর ?”
“একটা গ্যারেজ আছে আমার ।” অমিতের কথার মাঝেই দিব্যজ্যোতি ফিরে এল, “নাহ্, রাজী করানো গেল না লোকটাকে ।”
কারগিল যুদ্ধের স্মরণে গড়া ‘হল অফ ফেম’ লেহ শহরের বাড়তি আকর্ষণ । দেখতে দেখতে বুকের ভেতরে মোচড়াচ্ছিল । হাজার হাজার প্রাণের বিনিময়ে কারগিল বিজয় হয়েছে । আপাততঃ শান্তি ।
সৌরভদার চোখ ভিজে উঠেছে । বাবার মন তো ! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “১৯৭১র যুদ্ধ না হয় ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কিন্তু কারগিল যুদ্ধ ? আজো রহস্যময় মনে হয় । কী করে ঢুকল হানাদারেরা ! যেমন ১৯৬২র চিন-ভারত যুদ্ধ ! তেমনই আগ্রাসন ? মানুষ কী চায় ? যুদ্ধ না শান্তি ? যুদ্ধের বার্তা ছড়িয়ে শান্তি আসে না । সীমান্ত সন্ত্রাস নয়, সীমান্তে ছড়াতে হবে ভ্রাতৃত্ববোধ। দেশাত্ববোধ । দেশপ্রেমিক জানে যুদ্ধে দেশের ক্ষতি । সন্ত্রাসবাদীদের কোন দেশ হয় না, তাই তারা দেশপ্রেমিকও হয় না ।”
আগেই দেখেছি তাই শান্তিস্তূপে ঢুকলাম না আর । দিব্যজ্যোতি অমিতকে নিয়ে গেল । আমরা ক্যান্টিনে ঢুকলাম শেষবারের মতো মাখন চায়ের স্বাদ নিতে ।
আজ বেশ ছুটির মেজাজে আছি । সকালে জমীরের রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করতে গেছি । জমীর ফুলের গাছের পরিচর্চা করছিল । আমাদের দেখতে পেয়ে এসে একটু ঝুঁকে বলল, “আস্সালামও আলাইকুম ।”
প্রত্যুত্তরে কী বলব ভাবছি, সৌরভদা ততক্ষণে জবাবে বলেছে, “ওয়ালেকুম আস্সালাম ।” আমি তো হতবাক । সৌরভদার সত্যি জবাব নেই ।
সৌরভদা জমীরকে বসতে বলল, জমীর বসল না । দু’হাত এক করে ভৃত্যের মতো দাঁড়িয়ে রইল জমীর । বসছে না দেখে বললাম, “বৈঁঠিয়ে না জমীর ভাই । চা পীজিয়ে ।”
জমীর হেসে জানাল, “সুবে একবার পীতা হু । ও তো হো গয়া মেরা । আপ পীজিয়ে ।”
আর কিছুক্ষণ কথা বলে জমীর বিদায় নিল । জমীরের সব কথা বুঝতে পারি না । হিন্দি, উর্দু, লাদাখি মিশিয়ে বলে । আমরাও হিন্দি, ইংরাজী মিশিয়ে বলি । ওকে দেখে মনে হয় বেশ বোঝে আমাদের কথা ।
জমীরকে কিছু বললে ও মাথা ঝুঁকিয়ে বলে ‘জী’ । অত্যন্ত বিনয়ী মনে হয় ওকে যা ওর চেহারার সাথে বেমানান । উদ্ধত হলেই যেন ওকে মানাত ।
রাস্তার ধারে নানা আকৃতি আর নানা রঙের পাথর বিক্রি করছিল একজন লোক । পাথর দেখা, দরদাম করার সাথে আলাপও হল মাঝারি বয়সের লাদাখির সাথে । দুর্গম পাহাড় থেকে সে সংগ্রহ করে এসব পাথর । জাঁসকারের এক গ্রামে বাড়ি । ছেলে এখানে আমীর খানের স্কুলে পড়ে । বোর্ডিং স্কুল । প্রতি বছর শীতের শেষে ছেলেকে দিয়ে যায় বোর্ডিং স্কুলে আবার শীতের শুরুতেই নিয়ে ফেরে গ্রামে । যাত্রাপথ ভীষণ কঠিন । ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া সুরু নদীর উপর দিয়ে, খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে বরফে পথ করে চলতে হয় । এভাবে চলতে গিয়ে কতজন মারা যায় তবু এরা আসে । না হলে যে ওদের মতো ছেলেরাও মুর্খ থাকবে ! বাবার উপলব্ধি । লাদাখি বাবার কথা শুনে স্কুলটা দেখার ব্যাপারে উৎসাহিত হলাম ।
আমীর খানের সিনেমার শুটিং হয়েছিল তাই সবাই আমীর খানের স্কুল বলে চেনে এখন । স্কুলে কীভাবে যেতে হয় জেনে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগলাম । সৌরভদা বলল, “কয়েকবছর আগে লাদাখে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টিতে স্কুলটা কাদা-মাটির নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল । এখন আবার নতুনভাবে গড়ে উঠেছে স্কুলটা ।” সৌরভদা সব খবর রাখে !
বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে সৌরভদা লেহ-মানালির বাসের খবর নিল প্রথমে । জানা গেল লেহ-মানালি রুটের বাস এখন অনিয়মিত । সিজন এখনও শুরু হয়নি । হিমাচল ট্যুরিজমের বাসের বুকিং হয় ফোর্ট রোডের অফিস থেকে । ট্যুরিজমের বাসও চলছে না এখন । আমরা আমীরের স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম বাসে করে ।
দুপুরের কড়া রৌদ্রে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরলাম । রোদ্দুরের তাপ এত যে খেতে যেতেও ইচ্ছে করছিল না কারোর । কেক, বিস্কুটেই পেট ভরাতে হল । জমীর একবার এসে দাওয়াত দিয়ে গেছে । ওর বাড়িতে বিকেলের চায়ের নিমন্ত্রণ ।
সৌম্যশুভ্র ঘরেই শুয়ে রইল । সে চা খায় না তাই যাবে না জমীরের বাড়িতে । অজুহাত অজুহাতই হয় । ইচ্ছে না থাকলে কাউকে জোর করেও লাভ নেই । আমরা দু’জনেই গেলাম জমীরের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ।
ঘরে ঢোকার মুখে জুতো রাখার জায়গা । সুন্দর করে সাজানো ড্রয়িং রুম । মেঝেতে বহুমূল্য কার্পেট বিছানো । দেয়ালে সুন্দর সুন্দর পেইন্টিং । জমীরের স্ত্রীকে দেখতে পেলাম না । বাচ্চাকাচ্চাদেরও নয় । বাচ্চাদের পড়াতে নিয়ে গেছে বিবি । কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে । জমীর জানাল । একজন লাদাখি মহিলা এসে চা দিয়ে গেল আমাদের । জমীর চা খেল না । আগেই জানিয়েছিল দিনে একবারই চা খায় সে ।
ফেরার সময় জমীর সৌরভদাকে বলল, “আগলেবার ভাবীজিকো সাথমে লাইয়েগা । রহীয়েগা মেরা মেহমান বনকে ।” হয়ত কথার কথা তবু ক’জন বলে ! সৌরভদাও হেসে জমীরের হাত ধরে বলল, “আপ আইয়ে না কলকাতা ভাবীকো লেকে ।”
জমীর মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছে, “জী” ।
মানুষের সাথে মিশতে পারাটা সৌরভদার একটা বিশেষ গুণ । সৌরভদা সব রকম মানুষের সাথে মিশতে পারে । ছেলেটা উলটো স্বভাবের । সে পারে না কারোর সাথে মিশতে ।
হিমাচল ট্যুরিজমের অফিসে গিয়ে দেখা গেল অফিস বন্ধ । সাড়ে ছ’টায় বন্ধ হয়ে গেছে । পাশের অফিসে খোঁজ করে জানা গেল হিমাচল ট্যুরিজমের এসি বাসের যাত্রা শুরু হতে এখনও কয়েকদিন বাকি । জুলাইয়ের ৬তারিখ থেকে চলবে সম্ভবতঃ ।
সৌম্যশুভ্র খুব হতাশ । বলল, “প্লেনের টিকিট কাটো ।”
“সেকি ! টাংলালা, বারলাচালা, লাচুংলা, রোটাং দেখবি না ? বারবার কি আসা হবে ?” সৌরভদার কথাকে সমর্থন করে বলি, “তাইতো ! ফেরার পথটা তো দারুণ শুনেছি । ও পথে না গেলে লাদাখ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে !”
ছেলেটা আর পারছে না বোধহয় । বলল, “চাপ হয়ে যাবে খুব ।”
মেট্রোরেলে যাতায়াতের সুবাদে জানি এখনকার ছেলেরা একটু বসার জন্য কেমন ছট্ ফট্ করে । মা-বাবার আদরে বাঁদর না হলেও অলস আর অশক্ত হয়ে পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ।
ঘুরতে ঘুরতে স্টেট ব্যাংকের কাছে একটা ট্রাভেল এজেন্সির অফিস থেকে বুক করা হল ইনোভা গাড়ি আগামীকালের জন্য । রাত দশটায় ছাড়বে ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি অনেকটাই বেলা হয়ে গেছে । সৌরভদা ইতিমধ্যেই স্নান করে নিয়েছে । আমাকে উঠতে দেখে বলল, “তুমি কি বের হবে আমার সাথে ? আমি একটু বের হব । দেখি, প্লেনের টিকিট পাওয়া যায় কিনা ।”
“কাল যে ইনোভা বুক করলে ?”
সৌরভদা শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, “ছেলেটা আর ধকল নিতে পারছে না । এরপর ৪৭৭কিমির দীর্ঘ পথ । তার উপর রাতের জার্নি । ভয় হচ্ছে খুব ।”
উদ্বিগ্ন পিতার পাশে থাকা কর্তব্য মনে করে বললাম, “প্লীজ, আমাকে আধঘণ্টা সময় দাও । আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি ।”
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি সৌম্যশুভ্রও উঠে পড়েছে । সেও ঢুকে গেল ওয়াশরুমে । “বাবিও বলছে যাবে । এরোপ্লেনের কথায় চাঙ্গা হয়ে গেছে ।” মুখের উপরের কালো ছায়া সরে গিয়ে লাদাখের আকাশের মতো ঝক্ঝকে সৌরভদার মুখমণ্ডল ।
প্লেনের টিকিট পাওয়া গেল না । আগামী চারদিনের মধ্যেও নেই । সৌম্যশুভ্র খুব হতাশ । ওকে চাঙ্গা করে তুলতে জিজ্ঞেস করি, “তুমি চাঁদের পাহাড় পড়েছো ?”
মাথা নেড়ে জবাব দেয় সে, “হ্যাঁ, পড়েছি । আমার বাবা অনেকদিন আগেই কিনে দিয়েছিল বিভূতিভূষণ সমগ্র । চাঁদের পাহাড় সিনেমাও দেখেছি । ভালো লাগেনি ।”
“কেন ?” ওর মুখের উপর দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন করি ।
“বিভূতিভূষণের স্মেলটাই ছিল না সিনেমাতে । তবে ফটোগ্রাফি খুব সুন্দর ছিল ।” খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু ওজনদার বাক্য সৌম্যশুভ্র’র । সৌরভদার ছেলে সে । কিছুটা হলেও সৌরভদার স্মেল আছে তার ভেতরে । একটু ভোকাল টনিক দিলে চাঙ্গা হবেই মনে করে বললাম, “অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে শংকর দুর্গম, ভয়ংকর আফ্রিকার চাঁদের পাহাড়ে গিয়েছিল। তখনকার আফ্রিকা ছিল আদিম আর বুনো । শত কষ্টের মধ্যেও সে ভেঙে পড়েনি কেন জানো ? তার বুকে ছিল অদম্য সাহস । চ্যালেঞ্জ নেবার ক্ষমতা । তোমারও আছে । তাই এত সহজে ভেঙে পড়ো না ।”
“না, আমি ভেঙে পড়িনি । অনেকদিন হল তো । এখানকার রোদটাও আর সহ্য হচ্ছে না । তাই -” সৌরভদা ওর কথা লুফে নিয়ে বলল, “আর রোদ কোথায় ! আজকের দিনটাই তো শুধু । আর কয়েক ঘন্টা মাত্র । তারপর সারারাত কাটবে তুষাররাজ্যে । দেখবি সে এক অন্যরূপ পাহাড়ের !” ছেলেকে জড়িয়ে ধরল সৌরভদা । একটু থেমে আবার বলল, “ঘুম ঘুম চোখে রোটাংপাসে গিয়ে চোখ মেলে দেখবি কী দারুণ সিনারি ! তারপর পাইনে ঘেরা পথে চলতে চলতে মানালি । বিয়াস নদী । কত রকমের পাখি আছে জানিস সেখানে ? মানালিতে গিয়ে তোকে ট্রাউট মাছ খাওয়াব । তন্দুর ট্রাউট, গ্রিল্ড ট্রাউট যা মন চায় খাস । এখন চল তো বন্ধুদের জন্য কী কিনবি বলেছিলি ।”
পিতার আলিঙ্গন পুত্রের কাছে আশীর্বাদের মতো । পিতা-পুত্রের ঘনিষ্ঠতায় মেঘমুক্ত হল আকাশ । পিতার শক্ত হাত সন্তানকে ভরসা জোগায় । সৌম্যশুভ্রকে দেখে মনে হল সে অনেকটাই চাপমুক্ত এখন ।
বিকেলে এক নতুন সংকট দেখা দিল । গতকাল যেখান থেকে ইনোভা বুক করা হয়েছিল সেখান থেকে জানাল ইনোভা হচ্ছে না । যেতে হবে চৌদ্দ সিটারের ট্রাভেলার গাড়িতে । সৌরভদা স্ট্রেইট না করে দিয়েছে । ট্রাভেল এজেন্সির বুকিং-এ থাকা ছেলেটা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে ট্রাভেলার ভালো গাড়ি ।
পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেক কিছুই অ্যাডজাস্ট করে নিতে হয় । কথাটা সৌরভদার । কিন্তু ছেলের কথা ভেবে সৌরভদা এখন অ্যাডজাস্ট করতে কিছুতেই রাজী নয় । ট্রাভেল এজেন্সির ছেলেটা কয়েক জায়গায় ফোন-টোন করে জানাল আধঘণ্টার মধ্যে বের হতে পারলে একটা ইনোভা পাওয়া যাবে ।
এত কম সময়ে আমাদের পক্ষে রেডি হয়ে বের হওয়া সম্ভব না জানিয়ে সৌরভদা নাকচ করে দিয়েছে সে প্রস্তাবও । বাকবিতণ্ডা চলছেই । এরই মাঝে কাস্টমার এল । ছেলেটা তার সাথে কথা বলবে বলে আমাদের একজনকে পেছনের বেঞ্চে বসতে অনুরোধ করল । আমিই উঠে পড়েছি । সৌরভদাও উঠে দাঁড়াল চেয়ারটাকে সশব্দে পেছনে ঠেলে । জোরালো গলায় জানিয়ে দিল রাত দশটায় ইনোভা না পেলে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে । সৌরভদাকে এমন রূপে কোনদিন দেখিনি । সৌরভদার এই রূপ আমার কাছে অচেনা । শিব কখনও ভোলা মহেশ্বর, কখনও রুদ্ররূপী মহাকাল ! সৌরভদার মতো শান্ত লোকের রুদ্ররূপ দেখে সেটাই মনে হল আমার ।
সৌম্যশুভ্র পেছনের বেঞ্চে বসেছিল। চোখাচোখি হতেই হাসল । ওকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হল । আমাকে ফিসফিস করে বলল, “আজ ওর হয়ে গেল !”
সৌরভদার রুদ্রমূর্তি দেখে ছেলেটা ঘাবড়ে গেছে । বাইরে বেরিয়ে গিয়ে ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে দেখলাম । নতুন আসা কাস্টমার সৌরভদার কাছে সব শুনল । বাংলায় কথা বলছিলেন ভদ্রলোক । বয়স ষাটের কোঠায় । বিদেশীনি স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন । সাঁইত্রিশ বছর ধরে নিউইয়র্কের বাসিন্দা পুলক চৌধুরী । কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এত বছরেও বাংলা ভোলেননি দেখছি ?”
ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরে হাসলেন, “মাতৃভাষা কেউ ভুলতে না চাইলে ভোলে না কক্ষনো ।”
ট্রাভেল এজেন্সির ছেলেটা ফিরে এসে অফিসের অন্য আর একটা ছেলেকে ডেকে ওদের মাতৃভাষায় কিছু নির্দেশ দিয়ে দিল । নতুন ছেলেটা ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে বসল । সে আমাদের নিয়ে চলল অন্য কোথাও ।
মিনিট দুয়েক হাঁটার পর একটা বড় ট্রাভেল কোম্পানির অফিসে ঢুকল । বছর ত্রিশের একজন যুবকের সামনে নিয়ে বসাল সৌরভদাকে । আমাদের পেছনের সোফায় বসতে বলল ।
এই যুবকটি রীতিমতো চৌকস । সে সৌরভদাকে নরমে গরমে বোঝানোর চেষ্টা করছে । হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ ঘটতে দেখলাম । “শাট আপ ! আই ওয়ান্ট ইনোভা ওনলি । দ্যাট ইজ অলসো ইন বিটুইন নাইন অ্যান্ড টেন ।” সৌরভদার চিৎকার ।
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে মানুষটার । ধীর-স্থির লোকটার নাকের পাটা ফুলে উঠতে দেখলাম । সৌম্যশুভ্রকে দেখলাম এখনও নির্বিকার । মোবাইল টিপে যাচ্ছে । বাবার উপর তার অগাধ আস্থা নাকি এমনই স্বভাব ওর ! কী করে একটা ছেলে বাবাকে এমন রাগারাগি করতে দেখেও নির্লিপ্ত থাকতে পারে বুঝি না ! আমার তো রীতিমতো ভয় হচ্ছে । আজ যাওয়া হবে তো ?
সৌরভদা উঠে চলে আসছে দেখে ট্রাভেল এজেন্সির ছেলেটা ছুটে এল । হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “স্যার, প্লীজ বৈঁঠিয়ে । কোশিশ করতা হু ম্যাঁয় ।”
সৌরভদা বসতে রাজী নয় আর । গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল । আমরাও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমাদের ক্যাপ্টেনের পাশে । গূঢ় আলোচনা হচ্ছে ওদের দুজনের মধ্যে । মাঝে মাঝে ফোন চালাচালি । ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে সৌরভদার বুঝতে পারছি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
ছেলেটা এসে হাত জড়িয়ে ধরল আবার । সৌরভদার ভুরু কুঁচকে উঠেছিল ওকে এগিয়ে আসতে দেখেই । কিছু বলার সুযোগ দিল না ছেলেটা । হাসিমুখে বলল, “স্যার, আপকো ইনোভা মিল গয়া । লেকিন থোড়া তকলিফ করকে শেয়ারমে জানা হোগা । মেরা ঔর দো প্যাসেঞ্জার হ্যায় । আপকো ভি কম হো জায়গা । ঠিক হ্যায় স্যার ?”
সৌরভদার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল । আমার বুক থেকে একটা ভার নেমে গেল । ট্রাভেল এজেন্সির অফিস থেকে বেরিয়েই ছেলেটা বলল, “চলিয়ে স্যার, এক এক কোল্ড ড্রিংকস হো জায় ।”
সৌরভদা রাজী হল না দেখে আমাকে ধরল, “বলিয়ে না সাব কো ।” খুব জোরাজুরি করতে লাগল সে । সৌরভদার দিকে তাকাতেই সকৌতুকে কিছু একটা ইঙ্গিত করল । ধরতে পারলাম না ইঙ্গিতটা । বললাম, “ছেলেটা এত করে বলছে, চলো না !”
মোড়ের মাথায় একটা ষ্টেশনারী দোকানে ঢুকেছি । দোকানের মুখটা ছোট হলেও ভেতরে প্রায় কুড়ি ফুটের মতো লম্বা । শেষপ্রান্তে জমীরভাই এক শিখ পাঞ্জাবীর সাথে গল্প করছে । আমাদের দেখে শিখ এগিয়ে এল । বিশাল পাগড়ীর তুলনায় শরীর অনেকটাই কৃশ মানুষটার । সাধারণত যেমন লম্বাচওড়া পাঞ্জাবী দেখি তেমন নয় । কিন্ত চোখদুটো খুব উজ্জ্বল ।
ছেলেটা বলল, “চার কোল্ড ড্রিংকস ।” সৌরভদা জমীরের দিকে এগিয়ে গেছে ততক্ষণে ।
জমীরের সাথে সৌরদাকে কথা বলতে দেখে ছেলেটার মুখে চোখে অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠতে দেখলাম । দুটো কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নিয়ে গিয়ে একটা জমীরকে অফার করলাম । জমীর হাসল, “থ্যাঙ্ক ইউ ।” কোল্ড ড্রিংকস নিল না । সৌরভদা হেসে বলল, “জমীরভাই পীতা নেহী । তুমি আমারটা ধর । টাকাটা দিয়ে নিই।” সৌরভদাকে টাকা দিতে দেখে ছেলেটা এগিয়ে এসে বাধা দিতে গেল । সৌরভদা হেসে ওকেই সরিয়ে দিল ।
অবাক হইনি একটুও । আমি জানতাম সৌরভদা ঠিক এটাই করবে । তখন ইঙ্গিতটা না ধরতে পারলেও এবার বুঝেছি ।
জমীর আর বিষেন সিং ছোটবেলার বন্ধু । ফোর্ট উইলিয়ামে থাকার সময় একই স্কুলে পড়ত । সৌরভদাই জানাল দোকান থেকে বের হবার পর ।
ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে যেতে হল আর একবার । টাকা মিটিয়ে দিয়ে চলে আসার সময় ছেলেটা বলল, “স্যার, কোই ভুল হো গিয়া তো বেটা সমঝকর মাফ কর দিজিয়ে গা । ঔর ফির আইয়েগা লাদ্দাখ ঘুমনে । বান্দা আপকো খিদমতমে হাজির হো জায় গা ।”
সৌরভদা অনেক আগেই ওকে ক্ষমা করে দিয়েছে জানি । সৌরভদা কারোর সাথে শত্রুতা করতেই জানে না । কারোর উপর রাগ হলে বা অভিমান হলে সৌরভদা নিজেই দূরে সরে যায় । সে নিজেই একদিন বলেছিল ।
মুজিবর আমাদের অবাক করে দিল । সৌরভদা গেস্ট হাউসের ভাড়া মিটিয়ে দেবার পর মুজিবর সেখান থেকে চারশ’ টাকা ফিরিয়ে দিল । সৌরভদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “রিটার্ণ কিঁউ দে রহা হ্যায় ভাই ?” মুজিবর হেসে উত্তর দিল, “আপ জমীরভাইকা মেহমান । মেরা ভি মেহমান হো গয়া । ইস লিয়ে ডিসকাউন্ট ।”
আমরা কবে, কখন থেকে যে জমীরের মেহমান হয়ে গেলাম জানি না । কাশ্মীরে হামিদের মেহমান, এখানে জমীরের ! কাশ্মীর বা লাদাখের মানুষের মতো ভারতবর্ষের সব প্রান্তের মানুষই যদি বেড়াতে আসা সব মানুষকে অতিথি ভাবতে পারে তবে দেশটাকে টুকরো করে কার সাধ্য ? কিন্তু সবাই তো মজিদ বা মুজিবরের মতো বড় মনের হয় না । হামিদ বা জমীরের মতো আপন করেও নিতে পারে না । হলে ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগটা দেখতে হত না ।
সৌরভদা টাকাটা ফিরিয়ে দিতে গেল, “নেহী মুজিবর ভাই । ইয়ে আপকা বিজনেস হ্যায় । আপ রাখিয়ে ।”
মুজিবর কিছুতেই ফিরিয়ে নিল না টাকাটা । উল্টে সে বলল, “দো মাহিনাকে বাদ মেরা সাদী । দাওয়াত দেনে সে আয়েঙ্গে ?” সৌরভদা হেসে বলল, “সরি মুজিবর ভাই । এতনা জলদি নেহী আ সকতা হ্যায় ভাই । সাদী- মুবারক হো ।”
বসির খানের সাথেও দেখা করে এলাম । ধুরন্ধর ব্যবসায়ী সে । বলল, “ফির আইয়েগা কভী ।”
সৌরভদা কয়েক শিশি অ্যাপ্রিকট অয়েল নিল । বলল, “বাতের ব্যথায় খুব উপকার দেয় শুনেছি । তোমার বৌদির জন্য নিলাম । স্কীনের জন্যও খুব ভালো । নেবে নাকি একটা ?”
নিলাম একটা শিশি । সৌরভদাই দাম দিল । আমি দামটা দিতে গেলেও নিল না । বলল, “মানালি গিয়ে নেব ।” লামায়ুরু রেস্টুরেন্টে একেবারে রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরলাম ।
ঘরে ফেরার পর বললাম, “জমীর বা মুজিবর যেমন ভালো ব্যবহার করল ভাবাই যায় না ! আর বসির খানকে দেখ ! বেটা একেবারে পাক্কা বিজনেস ম্যান ! তাই না সৌরভদা ?”
সৌরভদা হাসল, “এটা এক একজনের এক এক রকমের পেশাদারিত্ব । ওরা জানে হয়ত আমরা আর কোনদিনই আর আসব না, কিন্তু আমাদের চেনা পরিচিতরা আসবে । ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওরা আমাদের সঙ্গে রিলেশন তৈরি করে রাখল । ট্রাভেল এজেন্সির ছেলেটার বয়স কম তাই ওর মধ্যে এখনও প্রফেশনাল অ্যাটিচ্যুড আসেনি । ভুল করে ফেলেছে । শেষে অবশ্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে ভুল শুধরে নেবার ।”
সৌম্যশুভ্র মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিল । হয়ত এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল । হেসে বলল, “সে তো তোমার ভয়ে । যা ভয় তুমি দেখাতে পার !”
সৌরভদা হেসে বলল, “আমি মোটেই ভয় দেখাই না । যা ঠিক বা যা হওয়া উচিত সেটার জন্য শেষপর্যন্ত লড়ে যাব এটাই পরিষ্কার করে সবাইকে জানিয়ে দিই ।”
“সৌরভদা, বাঙালী ব্যবসায়ীদের যদি এদের মতো পেশাদারিত্ব থাকত তবে বোধহয় পশ্চিমবাংলার টুরিস্ট স্পটগুলো ধুঁকত না পর্যটকের অভাবে । দার্জিলিং ছাড়া সে অর্থে আর কোন পর্যটন ক্ষেত্র চিনলই না টুরিস্টরা ! সেটাও তো যেতে বসেছে !” আমার মতামত জানালাম ।
সৌরভদা বলল, “ঠিকই বলেছো । পেশাদারিত্বের অভাব আছে বাংলায় । ডুয়ার্সের গরুমারা, জলদাপাড়ায় গেলেও বাকি জায়গাগুলোর খোঁজ করে না অনেকেই । রায়মাটাং, জয়ন্তী, বক্সাদুয়ার কী অসাধারণ সব বেড়ানোর জায়গা ! কিন্তু মানুষ ওদিকে যেতে ভয় পায় । নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে । বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় অবস্থাও তথৈবচ । হিমাচল, উত্তরাখণ্ডের শুধু সৌন্দর্য নয় মানুষকে উৎসাহিত করে নিশ্চিন্তে ঘোরা যায় বলে । কয়েক দশকের কাশ্মীর-অশান্তি হিমাচলকে আজ শীর্ষস্থানে পৌঁছে দিয়েছে পর্যটনে ।”
দরজায় নক করল কেউ । দরজা খোলাই ছিল । সৌরভদা অনুমানে বলল, “জমীরভাই ।” ঠিক তাই ! দরজার বাইরে জমীর । দেখা করতে এসেছে শেষবারের মতো ।
রাত সাড়ে ন’টায় এসে গেল গাড়ি । ট্রাভেল এজেন্সির ছেলেটাও এসেছে সঙ্গে । ওই আমাদের মালপত্র গাড়িতে তুলে দিল । গাড়ির নম্বর দেখে সৌম্যশুভ্র বলল, “হিমাচল প্রদেশের গাড়ি ।”
সৌরভদা মাথা নেড়ে সায় দিল, “হ্যাঁ, মনে হয় মানালির ফিরতি গাড়ি ।”
পেছনের সিটে এক জোড়া যুবক – যুবতী । ম্যারেড কিনা বোঝার উপায় নেই । সৌম্যশুভ্র সামনের সিটের দখল নিল । আমরা দু’জন বসলাম মাঝের সিটে । ‘জুলে’, ‘জুলে’ লাদাখ ।
শহর ছাড়িয়ে টয়োটা কোম্পানির সাদা ইনোভা গাড়িটা মানালির পথ ধরল । মসৃণ, ঝক্ঝকে রাস্তা । প্যাং গং লেকের আকাশটার মতো না হলেও বড় আকাশটা । লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়েছে লাদাখের নির্মল আকাশে । কড়াইয়ের মতো রাতের আকাশটায় অসংখ্য আলোর ফুল ফুটেছে ।
পথের দু’ধারে আলো-আঁধারির জগত । সাসপেন্স বা থ্রিলার জাতীয় কোন সিনেমা দেখতে বসে যেমন চোখের পলক ফেলতে গেলেই মনে হয় কিছু একটা মিস হয়ে যাবে ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে আমার । রহস্যময় আর অ্যাডভেঞ্চারে পূর্ণ পথ । রাত্রি তার দোসর । উত্তেজনায় কথা বলতেও ভুলে গেছি ।
সৌরভদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখলাম একটা জন্তুর মতো কিছু দৌড়ে গেল । পথের দু’ধারে ঝোপঝাড় । বন্যজন্তু না বিড়াল-কুকুর বোঝা গেল না ।
মাঝে মাঝে জনবসতিও চোখে পড়ছে । দোকান-বাজার সব বন্ধ হয়ে গেছে । পাহাড়ের মানুষ রাত জাগে না । ওদের সকাল হয় আমাদের আগে । পুরো দিনটাকে কাজে লাগায় ওরা ।
মাঝে একটা ধাবা খোলা দেখা গেল । ধাবাগুলো রাত জাগে । এ পথে মানালি হয়ে রসদ আসে লাদাখে । সারারাত ধরেই বোধহয় লরি যাতায়াত করে । সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি চলে দিনরাত । পথের ধারে হলদে ও লাল রঙের মার্কার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় চক্চক্ করছে । সমতল ছেড়ে গাড়ি এখন পাহাড়কে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠছে, বাঁক নিচ্ছে ঘন ঘন ।
লেহ থেকে যখন বেরিয়েছি তখন ঠাণ্ডা ছিল না, তবু সৌরভদা রাতের কথা ভেবে ছেলেকে থার্মোকটের ড্রয়ার পরতে বলেছিল । সৌম্যশুভ্র পরেনি তাই আমরাও পড়তে পারিনি । এখন মনে হচ্ছে ড্রয়ার না পরে ভুল করেছি ।
কথা নেই বার্তা নেই গাড়ি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল । ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামল । টায়ার চেক করল । হাত-পা ছুঁড়ল কিছুক্ষণ । তারপর সিটের নীচে থেকে বোতল বের করল একটা । ঢক্ঢক্ করে গলায় ঢেলে নিল খানিকটা । অ্যালকোহলিক গন্ধে পরিষ্কার হল বোতল রহস্য । পার্বত্যপথে বারবার সতর্কবার্তা থাকা সত্বেও এরা মানে না । নিষেধ না মানার মধ্যেই যেন পৌরুষত্ব !
বরফ দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে । এক জায়গায় অনেক নয়, ইতস্ততঃ ছড়ানো । আকাশটা এখন ছোট হয়ে গেছে । পথের দু’দিকেই পাহাড় । জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে । কাঁচ তুলে দিতে বাধ্য হলাম । আকাশটা হারিয়েই গেল । পাহাড় আর বরফ ছাড়া গাড়ির হেডলাইটে সামনের রাস্তা । ব্যস ! গভীর হতে যাওয়া রাত রহস্যের সন্ধান দিতে পারে ভেবে চোখদুটোকে খোলা রেখেছি তবু ।
তুষার রাজ্যে প্রবেশ করেছি আমরা । চারদিকেই শুধু বরফ । এমনকি পথের উপরেও । গতি কমে গেছে গাড়ির । ড্রাইভার চিৎকার করে কিছু বলল । লাফিয়ে উঠেছি সঙ্গে সঙ্গে । “ক্যায়া হুয়া ?” সৌরভদা আর আমি একসাথে চিৎকার করে উঠেছি ।
ড্রাইভারের কাছে যা শুনলাম মনে হল ‘তেন্ডুয়া’ অর্থাৎ একটা তুষার চিতা রাস্তা পার হয়েছে । সৌম্যশুভ্র’ও বলল, “স্নো লেপার্ড কিনা জানি না, কিছু একটা দৌড়ে গেছে দেখেছি । অনেকদূরে ছিল । গাড়ির আলো গায়ে পড়ার আগেই পালিয়ে গেছে ।”
সৌরভদা নড়েচড়ে বসল । বলল, “স্নো লেপার্ড এখানে থাকতেই পারে । তবে অসম্ভব চতুর হয় স্নো লেপার্ড । জনবসতি থেকে অনেক উঁচুতে এদের বাস । এরা যেমন দুর্দান্ত শিকারী তেমনি হিংস্র । এদের দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার । যাক, বাবি অন্ততঃ গল্প করতে পারবে ও কিছু একটা দেখেছে টাংলা পাসে ওঠার সময় । কিন্তু বাবি, আমি তো দেখছিলাম তুই হুডিতে মুখ ঢেকে ঘুমাচ্ছিস । দেখলি কী করে ?”
“মোটেই ঘুমাইনি আমি । এই পথে কেউ ঘুমায় নাকি ! আমি ট্রেনেই ঘুমাইনা আর গাড়িতে ! হুঃ ! তুমিই ঘুমাচ্ছিলে ।”
সৌম্যশুভ্র মাথা ঢেকে বসেছিল । সৌরভদার মতো আমিও ভেবেছিলাম সে ঘুমাচ্ছে । কিন্তু এখন ওর কথা শুনে বুঝতে পারছি ও ঘুমায়নি । প্রকৃতিপ্রেমিক প্রকৃতির মাঝে ঘুমায় না । সৌম্যশুভ্র বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছে । শারীরিক সক্ষমতা কম, কষ্ট সহ্য করার মানসিকতাও নেই তবু সে প্রকৃতিকে ভালোবাসে বলেই জেগে ছিল । দেখার চোখ আছে ওর । চাপ নিতে না পারলেও চাপে ভেঙে পড়ে না । ওদিকে পেছনের সিটের দু’জনের কোন আওয়াজ নেই । শালে জড়িয়ে দুটো শরীর এক হয়ে গেছে ।
সৌম্যশুভ্রকে বললাম, “তুমিও যেমন ঘুমাওনি, তোমার বাবাও ঘুমায়নি । সত্যিই তো এ পথে কেউ ঘুমায় নাকি ? আমরা মানালিতে গিয়ে হোটেলের ঘরে না হয় একটু বেশি ঘুমিয়ে নেব । কি সৌম্যশুভ্র তাই তো ?”
ছেলের হয়ে বাবার উত্তর, “অবশ্যই ! মানালিতে গিয়ে দু’দিন শুধু খাওয়া আর ঘুমানো ।” সৌম্যশুভ্র’র কোন উত্তর নেই ।
পৃথিবীতে নাকি দু’ধরণের মানুষ । উইনার্স আর লুজার্স । কিন্তু আমি জানি আমি ও দুটোর কোন দলেই নেই । আমার কাছে জীবন মানে বেঁচে থাকা আর সবকিছুর থেকে কিছু অন্ততঃ খুঁজে নেওয়া । জয়-পরাজয় নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বেঁচে থাকার জন্য ব্যাকুলতাও নয় । বেঁচে আছি তাই গ্রহণ করছি পৃথিবীর বাতাস । উপভোগ করছি প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ । সৌরভদার তো সব আছে । সৌরভদা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন সফল করে তোলার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে । যে স্বপ্ন দেখে আর স্বপ্নকে সাকার করে তুলতে ঝাঁপায় সেই তো উইনার ।
(ক্রমশঃ)
View Comments
বাঁধন হারা
তপন বিশ্বাস (ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাসের একাদশ পর্ব) পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ...