ফিরে পাওয়া
সুজাতা দাস
—মামী! মা’র জ্বর। আজ কাজে আসতে পারবে না।
রাধার গলা শুনে চমকে তাকাল শর্মিষ্ঠা। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঘড়ির কাঁটা ন’টার ঘর পেরিয়ে গেছে। সবে অফিসের ভাত আর টিফিন ধরিয়ে কর্তাকে বের করেছে। এখনও অজস্র কাজ। তার মধ্যে…
—একটু আগে খবর দিতে পারিস না। আমি স্কুলে বেরবো কী করে?
বাচ্চা মেয়েটার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে শত বিরক্তির মধ্যেও শর্মিষ্ঠা চুপ করে গেল।
—মাকে ডাক্তার দেখাতে বলিস।
নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে রাধা চলে গেল। ভ্যাপসা গুমোট গরম। সকাল থেকে মাথাটা ভারি হয়ে আছে। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। স্কুলে যেতেই হবে। অতএব…
ঝড়ের বেগে যাবতীয় কাজ সেরে দশটা পঞ্চান্ন স্কুলে পৌঁছল। লেটমার্ক পড়ে গেছে। বয়েজ স্কুল। বাড়ি থেকে হেঁটে দশ মিনিট। তাও দেরী। হেড স্যারের দিকে না তাকিয়ে হাজিরা খাতায় সই করল শর্মিষ্ঠা। কেমন এক অপরাধবোধে মনটা ভারী হয়ে গেল।
ক্লাস নাইনের শ্রেণি শিক্ষিকা। প্রথম পিরিয়ডে প্রতিদিন ক্লাস। বিক্ষিপ্ত মনে রেজিস্টার হাতে শর্মিষ্ঠা ক্লাসে ঢুকলো। আপাত হাসিখুশি শর্মিষ্ঠা ছাত্রদের কাছে রাগী মিস।আবার ভালোও বাসে।
—রোল নাম্বার 1..2,..3,..,4…,5,…6,…7…………
হঠাৎ তীক্ষ্ণ সিটির আওয়াজ। শর্মিষ্ঠা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। না, ক্লাসের কেউ নয়। স্কুলের এই বিল্ডিং টা বহু পুরোনো। দোতলায় শুধু নাইনের ক্লাস।সংস্কারের কারণে দোতলার বাকি ঘরে ক্লাস আপাতত বন্ধ।শর্মিষ্ঠা ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। দুটি ছাত্র সম্ভবত ইলেভেন বা টুয়েলভের, করিডর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে।
—পালাচ্ছিস কেন? প্রায় ছুটে গিয়ে ছেলে দুটিকে ধরে ফেলে শর্মিষ্ঠা।
ক্লাস টুয়েলভের অমিত আর প্রশান্ত। পড়াশোনায় অমনোযোগী। অবাধ্য ও অভদ্র।
—এখানে কী মনে করে? পার্ক মনে করেছিস?
—কী করেছি? প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠলো প্রশান্ত।
নামে প্রশান্ত কিন্তু ব্যবহারে অশান্ত। তুলনায় অমিত চুপচাপ। নিঃসাড়ে কাজ সেরে কেটে পরার ধান্দা।
–অভদ্রের মতো সিটি দিয়ে বলছিস, কীকরেছি? এখানে তোদের কিসের ক্লাস?
—আপনি দেখেছেন? এখানে কোথাও লেখা আছে আমরা আসতে পারবো না।
এই ঔদ্ধত্বে শর্মিষ্ঠার কান-মাথা গরম হয়ে গেল। ক্লাসের ছেলেদের চুপ করে বসতে বলে প্রশান্তকে নিয়ে গেল সোজা হেডস্যারের কাছে। অমিত সুযোগ বুঝে পালিয়েছে।
হেডস্যার নির্বিবাদী মানুষ। কারোর সঙ্গেই ঝামেলায় যেতে চান না। তিনি কোনো কড়া পদক্ষেপ নেবেন না জেনেও শর্মিষ্ঠা আসে। স্যার সমস্ত ঘটনা শুনে প্রশান্তকে মিসের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে। একগুঁয়ে, অবাধ্য প্রশান্ত ক্ষমা চাওয়া দূরের কথা, মিসকেই দোষারোপ করতে থাকে।
ক্রমাগত বাগবিতন্ডায় ক্ষুব্ধ শর্মিষ্ঠা চিৎকার করে ওঠে —ছেড়ে দিন স্যার। প্রোজেক্টে কীকরে পাশ করে আমিও দেখবো। ২০নম্বর ইন্টারনাল মার্কস।
প্রশান্ত আরও ক্ষিপ্ত। রক্তচোখে তাকায়।
—কাল তোমার গার্জেন নিয়ে আসবে। আজ বাড়ি চলে যাও।
হেডস্যারের কথায় আমল না দিয়ে অভদ্র, ঠেঁটা, বেয়াড়া প্রশান্ত স্কুল থেকে উদ্ধত ভঙ্গিতে বেড়িয়ে গেল। তুচ্ছ কারণে ক্লাসটা নষ্ট হওয়ায় বিক্ষিপ্ত মনে শর্মিষ্ঠা শুধু রোল কল করে টিচার’স রুমে ফিরে এলো। সেখানেও তুমুল আলোচনা।সহকর্মীরা আপোষে মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিল। আজকালকার ছেলে…
অন্যায়ের সাথে আপোষ —শর্মিষ্ঠার স্বভাব – বিরুদ্ধ। এই কারণেই সে বন্ধু বিহীন। স্রোতের প্রতিকূলে…
—শর্মিষ্ঠাদি, প্রশান্ত এসেছিল। আপনার ওপর খুব রাগ। খুব বাজে ভাষা ব্যবহার করে বলেছে, আপনাকে দেখে নেবে।
—বাহ্! ও বললো, তোমরা শুনলে?
—আমি বকেছি। বুঝিয়েছি । কিন্তু প্রশান্তকে তো চেনেন! খুব রাফ্। কী দরকার ঝামেলায় গিয়ে?
এই গা-বাঁচানো কথায় শর্মিষ্ঠার সারা শরীরে জ্বালা ধরে যায়।
—ঠিক আছে। এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। ও আমায় দেখবে, আমি ওকে দেখবো। দেখাদেখিটা আমাদের মধ্যেই থাক্।
সহকর্মীদের এহেন দুঃসহ মনোভাবে শর্মিষ্ঠা একরাশ বিরক্তি ও বিষন্নতা নিয়ে ক্লাসে যায়।
শিক্ষক জাতির মেরুদন্ড। পরিস্থিতি তাদের মেরুদন্ডহীন করে তুলছে। এই মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার বাঘবন্দী খেলায় আমরা সবাই বিপন্ন। না, এক্ষেত্রে কোনোভাবেই আপোষ নয়—
এক অসম্ভব জেদ শর্মিষ্ঠাকে পেয়ে বসে।
—ম্যাডাম! স্যার ডাকছেন।
সবে প্রথম পিরিয়ড শেষ করে শর্মিষ্ঠা খাতা নিয়ে বসেছে। অগত্যা খাতা বন্ধ করে হেডস্যারের ঘরে। স্যারের সামনের চেয়ারে এক ভদ্রমহিলা। একপাশে দাঁড়িয়ে ঠেঁটা প্রশান্ত। স্যার আলাপ করিয়ে দিলেন। প্রশান্ত ‘র মা। শর্মিষ্ঠাকে দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেন।
—মিস, ওকে ক্ষমা করে দিন। এই ছেলেকে নিয়ে আর পারছি না। ওর বাবা আর্মিতে আছে। নমাসে – ছমাসে বাড়ি আসে। আমাকেই সব সামলাতে হয়। আমার কথা শোনে না। প্রোজেক্টের নাম্বারটা…. প্লিজ একটু দেখবেন…
এতক্ষণে প্রশান্ত’ র মায়ের কান্নার অর্থ শর্মিষ্ঠার বোধগম্য হলো।
—কিরে! মিসের কাছে ক্ষমা চা! বল, ভুল করেছিস।
মাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো অবাধ্য প্রশান্ত।
—ছেড়ে দিন। আমাকে নাকি দেখে নেবে। ধর, তুই আমাকে মেরে ফেললি, তাতে কার বেশি ক্ষতি হবে? জীবনের অনেকটা সময় পার হয়ে এসেছি। এমন কিছু ক্ষতি হবে না। কিন্তু তোর ভবিষ্যৎ… ভেবে দেখছিস্?
—ম্যাম, ও ছেলেমানুষ,না বুঝে বলে ফেলেছে।ওর প্রোজেক্টের নম্বর…
—আপনার শুধু নাম্বার প্রয়োজন? ছেলে মানুষ হলো না অমানুষ হলো! —তা নিয়ে চিন্তা নেই? যান, নাম্বার নিয়ে ভাবতে হবে না।
ক্ষোভে ফেটে পড়ে শর্মিষ্ঠা।
—না মিস। এখনো চুপ করে আছিস? এই ক্ষমা চা।
মায়ের তাড়নায় প্রশান্ত অনেক কষ্টে বাঁহাতে ফুল ফেলল।
—মিস, আর হবে না।
ছেলের নম্বরের ব্যপারে একশ ভাগ নিশ্চিন্ত হয়ে মা অনুনয়ের ভঙ্গিতে অজস্র প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিলেন। প্রায় আপোষের রাস্তায় হেঁটেই সমাধানে বাধ্য হলো শর্মিষ্ঠা। অর্থাৎ মনে নয়, মেনে নেওয়া…
জীবন বয়ে চলছে সময়ের গাড়িতে চেপে। প্রায় বছরখানেক পর। আজও দেরী হয়ে গেছে। বছরের প্রথম দিন। আজও লেটমার্ক।
প্রায় ছুটতে ছুটতে স্কুলের কাছাকাছি।
—মিস!
পিছন ফিরে তাকালো শর্মিষ্ঠা। গলাটা খুব চেনা চেনা।
—প্রশান্ত! তুই! কিছু বলবি?
সাইকেল থেকে নেমে শর্মিষ্ঠাকে প্রণাম করে।
—আরে! কী করছিস?
হতচকিত শর্মিষ্ঠা অবাক হয়ে তাকায়। এই সেই প্রশান্ত? অবাধ্য অভদ্র বদমেজাজি প্রশান্তের চোখে মুখে কী এক প্রশান্তির ছায়া।
—মিস, Happy new year.
রঙিন খামে ভরা একটা কার্ড শর্মিষ্ঠার হাতে দিয়ে সলজ্জ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
—আমার আঁকা।
প্রশান্ত পড়াশোনায় অমনযোগী বা কমজোরী হলেও আঁকার হাত বরাবরই ভালো। শর্মিষ্ঠারও অজানা নয়। একগোছা টাটকা রজনীগন্ধা।
—মিস, আসছি ।
প্রশান্ত’র সাইকেল সামনে চৌরাস্তার মোড়ে জনজোয়ারে মিলিয়ে গেল। শর্মিষ্ঠার চোখে জল। শরীরে মনে শুধুই রজনীগন্ধার গন্ধ ।
View Comments
THE MYSTERY OF ATTAINING GODHOOD AND IT’S PROOF
সুজাতা দাস —মামী! মা’র জ্বর। আজ কাজে আসতে পারবে না।রাধার গলা শুনে চমকে তাকাল...