অপূর্ণ
সুজাতা দাস
—তপু , ভাত বেড়েছি! খাবি আয়।
—মা, আজ ফিরতে দেরি হবে।
—সে তো রোজই হচ্ছে?
—কী করবো বল? চাকরিটাই এমন…
—খাওয়া, ঘুম ঠিক করছিস না!
—মা! আমি ঠিক আছি।
—আর আমি তোর কোনো কথা শুনবো না।
—কী ব্যাপারে?
—কাল যে কথা বললাম, ভুলে গেলি?
—মনে আছে।
— কী ঠিক করলি?
—কীসের?
—আরে, মেয়ে দেখতে যাবার।
—মা, নতুন প্রোজেক্ট। এখন আমি সময় দিতে পারবো না।
—না বাবা, তা বললে কী করে হবে? আমি কথা দিয়েছি।
—লক্ষী মা, এবার টা ম্যানেজ করে নাও। প্লিজ।
মায়ের গালে গাল ছুঁয়ে তপন জুতো পড়তে লাগল।
—আসি মা।
—দুগ্গা! দুগ্গা!
ছেলের আদরে সুধাময়ী সব অভিমান ভুলে হাসিমুখে টেবিল মুছতে লাগল। এই তার বড়ো দূর্বল জায়গা।
—ও, পারুল! বাসনগুলো আগে ধুয়ে দাও।
—মাসিমা, দাদাকে বলেছেন?
—আর বলিস না। তোর মেসোমশাইকে নিয়েই যেতে হবে।
—আমি জানতাম। দাদার সময় হবে না।
হাসতে হাসতে পারুল বাসন ধুতে লাগল।
—এবছরের মধ্যে ব্যবস্থা করতেই হবে। কবে আছি, কবে নেই।
—আপনার যত খারাপ কথা। আমার সামনে বলেছেন, বলেছেন! দাদার সামনে কখনো বলবেন না। খুব ক্ষেপে যাবে।
মা ছেলের নিবিড় সম্পর্কে কেউ কাউকে ছাড়া ভাবতে পারে না। এমন কোনো কথা, এমন কোনো ভাবনা নেই —যা দুজনের মধ্যে কারোর অজানা! এ সংসারে গণপতি বাবু যেন অতিথি মাত্র।
যৌথপরিবারের ছোটবৌ সুধাময়ী আজ ছোটো পরিবারের একক গৃহিনী। একমাত্র মেয়ে তৃষার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার। মাত্র এক বছরের এই সুখ। দত্ত পরিবারের একান্নবর্তী সংসারে লক্ষীমন্ত ছোট বৌ- এর জীবনে স্নেহ- ভালবাসা – শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। সময়ের বদলে মূল্যবোধেরও বদল ঘটছে। আত্মকেন্দ্রিকতার চাপে যৌথপরিবার ভাঙনের পথে। দত্ত পরিবারও সেই স্রোতেই ভাসল। অনেক অশান্তি, মানসিক যন্ত্রণা ,অপমান ও চোখের জল। সুধাময়ীর ভালোলাগার, ভালোবাসার, ভালোথাকার দত্ত পরিবারে ভাঙন ধরল। বাধ্য হয়েই সুখের আশায় ভাড়াবাড়িতে….
ফেলে আসা দিনের দুঃখ ভুলে সুধাময়ী পুত্রবধূর স্বপ্নে বিভোর। কত শত ভাবনার জাল বুনে চলেছে দিনরাত।
—কীগো, কাল যাব কিন্তু!
—কোথায়?
—আরে! তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই দেখছি?
—ও, মেয়ে দেখতে তো?
—হ্যাঁ, মনে আছে তাহলে!
—আমরা দেখলে হবে? ছেলের পচ্ছন্দ?
—ও নিয়ে ভাবতে হবে না। ছেলেও যাবে। পরে।
কথা রাখতে বাধ্য হয়ে তপুকে ছাড়াই স্বামীর সঙ্গে সুধাময়ী মেয়ে দেখে এলেন। সুশ্রী শিক্ষিতা। ছোটো পরিবার। বাবা মা ভাই বোন। পরিবারটি পূর্ব পরিচিত। বেশ মনে ধরেছে।
—তপু, আর দেরি না করে দেখে আয় বাবা।
—জো আজ্ঞা! বেগমসাহেবা!
—খালি ইয়ার্কি!
মা-ছেলের হাসি গল্পে সন্ধের এই সামান্য চায়ের আড্ডায় অনেক রংবাহার। ছেলের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে সুধাময়ী তার স্বপ্নের ঝাঁপি খুলে বসে। একমাত্র ছেলের বিয়ে। নহবত বসবে। যেখানে যত আত্মীয় স্বজন সবাইকে নিমন্ত্রণ করতে হবে। তাদের আপ্যায়ন, বিয়ের কেনা – কাটা, গয়না তৈরী, খাবারের মেনু, মন্ডপ সাজানো কত কি…
—কীরে তপু, ঘুমিয়ে পড়লি?
—উঁহু! শুনছি শুনছি ।
—শুনছিস না ছাই! কিন্তু যা বলেছি মনে আছে তো?
—মনে আছে মাতাজী, এখন খেতে দেবে চলো।
পাকাকথা হয়ে গেল। সামনের অঘ্রাণে বিয়ে। মাত্র দুমাস পরেই। এক আকাশ খোলা মন নিয়ে জন্মেছে সুধাময়ী। বাপের বাড়িতে একগুচ্ছ ভাই-বোন আর শ্বশুর বাড়ির জা ভাসুর দেওর ননদ এবং তাদের ও নিজের সন্তান। তার স্নেহ – মায়া – মমতার সীমাহীন সাগরে সবাই ডুব দিয়েছে। অপমান অসন্মান কম জোটে নি জীবনে। তবুও সুধাময়ীর চোখে সবাই ভালো। মানুষের কালো দিকে সে তাকাতে চায় না। তাই নতুন অতিথির আগমন নিয়ে আশংকার মেঘ জমে নি।ভাবী পুত্রবধূর সাথে কাল্পনিক আলাপচারিতায় বুঁদ হয়ে আছে। উদাসীন স্বামী আর কর্মব্যস্ত ছেলের সংসারে বড় একা… সে আসছে… ভাবতেই আনন্দে সুধাময়ীর চোখ জলে ভরে এলো।
—কাকিমা..
—ওমা! মিঠু! এসো..
—সুখবর পেয়ে চলে এলাম।
—খুব ভালো করেছ। আমাকে একটু সাহায্য করো তো।
—কী ব্যাপারে?
—আর বলো না। একমাসও বাকি নেই। তপুকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে? তৃষার ছেলে – মেয়ের পরীক্ষা। আসতে পারবে না। বিয়ের কেনাকাটা… তুমি যাবে?
ভাসুরপো – বৌকে সাথে নিয়ে সুধাময়ী মা-দশভূজার মতো দশদিক সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একদিকে শাড়ি – গয়না – কসমেটিকস, অন্যদিকে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, খাবারের মেনু, বিয়ের কার্ড…
নাওয়া – খাওয়া মাথায় উঠেছে। সময় বড়ো কম…
—মা, তোমার কী শরীর খারাপ?
—না তো!
—খুব ক্লান্ত লাগছে। বেশ হাঁপাচ্ছ!
—না বাবা ।তুই বেশি ভাবিস্! সামনে বড়ো কাজ। আমি অসুস্থ হলে চলবে?
আজই তপু জামশেদপুর থেকে ফিরেছে। সকাল থেকেই সুধাময়ীর শরীরে জুত নেই। বুকের বাঁ-দিকে কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা। মাথাটা ঘুরছে। খাবার ইচ্ছাও নেই। এক অজানা আশংকার মেঘ মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায়। ছেলেকে কিছুই বলা যাবে না। ও ব্যস্ত হয়ে পড়বে। নিজেকে ভুলে অন্যের জন্য যে জীবন-ভোর ভেবে এসেছে সে নিজের শরীরের জন্য এই সময় কাউকে ব্যস্ত করতে চায় না।
—মা, চলো ডাক্তারের কাছে। একবার চেক-আপ করিয়ে আনি।
—বলছি তো তেমন কিছু হয় নি!
—শরীরের আর দোষ কী? তোর মা যা শুরু করেছে! সব নিজে করবে। এখনও দিন পনেরো সময় আছে। কিন্তু ওনার সময় নেই। চাই এখনই…
—তোমার ঐ আলসে গতিতে চললে হয়েছে আর কী?
ধীর স্থির উদাসীন গণপতি বাবুর সঙ্গে সুধাময়ীর এই বিরোধ চিরকালীন।
—পনেরো দিন আগে ফিরব বলেছি, ফিরেছি। এখন আমি ফ্রী। এতো তাড়াহুড়োর কী দরকার ছিল?
রাতে বুকের অস্বস্তি আরও বাড়তে লাগল। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই। সুধাময়ীর চোখে – মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ। তপুর নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে। দেরী না করে ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ডঃ সামন্তকে কল দেয়। Mild Attack. অতিরিক্ত পরিশ্রম ও মানসিক চাপ। Complete Bed Rest.
—সামনে ছেলের বিয়ে। আমি শুয়ে থাকলে চলবে?
—মা, ক’দিন রেস্ট নিন। একেবারে সুস্থ হয়ে যাবেন।
—কিন্তু…
—কোনো কিন্তু নয়। তুমি বিছানা থেকে উঠবে না। আমি সব সামলে নেব।
সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি তপু। ভালবাসার ও ভালো থাকার একান্ত আশ্রয় —মা।মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়! আর ভাবতে পারে না…
ওষুধের জেরে সুধাময়ী আচ্ছন্ন হয়ে বিছানায়।মায়ের খাবারের ব্যবস্থা করে বাবাকে ওষুধ বুঝিয়ে দিয়ে তপু বেরিয়ে পরল। একজন ট্রেন্ড আয়ার খোঁজে।
ঘোরের মধ্যেও সুধাময়ীর কানে বাজতে থাকে সানাই-শাঁখ – উলুধ্বনি…
—বৌদি! কী এমন হলো? তুমি বিছানায়!
—কে? পূর্ণিমা…
ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে থাকে সুধাময়ী। তপুর বন্ধু সুমিতের মা। পাশের পাড়ায় থাকে। মিশুকে সুধাময়ীর গল্পগাথার বান্ধবী ।অন্যের ব্যাপারে বিশেষ কৌতুহলী ।কিন্তু আজ কথা বলার ইচ্ছা নেই।
—ক’দিন পর ছেলের বিয়ে? এভাবে শুয়ে থাকলে চলবে?
—ডাক্তার নড়াচড়া করতে বারণ করেছে।
মৃদুভাষী গণপতি বাবু বেশ গম্ভীর স্বরেই বললেন। এই গায়ে – পড়া স্বভাবের প্রতিবেশিনীকে খুব একটা পছন্দ করেন না। শুধু গিন্নীর মুখ চেয়ে…
—ছাড়ুন তো দাদা, ডাক্তারের কথা! বৌদিকে এমন আলুথালু দেখতে ভালো লাগে? আমি একটু পরিষ্কার করে দি?
—না না! কোনো দরকার নেই। ছেলে জানলে, রেগে যাবে।
—ছেলে জানবে কি করে? মাথা ধুইয়ে কাপড়টা পাল্টে দেব। বৌদির ভালো লাগবে। আপনি একটু বাইরে যান।
সুধাময়ী ক্লান্ত চোখে তাকায়। অনিচ্ছা সত্বেও গণপতি বাবু পাশের ঘরে চলে যান।
অসুস্থতার খবর শুনে অবনীশবাবু এসেছেন।স্ত্রীর শারীরিক অবনতি নিয়ে বেয়াইমশাই – এর সঙ্গে একথা সেকথার মধ্যে হঠাৎই চিৎকার তারপর কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। বিছানা এলিয়ে পড়ে আছে সুধাময়ী। নিষ্প্রাণ নিষ্পলক চোখে কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। গৌরবর্ণা শরীর বেদনায় নীল। ঘরের এককোণে কাচুমাচু পূর্ণিমা।
—এ কী করলে?
আর্তনাদ করে উঠলেন গণপতি বাবু।
—আমি কিছু করিনি। আধশোয় অবস্থায় মাথা মুছিয়ে কাপড় ছাড়িয়েছি মাত্র…
চিৎকারে আশেপাশের কয়েকজন চলে আসে। কথায় কথা বাড়বে। চুপি চুপি বেড়িয়ে যায় পুর্ণিমা। খবর পেয়ে ফিরে আসে তপু।অর্ধ উন্মাদ তপু সুধাময়ীর সাজানো সংসার তছনছ করে দেয়। সদ্য কেনা জামাকাপড়, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের নানান জিনিস ছড়িয়ে পড়ে আছে চারপাশে..
দশই অঘ্রাণ। দূরে কোথাও পূরবী রাগে সানাইএর আলাপ। বাড়িতে প্যান্ডাল বাঁধা হয়েছে। আত্মীয় স্বজনে সরগরম। আজ সুধাময়ীর শ্রাদ্ধ ।মায়ের ছবির সামনে তপু।রজনীগন্ধা আর ধূপের ধোঁয়ায় পুরোহিতের উদাত্ত মন্ত্রোচ্চারনণ।তপুর দুচোখেে শুধুই অকাল বর্ষণ।

View Comments
কথা রেখেছিল
সুজাতা দাস —তপু , ভাত বেড়েছি! খাবি আয়। —মা, আজ ফিরতে দেরি হবে। —সে তো রোজই হচ্ছে?...