ছায়া
অনেকক্ষণ ধরে কুলের বিচিটা হাতে নিয়ে আছি। কিন্তু মারবার সুযোগ পাচ্ছি না। বিনয় বাবু মন দিয়ে বোর্ডে অঙ্কটা করিয়ে দিচ্ছেন। সারা ক্লাস চুপ চাপ। আমার বোর্ডের দিকে মন নেই। দীপকের সামনের বেঞ্চে ছেলেটা বসে আছে. একমনে বোর্ডের অঙ্কটা লিখেই চলেছে। ওর নাম প্রদীপ্ত। নতুন এসেছে স্কুলে। খুব চুপচাপ। ঠান্ডা। আমাকে সারা ক্লাস মেনে চলে অথচ ও আমার কাছে ঘেঁষে না। ওর বাবা শুনলাম -সরকারি অফিসার। তাই অহংকারী নাকি ! দেখাচ্ছি।
আমার একটা দল আছে। সবাই ভয় পায়। মাস্টার মশাইরা ও কিছু বলে না , কারণ রেজাল্ট যে খুব ভালো করি। শেষ পর্যন্ত দীপক মাথাটা একটু সরাতেই টাই করে বিচি টা ছুঁড়লাম। আমার লক্ষ্য ফস্কায় না। উঃ করে উঠে মাথাটা নাড়াতে গিয়ে ছেলেটার চশমা ছিটকে পড়লো। বিনয় বাবু -কি হলো ? বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ছেলেটা মিনমিন করে বললো -স্যার,পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে কুলের বিচি দিয়ে মারলো। -কে ? কার কাজ এটা? সারা ক্লাস জানে, তবু আমি জানি কেউই আমার নাম বলবে না। তাই হলো। বিনয় বাবু বার কয়েক ধমক দিয়ে আবার বোর্ডে লেখা শুরু করলেন। দীপক কানে কানে ওকে কিছু বললো বোধহয়। কারণ ছেলেটা পেছন ফিরে আমার দিকেই তাকালো একবার।
ক্লাস শেষ হলে ছেলেটা আমার কাছে এলো। -তুমি এতো জোরে আমাকে মারলে দেখ আমার মাথাটা কেমন ফুলে গ্যাছে। আমার চোখের জন্য এমনি ই খুব মাথা ব্যাথা হয়। হটাৎ করে আমার মনটা খুব খারাপ লাগলো। বললাম -বস , এক সপ্তাহ হলো নতুন এসেছিস। একদিনও কথা বলিস নি কেন.?
-আসলে দীপক তো আমার পাশেই থাকে ও বলে দিয়েছিলো তোমার থেকে সাবধান থাকতে তাই।
ছেলেটার মুখটা খুব সরল, একটু ভীতু মার্কা। মায়া লাগলো। সত্যি খুব জোরেই মারা হয়ে গেছে। -আমাদের বাড়ি এস না। খুব কাছেই চন্দ্র মোহন রায় লেন।
আমি এখনো সব রাস্তা চিনি না। আসলে এটা খুব পুরোনো শহর . অনেক গলি ঘুঁজি। আর আমাদের বাড়ি স্কুলের একেবারে অন্য প্রান্তে। তাই না জানলেও বেশ ভারিক্কি চলেই বললাম-হ্যাঁ জানি, বেশ একদিন যাবো।
পরেরদিন থেকে প্রদীপ্ত আমার পাশেই বসতে শুরু করলো। কবে থেকে যে প্রদীপ্তদের বাড়ির সবার খুব কাছেই চলে এলাম এখন আর মনে পরে না। অফিস এর সঙ্গেই ওদের থাকার কোয়ার্টার। কি সুন্দর সব সাজানো। প্রদীপ্ত আমাকে প্রায়ই বই দিতো পড়তে , গল্পের বই। আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। বইয়ের নেশা আমার মাথায় ঢুকিয়ে ছিল মা। নিজে সারাদিনের রাতের কাজ সেরে বইতে ডুবে যেতে দেখেছি একদম ছোট্ট থেকে। ভাঙা চোরা বাড়িতে আমাদের একমাত্র দামী জিনিস ছিল বই। বাবার তো বাক্স থেকে খাট সবখানেই বই ছাড়ানো। কিন্তু সেগুলো খুব বিচ্ছিরি রকমের মোটা আর বেশির ভাগ ইংরেজি লেখা। মা কে জিজ্ঞাসা করতাম এতো পড়েও বাবা কেন চটকলে কাজ করে মা ? প্রদীপ্তর বাবা কিরকম চাকরি করে জানো? সরকারী অফিসার । আর আমার বাবা কেন তাহলে চটকলে ?
-পার্টির নির্দেশ যে , চটকলের শ্রমিক সংগঠনের কাজের ভার পার্টি তোর বাবাকেই দিয়েছে -মা অল্প হেসে উত্তর দিলো । তোর বাবা কমিউনিস্ট, দেশের সবার ভালোর কথা ভাবে তোর বাবা, তার দল । সকারী অফিসার হয়ে শুধু নিজের ভালোটা সে চায় নি সোনা -মা আমার গাল টিপে বললো। আমার কমিউনিস্ট বাবা-মায়ের সাথে সাদামাটা বাড়িটার বিপরীত বলেই বোধহয় প্রদীপ্তদের বাড়ি আকর্ষণ করতো আমাকে।
কয়েক বছর পর প্রদীপ্তর বাবা বদলি হয়ে গেলো। আর প্রদীপ্তর সাথেই সম্পর্কটাও চলে গেলো। কিছুদিন খুব খারাপ লাগতো। মনে পড়তো ওদের বাড়ি।.পড়ার ঘর… ওর মায়ের মিষ্টি ব্যবহার। আমরা যে গরিব তার জন্য তাদের ব্যবহার কোনো আলাদা ছিল না।
হটাৎ করে আমার বাবার চটকল বন্ধ হয়ে গেলো। খুবই খারাপ অবস্থা তখন। এদিকে বোর্ড এর ফাইনাল পরীক্ষা। বাবা টিউশনি শুরু করলো, মা সেলাই। কিন্তু দারিদ্রের কাপড় টা আমাদের ক্রমশ বেআব্রু করে দিতে লাগলো। ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়ে গেলাম। বড় মামা বাবা কে বললো -ওকে ভর্তি করে দেও। আপাতত আমি টাকা দিচ্ছি। তোমার ব্যাপার তো জানি তুমি না হয় পরে তোমার সময় মতো দিয়ে দিও. অবশ্য এই প্রস্তাবটাও যদি তোমার সম্মানে লাগে তাহলে আলাদা কথা।
স্কুলের শেষ দিকেই বুঝতে পারছিলাম কম্যুনিস্টরা মানুষের কাছে ভালো ভাবেই পৌঁছে গেছে। সরকারি ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন হতেও পারে । চারদিকে মিছিল মিটিং , সরকারি শক্তির দাপাদাপি। ভর্তি হলাম শিবপুরে। আমি ঠিক করলাম আমাকে ঘুরে দাড়াতে হবে। না কমিউনিস্ট হয়ে কষ্ট করবো না. নিজের ভালো টা বুঝে নেবো। মানুষের মধ্যে সরকার পাল্টায় দেওয়ার চেষ্টা চলুক আমি এর মধ্যে নেই। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমার রেজাল্ট সবার চোখ টানলো।এমনকি ইউনিয়ন এর দাদারাও অনেক চেষ্টা করেও আমাকে দলে টানতে পারলো না। আমি জানি না এদের কারোর আমার মতো কমিউনিস্ট বাবা আছে কিনা। এদের কম্যুনিস্টেদের sacrifice কি তার সমন্ধে কোনো ধারণা আছে কিনা। কিন্তু আমি কমিউনিস্ট হতে পারবো না।
একসময় সত্যি সরকার পাল্টালো। ভাবলাম এবার যখন বাবার পার্টির সরকার হয়েছে নিশ্চয়ই বাবার একটা কিছু ভালো ব্যবস্থা পার্টি থেকে হবে। বাবার কাছে যারা নিয়মিত আসতো বিভিন্ন ব্যাপার আলোচনা করতে – বুঝতাম তারা অনেকে বয়সে বড় হলেও বাবাকে কত সন্মান করে। বাবার জ্ঞান – পান্ডিত্য,আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার গুন্ সবকিছুকেই তারা শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
সরকার – দেশে পরিবর্তন এলেও আমাদের সংসারে কোনো কিছুই পাল্টালো না। সেই টিউশনি আর সেলাই আমাদের ঘরে চাল নুন যোগানর ব্যবস্থা করে। বাবার এক কথা-আমি আদর্শের জন্য কমিউনিস্ট হয়েছি, সুযোগ নিতে পারবো না। শেষে পার্টি ই বাবাকে বাধ্য করলো একটা স্কুলে টিচার এর পদে যোগ দিতে।
আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে একটা বিদেশী কোম্পানিতে যোগ দিলাম। না , মা- বাবা আমার সঙ্গে গেলো না। তাদের চোখে তখনও অনেক স্বপ্ন। সমাজের সবার ভালো করার স্বপ্ন। দেখলাম রতন কাকা-যে আগের সরকারি দলের নেতা ছিল কেমন হটাৎ করে কমিউনিস্ট হয়ে গেলো। অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে থেকে দামি জামা কাপড় আর লম্বা লম্বা সিগারেট ছেড়ে বিড়ি আর পায়জামা প্র্যাকটিস করছিলো। কিছুদিন পর জেলার নেতা হয়ে একেবারে রাইটার্স বিল্ডিং এ যাতায়াত শুরু করলো। আমাদের বাড়িতে বাবার কাছে এখন বেশি কেউই আসে না।
আমি ইতিমধ্যে স্টেটস ঘুরে দিল্লী তে। না, মা- বাবা এতো চেষ্টার পরেও এলো না । ওই মাঝে মাঝে আসে , আর কয়েকদিন থেকে চলে যায়। মায়ের শরীর টা খুব ভেঙে গেছে। বাবা আগেও কম কথা বলতো এখন আরো চুপচাপ। নতুন ধরণের কমুনিজমের ব্যাখ্যা বোধহয় মেনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে । সময় পেলে বাড়ি যাই। নতুন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। মা প্রায়ই বলে বিয়ের কথা। -আগে আমার কাছে চলে এস তারপর বিয়ে করবো -আমি প্রতিবার একই উত্তর দি। বাবার রিটায়ারমেন্ট করার কয়েক দিন পরেই আমার বাড়ি যাওয়ার টিকিট কাটা আছে। কিন্তু মা যে তার আগে রিজারভেশন করিয়ে রেখেছে জানতাম না। তাই বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা হলো না এবার। আর কোনোদিন দেখা হবেও না।
বাবাকে নিয়ে দিল্লী তে চলে এসেছি। বইয়ে মুখ রেখে সারাদিন কাটিয়ে দেয়।খুব প্রয়োজন না হলে কথা বলে না। শুধু প্রতিদিন যখন আমার অফিসের গাড়ি আমাকে নিতে আসে তখন বাইরে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো বা আমার গাড়ি ছাড়লে সামনের ফুটপাথ দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে বেড়িয়ে যায়।সেদিন আমার গাড়ি বাবাকে পাশ কাটিয়ে যখন যাচ্ছে গাড়িটা থামিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম -কোথায় যাচ্ছো ? উঠে এস, তোমাকে নামিয়ে দেব।কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে সেই টানাটানা গভীর চোখের দৃষ্টি মেলে বাবা আমাকে বললো -এতটা পথ তো হেঁটেই এলাম….. ! তুমি চলে যাও। তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম -সারাজীবন এক আদর্শ নিয়ে সোজা পথে হেঁটে চলা একটা মানুষের পিছনে – স্বপ্ন ভঙ্গের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে একটা দীর্ঘ ছায়া আমার বাবাকে অনুসরণ করে চলেছে।
View Comments
Patience and acceptence.
অনেকক্ষণ ধরে কুলের বিচিটা হাতে নিয়ে আছি। কিন্তু মারবার সুযোগ পাচ্ছি না। বিনয় বাবু মন...
SHYAMAL MITRA
Authorদাদা, এইবার গল্পটা পরিপূর্ণ রূপ পেল। শুধু উপসংহারটা দরকার ছিল, যেটা আপনার কলম সুচারু ভাবে সম্পন্ন করেছে। একজন বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষের দৃঢ় ব্যক্তিত্ত্বের কথা অপূর্ব ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে আপনার লেখনী।
Sankar Ganguly
Authorআপনার পরামর্শের জন্য ই লেখাটা উন্নতমানের করা গেলো। যখন ই মনে হবে সমালোচনা ও পরামর্শ পাঠাবেন। ধন্যবাদ।