Sankars Creation

(ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাস)

তপন বিশ্বাস


।। ছয় ।।


চালকের নাম লামা । পোশাকি নাম একটা আছে হয়ত । বসির খান লামা বলেই ডাকছিল । বছর পঁচিশের লাদাখি যুবক । মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখে সারল্য আর হাসি মাখামাখি । উচ্চতা মাঝারি । ছিপছিপে চেহারা । বাবুলের সাথে খুব দোস্তি দেখলাম । বাবুল এসেছিল বোধহয় খানের নির্দেশে । বাবুল এলেই দেখি খান সিগারেট আনার নির্দেশ দেয় । আজও দিল । সৌরভদা ফিসফিস করে বলল, “এটা খানের স্টাইল !” ছেলে ঠিক শুনে ফেলেছে । বলল, “কাহানীর খান কিন্তু খুব সিগারেট খেত । একি সেই খানের ভাই নাকি ?”
ব্রিটিশরা শুনেছি সব সময় ঘড়ি ধরে চলে । পোল্যান্ডের মানুষ বোধহয় নয় । প্রায় আধঘণ্টা দেরি করে এল ওরা । সৌরভদার মতো আমিও সময় মেনে চলার চেষ্টা করি, বিশেষতঃ কোথাও যাওয়ার থাকলে । যাক্‌, খুব বেশি দেরি করেনি তিন পোলিশ সুন্দরী । ভুল হল একটা । তিনজনকেই বোধহয় সুন্দরী বলা যায় না । একজন বড্ড ঢ্যাঙা । টেনিস রাণী নাভ্রাতিলোভার মতো মুখশ্রী । চেহারাটাও শক্তপোক্ত । বয়স আন্দাজ করা শক্ত । তবে ত্রিশের মধ্যেই হবে হয়ত । লম্বা বলে ওর দিকেই আগে চোখ পড়ে যাওয়ায় দেখিনি ভয়ংকর রকমের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী পোলিশ কন্যাকে ।
খানের সৌজন্যবোধ আছে । পরিচয় করিয়ে দিল । মার্তা । সুন্দরী সব সময় অগ্রাধিকার পায় । এক্ষেত্রেই তাই হল । মার্তার কাঁধ পর্যন্ত চুল সাদা ফুটকি তোলা কালো রুমালে ঢাকা । শুধু সুন্দরী নয় । ভীষণ স্টাইলিস্ট। প্রথম দর্শনেই বোল্ড করে দেয় অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটিকে । তৃতীয়জনের নাম ক্যাটারিনা । মার্তার মতো ডানাকাটা পরী না হলেও সুন্দরী । তন্বী । বড্ড ছেলেমানুষ মনে হয় ওর বয়েস কাট চুলের জন্য ।
ঢ্যাঙা মেয়েটার নাম মারজেনা । তিনজনেই ঢোলা গেঞ্জি, ঢোলা পাজামা পরে এসেছে । চোখে সানগ্লাস পরতেও ভোলেনি । সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সঙ্গে এতদূরে যে পাড়ি দেবে তার জন্য কোন জড়তা-সংকোচ কিছুই নেই কারোর মধ্যে । তবু মেয়ে বলে সৌরভদা ওদের সামনের সিট অফার করল । “থ্যাংকস ।” বলে মার্তা ফ্রন্টসিটের দখল নিল । সৌম্যশুভ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি থমথম করছে মুখ । সৌরভদা ফিসফিস করে বলল, “সুন্দরীরা সব সময় নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে । আলাদা থাকে । প্রতি পদক্ষেপে সে মনে করিয়ে দেয় সে সুন্দরী । তার জায়গা স্বতন্ত্র । বোঝে না সৌন্দর্য চিরস্থায়ী নয় ।”
ক্যাটারিনা মাঝের সিটের কোণায় গিয়ে বসল । মারজেনা দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না আমরা উঠি । আমরা তিনজন পেছনের সিটে বসলাম মারজেনা আর ক্যাটারিনার মাঝে কেউই বসতে চাই না বলে ।
সিন্ধুনদের তীরে পপলার গাছে ঘেরা ছোট ছোট গ্রামের মাঝে নকশীকাঁথার মতো সবুজ-হলুদ সর্ষে খেত । সোনালি রোদে মাখো মাখো প্রকৃতির উচ্ছ্বাসে হাওয়ার সাথে আমরাও সামিল হলাম । সামিল না হয়ে উপায় কি ? লাদাখ যে এর জন্যেই দাওয়াত দিয়েছে আমাদের । ঘরে শুয়ে ঘুমানোর জন্যে নয় । পেছনের সিটে বসে খুব ভালো দেখা যায় না । সৌরভদা আমাদের মাঝে সোজা হয়ে বসে কখনো সামনে দিয়ে কখনো ডাইনে, কখনো বাঁয়ে দেখার চেষ্টা করছে । সৌম্যশুভ্র তো মাথা ঠেকিয়েই রেখেছে গ্লাসে ।
পথে পড়ল গালাস গ্রাম । লেহ শহরে পানীয় জল আসে গালাস থেকে।আধুনিক হয়ে উঠেছে গালাস। দোকানপাট, বাড়িঘর সবেতেই শহুরে ছোঁয়া। সৌরভদা গুনগুন করছে।বললাম,“একটু জোরে গাও না ।”
-এখন না পরে । হাসল সে । সৌম্যশুভ্র কানে ইয়ারফোন গুঁজে বোধহয় গান শুনছে । মার্তার মাথা দোলা দেখে মনে হয় সেও রয়েছে গানের জগতে । গানময় জগতে আমার সঙ্গে ব্যতিক্রম মারজেনা আর ক্যাটারিনা । ওরা দুজনে গল্প করছে । কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছি, কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে শব্দগুলো । যেসব শব্দ একের পর একটা জুড়ে ভাষার আকার নেয় সে শব্দগুলোর সাথে পরিচিতি না থাকলে সেগুলো কানে ঢোকে না । মুখ নাড়া দেখে তবু অনুমান করা যায়, ফলে দু’একটা শব্দ কানে ঢুকে যায় কখনো কখনো । এক্ষেত্রে সে সম্ভবনা নেই বলে আমিও গানের আশ্রয় নিই ।
পথে নৈসর্গিক দৃশ্যের খামতি নেই । নীল আকাশ আর ধূসর পাহাড়ই চমক দেখাচ্ছে । রঙ আর প্রকৃতিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পাহাড়ি পথে চলার ছন্দ আছে । সুশৃংখল ভাবে এগিয়ে চলে গাড়ি । কোন তাড়া নেই, ওভারটেক করা নেই, হর্ণ বাজানো নেই । কোন কোন বাঁকেও আছে চমক । সবুজ আঁচল বিছিয়ে প্রকৃতি অপেক্ষা করছে কয়েক হাজার ফিট নীচে কোথাও । তুলির টানে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ যেন !
দীর্ঘদিন না খেতে পাওয়া পাহাড়ের শরীরে মাংস নেই, শুধুই হাড়।গাছপালা তো দূরের কথা ঘাসও নেই । নানা আকৃতির রুক্ষ ধুসর পাথুরে শরীর । তবু তার মধ্যেই কখনো কখনো পাহাড়ের খাঁজে হঠাৎ স্পর্ধায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দু’আঙুলে ঘাস । ঠাণ্ডা হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে দুর্বল ঘাসের হালকা শরীর ।
একটা ভিউ পয়েন্টে গাড়ি দাঁড়াল । লেহ শহরটা দেখা যায় এখান থেকে । দূরে দূরে বরফমোড়া পাহাড় । পনের হাজার দু’শ ফিট উচ্চতার ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে সবাই ছবি তুলছে । সৌম্যশুভ্র আমাদের দু’জনের ছবি তুলল । আমি সৌম্যশুভ্র’র । ক্যাটারিনা এগিয়ে এসে সৌরভদাকে জিজ্ঞেস করল, “আর ইউ ও কে ?” সৌরভদার হাসিমুখে উত্তর, “ওহ্‌ ! ইয়েস ।”
মার্তা মাথা থেকে রুমাল খুলে চুলের নীচের দিকটা বেঁধে পজিশন নিয়েছে । মারজেনা ছবি তুলছে । মার্তার মুখে প্রথম হাসি দেখতে পেলাম । গর্বিত হাসি । সুন্দরীদের যেমন হয় আর কি । একজন ভারী চেহারার মধ্যবয়সী লোক এসে আমাকে ধরল একটা ছবি তুলে দিতে । ক্যামেরা অন করে আমার হাতে দিয়ে ফিল্মী কায়দায় পোজ দিল একটা বড় পাথরে পা তুলে । অনেক কষ্টে হাসি চেপে ছবি তুলে দিলাম ওর । মুম্বাই থেকে এসেছে বলল । মহারাষ্ট্রীয়ান । সঙ্গীরা গাড়িতে বসে আছে । অনেকটাই পেছনে ওদের গাড়ি । নোনা হাওয়ায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ে স্বাদ বদলাতেই না লাদাখে আসা । গাড়িতে না বসে থেকে ও তাই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে ।
গিরিপথে সময় ও শৃংখলা মেনে চলাই রীতি এখানে । মিলিটারিদের তত্ত্বাবধানে চলে সব । একসঙ্গে স্টার্ট করল সব গাড়ি । কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম ধস নেমেছে । জওয়ানরা পরিষ্কার করছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় । দু’একটা পাথর এখনও গড়াচ্ছে । অতি সাবধানে পেরোতে হল রাস্তাটা ।
একটু একটু করে ঠাণ্ডার অনুভূতি হচ্ছে উচ্চতার সঙ্গে বাতাসের জন্য । নির্মল আকাশের রঙ ঘন নীল । সূর্য আছে পাহাড়ের পেছনে কোথাও । দেখতে না পেলেও তার আলো ছড়িয়ে পড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি আছেন স্বমহিমায় । পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছড়ানো বরফ দেখে বুঝতে পারছি রাতে তুষারপাত হয়েছে । সৌরভদা ছেলেকে বলল, “বাবি, সোয়েটার, জ্যাকেট পরে নে । খারদুংলা আসছে ।” খারদুংলার নাম শুনে সৌম্যশুভ্র হাত বাড়িয়ে নিল শুধু জ্যাকেট । পরে নিল তাড়াতাড়ি । ওর জ্যাকেট মানে এখনকার ছেলেমেয়েরা যেমন পরে সেই হুডি । সৌরভদা বিড়বিড় করছিল, “ভারী জ্যাকেট কিছুতেই পড়বে না তাই ব্যাগ থেকে বের করিনি । সোয়েটারটাও পরল না !”
আমরা সোয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার সব পরে নিলাম । মার্তারাও শীতের পোশাকে নিজেদের মুড়ে নিল । একটু সময়ের জন্য গাড়ি দাঁড় করিয়ে জ্যাকেট পরে নিল লামাও ।
সংকীর্ণ গিরিপথ বেয়ে উঠছে গাড়ি । সারথির হাতে স্টিয়ারিং কখনো ডাইনে, কখনো বাঁয়ে ঘরছে । খুব সতর্ক থাকতে হয় এমন পথে । গাড়ি চালানো দেখে বোঝা যায় লামা এই বয়সেই দক্ষ ড্রাইভার হয়ে উঠেছে ।
“বাবি, কর্পূরের শিশিটা খুলে নাকের কাছে ধরে টান ।” সৌরভদার কথা শুনে সৌম্যশুভ্র’র দিকে তাকালাম । সে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে । সৌরভদা নিজের পকেট থেকেই একটা শিশি বের করে ছিপি খুলে ছেলের নাকের কাছে ধরল । সৌরভদার সঙ্গে আমারও উদ্বেগ আর অস্বস্তি বাড়ছে । আমাদের তিনজনের কাছেই হোমিওপ্যাথি ওষুধের ছোট শিশিতে কর্পূর গুঁড়ো আছে । উচ্চতাজনিত শ্বাসকষ্টে কর্পূর খুব ভালো কাজ দেয় । সৌরভদাই সব ব্যবস্থা করে এনেছে । ঘর থেকে বের হওয়ার আগে হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাইয়েছে । কোকা মাদার- দশফোঁটা করে । নিজেও খেয়েছে । সৌরভদা বলে, চমৎকার কাজ হয় । সৌরভদা কী যে জানে না ! হোমিওপ্যাথিটাও জানে ।
একহাতে কর্পূরের শিশি ছেলের নাকে ধরা আর এক হাতে ছেলের পিঠে হাত বোলানো- চলছেই সৌরভদার । নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল । ছোটবেলায় একদিন রাগ করে না খেয়ে ছিলাম বলে বাবা আমার পিঠে ছোট্ট করে একটা চাপড় দিয়েছিলেন । ব্যথা লাগেনি । ব্যথা লাগার মতো করে মারেনও নি, তবু অভিমানে কেঁদে ফেলেছিলাম । সেই প্রথম বাবার হাতে মার খাওয়া বলে । আমার কান্না দেখে ঠিক এমনি করে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন । বাবা আর কোনদিন মারেন নি । মারার মতো সুযোগও তিনি পাননি আর । মনে হয় তিনি বেঁচে থাকলেও বোধহয় আর কোনদিন মারতেন না । খুব মিস করি বাবাকে ।
কর্পূরে কাজ হয়েছে । সৌম্যশুভ্র এখন স্বাভাবিক শ্বাস নিচ্ছে । চোখ মেলে দেখছে জানলার ওপারের পৃথিবীটাকে। স্বস্তির নিঃশাস ফেললাম ওকে দেখে ।
বরফের চাদরে মুখ লুকিয়েছে গোটা পাহাড় । তাল তাল শুভ্র বরফ । বরফের পাহাড়, বরফের দুনিয়া । রাস্তাতেও বরফ । চাকার চাপে কাদা হয়ে গেছে বরফের পথ । জওয়ানেরা পরিষ্কার করছে রাস্তা । কারাকোরাম পর্বতশ্রেণীর এই গিরিপথের উচ্চতা ১৮৩৮০ফিট লেখা রয়েছে দেখলাম । বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরেবল পথ । খারদুং মানে শিব আর লা-মানে তো পাস বা গিরিবর্ত্ম । তাই খারদুংলা । শিব রয়েছেন এখানে ।
সূর্যের আলোয় ঝলসাচ্ছে তুষারমণ্ডিত শৈলশিখরগুলো । বরফে রিফ্লেক্ট করছে সূর্যরশ্মি । খালি চোখে দেখা তো দূরের কথা তাকানো যায় না । ঘন কালো রোদ চশমা ছাড়া বরফ রাজ্যে পা রাখা মানে চোখের মারাত্মক ক্ষতির আশংকা । অন্ধত্ব পর্যন্ত নেমে আসতে পারে । সৌরভদা আর আমার ফোটোক্রোমাটিক লেন্স । সৌরভদার সব দিকে খেয়াল ছিল । তিনটে এক্সট্রা সানগ্লাস কিনে এনেছে চশমার উপরে লাগিয়ে দেবার জন্যে । সৌম্যশুভ্র’রও চশমা আছে । খারদুংলায় ঢোকার আগেই সৌরভদা কখন ওর চশমার উপরে পরিয়ে দিয়েছে এক্সট্রা সানগ্লাস । এবার আমাকেও একটা বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও পরে নিল ।
সিয়াচিন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে চলছে যাত্রী ও গাড়ির নিয়ন্ত্রণ । হাঁটতে গিয়ে হাঁপ ধরে । অক্সিজেনের ঘাটতি রয়েছে বাতাসে । রক্তে কমে যাচ্ছে অক্সিজেন । দপ্দপ্ করছে মাথার ভেতরে । জোরে জোরে শ্বাস নিতে হচ্ছে ।
অসুস্থ যাত্রীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সেনাবাহিনী । উচ্চতাজনিত নানা সমস্যায় সাহায্য করে । তীব্র মাথা যন্ত্রণা, বমি বমি ভাব ডেকে আনতে পারে বিরাট বিপদ । অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা আছে সেনা শিবিরে । তাতেও কাজ না হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাহাড় থেকে নীচে নামিয়ে আনতে হয় অসুস্থ ব্যক্তিকে ।
সৌম্যশুভ্র ছবি তুলছে শিবমন্দিরের । আমিও তুলছি । পাহাড়ের । মন্দিরটা খুব বেশি দূরে না হলেও যাওয়া হল না অতটা বরফ ডিঙিয়ে । খুব ঠাণ্ডাও লাগছে । সেনাবাহিনীর দোকানে গরম ধোঁয়া ওঠা চা পাওয়া গেল । যে চা দিচ্ছিল তাকে বাঙালি ভেবে আলাপ করতে গিয়ে জানলাম সে অসমিয়া । তেজপুর শহরে বাড়ি । মাত্র দু’মাস আগেই এখানে পোস্টিং হয়েছে ।
উত্তর-পূর্ব সীমান্তের যুবক উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এসে রক্ষা করছে দেশের ভূখণ্ড । রাতে সিয়াচিনের শীতল শয্যায় শুয়ে উষ্ণতা খোঁজে । তার বান্ধবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে যায় না ? দেশের বাড়িতে ছেলের কথা ভেবে অনেক বিনিদ্র রাত্রি কাটায় ওর মা । দেশমাতৃকার জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয় গর্ভধারিনী মাকে ।
সৌরভদা ছেলের জন্য একটা টুপি কিনল স্যুভিনির শপ থেকে । সাদা কাপড়ের টুপিতে লেখা- ওয়ার্ল্ড হায়েস্ট মোটরেবল রোড, খারদুংলা – ১৮৩৮০ ফিট ।
নেশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়- সাবধানবাণী ভুলে একটা সিগারেট ধরাতেই সৌম্যশুভ্র বলল, “কাকু, তুমি কিন্তু ঠিক করছো না ।” সৌম্যশুভ্র কখনো কখনো আমাকে কাকুও বলে । ক’দিনে ওর সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আমার । নিজের কাকুই ভাবছে বোধহয় । ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, “গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে নামটা তোলার ইচ্ছে হল তো তাই ।”
সৌম্যশুভ্র সংশোধন করে দিল সঙ্গে সঙ্গে, “ওটা এখন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ।”
সৌরভদা হো হো করে হাসতে গিয়ে কেশে ফেলল । থামতেই চায় না সে কাশি । সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিলাম । নিজেকে অপরাধী মনে হল । সৌরভদা কাশি নিয়ন্ত্রণে আনার পর বলল, “কেন শুধু শুধু অক্সিজেন পোড়াতে গেলে বলত ? এমনিতেই অক্সিজেন কম এখানে !”
-সরি সৌরভদা । ক্ষমা চাইছি । নেশাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন । কিন্তু করতে তো হবেই । আর ভুল হবে না । চল, এবার গাড়িতে উঠি । ওরা অপেক্ষা করছে ।
কাছে, দূরে সর্বত্রই বরফ । একই পর্বত কখনো দূরে চলে যাচ্ছে, কখনো এগিয়ে আসছে । সারি সারি তুষারাবৃত গিরিশিখর । মাথার উপর নীল আকাশে ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী উঠছে মেঘের । আকাশের সাথে মিতালি পাতাতে চায় মেঘের দল । শীতল বরফিলা হাওয়ায় শরীরে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছিল । সোয়েটার, জ্যাকেট ভেদ করে ঢুকে খোঁচা মারছে শীতের তীর । মাফলার জড়িয়ে নিলাম মাথা থেকে গলায় । বরফে ঢাকা পাথরের পেছনে ইঁদুরের মতো একটা প্রাণী দৌড়ে গেল দেখলাম । এত দ্রুত গেল যে ভালো করে দেখতেই পেলাম না ।
আকাশে ডানা মেলে উড়ছে বাজ । তুষারচিতাও লুকিয়ে থাকতে পারে পর্বতকন্দরে । তুষারচিতা নাকি খুব চতুর হয় । ক্ষিপ্রও । জনমানবশূন্য তুষারপুরীর অনেক রহস্যই এখনও অজানা রয়ে গেছে মানুষের কাছে । কত রকমের প্রাণী বাস করে এই তুষার রাজ্যেও । ইয়েতি নিয়ে অনেককিছু শোনা গেছে । অস্তিত্ব আছে কিনা জানি না । যদি সত্যিই থাকে এখানে থাকার সম্ভবনা তো প্রবল । নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায় । উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি তীব্র আগ্রহে । ওদিকে আমাদের গাড়ি শুধুই পাক খাচ্ছে গিরিপথে । মনে হয় গোলোক ধাঁধায় একই পথে ঘুরে মরছি আমরাও । তবু এই গোলোক ধাঁধাতেই আমার শান্তি । পাহাড় আমার প্রেম, আমার বন্ধু, আমার শান্তির নীড় । তাই বারবার ফিরে আসি পাহাড়ের কাছে ।
কারাকোরামের গোলোক ধাঁধা থেকে মুক্তি মিলল অবশেষে । স্বাভাবিক ছন্দে এগোচ্ছে গাড়ি । শুভ্রতার ফাঁকে দেখা দিল গৈরিক আভা । একটু ধূসর, একটু সবুজ হতে হতে গোটা একটা গ্রাম উঠে এল পার্বত্যপথে । হৃদযন্ত্রের ক্রীয়া স্বাভাবিক হয়ে গেছে । রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি আর নেই মনে হয় ।
খারদুং গ্রামে আপেল, অ্যাপ্রিকটের বাগান দেখতে পাচ্ছি । সারা লাদাখেই অ্যাপ্রিকট মেলে । একে স্থানীয় ভাষায় বলে খুবানি । খুবানি থেকে তেলও মেলে শুনেছি । সে তেল রান্নার কাজে, ত্বকের পরিচর্চায়, এমনকি আলো জ্বালাতেও ব্যবহার করা হয় ।
পপলার পাতায় বাতাসের ছটফটানি, পাথুরে জমিতে ছোট ছোট বাড়ির দরজায় উঁকি দেওয়া মানুষের মুখ দেখতে দেখতে হারিয়ে ফেলছিলাম নিজেকে । সৌম্যশুভ্র চমকে দিল, “ওই যে ইয়াক !” তৃণভূমিতে ছাগল, ভেড়ার সাথে দুটো ইয়াক চরে বেড়াচ্ছে ।
একটুবাদেই পটপরিবর্তন আবার । সবুজ আঁচল সরে গিয়ে আবার নগ্ন হয়ে গেছে পাহাড় । রুক্ষ, কর্কশ হাওয়ার সাথে পাহাড়ের পাথুরে কাঠিন্য শুধু । তবু তার মধ্যেই চমক মাঝে মাঝে । পাথরের খাঁজে বুনো ফুল উঁকি মারছে, লম্বা শুকনো ঘাস খরখর করছে কোথাও ।
খাড়া পাহাড়ের অনেকটা উঁচু দিয়ে গতির ডানায় ভর করে ছুটছে আমাদের গাড়ি । পাথুরে দেয়াল ছাড়া কিছু নেই । ওপারেও একই পাহাড়ের চিত্র । নীল আকাশে সাদা মেঘ মাঝে মাঝে উঁকি দেয়, আবার হারিয়েও যায় । অনেকক্ষণ ধরে একই দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখ লেগে গিয়েছিল । পথের বাঁকে গাড়িটা টার্ন নিতেই হেলে যাওয়ার দরুণ চোখ মেলেছি । অদ্ভুত সুন্দর কখনো না দেখা একটা পৃথিবী ! নানা রঙ আর প্রকৃতির কোলাজ ।
একটা ছবি এঁকেছে ! সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলা একটা নদী, মাঝে মাঝে চরা, ছোট ছোট দ্বীপ, সেখানে দু’চারটে বাড়ি, শস্যখেত, ফলের বাগান । নদীর ওপারে সবুজ পাহাড় ন্যাড়া হতে হতে নীল আকাশ ছুঁয়েছে । চিত্রকর বোধহয় বিশাল একটা ক্যানভাস জুড়ে ছবিটা এখনও নিরলসভাবে এঁকেই চলেছে আমাদের পাথুরে পাহাড়ের পদতলে বসে । দু’দিকের পাহাড়ের মাঝে উপত্যকায় নদী থেকে শস্যখেতে ঢেউ তুলছে বাতাস । ফিসফিস করছে আমাদের কানে কানে । “চলে যাচ্ছ যে ! একটু দাঁড়িয়ে দেখে যাও।”
মার্তা লামাকে গাড়ি থামাতে বলল । সবাই প্রায় লাফিয়ে নামলাম । “নীচের উপত্যকার ক্যানভাসে কে এমন ছবি আঁকল সৌরভদা ? ইস ! নীচে নামার একটা সুযোগ পেলে এক্ষুনি নেমে যেতাম ।”
আমার অবস্থা দেখে সৌরভদা বলল, “ইচ্ছে তো করছে কিন্তু ওখানে যেতে হলে সম্ভবতঃ পা’কেই ভরসা করতে হয় । তাও অন্য কোন পথ দিয়ে । দেখছ না এখানে পাহাড়টা তো খুব খাড়া । পাখা ছাড়া নামার কোন উপায় নেই ।” আমার দিক থেকে এবার সৌরভদা ছেলের দিকে ফিরল, “এটা হল নুব্রা ভ্যালি । নুব্রা মানে হল বাগান । নদীর নাম নুব্রা- সে থেকেই উপত্যকার নামকরণ । সিয়াচিন হিমবাহ থেকে বেরিয়েছে বলে সিয়াচিন নদীও বলে কোথাও ।”
“কিন্তু সৌরভদা, এখানকার ম্যাপে কিন্তু লেখা আছে সায়ক নদী । উপত্যকার নাম সায়ক ।” আমার কথায় সৌরভদা অবাক হল না মোটেই । বলল, “সে তুমি যাই দেখে থাক না কেন নদী তো একটাই । গঙ্গাকেও তো এক এক জায়গায় এক এক নামে ডাকে মানুষ । গঙ্গা কোথাও ভাগিরথী, কোথাও হুগলী, কোথাও পদ্মা – নদী তো একটাই।”
আবার ছেলে দিকে ফেরে সৌরভদা, “নদী হল সবার মা । এমনকি দেশেরও মা । নদী মায়ের পীযুষ ধারায় জীবন চলে । নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে জনপদ । নদীবাহিত পলি মাটিকে উর্বর করে । পাথুরে জমিও তাই হয়ে ওঠে শস্যশ্যামলা । এখানে জোয়ার, বার্লি, নানারকম শাকসব্জি, সর্ষে, মটরশুঁটি ছাড়াও অ্যাপ্রিকট, আপেল, আমন্ড, ওয়ালনাট হয় জানিস তো ? মিড্ল এশিয়া থেকে বহুকাল ধরে ব্যবসায়ীরা আসত সিল্করুট ধরে । এখন সে পথ বন্ধ । পুরো সিয়াচিন এখন ফৌজি প্রহরায় থাকে।”
মার্তা সৌরভদাকে অনুরোধ করল ওদের তিনজনের একটা ছবি তুলে দিতে । সৌরভদা আবার সৌম্যশুভ্রকে বলল । সৌম্যশুভ্র হাসিমুখে এগিয়ে এল । ওদের ক্যামেরায় ওদের ছবি তুলে দিয়ে বলল, “আমার ক্যামেরায় একটা তুলব । বল না ওদের ।” সৌম্যশুভ্র খুব লাজুক জানি । সে তাই নিজে বলতে পারছে না । সৌরভদা বলল, “তুই নিজে বলতে পারিস না !” সৌম্যশুভ্র বাবার কথায় কোন উত্তর দিল না । সে আমার মুখের দিকে তাকাল । রিকোয়েস্ট করলাম মার্তাকে । ওদের আর একবার পোজ দেওয়ার জন্য ।
ছবি তোলা হয়ে গেলে ক্যাটারিনা হেসে ডানহাত তুলে আঙুল নাড়িয়ে উইশ করল আমাদের দলের কনিষ্ঠতম সদস্যটিকে । প্রত্যুত্তরে সৌম্যশুভ্র লাজুকভাবে হাসল ।
খালসাতে এসে সাময়িক বিরতি । ছোট একটা বাজার ছাড়াও সেনাবাহিনীর ছাউনি আছে খালসাতে । খাবারের দোকান আছে বাজারে । রুটি, ভাত, চাউমিন, মোমো পাওয়া যায় । আমরা এগ-চাউমিন খেয়ে নিলাম ।
একদল লোমশ কুকুর ঘুরছে খাবারের দোকানের আশেপাশে । একটা ষাঁড় ঘুরছে পথে । চমরী গাইয়ের দেশে ষাঁড় কোথা থেকে এল ভাবছি । সৌরভদা হেসে বলল, “ধর্মের ষাঁড় এখানেও !”
দোকান থেকে বের হতেই কুকুরগুলো আমাদের পিছু নিল । ছাড়ছে না কিছুতেই দেখে এক প্যাকেট বিস্কুট নিলাম ওদের জন্য । কুকুরগুলোকে খাওয়াতে যেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল । ভয়ে বিস্কুটের প্যাকেট ফেলে দিলাম । বিস্কুটের প্যাকেটের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দখল নিতে চেষ্টা করছে একে অপরকে সরিয়ে । সৌম্যশুভ্র হেসে কুটিপাটি !
সেনাছাউনির পাশ দিয়ে একটা পাহাড়ি ঝরণা ছুটছে নদীর দিকে । বড্ড তাড়া কিশোরীর । নদীর বুকে মিশে যেতে পারলেই যেন তার মুক্তি । আনন্দে পাগলপারা তাই ।
লামা তাড়া লাগাল হর্ণ বাজিয়ে । এখানে পথ চলতে কোন গাড়ি হর্ণ বাজায় না । বোধহয় পাহাড়ের শান্তিভঙ্গ করতে চায় না ।
ঘন ঘন দৃশ্যবদল হচ্ছে । পাহাড়ি ঝরণা, তৃণভূমি, ইয়াকের দল পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে যেন । ইতস্ততঃ বরফ ছড়িয়ে আছে ওপাশের পাহাড়ে ।
“ওখানে প্রকৃতি আপন খেয়ালে একটার পর একটা ছবি আঁকছিল রং-তুলি দিয়ে আর এখানে জাদুকাঠি নিয়ে বসে আছে । মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যের বদল ঘটছে তাই ।”
সৌরভদার কথায় সায় দিই, “একদম ঠিক বলেছ সৌরভদা । এখানে না এলে জানতেই পারতাম না কারাকোরামেও জাদু আছে ! হিমালয় সুন্দর, কিন্তু হিমালয়ের প্রকৃতি এত দ্রুত বদলায় না । হিমালয় একটু একটু করে টেনে নিয়ে যায় গভীরে ।”
সৌরভদা মার্তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,“ওরাও খুব এনজয় করছে । কিরে বাবি, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি ?”
“একদম না ! এরকম জায়গায় কেউ ঘুমায় নাকি ? একটা মোমেন্টও মিস করা যায় না ।” সৌরভদার প্রকৃতিপ্রেমিক ছেলের উক্তি ।
নীল আকাশের নীচে তুঁতেরঙা নদী । সবুজ তৃণভূমির বুক চিরে পিচ রাস্তা । লামা গান শুনতে শুনতে গাড়ি চালাচ্ছে । কখন থেকে গান বাজছে জানি না । আমাদের এখন গানের দিকে নজর নেই । কানের চেয়ে চোখ দ্রুত চলে বলে সুন্দরীতে মজেছি আমরা । দু’একটা ঘরবাড়ি দেখতে পাচ্ছি । ঢিলেঢালা তিব্বতীয় পোশাকে দু’চারটে লোকও দেখা যাচ্ছে । গাড়ির আওয়াজে ফিরে তাকাচ্ছে কেউ কেউ । একটা ইয়াক রাস্তা পার হচ্ছিল । লামা গাড়ির গতি কমিয়ে দিল । ইয়াকটা ধীরে সুস্থে রাস্তা পার হল । পাহাড়ের উপর কয়েকটা ইয়াক ঢুঁসোঢুঁসি করছে । সেদিকেই যাচ্ছে ও মোড়লি চালে । সামনে একটা লোক চা শ্রমিকের মতো টুকরি পিঠে নিয়ে হাঁটছে । গাড়িটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে পড়েছে । ফ্যাল ফ্যাল করে গাড়ির ভেতরের অতিথিদের দেখছিল বৃদ্ধ।অসংখ্য বলিরেখা মুখে তাঁর মুখে ।“বহুদিন আগে দেখা একটা ছবির কথা মনে পড়ে গেল।দার্জিলিঙে এমনি একটা ছবি দেখেছিলাম আভা আর্ট গ্যালারিতে।কী নিখুঁত ছিল ছবিটা!ঠিক এই মানুষটার মতো কোন এক বৃদ্ধের ছবি এঁকেছিল শিল্পী ।” সৌরভদা খুঁজে পেয়েছে ছবির মানুষকে । “যে কোন একজন শিল্পী এমন একজন মানুষের ছবি আঁকতে চাইবেই । মানুষের দারিদ্র, বার্ধক্য, অসহায়তা নিয়ে ছবিই তো কালজয়ী হয় । মানুষ মনে রাখে শিল্প আর শিল্পীকে, ছবির মানুষটাকে নয় । আমার অবশ্য শিল্পীকে নয় শিল্পটাকেই মনে আছে !” সৌরভদা নিজে নিজেকেই ব্যঙ্গ করল মনে হল ।
পাহাড়ের প্রকৃতি আবার রূপ বদলে নিয়েছে । তৃণভূমি উধাও গিয়ে পাথুরে দেওয়াল বেরিয়ে পড়েছে । মাঝে মাঝে শুধু বুনো গোলাপ উঁকি মারছে পাথরের খাঁজে । সব গোলাপই গোলাপি নয়, হলুদ গোলাপও আছে । তবে লাল গোলাপ দেখতে পাচ্ছি না একটাও । সৌরভদা বলল, “ওগুলোকে খুব সম্ভব সিয়াচিন গোলাপ বলে ।”
“একটা গোলাপ তুলে আনলে ভাল হয়।” কথাটা সৌম্যশুভ্র কাকে উদ্দেশ্য করে বলল জানি না । ওর বাবাই উত্তরটা দিল, “ফুল সুন্দর । তবে গাছ থেকে ছিঁড়ে নিলে ওর সৌন্দর্য শুধু কমেই যায় না কিছুক্ষণের মধ্যেই শুকিয়েও যায় । তার চেয়ে গাছে থাকাই ভাল না ? মানুষ দেখতে পাবে, মৌমাছি বা ভ্রমর এসে বসবে ফুলে । তুই কি চাস না পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠুক ফুলে, ফলে !”
সৌম্যশুভ্র কতটা কী বুঝল জানি না, বাবার কথার কোন উত্তরও দিল না । সৌরভদা ছেলেকে এভাবেই তৈরি করতে চাইছে । সব বাবারাই যদি এভাবে শেখাতে পারত ! পৃথিবীটা সত্যিই বদলে যেত ।
আপাততঃ পাহাড় শেষ । একটা সমতল ভূমির উপর দিয়ে ছুটছে আমাদের বাহন । বাদামি, সোনালি শিলাখন্ড ছড়িয়ে থাকলেও রাস্তা বেশ ভাল । হঠাৎ হঠাৎ ঢালু হয়ে যাচ্ছে পথ, আবার উঁচুতে উঠছে । বেশ লাগছে । তবে একটু সবুজ থাকলে আরো ভাল লাগত । সবুজ রঙ চোখের আরাম দেয় । বিরাট উপত্যকা, মাঝে মধ্যে দু’একটা ছোট কাঁটাঝোপ ছাড়া কোন গাছপালা নেই । অনেকক্ষণ চলার পথ ভাগ হয়ে গেল । দ্বিমুখী পথের বাঁদিকের পথ ধরল আমাদের গাড়ি । লেহ থেকে এতদূর এসেছি একটাই পথে তাই লামার কাছে জানতে চাইলাম ডানদিকের পথটা কোথায় যাচ্ছে । লামা জানালো ওটা সুমুরের পথ । সৌরভদা বলল, “সুমুরে বুনো গাধা দেখতে পাওয়া যায় । সুমুর হয়ে প্যানামিক যায় । প্যানামিকে একটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে । বিদেশী পর্যটকদের জন্য সুমুরের পথ বন্ধ । আমরা যেতে পারতাম পারমিট করিয়ে নিলে । কিন্তু অত সময় তো আমাদের হাতে নেই । তাছাড়া বাজেটও বেড়ে যেত তাই বাদ রেখেছি । তুরতুকটাও একই কারণে বাদ।”
সৌম্যশুভ্র জিজ্ঞেস করল, “কী আছে তুরতুকে ?”
“তেমন কিছুই নেই । তুরতুক হল সীমান্তগ্রাম । পাকিস্তান কোন একসময় দখল নিয়েছিল তুরতুকের । ১৯৭১সালের যুদ্ধের সময় ভারতের সেনাবাহিনী পুনরুদ্ধার করে । তুরতুকের অধিবাসীরা বালতি শ্রেণীর মুসলমান । সীমান্ত গ্রাম বলে ওখানেও বিদেশীদের প্রবেশ নিষেধ ।”
আবার পাহাড়ে উঠছি । গাছপালাহীন রুক্ষ, শুষ্ক পাহাড় । একটা কাঁটা ঝোপও নেই । তবে পাহাড়ে চমক আছে । সোনালি রঙের খাঁড়া পাহাড়, পিঙ্ক রঙের খাঁজওয়ালা পাহাড়, স্লেটরঙা কম উচ্চতার পাহাড় । স্লেটরঙা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বালি নামছে । ধুলো উড়ছে পাহাড়ি হাওয়ায় । বাঁদিকে একটা সোনালি পাহাড়ের গায়ে মৌচাকের মতো সারি সারি ঘরবাড়ি ।
“দেসকিট । নুব্রাভ্যালির একমাত্র শহর । সাব ডিভিশন । হোটেল, গেস্ট হাউস সবই আছে । কিন্তু আমরা থাকব টেন্টে ।”
-আহা ! দারুণ ! আনন্দে লাফিয়ে উঠল সৌম্যশুভ্র । আনন্দ আমারও কম নয় ! সৌরভদা খানকে যখন টেন্টে থাকার কথা বলেছিল তখনই আনন্দ হয়েছিল কিন্তু সেটা সিওর ছিলাম না । বাজেটটা একটু বেশি হবে । শেষ পর্যন্ত সৌরভদা কি ডিসিশন নেয় সেটা নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম ।
দেশকিট শহরটাকে পাশ কাটিয়ে আর একটা পাহাড়ের মাথায় উঠে এল গাড়ি । পাহাড়ের মাথায় অতি পরিচিত বুদ্ধমুর্তি । বৌদ্ধমন্দিরের মাথায় বিশাল আকৃতির মৈত্রেয়ী বুদ্ধ করজোড়ে পা ঝুলিয়ে বসে । স্বর্ণবর্ণের শরীর, মাথায় রাজমুকুট, পরনে গোলাপী বস্ত্র, হাতে, পায়ে, কোমরে ও গলায় যথাযত অলংকার । ১০৬ফুটু উচ্চতার বিশাল মুর্তি খুব বেশিদিন আগে নির্মাণ করা হয়নি । মুর্তি, মন্দির ও চাতালে আধুনিক সভ্যতার ছাপ ।
“মন্দির, মুর্তি নতুন হলেও মূল গুম্ফাটা কিন্তু ৩৫০ বছরেরও বেশি পুরানো । সেটা নিশ্চয় আছে এখনও । বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা দুর্গম পাহাড়ের কোন গুহায় বসে সাধনা করতেন, এখনও অনেক সন্ন্যাসী আছেন যাঁরা সাধনার জন্যে নির্জন-দুর্গম স্থান বেছে নেন । হিমালয়সহ প্রায় সব পাহাড়ই সাধু-সন্ন্যাসীদের সাধনাক্ষেত্র । ভক্তরা গুহাগুলোকে মন্দির, গুম্ফায় বদলে দেয় । আর ভক্ত বা ভক্ত সম্প্রদায় কালক্রমে নিজেদের প্রয়োজন বা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে ।” এ পর্যন্ত বলে সৌরভদা হাসল ।
“তা ঠিক সৌরভদা । আচ্ছা সৌরভদা, তুমি বিশ্বাস কর এভাবে সাধনায় মুক্তি মেলে ?” আমার প্রশ্ন শুনে সৌরভদা চোখ নাচাল, “কেন তোমার কি সাধু হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি ? সাধনা কিন্তু অনেকভাবেই করা যায় । তোমাকে আগে স্থির করতে হবে তুমি নিজের মঙ্গল চাও নাকি মানুষের মঙ্গল চাও । সেটা স্থির করেছো ? করে না থাকলে বলব পৃথিবীতে এখন ধর্মগুরুর চেয়ে মানবতাপ্রেমীর প্রয়োজন বেশি, পরিবেশপ্রেমীর প্রয়োজন । এসব নিয়ে এখন আর কথা না বলে চল, বেড়াতে এসেছি, ঘুরি ভাল করে । ছেলেটা বোরিং হচ্ছে ।”
পাহাড়ের একদিকটায় অনেকগুলো পাহাড় জুড়ে দেসকিট শহর আর একদিকে পাহাড়ের নীচে অর্ধচন্দ্রাকারে সবুজ আঁচল বিছানো মাটিতে ছোট ছোট ঘরবাড়ি । চাষবাস হয় বোধহয় । দূরে দূরে ধূসর পাহাড় । তারও পিছে তুষারমণ্ডিত পর্বতশ্রেণী । মাথার উপর মেঘশূন্য নীল আকাশে বসে নিঃসঙ্গ সূর্যদেব আগুন ঢেলে দিচ্ছে মাথায় । পাহাড়-পর্বত, মন্দির-শহর, চাষের খেত, সব মিলিয়ে প্রকৃতির অপূর্ব কোলাজে মন ভরে, শরীর নিতে পারে না । আশ্রয় খুঁজতে মন্দিরের পেছনে গেলাম । মন্দিরের পেছনে প্রাচীন গুম্ফাটি এখনও আছে । গুম্ফার প্রার্থনা কক্ষে ঢুকতেই শরীর জুড়িয়ে গেল । মানুষ দু’দণ্ড শান্তির জন্যেই তো এমন আশ্রয় খোঁজে । শান্তি পাওয়া যাক না যাক একটু স্থিরতা তো আসে ।
বিশ্রামের পর এগিয়ে যাওয়া । প্রাচীন সভ্যতার ছোঁয়ায় বর্তমান ভারতের সভ্যতা । আমাদের পরিচিত জগতের চেয়ে আলাদা । বিশাল এই দেশটার মাটি আর মানুষকে জানতেই তো বেরিয়েছি ।
জ্যাকেট, সোয়েটার অনেক আগেই খুলতে হয়েছিল । শরীরে পোশাক যা আছে তাতে গরম লাগার কথা নয়, কিন্তু শরীর জ্বলছে তাপে । পৃথিবীর মাটি এখন তপ্ত তাওয়া । বাতাস বয়ে আনছে আগুনে হল্কা । ঠোঁট শুকিয়ে খর খর করছে । বোতল বোতল জল শুষে নিচ্ছে শরীর । ভাগ্যিস জলের একটা কার্টুন লেহ থেকেই এনেছিল সৌরভদা ।
প্রকৃতির কণ্টকশয্যা । বড় কোন উদ্ভিদ নেই । মাঝে মাঝে কাঁটা ঝোপে ঘেরা সমতলে তাঁবু খাটানো দেখে বুঝতে পারলাম হুন্ডার গ্রামের কাছে এসে গেছি । রাস্তা পাকা না হলেও বন্ধুর নয় পথ । নয়া উপনিবেশের মধ্য দিয়ে ডাইনে বাঁয়ে ঘুরতে ঘুরতে যেখানে এলাম সেখানে তিনটে গাড়ি আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে । ছোট্ট একটা স্রোতস্বিনী । ঘাস গজিয়েছে স্রোতস্বিনীর দু’ধারে । বরফগলা জল।এত রোদেও গরম হয়নি । স্বছজলে ছোট ছোট ঢেউ তুলে খিল খিল করে হাসছে স্রোতস্বিনী কিশোরীর চপলতায় ।
স্রোতস্বিনী মাত্রেই নদী নয়।এটা একটা নালা। এক লাফে পেরিয়ে যাওয়া গেল । মার্তারাও পেরিয়ে গেছে । এতটা পথ একসঙ্গে এলেও পোল্যান্ড আর ভারতবর্ষের দুরত্বটা এখনও ঘোচেনি । তার একটা কারণ বোধহয় আমরা তিনজন পুরুষ আর ওরা তিনজন নারী । আর একটা কারণ সম্ভবতঃ ভাষা ।
বিস্তীর্ণ মরুর এপারে কাঁটাগাছ ওপারে ধূসর পাহাড় । পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে স্লেটরঙা বালি । দু’একটা পাহাড়ের মাথায় বরফ । কত রকমের, কত রঙের পাহাড় ! খাড়া, ঢালু, খাঁজ কাটা পাহাড় । বাদামি । সোনালি। পিঙ্ক । উত্তরের পাহাড়গুলোর পেছনে আরো পাহাড় । সেগুলোর পেছনে তুষরাবৃত পর্বত শিখর উঁকি দিয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে ।
প্রকৃতিপ্রেমিকের বিড়ম্বনার শেষ নেই । রসাস্বাদনের প্রধান অন্তরায় হল রোদ্দুর । মিঠেকড়া নয়, গনগনে রোদ । ঠিক মাথার উপরে সূর্য, সামনে বিরাট প্রান্তরে ধূ ধূ করছে বালুরাশি । লাদাখের মরুভূমি । কোল্ড ডেজার্ট।সৌরভদা ফিরে গিয়ে খারদুংলা থেকে কেনা টুপীটা নিয়ে এল গাড়ি থেকে,“বাবি, এটা পরে নে ।” আসার সময় রুমাল ভিজিয়ে মাথায় দিয়ে এসেছিল । আমাকে দিয়ে বলল, “এটা মাথায় দাও ।” অনিচ্ছাসত্বেও নিলাম । আসতে আসতেই অনেকটা শুকিয়ে গেছে । মাথায় দিতে না দিতেই শুকিয়ে গেল ।
একটা বড়সড় কাঁটাঝোপের পাশে বেশ কিছু লোক দেখে বললাম, “চলো তো সৌরভদা, ম্যাজিক ট্যাজিক হচ্ছে কিনা দেখি !” ম্যাজিক নয়, উট । দু’কুঁজওয়ালা ব্যাক্টেরিয়ান উট । লোমশ চেহারার দু’কুঁজের দেখা ভারতবর্ষে একমাত্র এই অঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায় । রাজস্থানের উটের তুলনায় এগুলো একটু ছোট । টুরিস্টদের মধ্যে কেউ কেউ উট সাফারি করছে । এই রোদ্রে সানস্ট্রোক হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা । আমাদের কারো উট সাফারির বাসনা নেই । একটু ছায়া পেয়ে উপভোগ করলাম লাদাখের মরুভূমির সৌন্দর্য ।
আশ্চর্য এক পৃথিবীর দরজায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির আপন খেয়ালে তৈরি হওয়া মরুতে বালিয়াড়ির ঢেউ তোলা দেখতে দেখতে সৌরভদা বলল, “স্যান্ড ডিউন্স । বাবি, ছবি তুলে রাখ । উটের ছবিও তুলিস । এই উট কিন্ত ভারতের অন্য কোথাও দেখতে পাবি না । মধ্য এশিয়ায় দেখতে পাওয়া যায় এদের । এই উটের দুধ নাকি খুব উপকারী । আর চেহারাগুলো দেখ, কী অদ্ভুত দেখতে ! নিশ্চিন্তে কাঁটা চিবুচ্ছে ।”
সৌম্যশুভ্র হেসে ফেলল, “উট কি কাঁটা বেছে খায় ?” লালমোহন গাঙ্গুলির বিখ্যাত উক্তি । সত্যজিৎ রায়ের অসাধারণ সৃষ্ট চরিত্র “জটায়ূ” ।
(ক্রমশঃ)

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post