Sankars Creation

তপন বিশ্বাসের ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাস।



।। এক ।।
“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
আমরা দু’জন চলতি হাওয়ার পন্থী ।”
ঘরছাড়া সমাজের লাইফ মেম্বার হয়ে আমার অগোছালো জীবনটা যখন আরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল তখনই সৌরভদার সঙ্গে আচমকাই দেখা হয়ে গেল মেট্রোরেলের কামরায় ।
চলতে চলতে পথে অনেক বন্ধু পেয়েছি । অনেক মানুষ সৌহার্দের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নানা সময়ে । মনের মধ্যে বিশেষ অতিথির জায়গাও করে নিয়েছে কেউ কেউ । সৌরভদা এমন একজন মানুষ যে আমার মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে নিজস্ব ঢং-এ । সৌরভদার সঙ্গ আমার সব সময়ই ভালো লাগে । চমৎকার মানুষ সে । আমার দাদার মতো । আমার বন্ধু । তাঁকে কখনো না করা যায় না । সে যখন বলল, “তোমার পায়ের তলায় তো সর্ষে- চলনা লাদাখ ঘুরে আসি । ছেলেটা বড় বায়না করছে । তাছাড়া ওর মোবাইলের নেশাটাও কাটানো দরকার । লাদাখ ভ্রমণে সেটা হয়ত কাটানো যাবে । যাবে ?” সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম ।
দু’জনে মিলে একদিন বসে দিনক্ষণ স্থির করে ফেললাম । সৌরভদা আমাকে একটাই দায়িত্ব দিয়েছিল । নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে যেন স্টেশনে হাজির হই ।
সৌরভদার ছেলে সৌম্যশুভ্রকে দেখেছি অনেকবার । খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে । মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারিতে ভালো রেজাল্ট করেছিল । সৌরভদা অবশ্য বলে, “ও হল খরগোশ ও কচ্ছপের গল্পের খরগোশ ।”
সৌম্যশুভ্র আজকাল মেতে আছে মোবাইল নিয়ে । “কি যে করে মোবাইল নিয়ে বুঝি না । ফেসবুক না কী সব আছে, তাই নিয়ে রয়েছে সে ।” সৌরভদার হতাশায় সৌম্যশুভ্রের কোন হেলদোল নেই । সে আছে তার জগতেই ।
লাদাখ শীতল মরুর দেশ । কষ্ট আছে লাদাখ ভ্রমণে । যাব যাব করে যাওয়া হয়নি উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে । সুগম পথে অনেক সঙ্গী জুটে যায় কিন্তু দুর্গম পথে সঙ্গী পাওয়া খুব মুশকিলের । যাও বা মেলে মনের সাথে মন মেলে না । ইচ্ছে গাড়ির বেসামাল অবস্থা তখন ।
হিমগিরি এক্সপ্রেসের এসি থ্রি টায়ারের টিকিট কেটে জানিয়ে দিয়েছিল সৌরভদা । সেদিন থেকেই মনটা উড়ে বেড়াচ্ছিল স্বপ্ন আর বাস্তবের বাইরে তৃতীয় একটা জগতে – যেটা দেখেছি আবার দেখিওনি, চিনেছি আবার অচেনাও । তবে এইযে আমার ওড়া সেটা শুধু এবারই তো নয় । কংক্রীটের জঙ্গলে যখন হাঁপিয়ে উঠি তখন এমনিতেই বেরিয়ে পড়ি কোথাও । প্রকৃতির কোলে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি যাতে ফুসফুসটা বিশুদ্ধ অক্সিজেন পেয়ে তাজা হয়ে ওঠে । তবে এবারের বেড়ানোটা সত্যিই অন্যরকম । একে লাদাখ তার উপর সৌরভদার সাহচর্য । ঘুমের বারটা বাজিয়ে রোজ রোজ কল্পনার জাল বুনি ।
বন-জঙ্গল, পাহাড়, সমুদ্র সবই আমার কাছে প্রিয় । তবু যেন মনে হয় পাহাড় আমার আলাদা একটা অনুভূতির জায়গা । পাহাড় আমাকে টানে বেশি । পাহাড়ের প্রকৃতি, পাহাড়ের মৌনতা আমাকে কৌতূহলী করে বারবার । পাহাড়ি মানুষ, পাহাড়ের ছোট ছোট জনপদ, নদ-নদী, অপরূপ ঝরণার উচ্ছলতা, পাহাড়ের উন্মুক্ত আকাশ আমাকে অনেক বেশি তৃপ্তি দেয় আপনজনের আতিথিয়তার মতো । ভূগোলকে মিলিয়ে দেয় ইতিহাসের দ্বারে ।
হিমালয়ের সৌন্দর্যের তো তুলনাই হয় না । হিমালয় শুধু আমাদের দেশের রক্ষক নয়, অপার বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিতে । জীবনকে ভরিয়ে দেবার জন্যে কত খুশির সম্ভার অন্দরে ! কত মানুষ হিমালয়ের অমোঘ আকর্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে । কেউ পর্বতশিরে চড়ার নেশায়, কেউ ঈশ্বরের সন্ধানে । কত রমণীয় স্থান, কত তীর্থক্ষেত্র যে ছড়িয়ে আছে হিমালয়ের নানাপ্রান্তে ! আর ভ্রমণ তো নেশার মতো । একবার যে এই নেশার কবলে পড়েছে তার মুক্তি নেই মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ।
এগারোটা পঞ্চান্নয় ট্রেন । ছাড়ল প্রায় আধঘণ্টা পরে । যাত্রীরা উঠেই শোওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে । সৌরভদাও সৌম্যশুভ্রকে তাড়া লাগাল, “বাবি, শুয়ে পড়তে হবে । ওঠ, বিছানা করি ।”
সৌম্যশুভ্র জানলার ধারে বসে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছিল । বাতানুকুল কামরা থেকে বাইরেটা পরিষ্কার দেখা যায় না । আলো-আঁধারের মাঝে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে কাঁচের পৃথিবী । ছেলেটাকে উঠিয়ে দিয়ে সৌরভদা মাঝের বার্থটা নামানোর চেষ্টা করতেই আমিও হাত লাগালাম । বিছানা হয়ে যেতেই সৌম্যশুভ্র জানলার ধারে গিয়ে বসল আবার । ঘাড় সোজা করা যায় না – সে ঘাড় গুঁজেই বসে রইল অদম্য ইচ্ছে নিয়ে । সৌরভদা ছেলের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি হেসে বলল, “ও নিচেই শোবে । ও উপরে উঠতে চায় না কখনো । আমি মাঝেরটাতে শুচ্ছি, তুমি উপরেরটাতে উঠে যাও ।”
আমার উল্টোদিকের বার্থে দৃঢ় চোয়ালের সুদর্শন এক জওয়ান । নিচের বার্থে সাদা ফ্যাটফ্যাটে চেহারার গ্রাম্য না হলেও সাধারণ আটপৌরে ঘরানার জওয়ানের স্ত্রী তাদের সাত আট বছরের কন্যাটিকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে চাদর গায়ে পেঁচিয়ে । মাঝের বার্থে বছর ত্রিশের যুবক কানে মোবাইলের ইয়ারফোন গুঁজে শুয়ে পড়েছে আগেই ।
সাইড আপারে পঁচিশ- ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলে । ওকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছি ট্রেনে ওঠার পরেই । লম্বা-ছিপছিপে চেহারা । চুলের ছাঁট দেখেই বুঝেছি সেও জওয়ান । কঠোর ট্রেনিং-এ মুখের পেলবতা উধাও হয়ে কাঠিন্য দেখা দিলেও বর্ষার মেঘের মতো চোখদুটোতেও মেঘের আনাগোনা । বারবার ফোন আসছে ওর মোবাইলে । কখনও কখনও তখন চোখদুটোতে শরতের আকাশ ।
সাইড লোয়ারে বিপরীত চমক । চল্লিশ-বিয়াল্লিশে আড়াই-তিন গুণের শরীরে বিপুল চর্বি সঞ্চিত করে ঘাড়- মাথা এক করে গলকম্বল বানিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে । শোয়ার পর শরীরের অনেকটা অংশই ঝুলে রইল সিটের বাইরে ।
একসময় সৌম্যশুভ্রও শুয়ে পড়ল । মাঝের বার্থ উঠে গেলে নীচের বার্থে বসে থাকা না গেলেও ছেলেটা তো ছিল এতক্ষণ ! ছেলেটা শুধু খেতে আর ঘুমাতে আসেনি ভেবে স্বস্তি পেলাম । ট্রেনে আমার কোনদিনই ঘুম হয় না ভালো । একা একা অনেক ট্রাভেল করি বলে সহযাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করা স্বভাবে গেঁথে গিয়েছে আমার । মাঝে মাঝে নিজের মনেই হাসি গোয়েন্দা নই বলে । আমি নেহাতই ছাপোষা মানুষ । পৃথিবীতে এসেছি দেখার জন্যে, জ্ঞান অর্জনের জন্যে যা এখানেই রেখে যাব । শুধু দুঃখ হয় এই ভেবে যে দুঃখটা যদি না থাকত পৃথিবীতে তবে খুব ভালো হত । “দুঃখ বিনা সুখলাভ হয় কি মহীতে ?” শুধু মাইকেল নন সবাই বোঝে ব্যাপারটা তবুও সবাই শুধু সুখ খোঁজে ক্ষ্যাপার মতো ।
ট্রেনের দুলুনিতে সাইড লোয়ারের অতি মাংসল শরীর যেমন একতাল ময়দার মতো নড়ছে তেমনই পাল্লা দিয়ে নাক ডাকছে । বিচিত্র সব আওয়াজ বের হছে নাক আর মুখ থেকে । কুম্ভকর্ণ কি এভাবেই ঘুমাতেন ? অকালে তার ঘুম ভাঙিয়ে রাবণ ঠিক কাজ করেছিলেন না করেননি জানি না । আমার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই কুম্ভকর্ণকে জাগিয়ে দিলে কোনো অন্যায় হবে না ।
বড় কোন স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়েছে । বাইরে অনেক আলো, অনেক মানুষের ছোটাছুটি । নীচে তাকিয়ে দেখি সৌম্যশুভ্র সর্পাসনের ভঙ্গিমায় জানলার বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছে । সত্যিই সে ট্রাভেলার ।
একটু পরেই ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে । চলতে চলতে বিরতি, বিরতির পর আবার চলা এই নিয়েই মানুষেরও পথ চলা । ট্রেনের পুনর্যাত্রা অর্থাৎ গন্তব্যে পৌঁছে ফিরতি যাত্রা আছে কিন্তু জীবনের চলা যে জন্মের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার ফিরতি যাত্রা নেই । এটা ভাবতে গিয়েই প্রশ্নটা মাথায় এল । যে বিগ ব্যাংয়ের ফলে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল তা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে নাকি ! বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে থামবে ? কোথায় এর শেষ ? এরও ফিরতি যাত্রা আছে ? কারোর কারোর কাছে এর খুব সহজ উত্তর আছে । নিজের বিশ্বাস নিয়ে নিজের মতো করে কাটিয়েও দেয় মানবজীবন । ইষ্টদেবতা বা ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে । আমি ঈশ্বর মানি না । কিন্তু মনের কোণে একটা প্রশ্ন প্রায়ই উঁকি দেয় । সব সৃষ্টির পেছনেই কারো হাত থাকে । ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির পেছনে কার হাত ? কে জগতপিতা বা জগন্মাতা ?
দূরপাল্লার ট্রেনে সকাল শুরু হয় একটু দেরি করে । সম্ভবতঃ শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই আমার সকাল হয়েছে আরো দেরি করে । মাঝের বার্থ নামিয়ে বাবা-ছেলে পাশাপাশি বসে কথা বলছে । উল্টোদিকের মাঝের বার্থের যুবক নেমে পড়েছে । বার্থ নামিয়েও দিয়েছে । ওকে দেখলাম না । নেমে গেল নাকি ? না, নামেনি । দাঁত ব্রাশ করতে গিয়েছিল । ও আসতেই মা-মেয়ে জানলার ধারে সরে গিয়ে বসতে দিল যুবককে । আমিও নীচে নেমে এলাম । “গুড মর্নিং”- সকালের সম্ভাষণটা সবার উদ্দেশেই ছুঁড়ে দিলাম । শুধু সৌরভদা হেসে উত্তর দিল, “গুড মর্নিং” । তারপর জিজ্ঞেস করল, “চা খাবে ?”
-হ্যাঁ, খাব । দাঁত মাজার ব্যাপার ছিল না । আমি রাতেই দাঁত মেজে শুই । আবার দুপুরে খাওয়ার পর মাজবো । এটা আমার সৌরভদার কাছেই শেখা । যদিও ছেলেটাকে এখনও শেখাতে পারেননি সৌরভদা । সৌম্যশুভ্র’র হাতে দেখলাম একটা মোটা বই । ওর হাত থেকেই হাত ছুঁইয়ে দেখে নিলাম ডন ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ ।
উল্টোদিকের যুবকের নাম নিখিলেশ দত্তগুপ্ত । লম্বাটে মুখ, হালকা চাপদাড়ি । চোখদুটো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত । টেক্সটাইল ইঞ্জিনীয়ার । লুধিয়ানায় কর্মস্থলে ফিরছে ক’দিনের ছুটি কাটিয়ে । বছর তিনেক আছে লুধিয়ানায় । স্ত্রী-কন্যাকে বাড়িতে রেখে গেল । একমাস পরে আবার এসে নিয়ে যাবে । দমদমে বাড়ি । শ্বশুরবাড়িও দমদমে । একা ফিরছে বলে স্বভাবতই মনটা খারাপ । গড়পড়তা বাঙালির মতোই হোম সিকনেসের কারণে মনটা ভারী হয়ে আছে তার উপর স্বল্পভাষী তাই বোধহয় গুটিয়েই রইল । আপার বার্থের জওয়ান এখনও ঘুমিয়ে আছে । মেয়েটা খুব বিরক্ত করছে ওর মাকে । সকালের আলোয় ভদ্রমহিলাকে দেখলাম । দীঘল চোখের তন্বী মেয়েটির বয়স ত্রিশের মধ্যে । কাল গায়ের রঙটা সাদা ফ্যাটফ্যাটে মনে হচ্ছিল আজ কিন্তু তা মনে হল না । দিনের আলোয় দেখলাম সত্যিই ফর্সা ।
সাইড লোয়ারের নাসিকা গর্জন চলছে শরীরের কম্পনের সাথে । সাইড আপারের সাড়া শব্দ পাচ্ছি না । ট্রেনের কামরায় অনেক লোক উঠেছে নিয়মবহির্ভুতভাবে । কালো কোট খুবই ব্যস্ত । বারবার পকেটে হাত ঢুকছে, বের হচ্ছে। সৌম্যশুভ্রর চোখ বইয়ের পাতায় । মাঝে মাঝে মোবাইলেও আঙুল চলছে । আমার চা পান আর কৌতূহলী চোখের নড়াচড়ার মাঝেই সাইড আপারের ছেলেটা নেমে পড়ল । টয়লেটের দিকে গেল । একটু পরে ফিরে এসে আবার স্বস্থানে ফিরে গেল । সৌরভদার সঙ্গে গল্প করার মধ্যেই দেখলাম জওয়ান নেমে পড়তেই মেয়ে ‘পাপা’, ‘পাপা’ করে জড়িয়ে ধরেছে বাবাকে ।
সৌম্যশুভ্র জানলায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরের জগতটা দেখছে এখন । গতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে যৌবন । ওকে বিরক্ত করা ঠিক হবে কিনা জানি না তবু মনে হল ওর সঙ্গে একটু কথা বলি । “সৌম্যশুভ্রর সাথে একটু গল্প করি”- বলতেই সৌরভদা বাঁদিকে সরে গিয়ে ওদের মাঝে বসার জায়গা করে দিল ।
সৌম্য ঘুবই শান্ত প্রকৃতির ছেলে । খুব ধীরে ধীরে পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলে । “তুমি বুঝি ইংরেজী গল্পের বই বেশি পড় ?” আমার প্রশ্নের জবাব দিল ছোট্ট করে, “নাহ্, বাংলাও পড়ি ।”
-বাংলায় কার লেখা পড়তে বেশি ভালো লাগে ?
-ফেলুদা পড়তে খুব ভালো লাগে । ব্যোমকেশ ভালো লাগে ।
-সত্যজিতের অন্য লেখা পড়ো না ?
-হ্যাঁ, খগম তো দারুণ !
স্বল্পভাষী ছেলেটা মুখ খুলছে । আজকালকার ছেলেরা সবাই কি কম কথা বলে ? নাকি বয়সটা তাদের কাছে একটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ? আমরা বড়দের সঙ্গে কত কথা বলতাম । পাড়ার বড়রা ডেকে ডেকে কথা বলত আমাদের সাথে । এখন পাড়া বলেই কিছু নেই । আছে শুধু এলাকা । পাশের বাড়ির লোকের সাথেও কথা হয় না । প্রতিযোগিতা আর রাজনীতির বেড়াজালে আটকে গেছে কাকা-জ্যেঠার মতো সম্পর্কগুলো । মাসিমা, কাকিমা সম্পর্কগুলো ঢুকে গেছে বোকাবাক্সে না হারিয়ে গেছে কোচিং সেন্টারে । সেখানে শুধু আন্টি আর আংকেল ।
সৌরভদা আলতো করে একটা ঠেলা দিল । সৌরভদার প্রশয় পেয়ে মনে হল ছেলেটাকে একটু নাড়াচাড়া করে দেখি । কাজটা কঠিন নিঃসন্দেহে । পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে ওকে জানতে হবে । সৌম্যশুভ্রর অগোচরে সৌরভদার সাথে আমার মত বিনিময় হয়ে গেল ।
-তুমি সিনেমা দেখ না ?
সৌম্যশুভ্র বই থেকে মুখ তুলে বলল, “হ্যাঁ দেখি । বাবার সাথে কয়েকবার হলে গেছি । বন্ধুদের সাথে গেছি দু’বার হ্যারি পটার দেখতে । টিভিতে কার্টুন দেখি মাঝে মাঝে ।” বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল সে ।
সৌরভদা মাথা নেড়ে বলল, “বাবির প্রথম সিনেমা টাইটানিক । ও তখন ছোট । গ্লোবে দেখিয়েছিলাম ওর জন্মদিনে । গ্লোব হলটা তো এখন উঠেই গেছে ।”
-টাইটানিক আমি সাতবার দেখেছি । দু’বার টিভিতে, চারবার কম্পিউটারে । কী সহজভাবে জানাল কথাটা ! ছেলেটা এখনও ছেলেমানুষ ।
সৌরভদা জানাল, “টাইটানিকের গানগুলোও ওর খুব প্রিয় ।”
সৌম্যশুভ্র বোধহয় এবার লজ্জা পেল । জানলায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছে সে । আমি ছাড়বার পাত্র নই । ওর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করি, “তুমি ইংরাজী বই কী কী পড়েছো ? কেমন লেখা তোমার ভালো লাগে ?”
জানলা থেকে মাথা সরিয়ে এনে উত্তর দেয় সে, “ডন ব্রাউন খুব ভালো লাগে এখন । ইনফারনো, দ্য লাস্ট সিম্বল পড়েছি আগে ।”
-হ্যারি পটার, টিনটিন এগুলোও পড়ে পড়ে । সৌরভদা আবার ঢুকে পড়ে আমাদের মধ্যে । ঈশারায় সৌরভদাকে থামতে বলি । সৌরভদা মুখ টিপে হাসে । সৌম্যশুভ্র বইয়ের পাতায় চোখ রাখে আবার । আমি নাছোড়বান্দা । জিজ্ঞেস করি, “হাদা-ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট পড়েছো ?”
সৌম্যশুভ্র হাসে লাজুক মুখে, “আগে খুব ভালো লাগত । এখন সায়েন্স ফিকশন, মেডিকেল ফিকশন পড়তে ভালো লাগে ।”
-আর কী পড়তে ভালো লাগে ? ছাড়ি না । খোসা ছাড়ানোর কাজটা চালিয়ে যাই । ও বাবার দিকে তাকায় একবার । বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে দেখে মোবাইলে কিছু দেখে নিয়ে মোবাইল পকেটে রেখে বলে, “আমার বাবা জুলে ভার্ণ, এইচ জি ওয়েলস কিনে দিয়েছে – পড়া হয়নি এখনও । বাবা অনেক বই কিনে দেয় । কিছু পড়েছি, কিছু পড়া হয়নি । এক বন্ধুর থেকে নিয়ে শার্লক হোমস পড়েছিলাম কিছুটা । এবার কিনে নিয়ে পড়ব আবার ।”
-আগে স্পেসের উপরে কোনো বই পেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত । সেই ছোটবেলা থেকেই ওকে স্পেসের উপর লেখা ইংরাজী বই আমিই কিনে দিতাম বইমেলা থেকে । এখন বইমেলা থেকে ডন ব্রাউন কেনে । সৌরভদা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও কানটা এদিকেই ছিল ।
সৌম্যশুভ্র রেগে ওঠে, “বাজে কথা বোলো না তো ! গত বছরও স্পেসের উপরে বই কিনেছি । দেব সাহিত্য কুটির থেকে রোমাঞ্চকর কাহিনী, হাঁদা ভোঁদা কিনেছি, সত্যজিত, শরদিন্দু কিনেছি আনন্দ থেকে । বাইবেল কিনেছি ।” ছেলের কথায় অভিমানাহত বাবা যেন স্বগোক্তি করে, “বই কেনা আর পড়া এক নয় । বই কিনলেই যে সবাই বই পড়ে তা কিন্তু নয় । যারা পড়ার তারা বই না কিনলেও পড়ে – ধার করে পড়ে ।”
সৌম্যশুভ্র গম্ভীরভাবে মন্তব্য করে, “আমি পড়ি ।”
সৌরভদা কতকটা ঝাঁজালো, “হ্যাঁ, পড়িস ! ওতো সময় কোথায় তোর ? এখন তো-” কানের উপর হাত চলে যায় সৌরভদার । ছেলে বাবার ইঙ্গিত ধরতে পেরে পারে । মুখ কালো করে জানলায় ফেরে ।
সৌরভদার কথা ঠিক । যারা বই কেনে তারা সবাই বই পড়ে না । ঘরে সাজিয়ে রাখে আর যারা পড়তে ভালোবাসে তারা যেভাবেই হোক বই জোগাড় করে পড়ে । এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ে কম, মোবাইল-কম্পিউটারে ডুবে থাকে । সৌম্যশুভ্র তো তবু পড়ে- অনেককিছুই পড়ে ।
খুব নরম জায়গায় আঘাত পড়ছে । আবহাওয়া প্রতিকূল । বাবা-ছেলের মাঝখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই শ্রেয় এই মুহূর্তে । একটানা চলতে থাকা কথোপকথনের মাঝে কখনো কখনো বিরতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে ।
খেত-জমির বুক চিরে দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে ট্রেনটা । বাতানুকূল কামরার বাইরে উত্তপ্ত পৃথিবী আগুনের মতো জ্বলছে । তীব্র গতিতে ছুটে আসা বাতাস পুড়িয়ে দিল মুখ । তার মধ্যেই মন ভালো করা প্রকৃতির সংসার । ঝলসান রোদে পিঠ পেতে ধান বুনছে কৃষক । বাংলায় তো বর্ষা এসে গেছে মরশুমি বায়ুর হাত ধরে । এদিকেও আসার বার্তা পৌঁছে দিয়েছে প্রাক বর্ষার বৃষ্টি ।
আলোকসুন্দর এক দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল প্রশান্তিতে । একটু আগের মেঘমেদুর আকাশ এখন সূর্য করোজ্জ্বল । সৌরভদার ডানহাত সৌম্যশুভ্রর পিঠে । পিতাপুত্রের বন্ধুত্বের বিরল দৃশ্য দেখে আমার চোখের কোণ ভিজে উঠল । জমিয়ে গল্প করছিল ওরা । আমার পুনরাগমনে ছন্দপতন ঘটলেও দু’জনেই সাদরে গ্রহণ করল আমাকে । পিতার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত সৌম্যশুভ্র আমার দিকে দুটো বিস্কুট বাড়িয়ে দিল হাসি মুখে ।
ভেজা চোখ, ভেজা মন নিয়ে সিটে বসে হালকা হাসির সাথে বললাম, “না,না, তুমিই খাও ।”
-নাও না । খুবই আন্তরিক সে । সৌরভদাও অনুরোধ করল, “নাও না ।”
নিতেই হল । সৌরভদা উঠে দাঁড়াল, “তোমরা বসে গল্প কর, আমি একটু ঘুরে আসি ।”
-না সৌরভদা, তুমিও বসো । তিনজনেই গল্প করি । বাবা-ছেলের মাঝে দেওয়াল তোলা নয় তিনজনের একটা টীম তৈরি করার প্রচেষ্টা আমার । খেলার মাঠে একটা টীম যখন খেলতে নামে তখন টীমের প্রত্যেকের একাত্মবোধ না থাকলে জেতা কঠিন নয় শুধু পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি । আমার কাছে ভ্রমণ মানে শুধু বেড়ানো নয়- অনেককিছু । ভ্রমণ মানে অনাবিল আনন্দ, অনাবিষ্কৃত জগতের হাতছানি । স্থান-কাল-পাত্রের ত্র্যহস্পর্শে তাল কেটে যাক আমি চাই না ।
বেড়াতে গেলাম । ছবি তুললাম । আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে গল্প করলাম, ছবি দেখালাম সেটা বেড়ানো, ভ্রমণ নয় । কষ্টের মধ্য দিয়ে, প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যা মেলে তা স্মৃতিকোঠায় জ্বল জ্বল করে । চোখ বন্ধ করলেই দেখা যায় ছায়াছবির চাইতেও উজ্জ্বল, সচল ছবি ।
সৌরভদা সঙ্গী হিসেবে খুব ভালো । অনেককিছু শেখার ও জানার আছে সৌরভদার থেকে । তিনি সত্যিকারের ভ্রমণপিপাসুও কিন্তু সৌরভদা এবার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন । বাবা-ছেলের ভালোবাসার বন্ধন মান-অভিমানের ধাক্কায় আলগা হয়ে গেলেই মুশকিল । সুরটা ধরে রাখতে হবে আমাকেই । সৌরভদার বয়স হয়েছে । ওর উচ্চতাজনিত অসুবিধের কথার সাথে সৌম্যশুভ্রর অনভিজ্ঞতা মনে রাখতে হবে । তাছাড়া কাশ্মীর সব সময়ই অনিশ্চয়তায় ভরা । পাকিস্থানি জঙ্গিরা কে কোথায় ওঁত পেতে বসে আছে মৃত্যুদুতের মতো কে জানে ? নিজের প্রাণের কথা ভাবি না । ওদের জন্য ভাবতে হবে । তাই প্রত্যেকের সুস্থ থাকাটা জরুরী । শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার উপর নির্ভর করছে লাদাখ ভ্রমণের সাফল্য । এ পথে বারবার যাওয়া যাবে না ।
পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো নয় এবার অন্তঃক্ষরী প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলব বন্ধুত্ব । প্রস্তাবটা দিতেই দু’জনেই লুফে নিল । শুধু সৌরভদা বলল, “আমি একটু টয়লেটে যাব আর আসব ।”

সৌম্যশুভ্র চিকেন ভালোবাসে । দুপুরের মিলে তাই চিকেন অর্ডার করেছিল সৌরভদা । ট্রেনের খাবারের স্বাদ নেই তবু দেখলাম সৌম্যশুভ্র বেশ তৃপ্তি করেই খেল । আমাদের মতো মা-মাসিদের হাতে সুস্বাদু নিরামিষ নানা পদের রান্না খাবার তো পেল না ওদের প্রজন্ম । ফাস্ট ফুড আর ফার্স্ট হওয়ার দৌড়ে সামিল হল উচ্চাশার ময়দানে ।
সৌম্যশুভ্রর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে আমার । ঘুম ঘুম দুপুরে গল্প করে, দাবা খেলে সময় কাটালাম আমরা । দু’দিনের ট্রেন জার্নি এমনিতেই খুব বোরিং । জওয়ানের মেয়ে লাভলির সঙ্গে সৌরভদার খুব ভাব হয়ে গেছে । সৌরভদাকে জোর করে এটা ওটা খাইয়ে দিচ্ছে সে । কখনো গলা জড়িয়ে ধরে আদর করছে সৌরভদাকে । একটা শিশুর দুরন্তপনায় রেলের কামরা মুখর এখন । একটা পরিবারের মতো হয়ে গেছি আমরা । ট্রেনে সারাদিন ধরে যাত্রী ওঠা নামা চললেও আমাদের আটটা সিটের কোন পরিবর্তন হয়নি । ফলে দ্বিতীয় রাতটা হল চেনা মানুষের চেনা দুনিয়ায় । এভাবেই মানুষ মানুষের বন্ধু হয়ে যায় এক সময় । মোটা মানুষটা কথাবার্তা না বললেও হাসি মুখে উপভোগ করছিল সৌরভদা আর লাভলির কীর্তিকলাপ ।
সৌম্যশুভ্র ছাড়া শুয়ে পড়েছে ট্রেনের গোটা কামরা । সৌম্যশুভ্র জানলায় মাথা ঠেকিয়ে কালকের মতোই সর্পাসনে । মাথা নামিয়ে দেখে নিয়েছি । সাইড লোয়ারের নাকের বাদ্যি বাজতে শুরু করেছে । গতরাতের অপূর্ণ ঘুমের হ্যাং ওভার চলছে, ঘুমের স্বস্তি আসেনি । তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি । একটা ঝাপসা অবয়ব । একটু একটু করে এগিয়ে আসে । ধরা দেয় না । মনে হয় মুখটা আমার খুব চেনা কিন্ত ভালো করে দেখার আগেই তো ভ্যানিস ! মুখ দেখা জলের আয়নায় নীল আকাশ সবুজের সাথে গলাগলি করে হাসে । টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে যেতে গিয়ে দেখলাম মায়ের পাণ্ডুর মুখ ।
দ্বিতীয় সকালটাও একই রকম । চা পানের পর গেটের দিকে গেলাম। কালকের আবহাওয়া সম্পূর্ণ বদলে গেছে । শুধু তাই নয় ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে আর আকাশটা ছাই রঙা মেঘে ঢেকে গেছে । আগের দিনের উত্তাপটা না থাকলেও গরম আছে । আনমনা হয়ে কাটালাম কিছুক্ষণ । নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গে নিলে অনেককিছু ভাবতে পারা যায় । সেটাই হল । অচেনাকে জানার জন্য ব্যাকুল মন ভরে উঠছে কল্পনার খুশিতে । ভ্রমণ তো এটাই ।
সাইড আপারের ছেলেটার সঙ্গে আলাপ হল গেটে দাঁড়িয়ে । সেনাবাহিনীতে আছে । প্রথম পোস্টিং । কূপওয়ারা সেক্টারে আছে । ক’দিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল । খুব মায়া হচ্ছিল ওর জন্যে । বাচ্চা ছেলে ।
লাভলি সৌরভদাকে জড়িয়ে ধরে সৌরভদার গালে গাল ঘসছে । ওর মা লজ্জা কাটিয়ে ফেলে গল্প করছে সৌরভদার সঙ্গে । এটাই তো ভারতবর্ষ । আমার দেশ ।
লাভলির ছোটমামা জম্মু স্টেশনে আসবে ওদের নিতে । মামাবাড়ি পঁচিশ-ত্রিশ কিলোমিটার দূরে । লাভলির দুই মামা । বাড়িতে নানা-নানীও আছে । ক’দিন থেকে তারপর যাবে ভান্ডারওয়ায় । ওদের নিজেদের বাড়িতে । সেখানে কাকা-কাকি ছাড়া দাদি আছে । দাদা নেই । দাদা কারগিল যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন । ওরা কাশ্মীরি ডোগরা । যুদ্ধে যেতে ভয় পায় না তবু দিদা ছোটছেলেকে সেনাবাহিনী বা আধা সেনাবাহিনীতে যেতে দেননি । তাছাড়া চাষবাসের কাজটাও তো কাউকে করতে হয় ।
লাভলির বাবা সি, আর, পি, এফের সাব ইন্সপেক্টর । রাঁচিতে পোস্টিং । লাভলির বড়মামা আর্মিতে আছে । কোলকাতায় বড় মামার কোয়ার্টারে দু’দিন থেকে এসেছে ওরা ।
লাঞ্চের পর থেকে লাভলির বাবা গোঁফ আর চুলের পরিচর্চা করছে । সুগন্ধী চুলের গন্ধে ভুরভুর করছে কোচের ভেতরটা । তেল মেখে মেখে চুল আর গোঁফের জৌলুস ফেরাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরা জওয়ানের মতো । যদিও প্রিয়া তার সঙ্গেই আছে তবু শ্বশুরবাড়ি বলে কথা ! সৌম্যশুভ্র কেশচর্চার বহর দেখে মুচকি মুচকি হাসছে । সৈনিক যখন যেখানে তখন সেখানকার ডিসিপ্লিন মেনে চলে সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি এখনও হয়নি ওর ।
সাইড আপারের ছেলেটা কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে সম্ভবত মোবাইলে গান শুনছে । গান শোনার বয়সই ওর । তবু কূপওয়ারায় গিয়ে সে মর্টারের শব্দ শুনবে । হাতে তুলে নেবে তার হাতিয়ার । সে তখন সৈনিক । দেশে হয়ত ওর মা-বাবা, ভাই-বোনেরা ওর কাছ থেকে আসা একটা খবরের প্রতীক্ষায় থাকবে । মায়ের চোখদুটো রাতেও জেগে থাকবে নিঃশব্দে । হয়ত কোন কিশোরীর বুকে ধুক্ ধুক্ করে চলবে প্রেমের গাড়িটা । সে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে এবার ফিরেই মা-বাবার সাথে কথা বলে এনগেজমেন্টটা পাকা করে রাখবে । কতকিছু ভাবি । সব ভাবনাই যদি সত্যি হত ? আমার ভাবনায় সাথে সবার ভাবনা যদি মিলে যেত তবে কি আমি আমি’তে থাকতাম ? নাকি পৃথিবীটা যুদ্ধক্ষেত্র হত ? যুদ্ধ চাইনি বলেই না আজ আমি ব্রাত্য প্রায় সবার কাছে ।
জানলার ওপারে বিষন্ন পৃথিবী । এপারে অলসতা । গন্তব্যে পৌঁছে গেলে নতুন পথে যাত্রা । যাকে যে পথে যেতে হবে সে চলতে শুরু করবে যাত্রার নিয়মেই ।
সোনারঙা রোদ রোদ বিকেলে জম্মু পৌঁছে গেলাম হিমগিরি এক্সপ্রেসের যাত্রা শেষে । লাভলিরা চলে গেল আত্মীয় পরিজনের বৃত্তে । আমরা চললাম নতুন পথের সন্ধানে । অচেনা-অদেখা পথের খোঁজে মানুষ ঘর ছাড়ে বারবার । মার্কো পোলো, হিউয়েন সাং, ফা-হিয়েন, মেগাস্থিনিসও একদিন ঘর ছেড়েছিলেন নতুনের খোঁজে । কলম্বাস তো নতুন এক দেশ আবিষ্কার করে চমকে দিয়েছিলেন বিশ্বকে । অতীশ দীপঙ্কর বুদ্ধের শান্তির বাণী এভাবেই পৌঁছে দিয়েছিলেন তিব্বতে । আর আমরা তো চলেছি নিজেদের দেশেরই আর এক প্রান্তে । আমরা আবিষ্কারকও নই, ধর্ম প্রচারকও নই । আমরা পর্যটক । নেহাতই আনন্দ আর সৌন্দর্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি । তবু আমার মনে হয় ভ্রমণ নিছক আনন্দ বা তৃপ্তির জন্যে নয়, নিস্তরঙ্গ কুঁয়োর জল থেকে উঠে এসে সমুদ্রযাত্রার মতো । তারপর সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে অজানা জগতের রসাস্বাদন, মণিমুক্তোর মতো অমুল্য জ্ঞান, মানুষকে চেনা সবই জুটে যায় দীর্ঘযাত্রায় । প্রকৃতি এতকিছুর আয়োজন করে রেখেছে কখনই একঘেয়েমি বা বিরক্তিকর মনে হয় না পথচলার সময় । প্রকৃতি মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক আর এই শিক্ষকের পাঠশালা হল আমাদের এই পৃথিবী ।

ট্রেনে উঠেছিলাম ১৫ই জুন । আজ সতেরো । রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে এসে টিভি চালিয়েছি । কী সাংঘাতিক ! কী ভয়ংকর দৃশ্য ! শেষের সে দিন কি এসে গেল ? উত্তরাখণ্ডের পাহাড়েবেষ্টিত কেদারনাথের মন্দির শহর থেকে রুদ্রপ্রয়াগ সর্বত্রই একই ছবি । জলের ভয়ংকর ছোবলে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ছে একের পর এক ঘরবাড়ি । হারিয়ে যাচ্ছে ঘোলা জলের ঘুর্ণিতে । সবই দু’দিনের পুরানো ছবি কিন্তু কী টাট্কা ! কী বীভৎস !
রুদ্রপ্রয়াগ আমার প্রিয় শহরগুলোর মধ্যে একটা । রুদ্রদেবেরও প্রিয় । সেই প্রিয় শহরের ছিন্নভিন্ন মৃতপ্রায় শরীরটা পড়ে আছে পরের দিনের ছবিতে । মন্দাকিনী ও অলকনন্দার সঙ্গম মৃত্যুপুরীর দ্বারের মতো ভয় দেখাচ্ছে ।
কেদারনাথ মন্দিরের পেছনের পাহাড়ের মাথায় থাকা চোরাবারির তাল থেকে ভয়ংকর জলদৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে কেদারের উপর । গিলে ফেলেছে উপত্যকা আর পূণ্যার্থীদের । একটা বাড়িও আস্ত নেই । কেদারনাথের মন্দিরটা রক্ষা পেয়েছে পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা বিরাট পাথরের জন্যে । অবশ্য ওটাকে পাথর না বলে একটা পাহাড় বলাই ভালো । পাহাড়টা মন্দিরের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে মন্দিরের রক্ষাকর্তা হয়ে । অবিশ্বাসীর মনে বিশ্বাস জাগিয়ে পাথর আর মাটির মধ্যে ডুবে আছে মন্দিরের শরীর । জানি না পাহাড়ে প্রাণের স্পন্দন আছে কিনা । সৃষ্টির এই ধ্বংসলীলা আর মৃত্যুপুরীর ছবি দেখে মনটা ভারী হয়ে গেল শ্রাবণের আকাশের মতো ।
‘চোরাবারির তাল’ – এই রহস্যময় হ্রদটার একটা ভালো নামও আছে । গান্ধীজির চিতাভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এখানে তাই গান্ধী সরোবর নামেও চেনে লোকে । বরফে ঢাকা হ্রদ এতদিন বিশাল জলের ভান্ডার ধরে রাখলেও এবার ধরে রাখতে পারেনি প্রকৃতির আর এক নির্মম খেলায় । মেঘ ভাঙা বৃষ্টির প্রচণ্ড চাপে ফেটে গেছে চোরাবারির তাল । বিপুল জলরাশি উপচে পড়ে গ্রাস করেছে কেদারনাথ থেকে রামবাড়া, গৌরীকুণ্ড হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ । নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে একের পর এক গ্রাম । হাজার হাজার বাড়ি ভেঙে পড়ে হাজার হাজার মানুষ ভেসে গেছে জলের তোড়ে । প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অসংখ্য মন্দিরের জন্য খ্যাত দেবভূমি গাড়োয়ালের পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা জনপদগুলোর উপর কোন এক হিংস্রদানব যেন তান্ডব চালিয়েছে নির্মমভাবে । বীভৎস ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগ্নপ্রায় পাহাড় । ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে মন্দাকিনী ফুঁসছে । যে রূপসী মন্দাকিনী তার অফুরন্ত সৌন্দর্য আর নীল চোখের আকর্ষণে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের মন কেড়ে নিত সে আজ ভয়ংকরী । রুপসী থেকে রাক্ষসীতে রূপান্তরিত ।
সেনাবাহিনীর জওয়ানরা উদ্ধারকার্য চালাচ্ছে হেলিকপ্টারের সাহায্যে । প্রায় দুঃসাধ্য সাধন করার চেষ্টায় অক্লান্ত সৈনিকের দল । দেশের রক্ষায় যেমন দশের রক্ষায়ও তেমন সৈনিককে যুদ্ধ করতে হয় । রণে ভঙ্গ দিলে চলে না ।
সৌরভদা বিড়বিড় করছে, “প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ । প্রকৃতি রক্ষার দায়িত্ব মানুষের- মানুষ ভুলে গেছে তা । লোভ আর অশিক্ষা সঙ্গে কিছু মানুষের অসহায়তা । জানি না আর কতদিন বেঁচে থাকবে পৃথিবী !” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সৌরভদার । স্পষ্টতই অনুভব করতে পারি ।
মন চাইছে না এগিয়ে যেতে । মানুষের দুঃখে মানুষই কাঁদে । অনেককিছু চোখে দেখা যায় না তবু দেখতে বাধ্য হই । অনেককিছু করা উচিত না তবু করি । জগতে কিছুই থেমে থাকে না । থেমে গেলেই বিপদ । জীবনও এগিয়ে চলে, জীবন থেমে যাওয়া মানে তো মৃত্যু ! মানুষের থেমে যাওয়া মানে সভ্যতারও গতিরুদ্ধ । সভ্যতার গতিরুদ্ধ মানে শেষের সে দিনের শুরু । তাই চলতেই হয় ।
সৌরভদার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম আমাদের এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয় । সৌম্যশুভ্র এখনও তেমন ম্যাচিওর নয় । ওকে বোঝানোও কঠিন । সবাই তো স্বামী বিবেকানন্দ বা গৌতম বুদ্ধ নয় ।
( ক্রমশঃ )

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post