Sankars Creation

তপন বিশ্বাস

ধারাবাহিক উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব

।। তিন।।
জঙ্গি হানায় কয়েকবছর আগে শ্রীনগরের টুরিস্ট রিসেপশন সেন্টার গুঁড়িয়ে গিয়েছিল । নতুন বাড়ির নির্মাণ চলছে । নব কলেবরে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের জন্যে । কাশ্মীরের মানুষদের জন্যেও । মানুষের সঙ্গেই মানুষ ভাল থাকে । পর্যটন একটা শিল্প । এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক মানুষের রোজগার । দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে সংস্কৃতির আদান প্রদান হলে উপকৃত হয় মানুষ ।
ট্যুরিজমের বাসের টিকিট গতকালই কেটে রেখেছিলাম । সকাল সাতটায় বাস হলেও একটু আগেই এসেছি । বাস দেয়নি এখনও । রোদ ঝলমলে সকাল হাসছে আমাদের আশ্বস্ত করতে । কিন্তু তাতে কি উদ্বেগ কমে ? আপাত শান্তির আড়ালে কোথায় বিপদ লুকিয়ে বসে আছে সেটা জানা সম্ভব না । আসন্ন বিপদের কথা আগে থেকে জানতে পারলে তো মানুষের জীবনে দুর্ঘটনা ঘটতই না । ভারতবর্ষের অন্যতম দুর্গম আর সন্ত্রাস কবলিত ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে প্রতি মুহূর্তে আশংকায় কেঁপে উঠবে বুক । তবু বাসের দেরিটা যেন আর সহ্য হচ্ছে না ।
বাস এল । বাসে ওঠা বসা আর নানারকম চেকিং-এর জন্যে ছাড়তে ছাড়তে দেরি হয়ে গেল ঠিক এক ঘন্টা । আমরা তিনজন ছাড়া সবাই লোকাল । টুরিস্টরা লোকাল লোকের সাথে বাসে ভ্রমণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না । এটা শুধু কাশ্মীরে বলে নয় সারা ভারতবর্ষেই । টুরিস্ট বাস বা কারে যাওয়াই পছন্দ করে সবাই । আমার মতো সামান্য কিছু মানুষ এখনও স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি চলতে চায় দেখেছি । সৌরভদাও তেমনই একজন মানুষ ।
দেরি পুষিয়ে দেবার জন্যেই হোক বা বন্ধের দিনের মতো ফাঁকা ফাঁকা রাস্তার জন্যেই হোক বাস কিন্তু ছুটছে এক্সপ্রেস গতিতে । যেন খুব তাড়াতাড়িই শহর ছাড়তে চাইছে বাসটা ।
মুসলমান স্থাপত্যের চিহ্ন নিয়ে দেখা দিচ্ছে আর একটা শহর । এলাকাটা বেশ ঘিঞ্জি । কিছু কিছু পাকাবাড়ি ছাড়া টিনের চাল দেওয়া কাঠের বাড়িই বেশি । প্রায় প্রত্যেক বাড়ির মাথায় সবুজ পতাকা উড়ছে পতপত করে । ফেজ টুপি, মেহেন্দি রাঙানো লম্বা দাড়ি, লম্বা ঢোলা পোশাক পরা কিছু মানুষ দেখা গেল বাজারে । এখানকার ঘিঞ্জি এলাকায় যারা বাস করে তারা দারিদ্র না অবহেলার শিকার জানি না । তবে শিক্ষার অভাব আছে সেটা দেখেই মনে হয় । শিক্ষার সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে যদি সরকারগুলো ভাবত তাহলে বোধহয় অনেক সমস্যাই মিটে যেত দেশের । আমাদের দেশে খাবারের তো অভাব নেই, বন্টন ব্যবস্থার অভাব । সেবার অমরনাথ যাত্রার সময় খানবল থেকে লোকাল জিপে করে পহেলগাঁও যেতে যেতে দেখেছিলাম দরিদ্র-অশিক্ষিত কাশ্মীরবাসীদের । চরম দারিদ্র আর বঞ্চনার শিকার তারা ।
দোকান-পাট খুলতে শুরু করেছে । ভিড়ও বাড়ছে । ফলে বাসের গতি কমে গেল অনেকটাই । ভয়ের পরিবেশ আর পরিস্থিতি মানুষকে সতর্ক করে দেয় কখনো কখনো । দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে ফারাকটা প্রতিটা দৃশ্যপটই বলে দিচ্ছে । মনে হচ্ছে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি । অথচ এটা ভাবার তো কারণ নেই ! কি জানি কেন মনে হল !
ইট, কাঠ,পাথর, টিনের পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে প্রকৃতির শ্যামল আস্তরণ বিছানো পথে । গ্রামবাংলার মতো পরিচিত দৃশ্যপট । শ্যামলবরণ প্রকৃতির বুকে শস্যক্ষেত, মাঠের মাঝে ইতস্ততঃ ছড়ানো বাড়িঘর । বড়-ছোট নানা ধরণের গাছ-গাছালি । মাথার উপর নীল আকাশে শরতের মতো হালকা মেঘের ভেসে বেড়ানো দেখতে পাচ্ছি বাসের জানলার ফাঁকে দৃষ্টি গলিয়ে দিয়ে । তবু কোথায় যেন ফাঁকি ধরা পড়ে যাচ্ছে বড় বড় গাছের আড়ালে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পাহারারত ভারতীয় সেনার পাহারাদারিতে । প্রিয়জনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ জওয়ান ডিউটি দিচ্ছে প্রাণ হাতে নিয়ে । ওদের জন্যেও তো মন কাঁদে । ওরা আমাদের মতোই মানুষ, শুধু সৈনিক নয় ।
সিন্ধুনদ কখন যে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে যাত্রার পথে, খেয়ালই করিনি । পিচ রাস্তার ওপারে পাইন আর বার্চের ফাঁকে নাচতে নাচতে চলেছে সে । মাঝে মাঝে পাহাড়ের কোলে ছবির মতো উপত্যকা, ফুলের ও ফলের বাগানে ঘেরা বাড়িঘর । সেনা ছাউনি সবুজ বনের ধারে ।
মনোরম এই পার্বত্যভূমির দখল রাখা আর দখলদারির মধ্যে দীর্ঘ লড়াই অনেক দিনের ! রক্তাক্ত হচ্ছে মাটি । বারুদের গন্ধে শ্বাসরোধ হয়ে আসা সময়ে নিশ্চয় বাতাসও কেঁদে কেঁদে ফেরে প্রকৃতির সাথে ।
আমার সামনের সিটে পিতাপুত্র নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ । দু’জনেই প্রকৃতিপ্রেমিক । প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে ওরা নিশ্চয় আপ্লুত এখন । সৌম্যশুভ্রর চোখে দেখার খিদে আছে দেখেছি । জানলার ধারে বসেছে সে । সৌরভদার মুখ দেখতে পাচ্ছি না । সে বোধহয় গুন গুন করছে এতক্ষণে । সৌরভদার মধ্যে একটা গান গাওয়া পাখি বাস করে যে ।
শোনমার্গে সাময়িক বিরতি । সকাল গড়িয়ে দুপুরে প্রবেশ করেছে সময় । বেশ কিছু পর্যটক এসেছে । খাবার দোকানগুলোতে ভিড় জমিয়েছে অনেকেই। সৌরভদা ছেলের জন্য ক্যাডবেরি কিনল । কিন্তু আমাদের যেটা দরকার সেটা নেই আশেপাশে কোথাও । একটু চায়ের জন্য মনটা কঁকিয়ে উঠছে দুজনেরই । ঘুরতে ঘুরতে মিলল অবশেষে । চা পানে তৃষ্ণা দূর হতেই ধূমপানের নেশা চেপে বসল আমার । কিন্তু অনেক সময় নষ্ট হয়েছে তাই আর সময় নষ্ট না করে পায়ে পায়ে চলার সাথে চোখ মেললাম প্রকৃতির মনভোলানো রূপের দিকে । শোনমার্গ নীল, সাদা আর সবুজের শহর । নীল আকাশের বুকে সাদা স্বপ্নালু মেঘের ঘুরে বেড়ানো । দূরে সারি সারি পাহাড়ের মাথায় বরফের মুকুট আর কাছের পাহাড়ের শরীর ঢেকেছে তৃণভূমির সবুজ গালিচায়, পাইনের ঋজু সারির শৃঙ্খলে । কোথাও কাঁচা মাটির গেরুয়া পথ গিয়ে শেষ হয়েছে ফুলের গাছ আর পাইনে ঘেরা সুদৃশ্য বাংলোয়, কোথাও পথ ঢুকে গেছে গহন বনের ভেতরে ।
সৌরভদা একটা সুন্দর বাংলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “বিত্তবানের প্রমোদ ভবন । তবে জানি না তারা কেউ এখন আসে কিনা । একটা সময় প্রায় প্রত্যেক সিনেমাতেই শোনমার্গে শ্যুট করা একটা গান থাকত । প্রকৃতি কোন কার্পন্য করেনি শোনমার্গকে সাজাতে গিয়ে ।”
-কথাটা ঠিক হল না সৌরভদা । প্রকৃতি কোন কার্পন্য করেনি কাশ্মীর গড়তে । কাশ্মীরের শরীরের এক একটা অঙ্গ এক একরকমভাবে সাজিয়েছে প্রকৃতি । গুলমার্গে গিয়েছি, পহেলগাঁওয়ে গিয়েছি, থেকেছি । কতবার ভেবেছি শোনমার্গে এসে একদিন ভালো করে ঘুরব, তা আর হল না । সেবারও বালতাল দিয়ে অমরনাথ থেকে ফেরার সময় এক টুকরো শোনমার্গ দেখেছিলাম, এবারও তাই ।
সৌম্যশুভ্র ছবি তুলছিল । আমাদের বলল মুখ ফিরিয়ে বাংলোটাকে পেছনে রেখে পাশাপাশি দাঁড়াতে । সাধের বাংলো আর পাইনবনের সঙ্গে আমরা বন্দী হলাম সৌম্যশুভ্রর ক্যামেরায় । ভবিষ্যতে আমাদের কারো স্মৃতি চারণায় ফিরে আসবে আজকের আধ ঘন্টার শোনমার্গ । বললাম, “আমাকে ক্যামেরাটা দাও তোমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দিই ।”
সে নির্দ্বিধায় আমাকে ক্যামেরা দিয়ে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াল । ছবি তোলা হয়ে গেলে সে আমার কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে একটা ঘোড়ার ছবি তুলতে যাচ্ছিল । ঘোড়াওয়ালা বলল, “ঘোড়ামে ঘুমনা হ্যায় বাবুজী ?” ঘোড়াওয়ালারা পর্যটকদের আশায়ই দাঁড়িয়ে আছে এখানে । সৌম্যশুভ্র মাথা নেড়ে না করতেই ঘোড়াওয়ালা ঘোড়া নিয়ে সরে গেল । কী ভেবে সৌম্যশুভ্র আর ছবি তুলল না ।
সৌরভদা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ওর ঘোড়ায় চড়তে খুব ভয় । দার্জিলিংয়ে ওকে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিতেই কি চিৎকার সেবার ! তখন ও খুবই ছোট । এখনও ভয় কাটেনি দেখছি । দে তোর একটা ছবি তুলে দিই ঘোড়াগুলোকে নিয়ে ।” সৌরভদার কথায় ছেলে ক্যামেরাটা বাবার হাতে দিয়ে জিভ ভেংচে দাঁড়াল । সৌরভদা ধমক দিয়ে উঠল, “এই কী হচ্ছে ! খালি বাঁদরামো না !”
ছেলে এবার দু’আঙুলে ভি দেখিয়ে পোজ দিল । বাবা ছেলের বন্ধুত্বের এও এক প্রকাশ । কৃত্রিম শাসন আর খুনসুটির ।
ছবি তোলা হয়ে গেলে সৌম্যশুভ্র আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আংকেল, পহেলগাঁও আর গুলমার্গ কি শোনমার্গের চেয়ে সুন্দর ?”
বললাম, “প্রত্যেকটা জায়গারই একটা আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আছে । তবে আমার মনে হয় পহেলগাঁও বেশি সুন্দর, কারণ ওখানে গিয়ে কয়েকদিন বেশ থাকা যায় । লিডার নদীর তীরে বেশ সুন্দর একটা পাহাড়ি শহর । সুন্দর সুন্দর বাড়ি, ঝকঝকে রাস্তাঘাট, ঝলমলে বাজার, মানুষের ভীড় । কাছাকাছি সাজানো বাগান, অসংখ্য ফুলের গাছ, ফলের গাছ, ঝরনা, ভ্যালি, পাইন বন, জাফরান ক্ষেত সবই আছে । চন্দনবাড়ির পথে ফিল্মি ভিলেজ- বেতাব ভ্যালি । শীতকাল ছাড়া সব সিজনেই মনোরম আবহাওয়া । সব মিলিয়ে মার্ভেলাস ! আমার কি মনে হয় জানো ? শোনমার্গ একটা পোস্টকার্ডের মতো সুন্দর । ছবি তোলা আর বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুরে বেড়ানোর জায়গা । একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে এখানে । খুব বেশি হলে সিন্ধুর তীরে গিয়ে ভিডিও তোলা । তারপর ছবি আর সিন্ধু নদের গর্জনে মুখরিত ভিডিওর স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাওয়া । আরো বেশি চাইলে একটু এগিয়ে খাজিয়ার হিমবাহ দেখে আসা যায়, ব্যস ! গুলমার্গে খুব ঠাণ্ডা । কিন্তু সারাদিন এনজয় করার জন্যে খুব ভালো । দিগন্ত বিস্তৃত পাইন বন, মাঠ, ভালো রেস্টুরেন্ট, নাচ-গান করে কিংবা হুটোপাটি করে সময় কোনদিক দিয়ে কেটে যাবে বুঝতেই পারবে না । তাছাড়া রোপওয়ে আছে । ওতে চেপে চলে যাও পাহাড়ের মাথায় বরফের রাজ্যে । মেঘের রাজ্যে দাঁড়িয়ে দেখ আর মনটাকে ভাসিয়ে দাও ভূস্বর্গের আকাশের নীলে । ইচ্ছে হলে স্কী করতে পার । আমোদ প্রমোদের সব উপকরণ মজুত আছে গুলমার্গে । তবে একটা রাতের বেশি থাকা সুখকর নয় । রাতে টেম্পারেচার অনেক নেমে যায় । হাড় কাঁপুনে হাওয়া ! তার চেয়ে বাপু পহেলগাঁওয়ে গিয়ে ক’দিনের বিশ্রাম নাও । শোনমার্গ বা গুলমার্গ থাকার জন্য বিত্তবান হতে হয়, পহেলগাঁওয়ে মধ্যবিত্তের ক’দিনের সংসার পাতার জন্য অনেক হোটেল আছে ।”
-তুমি ছোট করে তিনটে জায়গারই এত সুন্দর বর্ণনা দিলে যে পহেলগাঁও আর গুলমার্গের অনেককিছুই দেখা হয়ে গেল যেন । কি রে বাবি, তাই না ?
বাবি বাবার কথায় কতটা সহমত হল জানি না তবে খুব সুন্দর করে হাসল । বলল, “একবার যেতে তো হবেই পহেলগাঁও আর গুলমার্গে । এখানেও আসতে হবে আবার । তাছাড়া শ্রীনগরেরও অনেককিছু বাকি রয়ে গেছে ।”
বললাম, “অবশ্যই আসবে । মাকে নিয়ে আসবে । বাবা-মায়ের সাথে ঘুরে যাবে ভূস্বর্গ । তবেই না স্বর্গের স্বাদ নিতে পারবে । তারপর …” এটুকু বলে থামতে হল । সৌম্যশুভ্র এখনো অতটা বড় হয়নি ।
দুরন্ত সিন্ধুর তীর ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠছে বাস । বরফে মোড়া পাহাড় থেকে ঠাণ্ডা বাতাস এসে জড়িয়ে ধরছে আষ্টেপিষ্ঠে । পাহাড়ি ঝরণা সুর তুলছে পাহাড়ের বুকে । নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় করে মন উড়ে যায় মুহূর্তে । শোকের কালো ছায়া বা দুঃখের জলীয় বাষ্প কোথায় উবে গেছে !
পথ চলতে চলতে দেখে নিলাম খাজিয়ার হিমবাহ । শুভ্রতায় মোড়া বিশাল হিমবাহের ছটায় চোখ ঝলসে যায় । সাদা-কালোর এই সৌন্দর্যে কখনো কখনো রঙিনও ফিকে হয়ে যায় বলেই না পাহাড়ে উঠে মানুষ । সাদা-কালোর দুনিয়াও তো রঙিন পৃথিবীর চেয়ে স্বচ্ছ ।
তুষার সভ্যতা পেরিয়ে আবার সবুজের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে নতুন পৃথিবীর শরীরে । বড় গাছ নেই তৃণভূমিই সবুজ মেশাচ্ছে একটু একটু করে । ডানদিকে বালতাল । বাঁ দিকে পাহাড়ে চড়ছে গাড়ি । পাহাড়ের শরীর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পাথুরে পথের সন্ধান করতে গিয়ে অতি বড় সাহসীরও বুক কেঁপে যায় । ভঙ্গুর পাহাড় রুক্ষস্বরে সাবধান বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে দুঃসাহসীকে ।
গিরিপথে গাছ তো দূরের কথা – ঘাসও নেই । পাহাড়ের শুষ্ক শরীর থেকে এক ফোঁটা রসও মেলে না গাছ জন্মাবে কি ! অনেক নীচে বালতাল উপত্যকা সবুজ সাজে চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে আর সাহস জোগাচ্ছে প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষের মনে ।
পাথর গড়িয়ে পড়ছে ভঙ্গুর পাহাড়ের পথের মাঝে । পথ দুর্গম থেকে দুর্গমতর হচ্ছে আর বাস গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে করতে এগোচ্ছে এটাই একমাত্র সান্ত্বনা । কিন্তু সেটাও গেল । সামনের রাস্তা বন্ধ । বালি, পাথরে ঢাকা পড়ে গেছে এগোনোর পথ । উল্টোদিকে গাড়ির লম্বা লাইন ।
বাস থেকে নেমে পড়লাম । গাড়ির ড্রাইভাররাই হাত লাগিয়েছে পাথর-বালি সরাতে । জনপদ শূন্য পথে এগোতে গেলে এ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই ।
সারি সারি তাঁবু পড়েছে বালতালে । কিছুদিন পরেই অমরনাথ যাত্রা শুরু হবে । হেলিপ্যাডটাও দেখতে পাচ্ছি নীচে । সৌরভদা, সৌম্যশুভ্র দুজনেই নেমে পড়েছে । একটা পাথর গড়িয়ে পড়ল আমাদের বাসের গায়ে । পাথরটা ছোট । বড় হলে বাসটা গড়িয়ে যেত নিশ্চয় । টুকরো টুকরো হয়ে বালতালে গিয়ে পড়ত শেষে ।
বাইরে কড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকা গেল না । প্রাণ হাতে নিয়ে সবাই বাসেই উঠে বসলাম । বিপদ আছে জেনেই তো বেরিয়েছি ।
সৌম্যশুভ্র জানতে চাইল, “অমরনাথের কোন পথটা বেশি ভালো আংকেল ?” ওর উত্তরে বললাম, “বালতালের পথটা কম কিন্তু পহেলগাঁওয়ের পথটা বেশি সুন্দর । চন্দনবাড়ি, শেষনাগ, পঞ্চতরণী প্রত্যেকটা জায়গাই খুব সুন্দর । শেষনাগের নীলাভ সরোবরে বরফে মোড়া পাহাড়ের দীর্ঘ ছায়া, পঞ্চতরণীর পঞ্চনদের ধারা, আহা ! কী সুন্দর ! ভোলা যায় না । তবে পিসু চড়াই আর মহাগুণা পাস পেরোতে গিয়ে জীবন বেরিয়ে যায় যেন । পিসু চড়াই অনেকটা জেড আকারের পথ আর মহাগুণা পাসে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপট । আমি বালতাল দিয়ে নেমেছিলাম । নামতে গিয়ে বুঝেছিলাম পথ কম হলেও চড়াই বেশি এ পথে ।”
সৌম্যশুভ্র বলল, “পরের বার অমরনাথে যাব । পহেলগাঁও দিয়ে গিয়ে বালতাল দিয়ে ফিরব । তুমি আবার যাবে আমাদের সাথে ?”
সৌরভদা বলল, “ভালো রেজাল্ট কর আগে ।”
-অত চাপ নিচ্ছো কেন ! রেজাল্ট হয়ে যাবে । ছেলের জবাব ।
ছেলের জবাব শুনে সৌরভদা খুশি হল না । বলল, “হু, রেজাল্ট হয়ে যাবে ! মুখে তো সব সময়ই বলিস, অত চাপ নিচ্ছো কেন ! সাধে কি আর চাপ নিই ? তোর কাছে যা আশাকরি, যা তোর দেবার ক্ষমতা আছে তা দিচ্ছিস কই ? আমার শুধু কষ্ট হয় তুই নিজের উপর অবিচার করছিস বারবার । নিজেকেই ঠকাচ্ছিস এভাবে । তুই কি করতে পারিস এটা তোকে ভাবতে হবে । দেখবি সাফল্য তোর হাতের মুঠোয় এসে যাবে ।”
সৌম্যশুভ্র বাবার কথায় উত্তর করল না । শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে শক্ত খোলসের মধ্যে ঢুকে গেল । সৌরভদাও চুপ করে গেছে । বাবা তো, ছেলের ভবিষ্যৎ ভাবতে হয় বৈকি । সবাই মায়ের কথা বলে । সন্তানের ভালো-মন্দ, খাওয়ানো সব কিছুতেই মায়ের ছোঁয়া থাকে নিঃসন্দেহে । কিন্তু বাবার অবদান কি কম ? বাবারা শুধু দিয়েই যায়, আশা করে শুধুমাত্র সন্তানের প্রতিষ্ঠা । তাতেই তার গর্ব – লোকে বলবে অমুকের ছেলে । ছেলে খারাপ হলে লোকে বলবে অমুকের ছেলেটা মানুষ হল না। কেউ বলবে ভদ্রলোক ছেলেটাকে মানুষ করতে পারেনি । সব খারাপের দায়ভার নিতে হয় বাবাদের, মায়েদের নয় ।
নশ্বর দেহের খোলস থেকে বেরিয়ে মনটা এখন পঞ্চতরণীর পার্বত্য পথে ফিরে দেখছে । একদল বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দলে মধ্যবয়সী বিধবার সজল চোখের তারায় সেদিন কী ছিল না জানলেও তাকে ভুলিনি । পথ চলতে চলতেই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল অন্যান্য অনেকের সাথে । একসঙ্গে পথ চলেছিলাম অনেকটা । অংশুমানের মতো ওনার সঙ্গীরাও একটু পিছিয়ে পড়ছিল । আমরা দুজন একটু আগে হাঁটছিলাম । অনেক কথার শেষে বলেছিলেন, “এই দুর্গমপথে বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । আমি পেয়েছি । তাইতো আপনার সঙ্গে অনেককিছু শেয়ার করলাম ।”
সন্ধ্যের একটু আগে আবার দেখা হয়েছিল । মঞ্জুশ্রী দাস । নামটা তিনিই জানিয়েছিলেন । বেহালার দিকে কোথায় থাকেন যেন । আজ আর মনে নেই ।
অংশুমান ঘরে শুয়েছিল । আমি একাই বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । তিনিও তাই । আবার অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম ওনার সাথে । অনেক গল্প-কথা হয়েছিল পঞ্চতরণীর সেই অসাধারণ সন্ধ্যায় । সূর্যাস্তে রামধনু রাঙা আকাশের নীচে পাহাড়ের দীর্ঘ ছায়া তখন আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিচ্ছে উপত্যকার প্রতিটি কোণ । তাঁবুর ভেতরে জ্বলে উঠছে আলো । সামান্য হলেও আলোর ব্যবস্থা তো করেছে কাশ্মীর প্রশাসন । আচমকাই তিনিই কয়েকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আমার দিকে, “বলুন তো নারী-পুরুষের মিলন না হলে ভালোবাসা কি সম্পূর্ণ হয় কখনো ? শুধু ভাললাগায় ভালোবাসা জন্মায় ? ঘর না বেঁধে কাউকে শুধু ভালোবেসে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় ?”
উত্তর দিতে গিয়ে আমতা আমতা করছিলাম, “বড় কঠিন প্রশ্ন করেছেন, আমার কাছে এর উত্তর নেই কোন ।”
খুব কঠিন প্রশ্ন করেছিলেন তিনি । কেন করেছিলেন সেদিনও বুঝিনি, আজও বুঝি না, তবু মনে পড়ে যায় তাকে । আমি শুধু বুঝি উপযুক্ত সঙ্গী, মনের মানুষ খুঁজে না পেলেও ঘর বাঁধে মানুষ । সে ঘরে ভালোবাসা থাকতেও পারে নাও পারে । প্রয়োজন মেটে । তবে ঘর না বেঁধেও ভালোবাসা পাওয়া যায় ভালোবাসা দিয়ে । ভালোবাসা আর শরীর এক নয় ।
দেখা হয়েছিল আর একবার । অমরনাথের তুষারলিঙ্গের ছবি নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছিলেন । এসেছিলেনও । সেদিন চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে বলেছিলেন, তিনি নাকি স্বপ্ন দেখেছেন আমার সঙ্গে কামাখ্যার মন্দিরে গিয়েছেন । খুব আগ্রহ নিয়ে বলেছিলেন, আমি যদি তাকে নিয়ে কামাখ্যায় যেতে পারি তাহলে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় । যাইনি । বলেছিলাম, “আমার অত ধর্মে মন নেই । অমরনাথের পথে গিয়েছিলাম দুর্গম পথের টানে । ধর্মের টানে নয় ।”
আর কোনদিন দেখা হয়নি তার সঙ্গে । আমার মনের ঘরে বসত করা ভীতু মনটা সব সময় না হলেও কখনো কখনো পালানোর পরামর্শ দেয় । মঞ্জুশ্রী’র শ্রীবৃদ্ধি করার চেষ্টা করিনি ।
বাস ছেড়েছে অবশেষে । আবার চলতে শুরু করেছে গিরিপথে । উঁচু থেকে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে আমাদের বাস । বোধ হচ্ছে শিখরই ওর লক্ষ্য । আমার বাঁদিকের সিটে বসা লাদাখি যুবক- যুবতী খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে । স্বামী-স্ত্রী না প্রেমিক প্রেমিকা বোঝা না গেলেও ওদের প্রেমের গভীরতা আছে বুঝেছি । বাসে ওঠার পর থেকেই দেখেছি দুজন দুজনের খেয়াল রাখছে খুব । হিংসে হয় না, ভালো লাগে দেখে ।
ভয়ঙ্কর জোলিলা পাস অতিক্রম করতে করতে ভাবছিলাম একসময় এই পথ দিয়ে বানিজ্য করতে আসত মধ্য এশিয়ার ব্যবসায়ীর দল। এই পথ ধরে এসেছে শত্রুরাও । এখনও পাকিস্তানী হানাদাররা অতর্কিতে হানা দেয় বারবার । ভয় আর উদ্বেগ সঙ্গে নিয়ে চলতে হয় এ পথে । এর সঙ্গে আছে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা । অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত বরফে ঢাকা থাকে জোজিলা পাস ।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের অশান্তি চলছে স্বাধীনতার পর থেকেই । ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প – তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কাশ্মীরের মানুষ । কাশ্মীরের মানুষ দুটো দেশের উপরেই বীতশ্রদ্ধ । কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের একটা অংশ হয়ত আজাদ কাশ্মীরের পক্ষে, কিন্তু বড় একটা অংশ চায় শান্তি । ধর্ম নয় আগ্রাসনই যে পাকিস্তানের মূল উদ্দেশ্য সেটা বুঝে গেছে ওরা । আবার আফস্পা অর্থাৎ আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট –এর জোরে মিলিটারিরা অনেক ক্ষেত্রেই কাশ্মীরের জনগণকে সহবত শেখায় – এটাও মানুষ মেনে নিতে পারছে না । সেনাবাহিনীর জওয়ানদের দোষ নেই, তারাও তো জঙ্গি হানার শিকার হয় । কাশ্মীরে পোস্টিং মানে প্রতি মুহূর্তে প্রাণ হাতে নিয়ে চলা, দুঃসহ কষ্টের মধ্যে থাকা । দেশপ্রেমী সৈনিক যখন দেখে ভারত-পাকিস্তানের কোন খেলার দিনে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে তখন ক্ষুব্দ হবেই । রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষা করা, দেশকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা কর সেনাবাহিনীর কর্তব্য । কিন্তু কাশ্মীরের জনগণ সেনাবাহিনীর জওয়ানদের অত্যাচারটাই দেখে শুধু । তাদের ধনসম্পত্তি যে এখনও অবশিষ্ঠ আছে তার কৃতিত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর । আবার প্রাকৃতিক যে কোন দুর্যোগে তারা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার তুলনা কোথায় ?
সবুজ ফিরে এসেছে একটু একটু করে । ভেড়ার পাল চরে বেড়াচ্ছে তৃণভূমির সবুজ গালিচায় । পর্বতচূড়ায় বরফ, পাহাড়ের শরীর বেয়ে আসা তুষারনদী দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম । মাঝে মাঝে পাথর আর তাঁবুর ছেঁড়া ছেঁড়া কাপড়ে তৈরি অস্থায়ী আস্তানাগুলো দেখে মনে হল দরিদ্র মেষপালকরা রাত্রিবাস করে এখানে । ওরা ভারতীয় না পাকিস্তানী জানি না, জানি ওরা ভারী গরীব । গরীবের কি কোন দেশ হয় ?
সৌরভদা পেছনে তাকিয়ে বলল, “এই যে মেষপালকদের ডেরা দেখছো এরা কিন্তু আজ এখানে হয়ত কাল আর এক জায়গায় চলে যাবে । এরাও এক ধরণের যাযাবর । গ্রীষ্মকালে ভেড়া চরাতে চরাতে দ্রাস, কারগিল ওদিকে চলে যায় । শীতের আগেই আবার ফিরতে থাকে । এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড় । এক উপত্যকা থেকে আর এক উপত্যকা । চলতেই থাকে । এভাবেই শীতকালে পৌঁছে যায় জম্মুর বিভিন্ন উপত্যকায় ।”
“আর এদের পরিবার ?” জানতে চাই । রূপকুণ্ডের পথে দেখেছি গাড়োয়ালি মেষপালকদের । ওরা তিন-চার মাসের জন্য ঘর ছেড়ে ভেড়া চরাতে যায় বুগিয়ালে ।
“এদের অনেকের পরিবার সঙ্গেই থাকে । কারোর পরিবার হয়ত থাকে পাহাড়ি কোন গাঁয়ে । অদ্ভূত এদের জীবন । সারা বছর ধরে শুধু চলা আর চলা । পথ চলাতেই এদের জীবন, পথ চলাতেই মরণ । নেই কোন স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা, নেই কোন শিক্ষার অধিকার । প্রকৃতির শিক্ষাই একমাত্র অবলম্বন ।”
হায় রে ! স্বাধীন দেশের প্রত্যকটা মানুষের নাকি অধিকার- খাদ্য, বাসস্থান, আর শিক্ষার ? কোথায় ?
সরু ফিতের মতো একটা স্রোতস্বিনী, সবুজ মখমলের মতো ঘাস বিছানো প্রান্তরে একটা মারুতি কার হাত-পা মেলে দাঁড়িয়ে আছে । মানুষ চোখে পড়ল না । বাসের আওয়াজ পেয়ে লুকিয়ে পড়েছে কিনা কে জানে ! অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণে কাশ্মীর তো এভাবেই চলছে ।
পাঁচটা পাহাড়ে ঘেরা একটা ছোট্ট জলাশয় । দ্রোপদীকুণ্ড । দ্রোপদী নাকি এখানে স্নান করেছিলেন । পঞ্চপান্ডব পাহাড়ের ছায়া পড়েছে স্বচ্ছ জলাশয়ে । দ্রোপদীর স্নানের সময় পঞ্চপান্ডব বোধহয় এভাবেই পাহারায় ছিলেন । জনশ্রুতি আর লোকগাঁথা এভাবেই টিঁকে আছে এখনও । অতীত কথা বলে না ইতিহাসকে মনে করায় । যদিও সব অতীতই ইতিহাস নয় ।
তুঁতে নীলরঙা নদীর সাথে পাহাড়ের মিতালি । পূর্ণ যৌবনা নদী ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাথুরে বুকে । উলঙ্গ পাহাড় আকাশের নজর থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে সুন্দরীকে । থেমে গেল বাস । পাহাড়ের বুক চিরে চলা রাস্তা প্রকৃতির নগ্ন সন্ত্রাসের কবলে । বিশাল আকৃতির একটা পাথর কেউ ছুঁড়ে দিয়েছে রাস্তার উপর । ধস নেমে পথ অবরুদ্ধ ।
যন্ত্রদানবের সাহায্যে পাথর কাটার কাজ চলছে । পাহাড়ের শরীর বেয়ে এখনও ছোট ছোট পাথর গড়াচ্ছে । ছিটকে যাচ্ছে নদীর জলে । নদীর খুব কাছে কয়েকটা গাছ ঝুঁকে পড়ে মুখ দেখছে নদীর আয়নায় । লাস্যময়ী নদী একটু দূরে গিয়ে হারিয়ে গেছে দুই পাহাড়ের খাঁজে । রোদ্রের তাপে, ধুলোওড়া পথে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট ভুলে সৌম্যশুভ্র ছবি তুলছে একের পর এক ।
পথ পরিষ্কার হতেই আবার চলা । প্রকৃতির রূপ পাল্টাচ্ছে । ধূসর পাহাড়ের গা ঘেঁসে চলতে চলতে সবুজের মাঝে । চির সবুজের দেশ নয় । সবুজ আসে, সবুজ যায় । দূরে দূরে কালচে পর্বতের শরীরে বরফকুচি সূর্যের আলোয় চমকাচ্ছে । আমার পাশে বসা লোকটা আমার উপরে হেলে পড়ল । আমি একটু ঠেলা দিতেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসল । লাজুক হাসি । জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমিও হাসি । ভাবছিলাম সে বোধহয় কিছু বলতে চায় আমাকে । নাহ্ ! কিছুই বলল না । তবে সোজা হয়ে বসল ।
দিক বদল হয়েছে পাহাড়ের । বাঁদিকে পাহাড়, ডানদিকে উপত্যকা । উপত্যকার বুক চিরে ছুটে চলেছে আর এক পর্বতকন্যা । ছোট ছোট ঢেউ তুলে খিল খিল করে হাসছে আর কালো পাথরের শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে । পাথরগুলোও অদ্ভূত । চক্চকে । পাথর বলে মনে হয় না, যেন তাল তাল লোহা অর্ধেক শরীর জলে ডুবিয়ে বসে আছে ।
কে বলবে বিশ্বের দ্বিতীয় শীতলতম বসতি দ্রাস ? ন্যাড়া পাহাড়ে দুপুরের রোদে ভাজা হচ্ছে দ্রাসের মাটি । জনবসতি তেমন আছে বলে মনে হয় না । একটা সরাইখানা, টিনের ছাউনি দেওয়া কয়েকটা ঘর ছাড়া কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া একটা পাকা বাড়ি । ফুলের কয়েকটা গাছ, দুটো পপলার গাছ । বাইরে গেটের মাথায় লেখা- দ্রাস পুলিশ স্টেশন ।
শুকনো ঘাসজমি পেরিয়ে দূরে দূরে অনেকগুলো বরফমোড়া পাহাড় । দূরদর্শনের কল্যানে বারবার দেখা টাইগার হিল চিনে নিতে অসুবিধা হল না । কারগিল যুদ্ধের মূল ভূখণ্ড দ্রাস । ওই পাহাড়গুলোর কোথাও কোথাও লুকিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল পাক হানাদার । দীর্ঘ প্রাণঘাতী লড়াইয়ের পর আমাদের সেনাবাহিনী হটিয়ে দেয় হানাদারদের । কত মায়ের কোল খালি হয়ে গেছে, কত মেয়ে স্বামীহারা হয়ে গেছে, কত সন্তান পিতৃহারা হয়েছে এই বিজয়ের পথে । বারুদের গন্ধ আজ আর না থাকলেও ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে উপত্যকায় । কারগিল, দ্রাস, বাতালিক নামগুলো ভারতীয়মনে উৎকণ্ঠা আর আবেগের জন্ম দিয়েছিল সে সময় ।
শীতকালে দ্রাসের তাপমাত্রা হিমাংকের চল্লিশ ডিগ্রী নীচে নেমে যায় । কয়েক ফুট বরফের নীচে থাকা দ্রাস তখন ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে থাকে কোন অতন্দ্র প্রহরী । দেশকে ভালোবাসার দায়বদ্ধতা নিয়ে দেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রাম বা শহরের যুবক ।
সৌম্যশুভ্র ছবি তুলছিল । অদ্ভূতদর্শন একটা পাহাড় দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ওই চূড়াটা ওরকম চক্চকে কেন ?” প্রশ্নটা সৌরভদা না আমাকে জানি না । দুজনেই তাকালাম । ন্যাড়া মাথার একটা পাহাড় । বরফ রাজ্যে বাস করেও ওর শরীরে এক ফোঁটাও বরফ নেই । মসৃণ শরীরে একটা দাগও চোখে পড়ছে না । প্রকৃতির অদ্ভূত খেয়াল নাকি না বিজ্ঞানের বিষয় ! এতদুর থেকে এক একজন এক একরকম ভাববেই পারে । আমিও মজা করে বললাম, “ওটা তো টাকমাথা পাহাড় ।”
সৌরভদা হেসে ফেলল, “তুমি অমন বাচ্চা ভোলানো কথা বলে আমার ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া ছেলেকে বোঝাতে চাইছো ! কালাপাহাড় বললেও পারতে ।”
-নামটা কিন্তু জব্বর দিয়েছো আংকেল । পাহাড়টা কালো নয় কিন্তু । একটু অদ্ভূত রঙের । কিন্তু ওটার মাথায় বা গায়েও বরফ নেই কেন ! বড্ড চিন্তায় পড়ে গেছে । অবশ্য এ বয়সে কৌতুহল থাকাটাই স্বাভাবিক ।
চায়ের জন্যে মন উতলা হয়ে উঠেছিল । গোল বানরুটি দিয়ে চা খেলাম । সৌরভদা বানরুটি আর কেক দিয়ে এসেছে ছেলেকে । সৌম্যশুভ্র রোদের হাত থেকে বাঁচতে বাসে উঠে বসেছে আবার । বাসে বসেই খাচ্ছে ।
চায়ের পর ধুমপানের নেশাটা চাগাড় দিচ্ছিল । সিগারেটের প্যাকেট বের করতেই সৌরভদাও হাত বাড়াল । সৌরভদা সিগারেট বাদ দিয়ে দিয়েছিল অনেকদিন আগেই । তবু হাত বাড়াতে দেখে অবাক হয়েছি । সিগারেট নিয়ে সৌরভদা ছেলেকে দেখে নিয়ে জ্বালাল সিগারেটটা । একটা টান দিয়ে বলল, “ও ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করত না আমার সিগারেট খাওয়া । সঙ্গে আবার ইন্ধন জোগাত ওর মা । আমি তখন বলতাম, আমাদের সময় সিগারেট নিয়ে এত প্রচার ছিল না । বড়দের সামনে খেতে নেই জানতাম । বাবা-কাকাদের দেখেই শিখেছিলাম সিগারেট খাওয়া । সহজে কি আর বাদ দেওয়া যায় ? আস্তে আস্তে ছেড়ে দেব । ছেলেকে বলতাম, তুই কিন্তু একদম খাবি না । দেখছিস তো আমি ছাড়তে পারছি না । তবে কমাতে কমাতে ছেড়েও দিয়েছি প্রায় । লুকিয়ে দু’একটা খাই এখনো ।”
প্রচার মাধ্যম সমাজের ভাল-মন্দ দুটো দিক নিয়েই সক্রিয় এখন । তবু কোথায় যেন খামতি থেকে যাচ্ছে । মনকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে গিয়েও দেখছি সেখানেও অনেক প্রশ্ন । আমরা যা খাচ্ছি বা যা গ্রহণ করছি সবই তো বিষ ।
সৌরভদাকে কিছুটা উদাস লাগছে । কতকটা বিড় বিড় করে বলল, “আমি জানি আমার ছেলে কোন নেশা করে না । ওর নেশা হল মোবাইল । এটা যদি ছাড়াতে পারতাম !”
-তুমি অত চিন্তা কর কেন ? ও খুব ভালছেলে । ও নিজেই বুঝতে পারবে দেখে নিও ।
-চিন্তা কি আর সাধে করি ? ছাড়াতে পারছি না যে ! তার উপর ওদের হস্টেলে মদ, গাঁজা, ভাং সব চলে । কলেজের বাইরে দোকানগুলোতে সব নেশার জিনিস পাওয়া যায় । কর্তৃপক্ষ আর প্রশাসন একটু তৎপর হলে সব বন্ধ হয়ে যেত । সদিচ্ছার অভাব, বুঝলে ! রাষ্ট্র চাইলে এসব বন্ধ করতে পারে না তাতো নয় । কিন্তু প্রতি বছর দেশে যত ছেলেমেয়ে পাশ করে বের হয় তাদের কর্মসংস্থান করতে পারে না রাষ্ট্র । কিছু ছেলেমেয়ে এভাবে হারিয়ে গেলে কার কী এসে যায় বাবা-মা ছাড়া ? এখন তো আবার একটা নতুন নেশার আমদানি হয়েছে । অ্যাডহেসিভ। তা দিয়েও নাকি নেশা করছে ছেলেরা । সিগারেটটা ফেলে জুতোর নীচে পিষে দিল সৌরভদা, যেন ক্ষোভে হাতের কাছের শত্রুকেই শেষ করে দিল । তারপর ক্ষোভের সাথেই বলল, “আঠা দিয়ে যে নেশা করা যায় সেটা জানলাম একটা ছাত্র’র মৃত্যুর খবর শুনে । একটা অ্যাডহেসিভ দিয়ে নেশা করে প্রাণ গেল তরতাজা ছেলেটার ! মা-বাবার একমাত্র সন্তান । ভাবো !”
এ কোন সর্বনাশের দিকে চলেছে আমাদের সভ্যতা ? মদ, গাঁজা, হেরোইনের পর অ্যাডহেসিভ ! কাশির সিরাপ দিয়েও নাকি নেশা করা যায় ! লেখাপড়া ছেড়ে ছাত্ররা এসব কী করছে ? হতাশা, নাকি অনিশ্চয়তায় ভুগছে ছাত্রসমাজ ? নাকি মুনাফার লোভে এসব নেশার জিনিসের ব্যবসা করছে অসাধু ব্যবসায়ীর দল ? টাকার লোভে যারা দেশটাকে এভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ বা কোন আন্দোলন করতে দেখি না কোন রাজনৈতিক নেতা বা দলকে ।
দেশের জন্যে যুদ্ধে শহীদ হওয়া গৌরবের, কিন্তু নেশার ফাঁদে মৃত্যু বা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়ার মধ্যে কী বীরত্ব আছে ? ভয়ংকর নেশার টানে ছুটে যাচ্ছে দেশের লক্ষ লক্ষ যুবক । কেউ পাগল হয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ অপরাধী হয়ে যাচ্ছে । কে তাদের রক্ষা করবে ? স্বাধীনতার এত বছর পরেও নেশামুক্ত স্বপ্নময় একটা জগতের আশা করতে পারি না আমরা !
সর্ষের মধ্যেই ভূত ! দেশটাকে পঙ্গু করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে ঘরে-বাইরে । সীমান্ত সন্ত্রাস কিংবা আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দুটোই ধবংস না করতে পারলে তো দেশেরই সর্বনাশ !
আধুনিক কুরুক্ষেত্র দ্রাসকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি । পথ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে । একটা পথ বাতালিক সেক্টরের দিকে গেছে, একটা পথ কারগিলের দিকে । দুটো পথেই রুক্ষতা আর ধূসরতা মিশে আছে । মাটিতে মিশে আছে শহীদের রক্ত । চোখে না দেখা গেলেও অনুভব করা যায় । বাতালিকের পথটা উঁচু হয়ে বাঁদিকের পাহাড়ের দিকে চলে গেছে । কারগিলের পথটায় চড়াই কম । প্রায় সমতল ।
পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল গতিতে চলেছিল বাস । অনেকটা চলার পর সবুজ তৃণভূমি, গাছপালা আর শস্যক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছুটছি এখন । ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ সুরু ভ্যালিতে প্রবেশ করছি আমরা । লাদাখ অঞ্চলের সবচেয়ে উর্বর সুরু উপত্যকা । আর সুরু উপত্যকার প্রাণ কেন্দ্র হল কারগিল । ভারতে তো বটেই সারা পৃথিবীর লোকের কাছে পরিচিতি পেয়েছে যুদ্ধের জন্য, মানুষ বা প্রকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয় ।
(ক্রমশঃ)

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post