Sankars Creation

ধারাবাহিক উপন্যাস -দ্বিতীয় পর্ব

তপন বিশ্বাস

।। দুই।।
রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই হোটেল ছেড়ে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড । সেখান থেকে টাটা সুমোয় সওয়ারি হয়ে শ্রীনগর অভিমুখে যাত্রা । রেলপথের নির্মাণকাজ চলছে পথে । কয়েক বছর পর সরাসরি রেলপথেই পৌঁছে যাওয়া যাবে শ্রীনগরে । রক্ত চলাচল শরীরের সর্বত্র স্বাভাবিক না হলে অঙ্গহানি হওয়ার সম্ভবনা থাকে । সঠিক পুষ্টি পেলেই শরীর সুস্থ থাকতে পারে । দেশও একটা শরীরের মতো । দেশের পুষ্টির জন্যে চাই শিক্ষা, ভালোবাসা । দেশের মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার । দেশের মানুষের সাথে দেশের মানুষের আত্মীয়তা- বন্ধুত্ব । তার জন্যে চাই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ।
সৌম্যশুভ্র বেশ উপভোগ করছে পাহাড়ি প্রকৃতির সান্নিধ্য । সৌরভদার গুনগুনানির শব্দে খুশির আমেজ । নীল আকাশে সাদা মেঘের হাল্কা আড্ডা । সূর্যালোকে প্রকৃতি প্রসন্ন চিত্তে ঘরছাড়াদের মন ভরানোর সব উপকরণ সাজিয়ে দিচ্ছে একে একে । পাহাড়, বনভুমি, জনপদ ঘিরে চক্কর কাটছে আমাদের বাহন সকালের সোনালি রোদ গায়ে মেখে ।
বানিহাল টানেলে ঢুকছে গাড়ি । প্রায় দু’কিমির গুহাপথ । ভেতরে আলো থাকলেও উজ্জ্বলতার অভাবে ধুঁকছে গাড়ির ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া টানেল । অক্সিজেনের অপ্রতুলতা আর কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য শ্বাসকষ্টের কারণ হলেও বানিহাল টানেল স্মৃতিকোঠায় স্থায়ী জায়গা করে নেয় । আমার মতে কাশ্মীর ভ্রমণে প্রথম চমক এই বানিহাল বা জওহর টানেল । টানেল শেষ হয়েছে পাহাড়ের অন্য প্রান্তে কাশ্মীর উপত্যকায় । চমক লাগে টানেলের দু’প্রান্তে দু’রকম প্রকৃতি ! ওপারের বিশাল কাশ্মীর উপত্যকা সাদর আমন্ত্রণ জানায় ভ্রমণার্থীদের । স্মরণীয় এই মুহূর্ত এ পারের মানুষকে পীড়াও দেয় । এই টানেলেই বন্দী হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় । বন্দী অবস্থায় কাশ্মীরে মৃত্যু হয় তাঁর । ধর্ম বা ভাষা নয় এপার-ওপারের মানুষ মানুষের রাজনীতির শিকার । রাজনীতি মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ সৃষ্টি করে সবচেয়ে বেশি । এটা কবে বুঝবে মানুষ ?
হলুদ রোদে গা পেতে উষ্ণতা শুষে নিচ্ছে উপত্যকার মাটি । নীল সবুজের মিতালিতে খুশির ছোঁয়া। ভূস্বর্গ হাসছে উইলো গাছের পাতায় পাতায়, ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের ইতিউতি ঘোরা ফেরায় ।
-উইলো গাছ চেনো সৌম্য ? ওই যে লম্বা লম্বা সোজা সোজা গাছগুলো দেখছ সেগুলোই উইলো গাছ । ক্রিকেট ব্যাট তৈরি হয় উইলো কাঠ দিয়ে । জানো বোধহয় ?”
-আমি জানি । এর আগে ছবি দেখেছি, এবার চোখে দেখলাম । এখন চিনার গাছ দেখার জন্য উৎসুক হয়ে আছি । ছবিতে দেখেছি চিনারের পাতাগুলো কী সুন্দর দেখতে ! কথা শুনে মনে হল সত্যি সত্যিই ব্যগ্র সে । সৌরভদা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, “অবশ্যই দেখতে পাবি চিনার । কিন্তু চিনারের সোনালি-লাল পাতা দেখতে পাবি না এখন । শরৎকালে দেখা যায় ওই রঙ । এখন চিনারের সবুজ দেখেই মন ভরাতে হবে তোকে ।”
খানবলের ঘিঞ্জি মার্কেট, অবন্তীপুরের ধবংসাবশেষ, পামপুরার জাফরানের শুকনো ক্ষেত পেরিয়ে শ্রীনগরে পৌঁছাতে প্রায় তিনটে বেজে গেল । রাস্তা তেমন ভালো নয় । জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজম অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নামলাম আমরা । সঙ্গে সঙ্গে ঘেরাও হয়ে গেলাম কাশ্মীরিদের দ্বারা । ‘হোটেল চাইয়ে,বাবুজী ?’ ‘গেস্ট হাউস ?’ ‘আইয়ে সাব, ভালো হোটেলে নিয়ে যাবে আমি’ । নানা জনের নানা কথার মধ্যে ওদের বোঝানোর চেষ্টা করছি আমাদের হোটেল ঠিক করা আছে রাজবাগে । সৌরভদাকে আগেই বলে রেখেছিলাম রাজবাগের দিকে মাঝারি মানের একটা হোটেল দেখে উঠব । একটা অটোর জন্যে এদিক ওদিক দেখছি, কেউ কেউ জানতে চাইছে, কোন হোটেল ? আমি উত্তর না দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছি, “আপলোগ যাইয়ে না ।”
ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন বলে উঠল, “বাবুজী, আপ ?” এগিয়ে এল ঢ্যাঙা চেহারার একটা লোক । কাশ্মীরি জোব্বায় আমার তো সব কাশ্মীরিকেই একইরকম লাগে তবু চিনতে পারলাম ওকে । হামিদ- কাশ্মীরি শালওয়ালা । শীতের সময় আমাদের পাড়ায় শাল বিক্রি করতে যায় । বাবু’র দোকানে প্রায়ই দেখি । আমাদের পাড়াতেই বাসা ভাড়া করে থাকে ওরা কয়েকজন । আমি ওদের কারোর কাছ থেকেই কোনদিন কিছু কিনিনি তবু দেখা হলেই হাসে, কুর্নিশ জানায় । হামিদ এগিয়ে আসতেই ভীড় হাল্কা হতে শুরু করেছে । হামিদকে দেখে হেসে পরিচিতির সীল মোহর দিতেই বাকিরা উধাও । হামিদ আমাদের দুটো ভারী ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, “আইয়ে বাবুজী ।” বলেই হাঁটতে লাগল সে । বাধা দেওয়ার সময়ই পেলাম না । পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানি কাশ্মীরে কমিশন প্রথার ভালোই চল আছে । কিন্তু বিদেশ বিভূঁইয়ে পরিচিত কোন মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে তাকে অস্বীকার করি কী করে ? মনে আশঙ্কা নিয়ে ওর পিছু নিলাম । সত্যি সত্যিই তো আমাদের কোন হোটেল বা গেস্ট হাউস ঠিক করা নেই । যেতে যেতেই ওকে প্রশ্ন করি, “আপ কঁহা লে জা রহা হ্যায় ?”
পেছনে ফিরে এক গাল হেসে সে বলল, “মেরা এক দোস্তকা গেস্ট হাউস হ্যায় বাবুজী । বঢ়িয়া ঘর । খানে কা বন্দবস্ত ভি হ্যায় ।”
বুঝলাম হামিদ আমাদের ভালোই খসাবে । সৌরভদাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “কী যাবে ?” সৌরভদা হাত উল্টে যা ইশারায় দেখাল তার মানে একটাই দাঁড়ায়, উপায় কি ? মুখে বলল, “দেখাই যাক না ।”
হামিদ একটা অটো দাঁড় করাল রাস্তার ওপারে গিয়ে । একা একা অনেক বেড়িয়েছি । আজ পর্যন্ত সেখানকার মানুষদের কাছ থেকে কোনদিন বিপদ হয়নি । এখানে তো একজন চেনা মানুষের সাথে যাচ্ছি । আমার বরং ট্রেনে বেশি ভয় করে, তাই সতর্ক থাকি ।
রাজবাগের হোটেল চত্বর পার হয়ে মডার্ণ হসপিটাল রোড ধরে এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকের ঢালু একটা পথে নেমে গিয়ে একটা ছোট মাঠ আর দুটো বাড়ির পর ভারী লোহার গেট ওয়ালা বাড়িটার সামনে দাঁড়াল আমাদের অটো । এটা একটা জনবসতিপূর্ণ এলাকা । বেশি পুরানো নয় বাড়িঘর দেখলেই বোঝা যায় । এ বাড়িটার চারদিকে উঁচু করে দেওয়া টিনের বেড়া । তিনতলা গোলাপী রঙের বাড়ি । হামিদ একাই নেমে গেল । ভারী গেট ঠেলে ঢুকে গেল বাড়িটার ভেতরে । ভয় ভয় করছিল কিন্তু প্রকাশ করলাম না, সৌম্যশুভ্র ভয় পেয়ে যাবে ভেবে । সৌরভদাকে দেখলাম কেমন নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে । সৌরভদা অবশ্য এমনই । ধীর-স্থির, যাকে বলে স্থিতধী । শুধু দেখছি ইদানীং ছেলেকে নিয়েই একটু চিন্তিত । বাবা তো !
একটু পরে হামিদ বেরিয়ে এল গেট ঠেলে । এসেই আমাদের ভারী ব্যাগদুটো তুলে নিল কাঁধে । “আইয়ে বাবুজী ।”
গা ছম ছম করে উঠল । সৌরভদার মুখের দিকে তাকালাম । সৌরভদা ফিসফিস করে বলল, “পছন্দ না হলে বেরিয়ে আসব ।” সৌম্যশুভ্রকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর বাড়িটাই পছন্দ হয়নি । ভুরু কুঁচকে রয়েছে ওর ।
সামনের একটা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বেঁটে খাটো চেহারার একজন লোক । কাশ্মীরি জোব্বা না থাকলে তাকে কাশ্মীরি ভাবতেই পারতাম না । মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল সে । হামিদ পরিচয় করিয়ে দিল, “মজিদ, গেস্ট হাউসকা মালিক । ঔর মেরা দোস্ত ।”
কে যে কার দোস্ত কে জানে ! তবে এসেছি যখন তখন ঘরগুলো তো দেখতেই হয় । ওরা প্রথমেই তিনতলায় তিন শয্যার একটা ঘরে নিয়ে গেল আমাদের । বেশ বড়সড় ঘর । অ্যাটাচ্ড ওয়াশরুম । দক্ষিণের খোলা জানলার ওপারে একটা এল প্যাটার্নের লম্বাটে বাড়ি । সামনে ছোট মাঠ । ইটের পাঁচিল ঘেরা বাড়িটা সম্ভবত স্কুল ।
কোন হোটেল বা গেস্ট হাউসে নয়, মনে হল কারোর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি । সে আত্মীয় হতে পারে, বন্ধু হতে বা অন্য কেউ । আমাদের ঘরের উলটোদিকে সিঁড়ির অন্যপ্রান্তে ছোট ছোট দুটো ঘর আছে আরো । খোলাই রয়েছে ঘরগুলো । কেউ নেই ।
সৌরভদা আমাকে ইশারায় ভাড়া জিজ্ঞেস করতে বলল । হামিদকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, “ও সব বাদমে হোগা বাবুজী । আপলোগ মেরা মেহমান । আরাম কীজিয়ে । চা-পানি পীজিয়ে । ম্যাঁয় আপলোগোকা সামান লাকে দেতা হু ।”
-নেহী হামিদ ভাইয়া । রুপিয়াকে বাড়েমে পহেলেই বাত হোনা চাইয়ে । পিছে ঝামেলা ঠিক নেহী । আমার কথা জানিয়ে দিলাম স্পষ্ট করে ।
হামিদ নয় বাড়ির মালিক মাথা নেড়ে বিনয়ের সঙ্গে বলল, “বাবুজী, রুপাইয়া তো জরুর লেঙ্গে । ইস লিয়েই তো এ ঘর বনায়া । এহিসে মেরা দিন গুজরান হোতা হ্যায় । পরিবার চলতা হ্যায় । লেকিন এভি তো ঠিক- আপলোগ হামিদ ভাইয়াকা মেহমান, মতলব মেরা ভি কুছ লাগতা হ্যায় ।”
মেহমানই বটে ! বুঝতে পারছি হামিদ একজন দালাল । সে টুরিস্ট ধরে আনে । আর এই লোকটা বাড়িকে গেস্ট হাউস বানিয়ে ব্যবসা করছে । প্রথমে ভালো ভালো কথা বলে, খাতির করে – তারপর জবাই আর কি !
সৌরভদাকে জিজ্ঞেস করি, “কী করবে ? ঘরটা তো ঠিকই আছে কিন্তু টাকাপয়সার ব্যাপারটা ঠিক না হলে কী করে হ্যাঁ করি ? এরা তো এমন করছে যেন আমরা থাকছিই !”
সৌরভদা কিছু ভাবছে । বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্ধ নাকি কিছু বলতে ভয় পাছে সৌরভদা ? সৌরভদাকে আমি ভরসা করি । এই মহাসংকটে সেই উদ্ধার করতে পারে আমাকে । হামিদ আমার পরিচিত, সৌরভদার নয় । সৌরভদা বলতেই পারে, না, আমার পছন্দ হয়নি । অন্য কোথাও চল ।
অবিশ্বাসের বাতাবরণের মধ্যে আমাদের থাকাটা সেফ নাও হতে পারে ভাবছি । যতদূর দেখেছি বা বুঝেছি তাতে মনে হচ্ছে জায়গাটা শুধু স্থানীয় লোকজনই থাকে । বাইরের সাহায্য চট করে পাওয়া মুশকিল। সৌম্যশুভ্র নির্বিকার । খাটে বসে পা দোলাচ্ছে আর এদিক ওদিক দেখছে । সৌরভদা ঠোঁট কামড়ে ধরে এখনও ভাবছে । হামিদ কখন বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে ।
-ঠিক আছে দেখি না । মাত্র তো দু’দিনের ব্যাপার । দেখি কেমন অতিথি আপ্যায়ন করে এরা । তাছাড়া বেড়াতে বেরিয়েছি, এদের দেশেই এসেছি । এদের বিশ্বাস তো করতেই হবে । এরাও তো মানুষ । মানুষকে অবিশ্বাস করে জেতার চেয়ে মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকাও ভালো । সৌরভদার কথা শুনে আশ্বস্ত হলাম । ঠিক । আজ যদি আমাদের বোকা বানিয়ে ওরা বেশি টাকা নেয় তবে হামিদকে তো কোলকাতায় পাব ।
অতিথি হয়ে গেলাম মজিদের । হামিদ আমাদের ব্যাগগুলো দিয়ে গেছে । মজিদ এক জার জল আর তিন কাপ চা দিয়ে গেছে ।
সৌরভদা তাড়া লাগাচ্ছে, “বাবি, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে । আমরা তো শুধু কালকের দিনটা পাচ্ছি শ্রীনগর ঘোরার জন্যে । চল, আজ একটু ঘুরে নি ।”
আমারও তাই মত । শ্রীনগর আমার কাছে নতুন নয় তবু ঘরে বসে ভূস্বর্গের সন্ধ্যাবেলাটা নষ্ট করার মানেই হয় না । ঘড়ির কাঁটা একই পথ ধরে বারবার চলে কিন্ত চলতেই থাকে । চলাটাই তো জীবন । অনেক সময় অপচয় করে আজ বুঝতে পারি সময়ের মূল্যটা । সময় হল ক্ষণিকের অতিথি । যে মুহূর্তটা চলে যায় সেটা আর ফিরে আসে না । কে বলতে পারে আগামী একটা মুহূর্তই বিশেষ কোন উপহার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিনা !
সিঁড়ির শেষধাপে নামতেই হামিদ বেরিয়ে এল একটা ঘর থেকে যেন সে আমাদের আসার প্রতীক্ষায়ই ছিল । মজিদও বেরিয়ে এসেছে হামিদের পেছনে । হামিদই জিজ্ঞেস করল, “রাতকা খানা খাইয়েগা বাবুজী ?”
-ক্যায়া মিলেগা ? সৌরভদার প্রশ্ন ।
-রাইস, চাপাটি, ডাল-সব্জি, অন্ডা, চিকেন জো মাঙ্গিয়েগা । মজিদ হাসিমুখে জানায় ।
-এখানেই যখন খাবার পাওয়া যাবে তবে রাতে বাইরে খেতে যাব কেন ? সৌরভদার কথায় সহমত আমিও । “তুই কী খাবি ?” সৌম্যশুভ্রর কাছে জানতে চায় সৌরভদা ।
-চিকেন । সৌম্যশুভ্র ওর পছন্দের খাবারের কথাই বলে ।
সৌরভদা খুব বিরক্ত এবারে, “চিনেছিস এক চিকেন ! বেড়াতে এসেছিস এদের হাতে তৈরি ডাল-ভাত খেয়ে দেখবি তো কেমন রাঁধে এরা ! এখানকার শাকসবজির স্বাদ কেমন, কী খায় এরা সেটা না জানলে কিসের ভ্রমণ ! ট্রেনে তো চিকেন খেয়েছিস ! কাল দুপুরে আবার না হয় খাস ।”
সৌম্যশুভ্রর মুখ ব্যাজার । কষ্ট হল ওকে দেখে । বললাম, “সৌরভদা, ডাল-তরকারির সাথে ডিমের কারি বলি ?”
সৌরভদা বুঝল আমার উদ্দেশ্য । হেসে সায় দিল, “বল।”
সৌম্যশুভ্রর দিকে তাকাতেই সেও ঘাড় নেড়ে সায় দিল হাল্কা হাসিতে । এ যুগের ছেলে । নিরামিষে মন ভরে না । দোষটা অবশ্যই বাবার চাইতে মায়ের বেশি । এক একটা সন্তান । মায়েরা খাইয়ে খাইয়ে এমনটাই তৈরি করছে ওদের । একটা ডিম সূতো দিয়ে দু’ভাগ করে খেতে শেখেনি এরা । এক থালায় ভাত মেখে ভাইবোন মিলে একসাথে খায়নি কখনো । কি করে খাবে ? তাই চিলি চিকেন, চিকেন কষা খেতে খেতে দূরে ঠেলে দেয় শাকসবজি । থোড়-মোচার তো নামই শোনেনি অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালির সন্তান ।
হামিদ সঙ্গে সঙ্গে আসছিল । জিজ্ঞেস করল, “ডাল লেক যানা হ্যায় বাবুজী ?”
-যায়েঙ্গে । মনে মনে বললাম, ব্যাটা দেখছি পিছু ছাড়ছে না ! কী যে ওর উদ্দেশ্য কে জানে ! সন্দেহের বীজ একবার মনে বসে গেলে তাকে হঠানো খুব মুশকিল ।
রাজবাগে নির্মাণ কাজ চলছে জোরকদমে । পথের দু’ধারে অনেক হোটেল গড়ে উঠেছে নতুন নতুন । একবার একটা গুজরাটি হোটেলে উঠেছিলাম এখানে । কাশ্মীরের বিখ্যাত ‘গুস্তাবা’র কথা জিজ্ঞাসা করতেই ম্যানেজার বলেছিল, “মৎ খাইয়েগা বাবুজী । ও বীফসে বনতা হ্যায় ।”
গুস্তাবা গরু নয় ভেড়ার মাংস থেকে হয় জানি । ভেড়ার মাংস পিটিয়ে পিটিয়ে নরম করে ছোট ছোট বল করা হয় । হাল্কা মশলার সাথে রান্না করা হয় তারপর । গুস্তাবার প্রসিদ্ধি শুনেছি – খাওয়া হয়নি আজও ।
ভূস্বর্গের একটা বড় আকর্ষণ চিনার গাছ । অবশ্য গাছ না বলে একে বৃক্ষ বলাই ভালো । গাছ তো সবই, বৃক্ষ আর ক’টা হয় ! বৃক্ষকে গাছ বলা মানে পুরুষমানুষকে ছেলে বলার মতো । জিরো ব্রীজের ডানদিকে একটা বড় পার্ক আছে সেখানে অনেকগুলো চিনার বৃক্ষ । সৌম্যশুভ্রকে দেখিয়ে দিতেই সে শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠবে ভেবেছিলাম কিন্তু তা হল না । চোখদুটো ওর খুশিতে ভরে উঠেছে নিঃশব্দে পানপাত্রের মতো । খুশি উপচে পড়লেও বোধহয় ওর মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখতে পাওয়া যাবে না । অবাক হয়ে ভাবছি ছেলেটার মধ্যে অনুভূতি, আনন্দ, আবিষ্কারের নেশা, সুন্দর দুটো দেখার চোখ সব থাকা সত্বেও সে কেন উচ্ছ্বাসহীন ? কেন সে আমাদের মতো নয় ? সে চিনার চিনতে বিভোর হয়ে আছে নাকি পার্কের ফুলগাছের ভিড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে নিজের কোন প্রিয় ফুলকে কে জানে ?
চিনার বৃক্ষের ছায়ায় পার্কের ভেতরে আলো-আঁধারির জগত। বাগানটা সুন্দর হলেও কেমন যেন রহস্যময় ! একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে ওর আনাচে কানাচে । নাহ্, কেউ বলেনি, ভয়ও দেখায়নি । আমার মনে হল । আসলে একটু অস্বাভাবিকতা দেখলেই বোধহয় আমাদের মনের ভেতরে কু ডাকতে শুরু করে ।
হেঁটে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে । বেড়ানোর মজা হেঁটেই । তাছাড়া ডাল লেকের দূরত্ব এখান থেকে খুব বেশি না ।
-কী সৌরভদা, ডাল লেক হেঁটে যাবে তো ? সৌম্যশুভ্র, রাজী ? তাই হামিদ যখন জানতে চাইল অটো দাঁড় করাবে কিনা তখন মাথা নেড়ে না করে দিয়েও ওদের মতটা জানা উচিত মনে করে জিজ্ঞেস করলাম ।
সৌরভদা জানতে চাইল, “কতদূর ?”
-কাছেই । হেঁটে গেলে কুড়ি পঁচিশ মিনিট লাগবে বোধহয় ।
-তবে হেঁটেই চল । সৌরভদা তো হেঁটে যাওয়ার কথা বলল কিন্তু ওর ছেলে ? ওতো কিছু বলল না ! সে বলবেই বা কী ! জিরো ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে সে যে ভুস্বর্গের সুবাস নিচ্ছে । ওদিকে পশ্চিম আকাশে তোড়জোড় চলছে দিনের অন্তিম ঘোষণার । লাল টক্টকে থালার মতো সূর্যটা শরীর নিংড়ে লাল রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশের নীলে । দুইয়ে মিলে নানা রঙের আবির ছড়াছে ভুস্বর্গের দিগন্তে । ওদিকে চিনারের শরীর বেয়ে নামছে অন্ধকারের স্রোত । সে স্রোতের কম্পন এসে পড়ছে ঝিলমের স্রোতে । ঝিলমের ছোট ছোট তরঙ্গে সুরের মুর্ছনা । সৌরভদার কন্ঠে জেগে উঠেছে রবিঠাকুর –
“সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল, যেন খাপে-ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার ।”
সৌরভদা ভালো আবৃত্তি করে জানতাম । ওর মধ্যে একটা কবিমন আছে বলেই সৌরভদা আজও রোমান্টিক । আর সৌরভদার ছেলে বোধহয় ভাবুক । কথা কম, ভাবে বেশি ।
ডাল লেকে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে । হাউস বোটগুলোতে আলো জ্বলছে । সারি সারি বোটের আলোয় অপরূপা ডাল । ঝিকিমিকি রাত হাসিমুখে অভ্যর্থনা করছে তার ঘরের অতিথিদের । কে বলবে কাশ্মীরের জনজীবন বিচ্ছিন্ন ?
সৌরভদাকে একটা ছোট্ট ঠেলা দিয়ে বললাম, “বৌদিকে নিয়ে এসো একবার । কয়েকদিন কাশ্মীর বেড়ানোর সঙ্গে সুন্দর সাজানো গোছানো একটা হাউস বোট ভাড়া করে থেকে যেও একদিন । জীবনের সেরা মধুচন্দ্রিমা পালন করতে পারবে ।”
সৌম্যশুভ্রকে আড়চোখে দেখে নিল সৌরভদা । সৌম্যশুভ্র ছবি তুলতে ব্যস্ত দেখে গোঁফের ফাঁকে হেসে বলল, “তোমার বুঝি অভিজ্ঞতা আছে ?”
-হ্যাঁ, কিছুটা তো আছেই । মধুচন্দ্রিমাই বটে ! সত্যি সৌরভদা, ডাল লেকের ওই হাউস বোটে ঢুকলে নিজেকে রাজা রাজা মনে হয় । তবে সঙ্গে রাণী না থাকলে ভিখারীর মতো মন নিয়ে হা হুতাশ করতে হয় । অমরনাথ থেকে ফিরে একদিন হাউস বোটে ছিলাম আমরা দুই বন্ধু । খাওয়ার আগে আর পরে মিলিয়ে অর্ধেক রাতের বেশি সময় ধরে বসে ছিলাম হাউস বোটের ডেকে । একটা স্বপ্নের জগত অথচ স্বপ্ন দেখার সঙ্গিনী সঙ্গে নেই । কী অভিশপ্ত সে রাত ! আজও ভাবি সে রাতটা বরং হোটেলের ঘরেই কাটালেই ভালো করতাম । সব জায়গাই সব মানুষের জন্যে নয় ।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই সৌরভদা বলে উঠল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি সে গল্প । তুমিই বলেছিলে । তোমার সেই বন্ধু- কী যেন নাম – মনে পড়ছে না । তার নাকি ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল সেবার ?” সৌরভদার সঙ্গে আমিও সশব্দে হেসে উঠলাম । সৌম্যশুভ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে হাত নেড়ে জানালাম, কিছু না ।
সে বুঝতে পারল আমরা কোন হাসি বা মজার কিছু নিয়ে আলোচনা করছি । নিজের কাজে মন দিল সে । সৌরভদার প্রসন্ন মুখে বাতিস্তম্ভের আলো এসে পড়েছে একটু তেরচাভাবে । একদিকের তুলনায় আর একটা দিক বেশি উজ্জ্বল তাই । পুত্রের খুশিতে না আমার বন্ধুর কথা মনে করে সৌরভদা বুদ্ধের হাসি হাসছে জানি না, তবে এই হাসিখুশি নিয়েই তো থাকতে চাই । বললাম, “হ্যাঁ, ভয়ংকর অবস্থাই বটে ! হাউস বোটের রাজকীয় আতিথিয়তা আর জৌলুস ওকে আরো দুঃখী করে দিল । সঙ্গী হারা পাখির মতো কিচির মিচির করতে লাগল অংশুমান, ‘এতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল অথচ শ্রেয়াকে দেখাতে পারলাম না । আহা রে ! বেচারা কাশ্মীর বেড়াতে চেয়েছে কতবার !’ ভালো করে খেতে পারেনি । চিকেন তো মুখেই দিতে চায়নি । এক বোল ভর্তি একটা গোটা চিকেন আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব ! জোর করে খাইয়ে ছিলাম ওকে । অর্ধেকের বেশি খাবার ফেলে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম । তারপর শ্রেয়াহীন রাতটা অংশুমানের কী দুঃসহ যন্ত্রণায় কেটেছিল দেখেছি । অমরনাথের দুর্গম পথেও ওকে এত কষ্ট পেতে দেখিনি সৌরভদা । শারীরিক আর মানসিক কষ্টের ফারাকটা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ভালো করে । উপলব্ধি করেছিলাম এক চরম সত্য – মানসিক যন্ত্রণা শারীরিক যন্ত্রণায় চেয়ে অনেক বেশি পীড়াদায়ক । বুঝেছিলাম স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যেকার ভালোবাসা যে কোন বন্ধুত্বের উপরে ।
সৌরভদার মুখে দুষ্টুমির হাসি, “তুমিও তাহলে বোঝো সেটা ! আমি ভাবতাম তোমার মধ্যে বোধহয় সে ফিলিংস নেই ।”
বোকার মতো করে হাসি, “না বোঝার কী আছে সৌরভদা ! দুই বন্ধুর মাঝে যখন প্রায়ই কোন নারী এসে পড়ে, বিশেষতঃ সে নারী যখন একজনের স্ত্রী, আর সেই বন্ধু বারবার তার স্ত্রীর কথাই বলছে তখন তো যে কেউ বুঝবে স্ত্রীর জায়গা কোথায় । এটা আমি এখন ভালো করেই বুঝি যে বন্ধু হল পথের সাথী, ঘরণী ঘর ও মনের ।”
-তুমি তো বেশ দার্শনিকের মতো কথা বললে ! বন্ধু হল পথের সাথী, ঘরণী ঘর ও মনের ! কতকিছু লুকিয়ে আছে এই ছোট্ট কথাটার মধ্যে । এর ব্যবহারিক প্রয়োগ যে করতে পারবে সে নিঃসন্দেহে খুব সুখী হতে পারবে, কিন্তু কথাটা সত্যি হলেও প্রয়োগ করা খুবই কঠিন বাস্তবে । মনের ব্যাপারগুলো সব সময় শেয়ার করা যায় না স্ত্রীর সাথে । বরং অনেক সময় বন্ধুর সাথে শেয়ার করা যায় ।
-সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন মিল ও ভালোবাসা হয় কিনা খুব বেশি ধারণা অবশ্য আমার নেই । আসল কেমেস্ট্রিটাই তো জানি না । তাছাড়া সব বন্ধুই আবার পথের সাথী হতে পারে না –কেউ কেউ কুপথের সাথীও হয় । সৌরভদা বিচক্ষণ মানুষ । মনের গভীরতাও অনেক । তাই উচ্ছ্বাস কম, ভারটা বেশি । কথাগুলো বলে সৌরভদার জবাবের আশায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম অপলক দৃষ্টিতে ।
বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো পেছনে ঠেলতে ঠেলতে সে কিনা বলল, “চল, ওদিক থেকে ঘুরে আসি।” পলকহীন চোখের ভাষা বদলে গেল আমার । আমি বিস্মিত ! ভেবেছিলাম সাংসারিক জীবনের অনেক কথা জানতে পারব সৌরভদার কাছে থেকে । বন্ধুত্বের কথাটা না হয় আমি বুঝি কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারটা তো আমার চেয়ে দাদার বেশি জানা । উপদেশ দেবার এমন একটা মওকা ছাড়ল কীভাবে ! সৌরভদাকে আমার এখনও চেনা হয়নি বুঝলাম ।
হামিদ এতক্ষণ আমাদের সাথে সাথে থাকলেও একটু দুরত্ব বজায় রেখেছিল । সে হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, “আপলোগ এঁহা সে এক অটো পাকাড়কে রাজবাগ চলে যানা । ডরনে কা কোই বাত নেহী হ্যায় এঁহা । সালাম বাবুজী ।” বলে সে আর দাঁড়াল না । দ্রুতপদে চলে গেল সামনের দিকে। তাকিয়ে ছিলাম ওর গমন পথের দিকে । ডানদিকের একটা রাস্তায় ঢুকে গেল সে । সৌরভদা বলল, “ভালোই হল । বেচারা হয়ত নিজের কাজ নষ্ট করে আমাদের সময় দিচ্ছিল ।”
জুন মাসের মাঝামাঝি । ভিড় নেই তেমন । গুটিকয়েক বাঙালি পর্যটক ডাল লেকের তীরে বাঁধান চাতালে বসে ডালের সৌন্দর্যে বিভোর । দোকানপাটেও ভিড় নেই তেমন । ভয় আর অস্থিরতা দুইয়ে মিলে কাশ্মীরসহ শ্রীনগরকে শ্রীহীন করে তুলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে । পর্যটকের অভাবে ধুঁকছে ডালের ব্যবসা বাণিজ্য ।
-কেমন নিরুত্তাপ আর ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে শহরটাকে । যেন বরযাত্রীহীন বিয়ে বাড়ি ! আলোর রোশনাই আছে সানাই নেই । ভূস্বর্গের মাটিতে হানাহানি বন্ধ হলে আর একবার আসব সপরিবারে । ডাল লেকের হাউস বোটে থাকব সেবার । উপভোগ করব রাতের ডাল, কী বল ?
-ঠিক বলেছ সৌরভদা । এবার চল ফেরা যাক ।
-আর একটু থাকি না ? ছেলেটা বেশ এনজয় করছে । মধুচন্দ্রিমা না হয় নাই হল ভালো লাগাটা তো আছে । এর পর আর কোনদিন আসা হবে কিনা কে জানে ? আপনমনেই বিড়বিড় করে সৌরভদা ।
রাত ন’টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালাম । ভয়ের মুখোশ পরে কেউ আসেনি ভয় দেখাতে । ডালের জলজ হাওয়ায় মন ভিজে গেল অগ্রহায়নের রাতের শিশির-পরশের মতো । ফেরার সময় সৌম্যশুভ্র বলল, “কাল কিন্তু আর একবার আসব এখানে ।”
সৌরভদা ছেলের কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে বলল, “আসবই তো ! শিকারায় চেপে ডাল লেক ঘুরব না ?”
চমৎকার রেঁধেছে মজিদের বিবি । ডাল, সবজি আর ডিমের ঝোল । সৌম্যশুভ্র চেটেপুটে খেল । অবশ্য খিদেও পেয়েছিল খুব । আসার পথে এক জায়গায় দুপুরে ভাত খাওয়া হলেও বিকেলে তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি ।
মজিদ একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে দেখেছি । খাওয়ার পর প্লেট নিতে এলে জানতে চাইলাম, “ক্যাঁয়া হুয়া মজিদ ভাই । কভি চোট লাগ গিয়া থা ?”
মজিদ একটা গল্প শোনাল । সব মানুষের জীবনে যেমন গল্প থাকে হয়ত তেমনই একটা গল্প । তবু ওর জীবনের গল্পটা শুনতে শুনতে ঢুকে গেলাম গুলি-বোমার শব্দের মধ্যে অতি সাধারণ মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় । এই ইতিহাসের পাতাগুলো স্থান পায় না সরকারি নথিতে, স্থান পায় না স্কুল-কলেজের ইতিহাস বইয়েও ।
একটা সময় খুব খারাপ অবস্থা গেছে ওর । রাজনৈতিক অস্থিরতা, সন্ত্রাসবাদী হামলা, মিলিটারির ভারী বুটের আওয়াজের সঙ্গে গুলি-বোমা চলে মাঝে মাঝেই । যখন তখন রণক্ষেত্রের রূপ নেওয়া শ্রীনগরে টুরিস্ট আসতে ভয় পায় । মজিদ সাইকেল ভ্যানে করে ফল বিক্রি করত লালচকে । দারিদ্র তখন নিত্যসঙ্গী । একদিন একটা গাড়িবোমা বিস্ফোরণে উড়ে গেল ওর ফল ভর্তি ভ্যান আর ওর জায়গা হল লালচকের রাস্তায় । জ্ঞান হবার পর জানতে পেরেছিল একটা লোহার টুকরো এসে বিঁধে গিয়েছিল ওর বাঁ পায়ে । অনেকদিন ভুগতে হয়েছে জখম পাটা নিয়ে । এর চেয়ে প্রাণ চলে যাওয়া বোধহয় ওর কাছে ভালো ছিল । বিবিকে রোজগারের জন্য কী না করতে হয়েছে ! হামিদ ভাই সেদিন পাশে ছিল বলে বেঁচে গেছে ওরা ।
সুরেলা একটা পাখি সুর তুলে ডাকছে । দক্ষিণের জানলা বোধহয় সৌরভদাই খুলে দিয়ে থাকবে । স্কুলটা ভরে উঠেছে শিশুর কলকাকলিতে । ফুটফুটে শিশুর দল কত সকালে উঠে চলে এসেছে লেখাপড়া করতে । ওরা শিখতে চায়, খেলতে চায়, চায় মানুষের মতো বাঁচতে । সময় আর পরিস্থিতির চাপে ওরা কে যে কোথায় হারিয়ে যাবে সে তো ওদের জানার কথা নয়, জানেও না । বুকটা ভারী হয়ে গেলেও খুশি হলাম এই ভেবে যে ভূস্বর্গে ফুল ফোটে এখনও ।
স্কুল বাড়িটার পেছনে বড় বড় কতগুলো গাছের জন্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করেনি এখনও । চিনারের সাথে কয়েকটা পপলার গাছ আর ছোট বড় না নাম না জানা গাছের জটলায় গা ছমছমে একটা পরিবেশ ওখানে । রাতের দিকে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছিল । বনভূমি বৃষ্টিতে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে তাই । জানলার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশটা জানান দিচ্ছে আবহাওয়া বেশ ভালোই । একটু শীত শীত করলেও খুশি উপচে পড়ছে জানলা পথে ।
ডাল লেকে ভেসে বেড়ানোর টানে ফিরে এলাম ডাল লেকের ধারে । দরদাম করে শিকারা ঠিক করে উঠে পড়লাম শিকারায় । জল কেটে এগোতে এগোতে শিকারা চলে এল ডালের গভীরে । পসরা সাজিয়ে ব্যবসায়ী শিকারা ভেসে বেড়াচ্ছে ঝাঁঝিতে ভরা ডালের জলে । ওর মধ্যেই পানকৌড়ির দল টুক টুক করে ডুব দিয়ে খাবার তুলে নিচ্ছে মুখে ।
সৌম্যশুভ্র ছবি তোলায় ব্যস্ত । চুপিচুপি সৌরভদাকে বললাম, “তোমাকে বলতে ভুলে গেছি- আমাদের অমরনাথ ভ্রমণের পরের বছরই আমার সেই বন্ধু কাশ্মীর বেড়িয়ে গেছে সপরিবারে । শিকারাতে চেপে ঘুরতে ঘুরতে ফোন করেছিল অংশুমান । কী উচ্ছ্বাস বাপরে ! শ্রেয়ার সাথেও কথা বলেছিলাম । সেও খুব খুশি । কাশ্মীর ভ্রমণের পুরো মজাটাই ভাগ করে নিচ্ছিল ওরা । কে বলে এ স্বাদের ভাগ হবে না ! যে স্বাদ ভাগ করে নেওয়া যায় সেটাই তো সুস্বাদু ।”
সৌরভদা মুচকি হেসে বলল, “তুমি আসলে কী বলতে চাও ?”
আমিও দুষ্টুমির হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে বললাম, “আমি কিছুই বলতে চাইছি না । সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল তাই বললাম । আরে ! আরে ! ওই তো আমাদের হাউস বোটটা !” উচ্ছ্বাস দেখানোটা এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে সৌম্যশুভ্র চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীসের হাউস বোট আংকেল ?”
-ওই হাউস বোটটাতে আমি ছিলাম একদিন । সেবার যখন অমরনাথ থেকে ফিরি সে সময় । খুশিটা ছড়িয়ে দিতে দিতে বললাম । নামটা মনে ছিল না কিন্তু দেখা মাত্রই মনে পড়ে গেছে । “চেরী রাইপ” । নস্টালজিক হয়ে পড়লাম মুহূর্তে ।
জীবনে অনেককিছুই এভাবে আচমকাই ফিরে আসে । শুধু সময়টা ফেরে না । হারিয়ে যাওয়া মানুষ ফিরে আসে কখনো কখনো নতুন রূপে । কিন্তু যা খুঁজি বা যাকে খুঁজি তাকে কেন পাই না ? মন তবু খুঁজতেই থাকে । খুঁজতে খুঁজতে চোখে আসে চালসে । পরশ পাথর কখন হারিয়ে যায় ! “পাগল খুঁজে ফেরে পরশ পাথর” ।
কবুতর খানা, চারমিনার, নিশাতবাগ, মোঘল গার্ডেন, শালিমার বাগ ঘুরে মোঘল দরবারে উপস্থিত হলাম মধ্য দুপুরে । সৌরভদা বলল, “জানি বিত্তবানেরা জাগতিক সুখভোগের অধিকারী কিন্তু এক দুদিন আমরাও তো সুখের স্বাদ নিতে পারি । চল, আমরা আজ মোঘল দরবারের বাদশাহী স্বাদ গ্রহণ করি ।”
সৌম্যশুভ্র আকবর ফোর্টে যেতে চেয়েছিল । সময় হবে না । বললামও সেটা । তবে মোগল দরবারের জৌলুস আর লোভনীয় খাবারের সুগন্ধে সে ভুলে গেল আকবর ফোর্টে না যাওয়ার দুঃখ । বাদশাহী চিকেনের ডিশে সে মহাখুশি । কবজি ডুবিয়ে খেল । জোর ধাক্কা খেলাম আমি । গোস্তাবা’র স্বাদ নিতে গিয়ে রীতিমতো বেকুব । একে কোন স্বাদ নেই, তার উপর জীবন্ত ভেড়ার গন্ধই যেন নাকে ঢুকে গিয়ে পেট গুলিয়ে দিচ্ছে । সৌরভদারও একই অবস্থা হল প্রায় । বলেই ফেলল, “এর চেয়ে আমাদের মাটন কষা অনেক ভালো । ভাগ্যিস বাবি চিকেন ছাড়া অন্য মাংস খায় না ।”
শাহী রেস্তোরার শাহী খাবারে মন না ভরলেও টাকার কষ্ট ভুলে যেতে চেষ্টা করছি আমরা । অন্ততঃ সৌম্যশুভ্র তো খেয়ে খুশি । বন্ধুদের কাছে গল্প করতে পারবে সে মোঘল দরবারে খেয়েছে একদিন । সৌরভদা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হাসছিল । জিজ্ঞেস করলাম, “কী সৌরভদা হাসছ যে ?”
সৌরভদা ঠোঁট কামড়ে ধরেই ছেড়ে দিল । আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ । তারপর হাসতে হাসতে বলল, “গরীব মানুষের পান্তাভাতে পেঁয়াজ- লংকা অথবা আমাদের বেগুন পোড়া ভাত । আহা !”
সৌরভদাকে জানিয়ে রাখি, “সৌরভদা, বেগুন পোড়া কিন্তু কন্টিনেন্টাল ডিশ অনেক পাঁচতারা হোটেলে ।”
“হ’তে পারে । পরিবেশন করাটাই তো আসল । তোমার মধ্যে যে সব গুণ আছে সেটা একজন তখনই জানতে পারবে যখন সে তোমাকে জানতে পারবে । এই জানানোটাও একটা আর্ট । তোমার কোন প্রডাক্ট তুমি বিক্রি করতে চাইলে সেলের আর্টটা তোমাকে শিখতে হবে । বেগুন পোড়া এমনিতেই সুস্বাদু তার উপর বড় বড় হোটেলে নিশ্চয়ই অনেক কিছু দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করে অতিথিদের পাতে । দেখলে তো মোঘল দরবারের ঠাঁটবাঁট । অবশ্য এটাও ঠিক সব খাবারই যে সবার কাছে ভালো লাগবে তার কোন মানে নেই । শুনেছি প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী নাকি গুস্তাবা খুব পছন্দ করতেন । কাশ্মীরিদেরও তো বেশ প্রিয় একটা খাবার এটা । আমাদের ভালো লাগেনি বলে আর কেউ খাবে না ? তাছাড়া কাশ্মীরের আবহাওয়ায় নিশ্চয়ই এই খাবারটা কোন উপকারে আসে, তাই লোকে এত পছন্দ করে ।” সৌরভদা যে কোন বিষয় নিয়েই খুব ভাবে । এখন ছেলেকে কিছু শেখাতে ও বোঝাতেও চাইছে সৌরভদা বুঝি সেটা । ছেলেটা বুঝলে ভালো ।
মজিদ ভাইয়ের পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিতে মজিদের খোঁজে গেলাম । মজিদ আমাদের উদ্দেশ্য জেনে হাসল। নিরীহ, সরল হাসি । ঘরে নিয়ে বসিয়ে সে বিবিকে চা আনতে বলল । মজিদ হিসেবপত্র কিছুই দিল না । আমাদের চা পান করার ফাঁকে অনেক কথা বলল । কাশ্মীরের পরিস্থিতি, মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথাও জানাল । কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ শান্তি চায় । মিলিটারি শাসন, জঙ্গি সন্ত্রাস কোনটাই তাদের কাম্য নয় । তারাও বাঁচতে চায় মানুষের মতো ।
রাতের খাবারের পর সে বিল দেবে বলেছে । রাগ ও ভয় দুটোই হচ্ছিল । কি জানি কত কি চার্জ করবে । লোকটাকে যতটা বোকা বা সরল মনে হয় সেটা নাও হতে পারে । সব সময় মুখ দেখে তো মানুষ চেনা যায় না । মুখে মিষ্টি, চেহারায় নিরীহ মানুষই তো সফল ব্যবসায়ী হয় দেখেছি । “আদর করে, যত্ন করে খাইয়ে শেষে জবাই করবে না তো ?” কথাটা সৌরভদাকে বলতেই সৌরভদা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “তোমার দোস্ত যদি এটা করে তবে তোমারও কিছুটা দায় বর্তায় কিন্তু । দেখ, কী করে তোমার বন্ধু।” রাতের খাবার মজিদই নিয়ে এল । ভাত-ডাল, সবজি একটা । সৌম্যশুভ্রর জন্যে ডিম । আমরা ডিম খাব না ঠিক করেছিলাম কিন্তু ডবল ডিমের কারি, ফলে একটা ডিম আমরা দু’জনে ভাগ করে খেলাম । দুপুরে চিকেন খেয়েছে অনেকটা তাই রাতে ছেলেকে ডবল ডিম খেতে দিল না সৌরভদা ।
খাবারের প্লেট নিতে এসেছিল মজিদ । পেছনে হামিদ দাঁড়িয়েছিল দরজার বাইরে । ডাকলাম ওকে । “আইয়ে হামিদ ভাই ।” মনে মনে ভাবছিলাম ব্যাটা কমিশনের লোভেই এসেছে নিশ্চয় । অবশ্য হামিদ কালই বলেছিল সে আজ রাত্রে আসবে ।
হামিদ ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল । জানতে চাইল, “ক্যায়সা রহা আজকা দিন ? কঁহা গিয়া থা ?” কোথায় কোথায় গেছি জানালাম । শুধু মোঘল দরবারের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম ইচ্ছে করে ।
মজিদ ঘরে ঢুকে সৌরভদার হাতে একটা কাগজ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল । বসল না । ঘরে দুটো চেয়ার । একটায় হামিদ বসেছে আর একটায় সৌম্যশুভ্র আগে থেকেই বসে আছে । ভাবছি ওকে বলব কিনা চেয়ারটা ছেড়ে দিতে – দেখি সৌরভদার ভ্রু কুঁচকে উঠছে । সৌরভদার ভ্রু কুঁচকে ওঠা দেখে আমার নাকের পাটা ফুলে উঠছে । সৌরভদার হাত থেকে কাগজটা প্রায় ছিনিয়ে নিলাম । কাগজটাতে যা হিসেব দেওয়া আছে তা দেখে আমার চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে গেল বিস্ময়ে । ষোলশ’ টাকার বিল ! দু’দিনের ঘর ভাড়া এক হাজার টাকা । দু’রাতের খাবার ছ’শ টাকা । চায়ের দাম, সকালের নাস্তা বাদ । সৌরভদা বাঁ হাতের দু’আঙুল- তর্জমা আর বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠোঁটটাকে সূচাল করে কিছু ভাবছে । মজিদ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে । আমি সৌরভদাকে বলতে যাচ্ছি – এটা কী হল ? চা-টিফিন বাদ কেন ? মজিদ আমাকে থামিয়ে দিল ওর কথায়, “আপ লোগ হামিদ ভাইয়াকা মিত্র – মেরা ভি মিত্র হো গয়া না ? কুছ মত বলিয়ে ভাই সাব।”
সৌরভদা আর আমি মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি । হামিদ হাসছে । মজিদ লাজুক মুখে বলল, “মেহমান সে পৈসা লেনা আচ্ছা নেহী হ্যায়, তব ভি লিয়া না ! ক্যাঁয়া করে হমারা হালই এয়সা হ্যায় ।”
অনেক জোরাজুরিতেও আর কিছু দেওয়া গেল না । হামিদ সকালে আসতে পারবে না বলে হাত চেপে ধরে আজই বিদায় জানাল, “ফির আইয়ে গা বাবুজী । কোলকাত্তামে তো মিলেঙ্গে ভি । আপকো ভি সেলাম স্যার ।” সৌরভদাকে কুর্নিশ করে সৌম্যশুভ্রর দিকে হাত নাড়ল সে । হামিদ ও মজিদ কুর্নিশ করে বিদায় নিতেই সৌরভদা বলল, “কহ্লনের উত্তরপুরুষরা কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত কিন্তু রাজতরঙ্গিনীর দেশে যে আতিথিয়তা তোমরা দেখালে তা মনে থাকবে চিরদিন ।”
সৌম্যশুভ্র কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইল, “কহ্লন কে ? আর রাজতরঙ্গিনীর দেশ মানে ? এটা তো কাশ্মীর ! স্বাধীনতার পর থেকেই নাকি অশান্তি চলছে এই রাজ্যটাকে নিয়ে ! ভূস্বর্গ না বলে জঙ্গিস্তান বলা উচিত শুনেছিলাম । আমার কিন্তু ভালই লেগেছে এদের । আবার আসব এখানে ।”
এই সময়ের ছেলেমেয়েরা ভারতের ইতিহাস প্রায় জানেই না বলতে গেলে । নিজের মাতৃভাষাটাই ভালো করে শিখছে না এরা ! আসলে এ যুগের মা-বাবারাই চায় সন্তান ইংরাজী পড়ুক । ইংরাজী শিখে আন্তর্জাতিক হতে চাইছে ? তা নয় । মোটা মাইনের একটা চাকরি । ইতিহাস পড়ে কী হবে ? পৃথিবী বদলাচ্ছে মোবাইল, কম্পিউটারের হাত ধরে । আন্তর্জাতিক জালে জড়িয়ে যাচ্ছে শৈশব, কৈশোর । এটা হল একটা দিক । আর একদিকে অশিক্ষা, শিক্ষার অসম্পূর্ণতা, হতাশা, বেকারত্ব জন্ম দিচ্ছে জঙ্গি মানসিকতার ।
“শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, শাসক দুষ্টু হলেও দেশকে ভালবাসতে হয় । দেশের মানুষকে সম্মান করতে হয় । নারীকে সম্মান দিতে হয়, নারীর সম্মান রাখতে হয় । রাজা দামোদরকে সুদর্শন চক্র দিয়ে বধ করে রাণী যশোমতীকে কাশ্মীরের সিংহাসনে বসিয়ে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ । তারও অনেক পরে ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় এ রাজ্যকে গড়ে তুলেছিলেন ভারতসেরা করে । কাশ্মীরের সেই ঐতিহ্য এখনও ফেরানো যায় শুধু একটু ভালোবাসা আর সুশিক্ষার ব্যবস্থা করে ।” সৌরভদার কথায় সায় দিয়ে বললাম, ঠিক বলেছ সৌরভদা । কাশ্মীরের ঐতিহ্য ফেরানো সম্ভব । কোন মানুষ জন্ম থেকে যেমন খারাপ হয় না, জন্ম থেকে জঙ্গিও হয় না ।
সৌরভদা ছেলেকে বলল, “এবার ফিরে গিয়ে মনে করাস কবি কহ্লনের রাজতরঙ্গিনী কিনে দেব । পড়েই জেনে নিস সব ।”
(ক্রমশঃ )

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post