নীল যেখানে দেদার ছড়িয়ে
তপন বিশ্বাস
।। চার ।।
নদী সভ্যতার ধমনী । সিন্ধুনদ আর উপনদী সুরু মিলে লাদাখভূমিকে মায়ের মতো পালন করছে । অনেকগুলো নদ-নদী শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে সমগ্র লাদাখের পার্বত্য অঞ্চলে । বৃষ্টি প্রায় হয়ই না লাদাখে । সূর্যের প্রখর তাপে পাহাড়ের বরফ গলতে থাকে গ্রীষ্মের শুরু থেকেই । বরফগলা জল নেমে আসে পাহাড়ের গা বেয়ে । অসংখ্য ছোটবড় নদীর সৃষ্টি হয় । বরফগলা জলে পুষ্ট হয় সুরু নদী, সিন্ধু নদ । শীতে জমে বরফ হয়ে যায় নদীর উপরের স্তর । বরফ নদীর উপরে জেগে ওঠে নতুন পথ । শীতকালে এই পথ ব্যবহার করে মানুষ । ভারী ভারী কাঠ টেনে নিয়ে যায় লাদাখের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ।
হিমালয়, জাঁসকার, লাদাখ আর কারাকোরামের মাঝে অপরূপ সোনালি একটা জগত । ভারতবর্ষতো বটেই সারা পৃথিবীর কোন ভূ-প্রকৃতির সঙ্গেই মিল নেই লাদাখের । ময়ূরকন্ঠী নীল আকাশ, উত্তুঙ্গ পাহাড়, হিমবাহ বিগলিত তুঁতে রঙা নদী । ধুলোওড়া বাতাসে শ্বাস নিতে কষ্ট হলেও চোখের তৃপ্তিতে খুশি হয়ে ওঠে মন ।
সুরু নদীর আঁচল বিছানো জমি যে কত উর্বর সেটা সচক্ষেই দেখছি । রুক্ষ আর ধূসর প্রকৃতির মাঝে এক টুকরো সবুজ উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছে রূপসী সুরু । নয়নাভিরাম প্রকৃতির সঙ্গে তার ভারী বন্ধুত্ব । একে অন্যকে ছাড়তেই চায় না ।
বাসটা ডানদিকে বাঁক নিতেই সুরু নদী চলে গেল আড়ালে । ঘিঞ্জি একটা পথ বেয়ে ততোধিক ঘিঞ্জি একটা শহরে প্রবেশ করছে বাস । অপরিচ্ছন্ন আর অগোছালো শহর । কারগিল জেলার সদর । লাদাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা । শ্রীনগর -লেহ যাতায়াতের পথে যাত্রীরা এখানে রাত্রিবাস করে একদিনে এই দুর্গম পথে ৪৩৪ কিমি পথ পাড়ি দেওয়া কষ্টকর বলে । কারগিল শ্রীনগর থেকে ২০৪ কিমি, লেহ থেকে ২৩২কিমি ।
বাস থেকে নেমে হোটেলের সন্ধানে যেতে যেতে বুঝলাম শহরটা অপরিকল্পিতভাবে বেড়েই চলেছে । ভালো মানের হোটেল যা আছে ঘর খালি নেই । এদিকে পথে হাঁটাও বিরক্তিকর হয়ে উঠছে । শিমূল তুলোর মতো কিছু একটা উড়ে বেড়াচ্ছে । নাকে,মুখে ঢুকে যাচ্ছে । বিচ্ছিরি ব্যাপার !
পুরো শহরটা চরকির মতো পাক দিয়ে ফেলেছি প্রায় । সৌম্যশুভ্র ক্লান্ত হয়ে পড়েছে । এ যুগের ছেলেরা এত ধকল নিতে শিখল কোথায় ? বয়স হলেও সৌরভদা ছুটছে টগবগে ঘোড়ার মতোই । সৌম্যশুভ্রকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা দুজনেই হোটেল খুঁজছি । পাওয়া গেল । হাসপাতালের কাছে সাধারণ মানের একটা লজ । “একটা তো রাত ! থেকে যাই বল ?” সৌরভদার কথায় সম্মতি জানালাম, “ হ্যাঁ । আমার কোন অসুবিধে নেই । তোমার ছেলের পছন্দ হলেই হল ।”
বাস থেকে নামার পর বাস কন্ডাক্টর বলেছিল কারগিলে দেখার কিছু নেই । আমরা চাইলে ভোরেই চলে যেতে পারি । আমাদের তিনটে সিটই রেখে দেবে বলেছে । ঠিক চারটেয় বাস ছাড়বে । সৌরভদা মাথা ঝাঁকিয়েছিল । অত ভোরে যাওয়া যাবে না । আমারও কারগিলের সকালটা দেখার ইচ্ছে । বেড়ানোয় ব্যস্ততা রাখতে নেই । না করে দিয়েছি কন্ডাক্টরকে ।
নামেই লজ । আসলে একটা বাড়ি । রাস্তার সমান্তরালে বাড়ির দ্বিতীয়তল। আমাদের ঘর তিনতলায় । রাস্তার উপর থেকে প্রায় সমকোণে সিঁড়ি উঠে গেছে তিনতলার । তিনতলায় মাত্র দুটো ঘর, আর একটার নির্মাণ চলছে । ঘরের সামনে খোলা ছাদ । সেখান থেকে একটা খাঁড়া সিড়ি নেমে গেছে দোতলা হয়ে একতলায় । বাড়ির মালিক নূর মহম্মদ সপরিবারে বাস করে একতলায় । লম্বা, ছিপছিপে চেহারার সঙ্গে মানানসই মুসলমানি দাড়ি । পরণে ঢোলা পোশাক- লম্বা জামার সাথে ঢোলা পাজামা । কুতকুতে চোখদুটোতে সতর্ক দৃষ্টি । নূর মহম্মদের স্ত্রীর চেহারা কিন্ত মঙ্গোলীয় ধাঁচের । পোশাকেও তিব্বতী ছোঁয়া । তিব্বত ঘেঁষা লাদাখে তিব্বতী প্রভাব তো থাকবেই । ভূ-প্রকৃতি আর আবহাওয়ার সঙ্গে জনজীবনেও লাদাখ আর তিব্বত পাশাপাশি । হাজার বছর ধরে তিব্বত আর লাদাখের মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাচরণ করছে । শুধু কারগিলই বোধহয় ব্যতিক্রম । তবে মুসলিম রীতি মেনে মুসলিম রমণীর বোরখা পরার চল বোধহয় নেই কারগিলে ।
একটা আপেল গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাঁদিকে । অ্যাপ্রিকট গাছ আছে কয়েকটা । কয়েকটা লাল আর সাদা ফুলের গাছ । কী ফুল জানি না । সবই অচেনা । ঘরোয়া পরিবেশ আর পেছনের পাহাড়টা দেখে ভালোই লাগছে আমাদের নতুন আস্তানায় । নতুন ঘরটায় সিমেন্ট, বালি ছড়ানো । কাঠের একটা সিঁড়ি লাগান আছে দেখে উঠে পড়লাম কারগিল শহরটাকে দেখব বলে । দারুন ! শহর থেকে দূরে, অনেকটা দূরে ছবির মতো একটা উপত্যকা । আর প্রায় বৃত্তাকারে উপত্যকাকে ঘিরে বয়ে চলেছে সুরু নদী । নয়নাভিরাম এই দৃশ্য একাই উপভোগ করব এমন বেরসিক আমি নই । সৌরভদাকে ডাকলাম । আমার ডাকে সৌরভদাও উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে । উচ্ছ্বসিত সৌরভদা চিৎকার করে ডাকল ছেলেকে, “বাবি দেখে যা !”
সৌম্যশুভ্র ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়েছিল এসেই । বাবার ডাকে কতকটা বিরক্তি নিয়ে বাইরে এল । অনিচ্ছাসত্বেও খুব কষ্ট করে উঠল সিঁড়ি দিয়ে । প্রকৃতিপ্রেমিক সে । খুশিতে চক্ চক্ করছে ওর চোখ ।
-মস্তবড় একটা ভুল হয়ে গেছে আমাদের ! শ্রীনগর থেকে বাসে না এসে নিজেরা গাড়ি ভাড়া করে এলেই ভাল করতাম । শহরে না থেকে ওদিকে কোথাও থাকলে ভাল হত । সত্যিই বিত্তবানেরাই জাগতিক সুখ ভোগের অধিকারী । বলেই সৌরভদা হেসে উঠল সশব্দে ।
সৌম্যশুভ্র’র সঙ্গে আমিও বিস্মিত । পরক্ষণেই মনে হল সৌরভদার হতাশার বহিঃপ্রকাশ ওই হাসি । হাসির মধ্যেই কৃত্রিমতা, ক্রুরতা, সরলতা, হতাশা আর যন্ত্রণা ভেসে ওঠে । হাসি দেখেই মানুষ চেনা যায় । সৌরভদার নিজের জন্য যতটা না কষ্ট হচ্ছে ছেলেকে বঞ্চিত করার কষ্টটা তার চেয়ে বেশি । সৌরভদাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি, “এখানে থেকেও তো খারাপ লাগছে না সৌরভদা । তোমার মতো দেখার চোখ তো বিত্তবানের থাকে না তাই তারা শারীরিক সুখের কথা আগে ভাবে । দূর থেকেও প্রকৃতির স্বাদ নেওয়া যায়, রস নিংড়ে নিতে জানতে হয় । ক’জন পারে ? কি সৌম্য, ঠিক বলেছি ?”
সৌম্যশুভ্র হাসল । হাসলে ওকে বেশ লাগে । “ঠিক বলেছ আংকেল । এখান থেকে ভালই লাগছে । তবে ওর ভেতরে যেতে পারলে ডেফিনেটলি বেশি ভাল লাগত । এবার তো হল না, পরে না হয় আর একবার আসব । তুমি আসবে তো ?”
চোখে জল এসে যায় আর কি ! ছেলেটা প্রত্যেকবার এমন করে জিজ্ঞাসা করে যেন ওর বাবার মতো আমিও ওর আপনজন । ভাল লাগে ভেবে যে সে আজকালকার ছেলেদের মতো আত্মকেন্দ্রিক নয় মোটেই ।
সৌরভদা ছেলের কাঁধে হাত রাখে, “সবাই আসব । কিন্তু তোকে তার আগে উপযুক্ত হতে হবে । বেড়াতে গেলে টাকার প্রয়োজন জানিস তো ?”
সুন্দর সময়টা সুন্দরভাবে উপভোগ করতে হয় । ছন্দপতন হোক চাই না । সৌম্যশুভ্র’র পিঠে হাত রেখে বললাম, “ও উপযুক্ত হবে সৌরভদা । খুব ভাল ছেলে তোমার ।” কাঁধ ও পিঠে দুটো ভরসার হাত । সৌম্যশুভ্র বলল, “আমি ক্যামেরাটা নিয়ে আসি ।” লজ্জা পেয়েছে বোধহয় ।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার থেকে একটু দূরে মসজিদ । কারগিলের সিংহভাগ মানুষ শিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত মুসলমান । বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবে কারগিলের প্রসিদ্ধি বহু প্রাচীনকাল থেকে । সিল্করুট ধরে চিন, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া,তুর্কিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা আসত তাদের নানারকম সম্ভার নিয়ে । নিয়মিত ব্যবসা চলত এ দেশের সাথে । সিল্করুট এখন রুদ্ধ। অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণে কারগিল পর্যটকদের কাছেও আতংকের ।
রুখুসুখু পাহাড় ঘেরা শহরটাও একটা পাহাড়ের উপর । নীচে শস্যশ্যামল সুরু ভ্যালি । লজের সামনের রাস্তার একপ্রান্ত নেমে গেছে বাজারের দিক দিয়ে সুরু উপত্যকার দিকে আর একটা প্রান্ত প্রায় খাঁড়া উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায় । ফুল ও ফলের বাগান ঘেরা সুন্দর সুন্দর বাড়ি । আপেল, অ্যাপ্রিকটের মাঝে সুন্দর সুন্দর পপলার গাছ পথের সৌন্দর্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে ।
ধূসর পাহাড়গুলোর মাথায় আকাশ একটা নীল চাঁদোয়ার মতো ঝুলে পড়ছে । দু’একটা পাহাড়ের মাথায় ইতস্ততঃ বরফ ছড়িয়ে । সূর্যের আলোয় হীরের নাকছাবির মতো চমকাচ্ছে ।
একটু পরে টুক করে সূর্য ডুবে গেল পাহাড়ের মাথায় লাল রঙ ছড়িয়ে দিয়ে । কারগিলের আকাশে এক টুকরো মেঘও নেই যে আকাশটা সূর্যাস্তের লাল রঙটা ধরে রাখবে ! লালতো বটেই আকাশের নীল রঙটাও হারিয়ে আকাশটা ছাইরঙ মেখে ফেলল কিছুক্ষণের মধ্যেই । আর তখনই দুটো একটা করে ফুল ফুটতে লাগল আকাশে । নাহ্ ! কারগিল একেবারে বঞ্চিত করবে না । মেঘহীন আকাশের দখল নিতে উঠে আসছে নক্ষত্রের দল ।
“এই এদিকে আয় তো । এইটা ধর ।” বাংলা শুনে চমকে উঠলাম । এক লাফে ঘর ছেড়ে বাইরে । “কে ? কে বাংলায় কথা বলল ভাই ?” নতুন ঘরটার কাজ করছে কয়েকজন যুবক রাজমিস্ত্রি । চেহারা দেখেই মনে হয় বাঙালি । ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এক যুবক এগিয়ে এসে গ্রামবাংলার ভাষায় বলল, “এখানে আমরা যারা কাজ করছি, তারা সবাই বাঙালি । আপনে বাঙালি ! বেড়াতে আসছেন কর্তা ?”
মাতৃভাষার এমনই জাদু । ভাব জমিয়ে ফেললাম । মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছে । সবাই বাঙালি মুসলমান । প্রতি বছর আসে । মজুরি বেশি । দিনরাত কাজ করে ওরা । দেশে এই সময়টা রাজমিস্ত্রির কাজ থাকে না বর্ষাকাল বলে । আজিজুল, নুরুলরা তাই পরিযায়ী পাখির মতো উড়ে আসে এখানে । তিনমাস কাজ করে ভালরকম আয় করে দেশে ফিরে যায় ।
আমুর বাজ’রা যা পারে মানুষ কেন পারবে না ? ডানা না থাক ওড়ার স্বপ্ন তো থাকতেই পারে মানুষের । কূপমন্ডুক হয়ে ঘরে বসে না থেকে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেই হল । কাজ নিজে থেকে হাতে ধরা দেয় না । খুঁজে নিতে হয় । সুদূর আসাম থেকে কেরালা বা মুর্শিদাবাদ থেকে লাদাখ, এভাবেই মানুষ কাজের খোঁজে ছুটছে ।
রাতের খাবার খেতে নীচে বাজারের দিকে যেতে হল । লজে খাবারের ব্যবস্থা নেই । ফিরে এসে দেখলাম আমাদের পাশের ঘরে অতিথি এসেছে কয়েকজন । আলাপ হল । বেঙ্গালুরু থেকে এসেছে ছ’জনের একটা দল । পঁচিশ থেকে আঠাশের মধ্যে বয়স । প্রত্যেকেই আইটি সেক্টরে কাজ করে । বাইক চালিয়ে এসেছে । যাবে প্যাং গং লেক । অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস খুব জনপ্রিয় এখন । ওরাও অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ক’দিনের ছুটি নিয়ে চলে এসেছে লাদাখে । গতি আর দুর্গম পথের খোঁজে ।
প্রত্যেকেই খুব স্মার্ট । ঝক্ঝকে কথাবার্তা । আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এও একটা চেহারা । মারণঘাতী নেশার নিজেদের না ডুবিয়ে দেওয়া নয়- জীবনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে যৌবনের স্বাদ গ্রহণ করতে চায় এরা । এতে সাহসিকতা যেমন আছে তেমনি আছে স্পর্ধা । এরা দেশের ভবিষ্যৎ । স্বপ্নের কারিগর ।
একটা স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে আমারও । ঘসা কাঁচের ফাঁক দিয়ে নয়- মনের জানলা দিয়ে । শুধু বাঙালি বা ভারতীয় নয়, বিশ্বমানবের হাত ধরে সভ্যতার উত্তরণ হোক । আগ্নেয়াস্ত্র বা মারণাস্ত্র নয়- সৌহার্দ্যের হাত প্রসারিত হয়ে ছুঁয়ে ফেলুক মানবতাকে । পৃথিবীটা তাহলে বেঁচে থাকবে আরো অনেকগুলো বছর ।
কারগিল থেকে একটা পথ চলে গেছে লেহ’র দিকে, আর একটা পথ জাঁসকারের দিকে । সুরু উপত্যকার গ্রামগুলোতে যাওয়ার বাস ছাড়ছে কারগিল থেকে । কারগিলে থাকা হল, বেড়ানো হল না । সুরুভ্যালি, ভীমবাট, জাঁসকার পরেরবারের জন্য তোলা রইল । শেয়ারে একটা জাইলো গাড়ি পেয়ে গেলাম স্ট্যান্ডে । একটু অপেক্ষা করতে হল প্যাসেঞ্জারের জন্য । আমরা ছাড়া একজন প্যাসেঞ্জার ছিল । আর একজন হলেই ছেড়ে দেবে বলেছিল । শেষে একজন নয় দু’জন পাওয়া গেল । গাড়ি ছেড়ে দিল ড্রাইভার ।
সকালে কারগিলের আকাশটা সুন্দর ছিল । নতুন ঘরের ছাদ থেকে সুরুভ্যালির সবুজ দেখেছিলাম নতুন সূর্যের আলোয় । সূর্যোদয় দেখা হয়নি উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে । টাইগার হিলে গিয়ে সূর্যোদয় কি সবাই দেখতে পায় ? সূর্যোদয় না দেখলেও সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত না হলেই হল । ওই সকালেই বেঙ্গালুরু’র যুবকদের তিনটে বাইক ছুটে গিয়েছে লেহ’র উদ্দেশ্যে । আমরা রওনা দিয়েছি তার অনেক পরে ।
রোদের তাপ বাড়ছে চড়চড় করে । শুকনো হাওয়া শুষে নিচ্ছে শরীরের জল । ধূসর পাহাড়ের গায়ে এলোমেলো খাঁজ । নির্মেঘ আকাশের নীচে জনশূন্য প্রান্তরের বুক চিরে ধুলো উড়িয়ে চলেছে মিলিটারি কনভয় । ইনোভা, জাইলো, স্করপিও সহ ছোট বড় অনেক গাড়িই আমাদের মতো সওয়ারি নিয়ে চলেছে তারই ফাঁকে ফাঁকে । লরিও চলছে দু’একটা । পথে দেখার কিছু নেইয়ের মাঝেও অনেককিছু আছে । অন্য কোথাও এমন প্রকৃতি নেই বলেই তো দেখার অনেককিছু আছে । যা নেই ভূ ভারতে তাই নাকি আছে মহাভারতে !
প্রকৃতি একটু একটু করে সাজ বদলায় এখানে । একটু একটু করে সবুজ ফেরার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মুলবেকে । কারগিল থেকে বিয়াল্লিশ কিমি দূরে মুলবেক । বুদ্ধের বিশাল মুর্তির কাছে দাঁড়াল গাড়ি । পাথরের বুকে খোদাই করা মুর্তি । সপ্তম শতাব্দীতে তিব্বতী বৌদ্ধরা নির্মাণ করেন ন’মিটার উচ্চতার অসাধারণ এই বুদ্ধমুর্তিটি । বুদ্ধদেব এখানে ভবিষ্য বুদ্ধ ।
বিশাল পাথরের গায়ে ফাটল ধরেছে । ভবিষ্য বুদ্ধের শরীরেও ফাটল । দীর্ঘ সময় কেড়ে নিয়েছে অনেককিছুই । সপ্তম শতাব্দীর বিস্ময় মুর্তি শুধু পাথরের মুর্তি হয়েই দাঁড়িয়ে আছে এখনও ! মুর্তির পাশে বৌদ্ধগুম্ফায় সুন্দর সুন্দর চালচিত্র, নানা আকারের ও নানা ধরণের স্ট্যাচু । ওয়াকা নদীর ধারে সবুজ উপত্যাকায় ঘরবাড়ি । নদীর অপর তীরে বাদামি, গৈরিক, শ্লেটরঙা গ্রানাইট পাথরের পাহাড় । সব মিলিয়ে প্রকৃতির অপরূপ কোলাজ । আর মাথার উপরে ময়ুরকন্ঠী নীল আকাশ । আহা !
একটা দোয়েল পাখি দোল খাচ্ছে তারের উপর । আর একটা দোয়েল পাখি একটু দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিকের বোতল, প্যাকেটের মধ্যে খাবার খুঁজে চলেছে । সৌরভদার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই দৃশ্য তাকে পীড়া দিচ্ছে । সৌম্যশুভ্র ছবি তুলছে একের পর এক । সে ক্যামেরা বন্দী করল দোয়েল পাখিদেরও । চলার পথে একটু দেখে আবার চলা শুরু । শুধু স্মৃতিটুকু ধরে রাখি আমরা- কেউ ক্যামেরায়, কেউ মনে ।
পাহাড়ের গায়ে শিবলিঙ্গ, মন্দির, অদ্ভূতদর্শন জীবজন্তুর মুর্তি । সবই বাতাসের শিল্পকর্ম । ধুলোওড়া পাহাড়ের শরীর বাতাসের আঘাতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আকার নেয় এমন । এগুলোও দেখার মতো । প্রকৃতির শিল্পকলা বিস্ময় সৃষ্টি করে মানুষের মনে । সৌরভদাও দেখছে কিন্তু একটু যেন মনমরা লাগছে ওকে । মেঘহীন নীল আকাশ ঝুলে পড়েছে পাহাড়ের পেছনে । সৌরভদাও তাই । ওর মনটা অন্য কোথাও ঝুলে পড়েছে বোধহয় । “কি সৌরভদা, বৌদির কথা মনে পড়ছে বুঝি ?”
“তা একটু মনে পড়ছে । এর আগে এমন একা একা থাকেনি তো কোনদিন । বলেছিলাম, বাপের বাড়ি গিয়ে থেকো । তা বলল, সেখানেও তো প্রায় একাই থাকতে হবে । দাদাবৌদি তো বাড়িতে কম সময়ই থাকে ।”
“মাম্মাম এখন মাসিদের বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে মজা করে ।” সৌম্যশুভ্র ওর পছন্দের সামনের সিটে বসেছে । মোবাইল থেকে মুখ না তুলেই বলল কথাগুলো । সৌরভদার কথা ওরও কানে গেছে ।
“তুই তো সব জানিস ! সন্তানকে ছেড়ে থাকতে মা-বাবার যে কী কষ্ট সেটা তুই এখন বুঝবি না । তোর যখন ছেলেমেয়ে হবে তখন বুঝবি ।” বৌদিকে একা রেখে আসার জন্য যত না দুঃখ তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছে মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে এতদূরে নিয়ে আসার জন্যে বোধহয় । মা-বাবা-সন্তান নিয়েই তো সংসার । এদের একজনকে ছাড়াও যে সংসার চলে না । আর সেই সংসারের সুখ-শান্তি, আনন্দ বা দুঃখের ভাগীদারও তারাই । তবু জীবনের কোন এক আনন্দ থেকে কেউ একজন বঞ্চিত হলে খারাপ লাগারই কথা । দুঃখ ভাগ না করলেও চলে কিন্ত আনন্দ ভাগ না করে নিলে তৃপ্তি পাওয়া যায় না ।
“ও এত কষ্ট সহ্য করতে পারবে না বলে নিজেই আসতে চায়নি ।” সৌরভদার কথা ধরে নিয়ে সৌম্যশুভ্র বলল, “মাম্মাম এতক্ষণ গাড়িতেই বসে থাকতে পারত না । হাঁটুর ব্যথায় মরে যেত ।”
সৌরভদা শরীর আরো পেছনে হেলিয়ে দিয়ে পা আরো সামনে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “খারদুংলা পাসেও নিয়ে যাওয়া যেত না ওকে । শ্বাসকষ্ট হত । অ্যাজমা আছে না । আমার তো বাবিকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে ।”
সৌম্যশুভ্র সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে, “আমার জন্য ভাবতে হবে না । আমি ঠিক পারব । আমার এখনও কোন কষ্ট হচ্ছে না । দারুন এনজয় করছি আমি ।”
সৌরভদা ঠোঁট উল্টে বলল, “হু, মুখেই মারিতং-”।
আমার এবার কিছু বলা উচিত মনে করে বললাম, “না, না , ও ঠিক পারবে । বৌদিকে আনলেও পারতে । শুনেছি এখানকার ড্রাই ওয়েদারে হাঁপানির রুগীরা ভালই থাকে । তাছাড়া পলিউশন নেই, অসাধারণ প্রকৃতি, মনের জোর এমনিতেই বেড়ে যায় । তবে একটু অক্সিজেনেই ঘাটতি আছে । খারদুংলা পাস যাওয়ার সময় অনেক গাড়িই নাকি অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখে টুরিস্টদের কথা ভেবে । ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বৌদিকে আনতে পারতে কিন্তু ।”
সৌরভদা সোজা হয়ে বসল । “বাবিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম । আমাদের লাদাখ ভ্রমণের কথা শুনে ডাক্তার বলেছিলেন, ইস্ ! আমার এক্ষুনি আপনাদের সাথে চলে যেতে ইচ্ছে করছে । বলেছিলাম, চলুন না । ডাক্তার হেসে বলেছিলেন, ইচ্ছে হলেই তো যেতে পারি না আমরা । ডাক্তারদের অনেক প্রব্লেম । অনেক যন্ত্রণা । এতদিনের জন্য যাওয়া তো অসম্ভব । যান, আপনারা ভাল করে ঘুরে আসুন । এসে গল্প শুনিয়ে যাবেন কিন্তু । কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ আর ইনহেলার রাখার পরামর্শ দিলেন ।”
এরপর সৌরভদার কাছে ডাক্তারের অনেক গল্প শুনলাম । সব ডাক্তারই প্রফেশনাল অথবা অর্থপিশাচ হয় না, কেউ কেউ মানবিকও হয় ।
সৌম্যশুভ্র হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “দেখ, দেখ !”
পাহাড়ের বুকে অদ্ভূত শিল্পকর্ম করে রেখেছে কেউ । ক্রিম রঙের ঢেউ উঠছে পাহাড়ের গায় । তাল তাল মাখন দিয়ে একের পর এক কেক বানিয়ে তার উপর আবার ক্যাডবেরি ছড়িয়ে দিয়েছে কোন এক অদৃশ্য কারিগর ।
প্রকৃতির এই অদ্ভূত ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম । সৌরভদা হেসে বলল, “আমাদের চন্দ্রাভিযান সফল হল । আমরা এখন ল্যান্ড অফ মুনে পা রাখতে চলেছি ।”
চাঁদের পাহাড় – লামায়ুরু’র এই নামটাই বোধহয় সঠিক । বিভূতিভূষণ এই চাঁদের পাহাড়ের সন্ধান পাননি । পেলে হয়ত খুব সমস্যায় পড়ে যেতেন । সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা এক একজনের কাছে এক একরকম । বর্ণনা দিতে গিয়েও এক একজন এক একরকম ভাবে । খোঁজে নতুন নতুন শব্দ । তাতে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা যেমন তাতে বদলায় না তেমনি বদলায় না সুন্দরতা । সুন্দর সব সময়ই সুন্দর ।
সৌরভদা বলল, “ল্যান্ড অফ মুনের সৌন্দর্যের টানে দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকেরা এসে ভীড় জমায় লামায়ুরুতে । জ্যোৎস্নারাতে এখানে মুনল্যান্ড ভিউতে দাঁড়িয়ে ল্যান্ড অফ মুন দেখার জন্যে ।”
মুনল্যান্ডে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না রাতে ল্যান্ড অফ মুনের অসাধারণ দৃশ্য দেখা থেকে এবারের মতো আমাদের বঞ্চিত থাকতে হবে ভেবে সৌরভদার সঙ্গে আমারও খুব খারাপ লাগছে । লামায়ুরুতে আমাদের থাকার কোন পরিকল্পনা নেই ।
রুক্ষ, শুষ্ক সোনালি পর্বতের বুকে প্রকৃতির এই শিল্পকর্ম অনেকদিন সভ্য সমাজের কাছে অজানাই ছিল । লামায়ুরু এখন পর্যটন জগতে পরিচিত নাম । সৌন্দর্য প্রেমিকের দুটো চোখের সাথে ট্যাঁকেরও জোর থাকতে হয় কখনো কখনো । সৌরভদার কথায়-বিত্তবানেরাই জাগতিক সুখভোগের অধিকারী ।
“লামায়ুরুতে এসে একবার থাকতে হবে ।” সৌম্যশুভ্র’র কথা শুনে সৌরভদা হেসে বলল, “প্রতীক্ষায় থাকব জ্যোৎস্নারাতে চাঁদের পাহাড়ে এসে থাকার । দেখি তুই কবে নিয়ে আসতে পারিস ।”
নীচে কোথাও শুটিং চলছে তাই লামায়ুরু গ্রামেও ঢোকা গেল না । উপরের রাস্তা দিয়েই চলে যেতে নির্দেশ করল স্থানীয় পুলিশ । সৌরভদার কাছেই জানলাম, লাদাখের প্রাচীনতম বৌদ্ধগুম্ফা লামায়ুরুতেই । অনুমতি নেই তাই দেখা হল না । তবে একটা লাভ হল উপরের রাস্তা থেকে খুব সুন্দরভাবে দেখা গেল চাঁদের পাহাড়কে । সৌম্যশুভ্র ভিডিও করছিল ।
বিরাট চেহারার কয়েকটা ডাইনোসর পরস্পরের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে থাকলে যেমন দেখায় তেমনই পাহাড়ের রূপ । মসৃণ, ধূসর বাদামি রঙের উপর হাল্কা সবুজ আভা মিশে জীবন্ত রূপ দিয়েছে কিন্তু পা নেই বলে চলৎশক্তি হারিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডাইনোসরের দল । এভাবেই পাহাড়ের নতুন নতুন দৃশ্য দেখতে দেখতে ফাটুলা পাস পেরিয়ে চুম্বক পাহাড়ের টানে গড়াতে গড়াতে চলেছি । শরীরের ক্লান্তি বেড়েই চলেছে শুষ্ক আবহাওয়ার জন্যে । কতদূর, আর কতদূর লেহ শহরটা ?
লেহ ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড থেকে আবার একটা গাড়ি ভাড়া করতেই হল । অচেনা শহর । কিছুই চিনি না । সৌরভদা আর আমি একই প্রকৃতির টুরিস্ট । আগে থেকে হোটেল-লজ বুক করে আসি না । কোথায় কতদিন থাকব আগে থেকে ভেবে রাখার চেয়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারেই সহমত আমরা । প্রিপ্ল্যান্ড বেড়ানোর মধ্যে স্বাদ ও বৈচিত্র কম । কষ্ট করে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সহজেই পেয়ে যাওয়ার মধ্যে তা পাওয়া যায় না । সহজে পাওয়ায় প্রাপ্তি আছে, মজা নেই ।
ভাড়া গাড়ির ছোকরা চালক বড় বড় হোটেল, রিসর্টে নিয়ে যাচ্ছিল । পপলার গাছে ঘেরা সুন্দর সুন্দর কটেজ । দৃষ্টিনন্দন আর বিলাসবহুল হোটেলের কমতি নেই লেহ’তে । সৌরভদা ওকে বলেছিল সার্কিট হাউসে নিয়ে যেতে । নিয়েও গিয়েছিল পপলারের ছায়াময় পথ ধরে সার্কিট হাউসে । ঘর খালি নেই । সব বুক্ড । দেরিতে হলেও ছোকরা বোধহয় বুঝেছিল, আমাদের ট্যাঁকের জোর কম । অনেক দেখার পর ও আমাদের একটা মাঝারি মানের গেস্ট হাউসে নিয়ে এল । বাজারের মধ্যে কংক্রিটের ঘেরাটোপে চারতলা একটা বাড়ি । সাধ্যের মধ্যে এবং সবকিছু দূরত্বের মধ্যে বলে পছন্দ হল । ঘর দেখলাম । তিনতলায় একটা ডাবল আর একটা সিঙ্গল বেডের ঘর বেশ ভাল লেগে গেল । অসুবিধে বলতে লিফট নেই । সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলায় উঠতে হবে ।
উত্তর কোলকাতার বনেদি বাড়ির মতো মাঝখানে উঠান নিয়ে টানা বারান্দার চারদিকেই ঘর । ঘরের চাইতে বড় ওয়াশরুম । অবাকই হলাম । জলের অভাব লেহ সহ পুরো লাদাখেই । অনেক দূর ত্থেকে পাইপ লাইনে কর জল আসে দিনে দু’বার । জল অপচয় করা যাবে না বলে দিয়েছে মালকিন । কাচাকাচি বারণ । ঘরে মস্ত বড় কাঁচের জানলায় ভারী পর্দা ঝুলছে । পর্দা সরিয়ে দিলে পুরো বারান্দাসহ উলটো দিকের ঘর দেখা যায় । বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় ঘরের ভেতরটাও । শয্যার মাথার দিকে একটা ছোট জানলা । সে জানলা দিয়ে লেহ শহরের একটা দিক দেখা যায় ।
মালকিনের গলার আওয়াজ সুরেলা । ভারী লাদাখি জোব্বার আড়ালে লুকানো শরীরটার বয়স অনুমান করা শক্ত । মুখ দেখে যুবতী নয় বোঝা গেলেও বিগত যৌবনা নয় । নাক-মুখ মঙ্গোলীয় হলেও মিষ্টি চেহারা, এ দেশের নিরিখে রূপসী বলা যায় বোধহয় । গেস্ট হাউসের রেজিস্টারে নাম ঠিকানা লিখিয়ে নিয়ে হেসে বিদায় নিল সে । হাসিটাও খুব সুন্দর মালকিনের ।
সময় নষ্ট করা আমাদের ধাতে নেই । ব্যতিক্রম সৌম্যশুভ্র । ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়েছে । মোবাইল টিপছে । সৌরভদার মতো আমারও অবাক লাগে । কাশ্মীরে আসার পর থেকেই নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না । এখানে তো নেইই । ও কী করে মোবাইলে ? খেলে কিছু ? দেখতে দেয় না মোটেই ।
আমিই তাড়া দিলাম, “সৌম্য উঠে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও । বেরব ।”
কাছাকাছি সব আছে । ব্যাংক, রেস্টুরেন্ট, ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড । ট্রাভেল এজেন্সির ছড়াছড়ি । অভাব চায়ের দোকানের । কোলকাতা তো বটেই অন্য শহরের চা-পায়ীদের খুব কষ্ট এখানে । ফুটপাতে বিভিন্ন ধরণের স্ট্যাচু, ছোটবড় বুদ্ধমুর্তি, পাথরের মালা-অলংকারের পসরা সাজিয়ে বসে লাদাখি-তিব্বতী মহিলা ।
ফোর্ড রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোথাও মিলল না চায়ের দোকান । তেমন কিছু পেটে পড়েনি আজ । মুলবেকে এগ-নুডলস খেয়েছিলাম । তারপর থেকে বিস্কুটই ভরসা ছিল । সৌম্যশুভ্র বিস্কুটের ফাঁকে ফাঁকে ক্যাডবেরি খেয়েছে । বিকেল গড়িয়ে গেছে তাই আমরা ভেবেছি সন্ধ্যের পর রাতের খাবার খেয়ে নেব । চায়ের তেষ্টা মেটাতে শেষে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই হল ।
ট্রেকিং, এক্সপ্লোরেশনের ব্যবসার রমরমা এখানে । ট্রাভেল সিজন এখনও শুরু হয়নি তেমন । জুলাই-অগাস্টে টুরিস্ট বেশি আসে লাদাখে । ঢুঁ মারলাম কয়েক জায়গায় । নুব্রা ভ্যালিতে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে । রেটে পোষাচ্ছে না কিছুতেই । একটা ছোট অফিসে গিয়ে পরিচয় হল এক বঙ্গ সন্তানের সাথে । বাবুল সেন । মানি এক্সচেঞ্জের কাজ করে । কোম্পানি কয়েকমাসের জন্য এখানে পাঠিয়েছে । এই অফিসটাতেই বসে । অফিসটা ওর কোম্পানির নয়, বসির খানের । ট্রাভেল এজেন্সিটা বসিরের । মাত্র চার মাসের ব্যবসা এখানে । কোম্পানি বাবুলের বসার জন্য ভাড়া দেয় খানকে । বাবুল আর একটা বাঙালি ছেলের সাথে ঘর শেয়ার করে থাকে শহর থেকে একটু দূরে । “খান এই গেছে কোথাও । ফিরবে এক্ষুনি । লোকটা কথায় পাক্কা । কিন্তু খুব বদরাগী ।” আগেই সাবধান করে বাবুল ।
বাবুল আমাদের দু’জনকে চেয়ারে বসতে বলে সৌম্যশুভ্রকে বেঞ্চে বসতে বলল । ও নিজেও বেঞ্চে বসল। খানের টেবিলে কাঁচের নীচে নানা জায়গার ছবি আর বেশ কিছু ভিজিটিং কার্ড । দেয়ালে লাদাখ অঞ্চলের জীবজন্তুর ছবির সাথে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ।
বসির খানের মুখ দেখেই চমকে উঠলাম । কোথায় যেন দেখেছি ! আমাদের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে লাদাখের প্রকৃতির চাইতেও বেশি রুক্ষস্বরে বলল, “বলিয়ে ।” আবার চমক ! গলার আওয়াজটাও খুব চেনা । স্মৃতির ঝাঁপি হাতড়াতে লাগলাম । লাভ হল না । বসির খানের পরণে গ্রে কালারের ট্রাউজার, সাদা হাল্কা স্ট্রাইপের হাফ শার্ট । বেশ লম্বাও । আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে খান বার বার বাইরের দিকে দেখছিল । কথাবার্তার মধ্যে খানই প্রস্তাবটা দিয়েছিল, শেয়ার করে যেতে পারলে খরচ অনেক কম । আমরা রাজী । ভোটার কার্ড আর ভোটার কার্ডের জেরক্স, পাসপোর্ট সাইজের ফটো সঙ্গেই ছিল । ইনারলাইন পারমিটের জন্য দিতে হল । সঙ্গে পাঁচশ টাকা । খান বাবুলকে ডেকে বলল, “বাবুল, এক সিগারেট লেকে আও ।” যেমন কর্কশ স্বর তেমনি বলার ধরণ । সৌরভদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বলতে চায় । সৌরভদার হাতে চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করি । বাবুল তো বলেছে লোকটা কথায় পাক্কা ।
বাইরে বেরিয়েই সৌম্যশুভ্র বলল, “কাহানীর খান।” এতক্ষণে বুঝলাম লোকটাকে কেন এত চেনা মনে হচ্ছিল । দুটো মানুষ কখনো এক হয় ! চেহারা আর কথাবার্তায়ও !
জমীরের সাথে রাতে পরিচয় হল । দীর্ঘকায় জমীরকে দেখে পাঠান বা আফগান যোদ্ধা বলে মনে হয় । চওড়া কপাল, উন্নত নাকের সাথে মানানসই বাদামি গায়ের রঙ । সাদা লম্বা ঝুলের জামা আর ঢোলা পাজামা, পায়ে চপ্পল । মাথায় টুপি নেই, আছে ঘন কালো চুল । ওর কাছেই জানলাম গেস্ট হাউসের মালিক ওরা নয় । ওর চাচেরা ভাই । ও ক’দিনের জন্য শ্রীনগরে গেছে বাড়িতে । জমীর আর ওর স্ত্রী দেখাশোনা করছে তাই । গেস্ট হাউসের পাশে যে রেস্টুরেন্ট আর রাস্তার পাশে কেক-প্যাটিসের দোকান সে দুটো জমীরের । সঙ্গের একতলা বাড়িটাও ওদের । ঘর থেকে একটা চেয়ার এনে দিলেও সে বসেনি । দাঁড়িয়েই কথা বলছিল ।
জমীরভাইকে একটা অ্যাশট্রে এনে দিতে বলতে সে একটা মহা মূল্যবান উপদেশ দিয়ে রাখল । লেহতে অক্সিজেনের মাত্রা কম । সিগারেট না খেলেই ভাল । বাঙালিরা যে খুব সিগারেট খায় জানে ও । জমীর ছোটবেলায় অনেকদিন কোলকাতায় ছিল । ওর বাবা সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন । ফোর্ট উইলিয়ামে ছিলেন সে সময় । জমীরের শ্বশুরও সেনা অফিসার ছিলেন । জমীরের কাকা এখনও আছেন এয়ারফোর্সে । সামনের বছর রিটায়ার করবেন । পুরো মিলিটারি ফ্যামিলি ! এই প্রজন্মটাই শুধু ব্যবসায়ী !
লোডশেডিং হয়ে গেল হঠাৎ । জমীর জানাল জেনারেটর আছে । তবে সম্ভবতঃ চালানোর দরকার পড়বে না । বিজলি এসে যাবে একটু পরেই ।
জমীর অ্যাশট্রে নিয়ে ফেরার আগেই বিজলি এসে গেল । আরো কিছুক্ষণ গল্প করে সে বিদায় নিল । আমরা সিগারেট টানার জন্য বারান্দায় বসে রইলাম কিছুক্ষণ । মুখোমুখি নয় একটু আড়াআড়ি বসেছি তৃতীয় চেয়ারটাকে মাঝে রেখে । ওটাই অ্যাশট্রে রাখার টেবিল এখন । লেহ শহরে নিস্তব্ধতা নেমে আসছে ধীরে ধীরে । একটু একটু করে ঠাণ্ডা হচ্ছে লেহ’র উত্তপ্ত শরীর । সারাদিন ধরে কী রোদটাই না দিয়েছে সূর্যদেব ! প্রায় গাছপালাহীন শহরটা পুড়েছে রোদের তাপে । তাপ বিকিরণ করছে এখন ।
সৌরভদাকে খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে । সৌরভদা কোন কারণে কি খুব চিন্তিত ? সম্ভবতঃ ছেলের ব্যাপারেই । ছেলেটা এমনিতে ভাল । কিন্তু কোথায় যেন ফাঁক আছে । কথা কম বলে । কারোর সাথে মিশতে পারে না সৌরভদার কাছেই শুনেছি । শারীরিক ধকল নেবার ক্ষমতাও কম । সৌরভদা চেষ্টা করছে নানাভাবে । সব বাবারাই বোধহয় চায় ছেলে যেন তাকে ছাপিয়ে যায় । সব শিশুর মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে সন্তানের পিতা আর সব বাবার চিন্তার মধ্যেই থাকে সন্তানের ভবিষ্যৎ ।
(ক্রমশঃ)
View Comments
ছুট
তপন বিশ্বাস ।। চার ।। নদী সভ্যতার ধমনী । সিন্ধুনদ আর উপনদী সুরু মিলে লাদাখভূমিকে...