Sankars Creation

সুজাতা দাস

—কী নাম তোমার?
—শোভন।
—সামনে এসে বসো।
শোভন অনিচ্ছা সত্বেও সামনের বেঞ্চে বসল। শ্যামলা রোগা উসকো – খুসকো চুল। পরনে মলিন হাফপ্যান্ট, কোঁচকানো দাগধরা শার্ট। বাজারের ব্যাগে শ্লেট পেনসিল, একটা ছেঁড়া প্রথম ভাগ। পায়ে ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই চপ্পল। বছর ছয়েকের এই সাদামাটা শোভনের চোখ দুটো বড় মায়াময়। প্রথম দিনেই নমিতাদির চোখে পড়ে যায়।
—শ্লেট পেনসিল বার কর্। আমি যা লিখছি লেখ্।
বোর্ডের কোনো বর্ণই তার পরিচিত নয়। আজকের আগে শ্লেটে দাগ পর্যন্ত টানে নি। ক্লাসের সবাই কিছু না কিছু লিখছে। শুধু শোভন করুণ চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
—কী হলো? লেখ্?
—আ-মি পারি না।
—দেখে চেষ্টা কর্।
—আ-মি পারি না।
শোভনের দুচোখেে জল। নমিতাদি তার মাথায় হাত রাখল। হাতে ধরে শ্লেটে লেখাল।
—কাল আবার লিখতে হবে। বাড়িতে সবাই লিখবে।
মায়ের সাথে শোভনের যত গল্প। আপাত লাজুক অল্প- ভাষী ছোট্ট শুভ’র বকবকম থামতেই চায় না। সারাদিনের খাটা-খাটনির পর সবিতা বিরক্ত হয়।
—ঠিক আছে। সব শুনেছি। কাল ইস্কুলে দিদিমণির কাছে ভালো করে শিখবি। এখন একটু দোকান যা। চাল আর আলু নিয়ে আয়।
—মা, দিদিমণি লিখতে বলেছে।
—পরে লিখিস।
পঞ্চানন ফিরল। বাবাকে দেখে শুভ আবার শুরু করল। আজ ভিত কাটার কাজ ছিল। বড়ই ক্লান্ত। পুকুরে ডুব দিয়ে পেটে কিছু না পরা পর্যন্ত মেজাজ চড়া।
—এখন থাম বাবা। আমি শুনে কী করব?
—দিদিমণি লেখা শিখিয়েছে।
—বেশ করেছে। এখন বিরক্ত করিস না।
ধমক খেয়ে চুপ হয়ে যায় শুভ। শুকনো মুখে বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটা দেয়। প্রথম স্কুলের যাওয়ার গল্পে কারোর আগ্রহ নেই। দুই দিদি মা’র সঙ্গেই ঠিকে – ঝির কাজ করে সারাদিন। সন্ধেবেলা ঠোঙা তৈরি করে। তাই তারাও ব্যস্ত।
স্কুলে যাওয়া নিয়ে কোনো বকুনি নেই, শাসন নেই। পড়া নিয়েও নেই কারো মাথাব্যথা। মা-দিদিরা কাজে বেড়িয়ে গেছে। বাবা বেড়িয়েছে সাতসকালে ।ঢেকে রাখা পান্তাভাত মুখে দিয়ে শোভন ছোটে স্কুলে। সবার আগে। স্কুলের সামনে লাগানো গাঁদা যে তারই যত্নে বেড়ে উঠছে। পড়াশোনায় খুব সাধারণ। কিন্তু শান্ত, ভদ্র, বাধ্য শোভন দিদিমণিদের খুব প্রিয়। সবাই টিফিনে খায়। শোভনের কোনো টিফিন নেই। এককোণে বসে থাকে। দিদিমণিরা নিজেদের খাবার থেকে তাকে জোর করে খাওয়ায়।তাই লাজুক শোভন টিফিন খাওয়ার ভয়ে ঘুরে বেড়ায় স্কুল – সংলগ্ন মাঠে। কিছু না-পাওয়ার জীবনে দিদিমণিদের ভালোবাসা, আদর, শিক্ষায় শোভন প্রাথমিকের গন্ডী পেরলো।
—বাবা, এবার তো বড় ইস্কুলে যেতে হবে?
—যাবি। শম্ভুবাবুও বলছিলেন। পড়াতে।
—তা-ই!
—হ্যাঁ রে! আমরা তো গো-মুখ্যু। তোর যদি হয়!
—বাবা, আমি অনেক পড়ব।
—হ্যাঁ হ্যাঁ পড়বি। আমার মতো মজুর খাটতে হবে না। তুই অফিসের বাবু হবি।
বাবার কথায় শুভ’র চোখে জল। অনেক স্বপ্ন মন জুড়ে।পঞ্চানন দিন-মজুর ।নিরক্ষরই বলা যায়।বাংলা অক্ষর জ্ঞান সামান্য। সই করতে পারে। কিন্তু সে একজন শিল্পী। ঢাকের বোলে তার হাত কথা বলে। দোল-দুর্গোৎসবের দিনে পঞ্চানন বেড়িয়ে পরে ছেলের হাত ধরে। ঢাক আর কাঁসরের বোলে মেতে ওঠে উৎসবের দিন-রাত। শুভও অল্প সল্প ঢাক বাজানো শিখেছে। কলকাতার এক নামী বারোয়ারিতে ইদানিং পঞ্চানন খুব সুনাম কুড়িয়েছে। প্রতিবছরই ডাক পরছে। বারোয়ারির সেক্রেটারি শম্ভুবাবু শুভকে খুব পচ্ছন্দ করে। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি ব্যপারে খুব উৎসাহী। সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন।
আজও মায়ের হাতের পান্তা খেয়ে স্কুলের পথে।নতুন স্কুল। অনেক ছাত্র। নতুন স্যার। সবই অপরিচিত মুখ। ফাইভ সি’র লাস্ট বেঞ্চে এককোণে কাচুমাচু মুখে বসে থাকে শোভন। স্যারেরা আসেন, পড়ান। পিরিয়ডের পর পিরিয়ড যায়। কিন্তু কিছুই যেন মাথায় ঢোকে না। মাথার ওপর দিয়ে যায়। সুমন স্যারের ক্লাস। ইংরেজি পড়ান। মনের কোণে অজানা ভয়। আজ spelling জিজ্ঞেস করবেন। কী জানি কী হয়…
—পড়া তৈরী তো!
—হ্যাঁ, স্যার।
—দেখি, কার কত দৌড়!
—তপন, তুই বল্? Prince?
ক্লাসে চল্লিশ জন ছাত্র। স্যার একেএকে সকলকে জিজ্ঞাসা করছেন। কেউ পারছে, কেউ পারছে না। এখনও শোভন অধরা।
—Fourteen?
কেউই সঠিক জবাব দিতে পারছে না। স্যার বেশ বিরক্ত।
—কিরে, এই সহজ spelling টা পারছিস না!
—স্যার, Fourteen.
—শোভন! আমি জানতাম তুই-ই পারবি।
সুমন স্যার শোভনের কাছে যায়। পিঠে হাত রাখে। এই অসফল জীবনের প্রথম পুরস্কার । বাড়ি ফিরে শোভন মাকে জড়িয়ে ধরে। দুচোখেে জল।
—কী হয়েছে?
—মা, আমি পেরেছি, আমি পেরেছি।
—কী পেরেছিস?
—সুমন স্যার বলেছে।
—কী?
—আমি পারব… আমি পারব… আমি পারব…
মনের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছা – শক্তি ডানা মেলল নীল আকাশে। পিছন সারির এলেবেলে শোভন আজ প্রথম সারির লক্ষ্যভেদে… । ক্লাসের পর ক্লাস —প্রথম দশজনের মধ্যে শোভন। ক্লাস টেনের টেস্টে প্রথম।

মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের কেউ- ই আজ কাজে যায় নি। ছোট্ট কুঁড়েটা পায়েসের গন্ধে ম – ম করছে। আজ শোভনের জন্মদিন ।
—মা, পায়েস করছ?
—তোর জন্মদিন যে!
—তাতে কী?
—আমাদের বুঝি ইচ্ছা করে না? তার ওপর ফল বেরুবে।
—শুধু শুধু পয়সা নষ্ট।
—হোক্। তোর বাবা মাংস আনতে গেছে। মিস্টিও আনবে। সবাইকে দিতে হবে না?
—মাগো, যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়াব… সেদিন… তুমি দেখ, আমি পারব…
মা-ছেলের চোখের জলে এই হতদরিদ্র পরিবারে আজ উৎসবের ছোঁয়া। বেলা দশটা নাগাদ সুখবর এলো। আশি শতাংশ নম্বর পেয়ে স্কুলের সেরা শোভন।
স্কুল-মাঠে বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠান। সবকাজ ফেলে পঞ্চানন বৌ-মেয়েদের হাত ধরে সবার আগে উপস্থিত। তাদের পরিবারে সাতপুরুষে কেউ স্কুলের ত্রিসীমানায় যায় নি। শোভন স্কুলের সেরা।স্বপ্ন দেখছে না তো?
—আমাদের স্কুলের গর্ব শোভন। শুধু ভালো রেজাল্ট নয়, এমন সভ্য ভদ্র নম্র মেধাবী ছাত্র এ স্কুলের অমূল্য রত্ন। পড়াশোনার বাইরেও নানান বিষয়ে তার দক্ষতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। ভবিষ্যতে পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমরা আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব।
হাততালি প্রশংসা আর পুরস্কারের বন্যায় ভাসতে ভাসতে শোভন যেন কোন্ স্বর্গরাজ্যে।
ঢ্যাম্ কুড়া কুড়… ঢ্যাম্ কুড়া কুড়… ঢ্যাম্ কুড়া কুড়…
ঢাকের বোলে মেতে উঠল স্কুল প্রাঙ্গণ।দুচোখে জলের ধারা। শরীর সমস্ত রস-রক্ত এক করে পঞ্চানন ঢাকি ঢাক বাজাতে লাগল।

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post