অবাস্তব
– “আয় রে পুলু”। নীল কাকু রোজকার মতোই হেসে আমার দিকে তাকালেন। আমি প্রায়ই ভাবি নীল কাকুকে এড়িয়ে কাকিমার কাছে যাবো , কিন্তু লিখতে লিখতে ঘাড় না ঘুড়িয়ে কাকু যে কি করে আমাকে দেখে ফেলে বুঝতে পারি না। আমি মিমির সঙ্গে খেলতে আসি। আমি জানি নীল কাকু খুব মস্ত বড় লেখক। আমার বাবা বলেছে। বাবা তো নীল কাকুর বন্ধু, তাই জানে। আমি মিমির সঙ্গে খেলে কাকিমার কাছে মাঝে মাঝে কাকুর লেখা গল্প – ছোটদের জন্য লেখা যেগুলো সেগুলো পড়ি। কাকু আমাদের পাড়ায় থাকে বলে আমরাও খাতির পাই অন্য পাড়ার লোকেদের কাছে।
সেবার যখন দাড়ি গোঁফ বেড়োনোর পর ছোটদের সঙ্গে সরস্বতী পুজো ছেড়ে বড়দের দূর্গা পুজোতে ঢুকেছি ,সে বছরে একটা দারুন গল্প আমি প্রথম পড়লাম দিকশূন্যপুরের গল্প। নীলুর গল্প , বন্দনাদির গল্প। এবং সেটা কাকু যে অফিসে চাকরি করেন সেই পত্রিকারই শারদীয়া সংখ্যায়। ভীষণ একটা আমার মনের পছন্দের সঙ্গে মিলে যাওয়া জায়গা …মানুষদের গল্প। মনে হলো এরকম একটা জায়গার কোথাও বোধহয় আমার মনেই ছিল। আমি নীল কাকুকে জিজ্ঞাসা করলাম
-কাকু এই জায়গাটার কথা কে লিখেছে বলতো ? নাম দিয়েছে নীললোহিত। তুমি কি তাকে চেনো ?
-আরে চিনবো না কেন ওটা তো আমার বন্ধু নীললোহিতের লেখা।
-সত্যি কি এরকম জায়গা আছে ? আমার মনে তখনো সন্দেহ।
– তা আমি জানি না। দেখা হলে নীললোহিতকে জিজ্ঞাসা করবো
-কেন রে ? তুই কি যাবি নাকি দিকশূন্যপুরে ?
– হ্যাঁ , খুব ভালো লাগলো জায়গাটার কথা। খুব ইচ্ছে করছে।
আমাদের সেই সময়ে সব কিছু বিশ্বাস হতো। সেই দিনে কাঁটা ঝোপের বাস্তবতা সামনে ছিল না, অনেক আলো বাতাস আর খোলা জানালার মন ছিল। এতো জটিলতার জাফরী দেওয়া বাড়িতে বাস ছিল না , হৈ চৈ করা , হো হো করে হেসে ওঠার মতো একঝাঁক মানুষ ঘুরে ফিরে বেড়াত।
-আমি যদি যাই তোকেও নিয়ে যাবো। নীল কাকু আমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিলেন।মা যেমন করে রোজ রাতে আমার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়াতো ঠিক তেমনি করে।
– সত্যি ! অবাস্তব নয় তো ! আমার সন্দেহ থেকেই যায় কারণ মা চলে যাবার পর যদিও সবাই বলতো – কাঁদিস না পুলু , তোর মা ঠিক ফিরে আসবে। আমি বিশ্বাস করতাম। কিন্তু মা তো আসে নি আর । আমার ক্লাসের বন্ধু অনু বলে প্রায়- তোর মা ফিরতে পারে না কখনো । ফিরলে অবাস্তব কান্ড হবে।
– আজকাল তুই বাস্তব অবাস্তব জেনে গেছিস দেখছি। অবাস্তব মানে কি বলতো ? আমি চুপ করে থাকি। কাকু বলযেন- ওরে পাগল, অবাস্তব মানে হলো অবাক করা বাস্তব। বুঝলি কিছু ?
– অনু থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতো। কারণ আমি বুদ্ধিমান হতে পারি নাকি! আমার অ্যানুয়াল পরীক্ষার যা ফল হয়…. ! অনু প্রতি বছর ফার্স্ট হয়।
আমার আর দিকশূন্যপুর কোনোদিন যাওয়া হয় নি। কারণ নীল কাকু কয়েক মাস পরে আমাদের পাড়া ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতায় চলে গেলেন। তার থেকেও মস্ত কারণ -আমি বড় হয়ে গেলাম। আমার বিশ্বাসটাই যে চলে গেলো। কাকুর বন্ধু নীললোহিত একদিন কাকুকে নাকি বলে পাঠিয়েছিলেন -দিকশূন্যপুর যাওয়ার রাস্তাটা বিশ্বাস করে খুঁজে নিতে হয়। না হলে নাকি পাওয়া যায় না। আমি কোনো দিনই নীললোহিত হতে পারলাম না।
কিন্তু একদিন আমি সত্যিই দিকশূন্যপুরে যেতে পেরেছিলাম। তখন আমি অবসর নিয়ে বাড়িতে একা। কারণ আমি বিয়ে করি নি, মা তো ছেলেবেলায় হাত ছেড়ে দিয়ে কবে যে চলে গেছে। বোনেরা বাইরে শ্বশুরবাড়িতে গিন্নিপনার চাকরিতে ব্যস্ত। দুই দাদাই কলকাতায় নামিদামি ফ্ল্যাটের ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের জেলখানার ঘানি টানছে। বাবা অনেকদিন হলো মায়ের সঙ্গে দেখা করে সেখানেই বসবাস করছেন। আমারও খুব বেশিদিন বাকি নেই সবাইকে টাটা করে মা বাবা র ঠিকানায় চলে যাবার। আমাদের দেশের বাড়ি গড় শিবপুরের হরিদা আমার কাছে রয়ে গেছে আমার খাওয়া দাওয়া আর দেখভাল করার জন্য। এখন এই বুড়ো বয়েসে আমার বিশ্বাস ফিরে এসেছে। আমি বেশ দেখতে পাই নীললোহিত কে, বন্দনাদি কে, তারা কেমন ঘুরে বেড়ায় দিকশূন্যপুর গ্রামের দিগন্ত জোড়া মাঠের মধ্যে ,হৈ হৈ করে কি সুন্দর দিন কাটায় তারা। সবাই নিজের মনে করে পরের পাশে দাঁড়ায়, সেখানে কোনো টাকা পয়সা চলে না , যার যেটা দরকার সেটা মাঠে ফলায়। একজন আরেকজনের সঙ্গে ফসল বিনিময় করে ,কষ্ট আছে কিন্তু কারোর কোনো অভিযোগ নেই। সেখানে আধুনিক উপকরণের কোনো চিহ্ন নেই , কিন্তু সবাই কত আনন্দ আর হাসি মজা করে দিন কাটায়। ডাকঘর নেই কারণ সবাই বাকি বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে না। চাঁদের আলোতে তারা পরস্পরের হাত ধরে নাচ গান করে , কেউই কারোর সঙ্গে হিংসা করে না। একমাত্র নীললোহিত ই ব্যতিক্রমী মানুষ , যে বাইরের দুনিয়া থেকে যেতে পারে , কারণ বিশ্বাস না থাকলে দিকশূন্যপুরে যাবার রাস্তা কেউ খুঁজে পায় না। আর দিকশূন্যপুর লোকেরা বাইরের লোকেদের তাদের জায়গাটা দেখতেই দেয় না। জায়গাটা আছে আবার নেই ও বটে।
এই বিশ্বাস থাকলেই ডাক আসে দিকশূন্যপুরের। আমিও একরাতে হঠাৎ করে শুনতে পেলাম বন্দনাদির গলা। -পুলু চালো , তোমার অনেকদিনের শখ যে আমাদের দিকশূন্যপুর দেখার। আমার হাত ধরো। আমি রাতের খাওয়া শেষে কাগজ পড়ছিলাম। ঠিক তক্ষুনি বন্দনাদির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। ভুলে গেলাম যে সদর দরজা খোলা রইলো।
যখন এসে পৌঁছলাম দিকশূন্যপুরে , দেখি গ্রামে ঢোকার মুখেই শীত কালের ভোরের রাতের কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নীললোহিত আর বন্দনাদি। আমি ঘাবড়ে গিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। বললাম -বন্দনাদি তুমি তো ডাকলে। আমি রাতের খাবার খেয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলাম বিছানায়। তুমি আমাকে ডাকলে আমার সঙ্গেই তো এলে। তাহলে এখন আমার জন্যে এখানে দাঁড়িয়ে কি করে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
এটাই হয় যে পুলু। যদি কেউ সত্যি করে বিশ্বাস করে তাহলে আমরা তাকে ডেকে নিই। তার হাত ধরি ঠিকই , কিন্তু আসলে সে একলা আসে। আমরা এখানেই তার জন্য অপেক্ষা করি।
দু দিন থেকেই যাব , হরিদা যেদিন আসার কথা তার আগে পরে ফিলেই হবে।
এখানে এলে বাড়ির কথা বলা যাবে না পুলু। যদি তুমি বেশি বাড়ির কথা ভাব তাহলে আমরা তো তোমাকে থাকতে দেব না. কারণ তুমি তাহলে দেখবে আমরা তোমার চোখের সামনেই আর নেই।
নীললোহিত দেখলাম হো হো করে হেসে উঠলো।
বন্দনা দি আমাকে ওর বাড়ি দিকে নিয়ে চললো।
-আজ আমার ঘরে শসা আছে , নীলু এখানে যার বাড়িতে আছে সে আমার বাকি শসা গুলো নিয়ে কিছু খৈ আর নারকোল দিয়ে গেছে। তোমাকে কিন্তু তা ই খেতে হবে পুলু।
-বন্দনা দি আমি তো আজ কিছুই খাব না। আমি তো খেয়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে যখন কাগজ পড়ছিলাম তখনি তো তুমি আমাকে নিয়ে এলে।
কয়েকদিন যে কাটলো জানি না। কিন্তু এমন একটা স্বপ্নের দেশে যে আমি এসেছি সেটা সত্যি না আরো কিছু সেটা বুঝতেই আমার অনেকদিন কেটে যাবে বোধহয় ।
তবে আমাকে ফিরতেই হবে. হরিদা কে একবার বলতে হবে, না হলে বুড়ো মানুষটা আমার কথা ভেবে পাগল হয়ে যাবে। আমাকে খুব ভালোবাসে সে বন্দনা দি। তবে এই একবার। আর কোনোদিন এই সবুজ মাঠ ঘাট আর আদিগন্ত নীল আকাশের দেশ ছেড়ে আমি যাব না।
বাড়ি ফিরে বাকি সময়টা হরিদার জন্য বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। আমি তো এখন দিকশূন্যপুর রাস্তা চিনে গেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যেতে হবে আমাকে ।
-পুলু দাদা , এই ভোর রাতে বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছো কেন , ঠান্ডা লেগে যাবো যে। হরি দাদা আমাকে ঠেলে ওঠানোর চেষ্টা করতেই আমি ভুলে গেলাম দিকশূন্যপুরের যাবার রাস্তা।
না এখনো পর্যন্ত মনে পড়ে নি।
View Comments
The Netizen
– “আয় রে পুলু”। নীল কাকু রোজকার মতোই হেসে আমার দিকে তাকালেন। আমি...