Sankars Creation

সুজাতা দাসের গল্প

সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। টিপটিপ, টুপটাপ, রিমঝিম, ঝমঝম ।বৃষ্টিরানীর মিষ্টি গানে ঘুম চোখ খুলেই তাপস বাবু পণ করলেন- না, আজ যতকাজই থাক, ঘরের বাইরে পা দেব না। রিটায়র্ড মানুষ। সংসারের তাগিদে ব্যাংক, পোস্ট অফিস, বাজার করার মতো ব্যাজার কাজ সারেন বাধ্য হয়ে। বাকি সময় ছবি আঁকা, গীটারে সুরে তোলা । গান শোনা, টিভি দেখা তো আছেই। অবসর জীবন কাটছে মন্দ না।
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম- না, কথাটা মিলল না। গিন্নীর মুখে আসন্ন কালো মেঘের ঘনঘটা। বারবার মনে করে দেওয়া সত্ত্বেও তেল,চা,চিনি, আদা আসে নি। সুমিতা সাফ জানিয়ে দিল,ও বেলা চা বন্ধ। রান্নাও।
গিন্নীর থমথমে মুখের গজগজানি শুনতে শুনতে তাপস বাবু পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে বেরোতে গেলেন। সেখানেও বিপত্তি। কাল কাদায় পড়ে চটির দফারফা হয়েছিল, ভুলেই গেছিলেন। অগত্যা অন্য এক জুতো  পায়ে গলিয়ে, ছেঁড়া চটি, বাজারের থলি আর একমুখ বিরক্তি নিয়ে সাইকেলে চাপলেন।

স্টেশন রোডে রামু – মুচির দোকান। রামুর ভালো নাম রামশরণ পাশোয়ান। দেশ-ঘর বিহারের ছাপড়া।এখানে প্রায় তিনপুরুষ তাদের বাস। দশ-ফুট বাই বারো -ফুটের একটা দোকান ঘর। প্রায় বছর চল্লিশের পুরোনো। অবশ্যই ভাড়ার। সেখানেই খাওয়া, থাকা, শোওয়া, রুটি – রোজগার —সবকিছুই। বাপ – ছেলের সংসার । বৌ দেশ – ঘরে। গ্লুকোমায় দৃষ্টিশক্তি প্রায় ক্ষীণ। কিন্তু জুতো সারাই  এ রামুর হাত কথা বলে।শুধু জুতো সারাই নয়, নতুন জুতো বা চটির অর্ডারও আসে। বাঁধা খরিদ্দারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। পঞ্চাশোর্দ্ধ মানুষটির মুখে হাসি লেগেই থাকে।
—রামু ! চটিটা দেখোতো? সারানো যাবে কী?
সাইকেলটা রেখে দোকানে ঢুকে তাপস বাবু হকচকিয়ে গেলেন। পায়ের আওয়াজে যে একগাল হেসে তাকত, আজ একমনে জুতো সারাই-এ ব্যস্ত?
—ও রামু ! ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? শরীর খারাপ?
— বাবুজী! ও আপনি! না না তবিয়ত ঠিক আছে।
মাত্র মাস দুয়েক পর দেখা। বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। চোখে  মুখে সব হারানোর ছাপ। মুখে কোনো হাসি নেই। এ কোন্ রামু?
—কিষাণকে দেখছি না? দেশে গেছে?
—না বাবুজী। ও তো আর নেই!
—নেই মানে? কোথায় গেল?
—ভগবন কে পাস…
ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল রামু। তাপস বাবু এই অপত্যাশিত ঘটনায় হতবুদ্ধি।
—কেঁদো না রামু। কী এমন হলো? অসুখ করেছিল?
—তা বলতে পারেন ।বড়লোকের ঘোড়া রোগে ছেলেটা মরল বাবুজী।
—সে কেমন রোগ?
—ইশক্ বাবুজী… ইশক্…
বাঁধ ভাঙা বৃষ্টির মতো রামুর কান্নাধরা গলায় সে কাহিনী অঝোরে ঝরে পড়ল। তাপস বাবু নির্বাক শ্রোতা।


একমাত্র ছেলে কিষাণ। স্কুলের গন্ডী পার হয়েছে কোনো রকমে। কিন্তু খেলাধুলায় চৌখস ।খুব ভালো ফুটবল খেলে। ছেলের ইচ্ছাতেই একটা ক্লাবে ভর্তিও করে দিয়েছে। রীতিমত প্র্যাকটিস করে। ক্লাবের একজন তুখোর খেলোয়াড় হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যায়। বছর তেইশের কিষাণ পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির পেটানো চেহারার তরতাজা যুবক। খেলা আর বাবার কাজে হাত লাগানো —এইছিল কিষাণের জগত।বয়সের ধর্ম। দুচোখেে রঙিন স্বপ্নের হাতছানি। ক্লাবেই মণিকার সাথে আলাপ। যোগার ক্লাসে শনি রবিবার আসত। তন্বী, লাবণ্যময়ী। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় এম. এ পড়ছে। খুব উচ্ছল, হাসিখুশি। প্রথম দেখায় কিষাণ মুগ্ধ। নিজের যোগ্যতা নিয়ে ভাবতে চায় নি। কিষাণের সুপুরুষ চেহারা আর ভদ্র স্বভাবের কাছে মণিকাও একদিন হার মানল। চিরকালীন অসম প্রেমের আরও এক ইতিহাস।
মণিকা ভালো গীটার বাজায়। বাড়িতে দু-দুটো গীটার। একটা ইলেকট্রিক গীটারের খুব শখ। জন্মদিনের বিকালে বাড়িতে বিশেষ অনুষ্ঠান। তবুও মণিকা পার্কে আসে কিষাণের ডাকে। হাতে ইলেকট্রিক গীটার। মণিকা অবাক। কিষাণ তার জন্য গীটার এনেছে। আনন্দের মধ্যে যদিও জানতে চেয়েছিল এতো টাকা কোথা থেকে এল।উত্তরের অপেক্ষা না করেই আনন্দে আত্মহারা মণিকা সেদিন ফিরে গিয়েছিল। শুধু মণিকার মুখের হাসিটুকুর জন্য কিষাণ তার এতোদিনের সামান্য সঞ্চয় নিঃশেষ করে ফেলেছে ।
এই গীটারই কাল হলো। মণিকার বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল। চিরকাল যা ঘটে তাই ঘটল। মণিকার বাড়ি থেকে বেড়োনো বন্ধ হলো। ফোনও বন্ধ। দিনের পর দিন মণিকার দেখা না পেয়ে দিশেহারা কিষাণ ছুটে যায় মণিকার বাড়ি। পাগলের মতো ডাকাডাকি শুরু করে। বাড়ির চাকর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেয়।তবুও হার মানল না। তীর্থের কাকের মতো কিষাণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির গেট ধরে।

একদিন সকালে হঠাৎই স্থানীয় কাউন্সিলর সাথে নিয়ে মণিকার বাবা, দুই দাদা রামুর দোকানে হাজির। রামু বিন্দু বিসর্গও জানত না। তাদের সব কথা শুনে হতবাক। কিষাণ দোকানেই ছিল। তার হাতে মণিকার লেখা চিঠি তুলে দিয়ে তারা জানায়, মণিকা চায় না এই সম্পর্ক। রীতিমত হুমকি দিয়ে যায়। কাউন্সিলরের সামনে কোর্ট পেপারে মুচলেকা দিতেও বাধ্য হয় কিষাণ।
আজ পর্যন্ত যে ছেলেকে উঁচু গলায় একটাও কটু কথা বলেনি, আজ লজ্জায় দুঃখে ক্ষোভে ফেটে পড়ল রামু।কিষাণের গালে সপাটে এক চড় মেরে যা মুখে এলো বলে গেল।
পরের দিন থেকে ছেলে চুপচাপ। শান্ত। প্র্যাকটিসেও যায়। কাজেও খুব মনোযোগী। রামু নিশ্চিন্ত। আজকালকার ছেলেদের নিয়ে বড়ো চিন্তা। পনেরো দিন কেটে গেল।

সেদিন ২২শে জুন। হঠাৎই একটা জরুরী কাজ পড়ে গেল। কলকাতা যেতে হবে। ফিরবে ২৩শে জুন সকালে। কিষাণকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রামু বেড়িয়ে গেল। পরের দিন ফিরল, তখন ঘড়িতে সকাল এগারোটা। কী ব্যাপার? এখনও দোকান বন্ধ। এতবেলা পর্যন্ত ছেলেটা ঘুমোচ্ছে? অনেক ডাকাডাকিতে সারা না পেয়ে অস্থির বাবা আশেপাশের লোকজন ডেকে দরজা ভাঙতে বাধ্য হলো। সিলিং ফ্যানের রডে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে কিষাণের নিথর দেহ।
—বাবুজী!
সম্বিত ফিরে এলো তাপস বাবুর।
—বলো রামু।
একটা পলিথিন প্যাকেট থেকে একমুঠো কাগজের টুকরো তুলে দিল তাপস বাবুর হাতে।
—কী এগুলো?
—আপনিই দেখুন। অনপড় আদমী। সবাই বলছে মুহব্বতের কথা।
I love you. I love you. I love you… তাপস বাবু হাত থেকে কাগজের টুকরো গুলো মাটিতে পড়ে গেল। পরম যত্নে রামু কাগজ গুলো আবার প্যাকেটে ভরল।
—ওর পকেটে পেয়েছি। ফেলতে পারছি না।
এতো যন্ত্রণার মধ্যেও কথায় কথায় রামুর হাতের কাজ শেষ।
—নিন, বাবুজী। হয়ে গেছে।
—হয়ে গেছে? আজ আসি রামু। অনেক দেরী হয়ে গেল। মন খারাপ কোরো না। ভালো থেকো।
—বাবুজী! একটা উপকার করবেন?
—হ্যাঁ, বলো।
—ওটার কিছু ব্যাবস্থা করা যাবে?
ঘরের এককোণে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চেরি কালারের একটি ইয়ামাহা ইলেকট্রিক গীটার। কিষাণ মারা যাবার পর মণিকার বাড়ি থেকে ফেরত দিয়ে যায়।
—ওটাকে সহ্য করতে পারছি না। ওটাই যত নষ্টের গোড়া। আমার কিষাণের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। আপনি নিয়ে যাবেন?
—বিক্রি করে দাও। দাম পাবে।
—আমার বেশী দামের দরকার নেই। বিনি পয়সায় না নিতে চান, কিছু দিয়ে নিয়ে যান।
চরম অস্বস্তি নিয়ে তাপস বাবু উঠে দাঁড়ালেন।
—রামু আজ আসি। বাজারে যেতে হবে।
একমিনিটও সময় নষ্ট না করে তাপস বাবু সাইকেলের প্যাডেলটায় জোরে চাপ দিলেন। নিষ্পলক শূন্য চোখে রামশরণ তাকিয়ে থাকে বৃষ্টি ভেজা রাস্তার দিকে।

সুজাতা দাস

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post