Sankars Creation

তপন বিশ্বাস

।। এক ।।

রিটায়ারমেন্টের পর পাকাপাকি ভাবে দেশের বাড়িতে ফিরবে প্রিয়াংশু । সেরকমই ইচ্ছে নিয়ে এবার বাড়িতে এসেছে কয়েকদিনের জন্যে । ছেলে শুভ্রাংশু ব্যাঙ্গালোরে আইটি সেক্টরে আছে । কোলকাতার ফ্ল্যাটটা থাকবে । শুভ্রাংশু যদি কোনদিন কোলকাতায় ফিরে আসে তখন কাজে লাগবে । তাছাড়া প্রিয়াংশুও মাঝে মাঝে যাবে কোলকাতায় । ফাঁকা বাড়ি ফেলে রাখার অনেক অসুবিধা । ফ্ল্যাটে ওসব ঝামেলা নেই । কেয়ারটেকারকে বলে এলেই হবে চিঠিপত্র এলে বোসবাবুকে দিয়ে দিতে । প্রতিবেশী হিসেবে বোসবাবু বেশ ভালই । রিটায়ার্ড অধ্যাপক । দু’বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন । ছেলে চাকরি করে আইটি সেক্টরে । আজকাল তো ওই একটা সেক্টরেই যা চাকরি হচ্ছে । মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বছর চারেক আগে। মেয়ে জামাই দুজনেই ব্যাংকে চাকরি করে ।
অনেকদিন ধরেই ভাবছিল দুটো ঘর বানানোর প্রয়োজন । ওদের নিজস্ব কোন ঘর নেই এখন । দাদা আর ভাই দুজনে ভাগ করে নিয়েছে ঘরগুলো । প্রিয়াংশুরা এলে ভাই একটা ঘর ছেড়ে দিত, ব্যস । এভাবেই চলে এসেছে এতদিন । এবারও তাই হয়েছে ।
শুচিস্মিতা আগেই বলেছিল, “ওখানে গিয়ে কিন্তু ঘর তুলতে হবে তোমায় । তোমার ভাগে তো কিছুই রাখেনি ওরা । একটা ঘর তো তোমার নামে রাখা উচিত ছিল । এখন ঘর বানালেও সেই পেছন দিকে বানাতে হবে । আমাদের জন্যে ওরা সামনের দিকে কোন জায়গাই রাখেনি ।”
প্রিয়াংশু বলেছিল, “ওকথা বলছ কেন ! জয়েন্ট ফ্যামেলি আমাদের । আগেভাগে কেউ আলাদা হওয়ার কথা ভাবিনি কখনো। এখনও ভাবি না । আমি বাইরে ছিলাম তাই ওরা ঘরগুলো ব্যবহার করেছে । এই তো মাত্র কয়েকখানা ঘর । তাছাড়া বিতান, ঈশান দুজনেই বড় হয়েছে । ওদের তো এখন আলাদা ঘরের প্রয়োজন ।”
-কেন তুমি বা তাতান কি এ বাড়ির ছেলে না ? তোমাদের কথাও তো ভাবা উচিত ছিল । বলেছিল শুচিস্মিতা । কথাটা ঠিক । তবু শুচিস্মিতার সুরে সুর মেলায়নি প্রিয়াংশু । বরাবরই এমন সে । কখনো মুখ ফুটে কিছু চায়নি কারোর কাছে । সেদিন হেসে বলেছিল, বাড়িতে না থাকলে এমনটা তো হতেই পারে । ঘর কি কখনো খালি পড়ে থাকে ? আমার নিজের লোকেরাই তো ব্যবহার করছে । দুটো ঘর তুলে নিলেই হল । ক’টা দিন একটু কষ্ট হবে । ওটুকু মানিয়ে নিও ।
গোল বাধল ঘর কোথায় হবে তা নিয়ে । উঠানের ডানদিকে কুয়োর পাড় ঘেঁসে যে জায়গাটা আছে সেখানে একটার বেশি ঘর উঠবে না । তাছাড়া ওখানে বাতাবি লেবুর গাছটা আছে যে । গাছটা এখনও ফল দেয়। বৌদি তো বলেই ফেলল, “ছোড়দা, তুমি পেছনের দিকে ঘর তুলে নাও না । পেছনটা তো পুরো ফাঁকাই পড়ে আছে ।”
শুচিস্মিতার পছন্দ হয়নি কথাগুলো । না হওয়ারই কথা । সে উত্তর দিল সঙ্গে সঙ্গেই, “বাহ্, দিদিভাই,বাঃ ! তোমরা সবাই সামনের দিকে থাকবে আর আমরা বাড়ির পেছনে ! বের হওয়ার রাস্তাটাও পেছন দিক দিয়ে করে নিতে হবে ?” ওর কথায় ব্যঙ্গ্যোক্তি ঝরে পড়ে।
কমলিকা তাড়াতাড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামে, “নাহ্ শুচিদি, রান্না ঘরের পেছনের দিকে একটা দরজা করে নিলেই তো বাড়ির সঙ্গে জয়েন্ট হয়ে যাবে ।” ভাই বউ একটু মুখরা হলেও প্রিয়াংশুকে মান্য করে । বুদ্ধিমতি মেয়ে, তবে নিজেদের অধিকার ছাড়তে রাজী নয় কোনভাবেই সেটাও বুঝিয়ে দেয় । দাদা বা ভাই কেউই কোন মন্তব্য না করলেও প্রিয়াংশু জানে ওদের মৌনতাই ওদের সম্মতির নীরব সমর্থন ।
বিতান বলে, “ভালোই হবে আমরা আবার একসাথে থাকব । বাড়ির ছেলেরা বাড়িতে ভিড় করে থাকলেই তো মজা ।” বিতান পরবর্তী প্রজন্মের বড় ভাই । সে তার দায়িত্ববোধ থেকেই হয়ত কিছু বক্তব্য জানানোর প্রয়োজন মনে করে জানিয়ে দিল তার মতামত। যদিও আঠাশ বছর বয়স হয়ে গেলেও সংসারের দায়িত্ব সম্বন্ধে সে এখনও ওয়াকিবহাল নয় । বাইক নিয়ে কখন কোথায় ছুটছে সেটুকু জানার অধিকার নেই এ বাড়ির কারোর । মাঝে মাঝে ফোন করে কাকুর খোঁজ নিত সে । ইদানীং সেটাও বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু তাতানের সঙ্গে হোয়াটস্ অ্যাপে যোগাযোগ রাখে নিয়মিত । তাতান দূরে থাকে বলেই হয়ত সম্পর্ক ভালোই আছে । ঈশানের সঙ্গে একদমই বনে না ওর ।
বড়দার দেখাদেখি ঈশানও মুখ খোলে, “ছোড়দা এখানে থাকলে আমার ভালো হয় । ছোড়দা তো আমাকে খুব ভালোবাসে, বড়দার মতো মারে না কক্ষনো । কিন্তু ছোড়দা তো জেঠুর মতো বাইরেই থাকবে । পূজোর ছুটিতে আসবে শুধু ।”
ঈশানের এই বয়সে তাতান এ বাড়িতে এলে বলত, “আমরা আজ ভিড় করে শোব দুপুর বেলায় ।” ওর জ্যাঠাইমা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করত, “আর রাতে কী করবি ?” তাতান হেসে বলত, “রাতে বাবি’র কাছে ছাড়া আমি ঘুমাই না ।”
আজ তাতাই যদি আসত তবে বাড়ির মানুষগুলোর কথা শুনে কী ভাবত কে জানে ? ছেলেটা তো জানে ওর বাড়ি মানে এটাই । কোলকাতার ফ্ল্যাটটা কেনা হয়েছে বাবি কোলকাতায় চাকরি করত তাই । যে যখন কোলকাতায় যাবে সেই থাকবে ফ্ল্যাটটাতে । প্রিয়াংশু ব্যাঙ্ক থেকে লোন করে কিনেছিল ফ্ল্যাটটা ।
নদীর গতিপথের মতো আলোচনার গতিপথ বদলে যায় । মূল মামলার নিষ্পত্তি হয় না ।
তিস্তার দু’পারের মানুষ অনেক ভাঙাগড়ার সাক্ষী । আটষট্টির ভয়াবহ বন্যা থেকে আজ অবধি নদীপথ বদলেছে বেশ কয়েকবার । তিস্তা ব্যারেজ হওয়ার পর শুখা মরশুমে তিস্তার কঙ্কাল পড়ে থাকে শুধু । জলচুক্তি নিয়ে বারকয়েক আলোচনা হয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে । সে মামলার নিষ্পত্তিও হয়নি আজও । বর্ষায় এখনও পাড় ভাঙে নিয়মিত । বন্যার জলে প্লাবিত হয় দু’পারের গ্রামগুলো । তবে আটষট্টির মতো ভয়ঙ্করী বন্যা হয়নি আর । সারা পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের জলবায়ুরও পরিবর্তন হচ্ছে । আগের মতো বৃষ্টিও হয় না এখন । বর্ষাও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে । কখনো নিম্নচাপ আর ঘূর্ণাবর্তের হাত ধরে বৃষ্টি ভাসায় উত্তর ও দক্ষিণকে । কখনো বাংলাদেশে চলে যায় ঘূর্ণাবর্তের হাত ধরে । আবার কখনো ঝাড়খণ্ড বর্ষাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যায় লাল মাটির দেশে । জলে ভাসে দক্ষিণবঙ্গ ডিভিসি, পাঞ্চেত আর মাইথনের ছাড়া জলে । প্লাস্টিক, অনিয়ন্ত্রিত বাড়ি, হাইরাইজ সমস্যা বাড়ায় আরো । মরানদীর বুক ভেসে যায় জলে । বানভাসি মানুষের দুর্গতি বাড়ে জমা জলে ।
পরেরদিন দুপুরে ফাঁক পেয়ে শুচিস্মিতা বলল, “দেখলে তো তোমার আপনজনদের কেমন করে বুঝিয়ে দিল তোমার জায়গা কোথায় ? এখনো এখানে থাকার কথা ভাববে ?”
প্রিয়াংশু আহত হয় শুচিস্মিতার কথায় । “শুচি, ওরা শুধু আমার আপনজনই না । আমার মনে হয় ওরা আমার শরীরের এক একটা অংশ । ওরা আলাদা হয়ে গেলে আমি কি ভাল থাকব ? একবার ভেবে দেখ না একটা ছোট্ট দোকানের উপর দু’ভায়ের সংসার চলে। ওরা তো একটু বিষয়ী হবেই । ওদের তো আর কিছু নেই । আমার একটা ফ্ল্যাট আছে । পেনশন পাব । চাকরি করা একটা ছেলে আছে । তুমি কোথায় আমার পাশে দাঁড়াবে তা না আমার মনটা বিষিয়ে দিতে চাইছ । আমার মনটা বিষিয়ে গেলে তোমার কি মঙ্গল হবে ? কারোর মন একবার বিষিয়ে গেলে সেটা কারোর পক্ষেই ভাল হয় না । একটা কথা জেনে রেখো এ বাড়িটার পরতে পরতে আমার মা বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে । তোমার যেমন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আমারও তো ইচ্ছে করে আমার বাবার বাড়িতে থাকতে । আমাদের সমাজের সৃষ্ট নিয়মে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে স্বামীর ঘরই মেয়েদের ঘর হয় । না হলে তুমিতো তোমার বাবার বাড়িতেই থাকতে পারতে ।” একসঙ্গে এত গুলো কথা বলতে হল বলে খুব খারাপ লাগছিল প্রিয়াংশু’র ।
শুচিস্মিতা শোয়ার তোড়জোড় করছিল । দুপুরে একটু না ঘুমালে ওর চলে না । বরাবরের অভ্যাস । ভোরবেলায় ওঠে । ঘুম তো পাবেই । প্রিয়াংশু’র কথা শোনার পর হঠাৎ কেমন বদলে গেল ওর চোখ-মুখ । চোখের মধ্যেই নাকি ফুটে ওঠে মানুষের আসল রূপ। তাই যদি হয় তবে ও কী শুচিস্মিতাকে এতদিন চিনতে পারেনি ! ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় করছে প্রিয়াংশুর । কেমন যেন হিংস্রতা ফুটে উঠেছে ওর চোখে । হিস্ হিস্ করে উঠল সাপের মতো, “তুমি তো শুধু আমার দোষ দেখতে পাও । ওদের দোষ দেখতে পাও না । ওরা যে তোমার থেকে সব কিছু পেয়েও তোমার প্রাপ্য কিছুই দিল না সেটা দেখতে পাও না । আমার আর কিছু দরকার নেই । ফিরে চল কোলকাতায় । ওখানেই থাকব ।”
এ শুচিস্মিতাকে চেনে না প্রিয়াংশু । অপরিচিত মনে হয় । জীবনের সায়াহ্নে এসে সে কি দেখছে ! সামান্য জায়গা-জমি নিয়ে আপনজনদের সঙ্গে যে বিবাদ করতে হবে সে কোনদিনই ভাবেনি । সবার সঙ্গে মিলেমিশে জীবনের শেষ কটা দিন আনন্দে কাটিয়ে দেবে বলেই সে ফিরে আসতে চেয়েছে । একবারও ভাবেনি শুচিস্মিতা এসব ভাববে । ভাইয়েরা যে তাদের দখলদারি ছাড়বে না সেটা অনুমান করেছিল আগেই । তা ভেবে মনে মনে নিজেকে তৈরিও করে রেখেছিল । দুটো ঘর তুলে নেবে ভেবেছিল অনেক আগেই । ছেলেটাও মাঝে মাঝে এসে থাকবে তার আপনজনদের সঙ্গে । দেশ ও মাটির ছোঁয়া পেতে কার না ভাল লাগে । যদিও তাতানের এখন এ বাড়ির উপর তেমন টান নেই । এর জন্যে এ বাড়ির মানুষগুলোই দায়ী । তাতান বলে, সবাই শুধু ভাষণ দেয় । কাজের কাজ কিছু করে না । মাঝে মাঝে মনে হয় তাতানটা ওর বড় মামার মতো । যেমন গায়ের রঙ তেমনি স্বভাবেও । মুখটা পেয়েছে ওর মায়ের মতো । ওর শুধু একটাই জিনিস পেয়েছে তাতান । জেদ । প্রিয়াংশুর ছেলে প্রিয়াংশুর মতোই জেদী । মনটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল প্রিয়াংশুর । চিনচিন করছে বুকের ভেতরে । বড্ড একা একা লাগছে এখন । মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করল সে । একটা আবছা অবয়ব । যন্ত্রণাক্লিষ্ট একটা মুখ ভেসে উঠছিল ভেজা চোখের পর্দায় । ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল প্রিয়াংশু ।

।। দুই ।।

প্রিয়াংশু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই খুব কান্না পেল শুচিস্মিতার । কান্নার বেগ বুক থেকে উঠে এলেও গলার কাছে আটকে গেছে কোনভাবে । চোখ পর্যন্ত পৌঁছায়নি ফলে দম আটকানো অবস্থা এখন । জল থেকে ডাঙায় তোলার পর মাছের অবস্থার মতো। মনে হচ্ছে এক্ষুনি দম আটকে মরে যাবে সে । বালিশটা বুকে চেপে ধরে বুকটাকে হাল্কা করার প্রাণান্তকর চেষ্টা সত্বেও হাল্কা হয় না । চোখের আগুনটা এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে যে । অথচ ও এভাবে বলতে চায়নি । বাধ্য হয়ে বলে ফেলেছিল । মানুষটা সবার জন্যে সারাজীবন শুধু ভেবেই গেল । সবার জন্যেই অনেক করেছে । কিছু চায়নি কারোর কাছে । সেই বিয়ের দিন থেকেই লোকটাকে সবার চেয়ে আলাদা মনে হয়েছিল । বিয়েতে দাবি তো কিছু ছিলই না ,উপরন্তু আশীর্বাদের সোনার বোতামটাও কোনদিন পরাতে পারেনি শুচিস্মিতারা । ওর মায়ের কথাও শোনেনি গোঁয়ার মানুষটা । প্রথম প্রথম খুব রাগ হত ওর উপর । খুব দেমাকি মনে হয়েছিল ওকে । কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পেরেছিল লোকটা সত্যিই ভিন্ন প্রকৃতির । নিজের প্রতি আস্থা আর সততার উপর নির্ভর করতেই সে পছন্দ করে । লোভ আর ঈর্ষা দুটোই ওর মধ্যে নেই । তবে অসম্ভব রকমের জেদী মানুষটা । ওটাকেই শুচিস্মিতার ভয় ।
শরীরে নানারকম রোগ বাসা বেঁধেছে । ডায়াবিটিসের ওষুধ খেতে হয় নিয়মিত । ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেয়েও নিস্তার নেই বাতের ব্যথার । মুভ থেকে ভোলিনি সব ফেল । বাতের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে প্রায়ই । এখানে ভালো ডাক্তারেরও খুব অভাব। তেমন কিছু হলে সেই কোলকাতায় ছুটতে হবে । প্রিয়াংশু’র শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না আজকাল । ওরও তো ব্লাডসুগার । ইদানিং চোখের সমস্যা হচ্ছে ।
ঘুম আসছে না কিছুতেই । দিদিভাই কতদিন বলেছে, তোর বরের তো অনেক টাকা । এখানে একটা জমি কিনে রাখতে বল । হাসি পায় ওর । যে মানুষটা সারাজীবন শুধু বিলিয়েই গেল, নিজের জন্যে জমালো না কিছুই তাকে নিয়ে সবাই কত কিই না ভাবে ! তার নাকি অনেক টাকা ! ওসব নিয়ে কিছু বললে দাতার অসম্মান হয় জানে সে । শুচিস্মিতা তাই হাসতে হাসতে বলেছে, তুমি তোমার দেওরটিকে চেনো না ? এখানে জমি কিনে আলাদা বাড়ি করে থাকবে সে ! এ বাড়িটাই ওর কাছে মায়ের মতো । দেখে নিও রিটায়ারমেন্টের পর এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও থাকবে না সে ।
সেটাই হয়েছে । প্রিয়াংশু ফিরে আসতে চায় । শুচিস্মিতার মনে হচ্ছে না ফিরলেই ভাল হয় । দূরে থাকলে সম্পর্ক ভাল থাকে । এখন যে কী হবে কে জানে । দেওর শীতাংশু যা গোঁয়ার গোবিন্দ । ভাসুরকে বরং কিছুটা অ্যাডজাস্টেবল বলে মনে হয় । যদিও বড় ভাই হয়ে বড় ভাইয়ের তেমন কোন দায়িত্ব পালন করেনি কোনদিন । ওদিকে কমলিকা কিছুটা বুঝদার, কিন্তু মুডি । বিতান বদরাগী হলেও কাকাকে ভালবাসে । ঈশানও ওর ছোটো জেঠুকে খুব ভালবাসে । তবে ও খুবই ছোট । বৈষয়িক বুদ্ধি হয়ত হয়নি এখনও । তাতানকে নিয়ে চিন্তা আছে । তাতান এসব শুনলে হয়ত রেগে যাবে । বলবে কোলকাতায় ফিরে যেতে নয়ত ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যেতে চাইতে পারে । সে বাবার মতো জেদী আবার কাকার মতো গোঁয়ার । শুচিস্মিতা অনেকদিন ভেবেছে ছেলেটা ওর কিছুই পায়নি । মামাবাড়ির ধাত একটু পেলে ভাল হত ।
এ বাড়ির লোকগুলো শুধু নিতে জানে । প্রিয়াংশু যে কি করে অন্যরকম হল ভেবে পায় না শুচিস্মিতা । ও যখন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল তখন খুব কান্না পেয়েছিল ওর । বাড়ির একমাত্র চাকুরে ছেলে ফলে প্রিয়াংশুর দায়দায়িত্বও বেশি । অথচ এ বাড়িতে ওর নামে কোন ঘর নেই ।
প্রিয়াংশু বলেছিল, “এ বাড়ির দস্তুরই এই । আমরা সবাই মিলেমিশে থাকতে অভ্যস্ত । দাদার বিয়ের পর দাদা ওদিকটায় থাকতে শুরু করে কারণ মা তখনও বেঁচে । বোন যতদিন ছিল ততদিন বোন থাকত পাশের ঘরটাতে । আমি আর ভাই তো একঘরেই থাকতাম। মা থাকত এই ঘরে । এখন থেকে আমরা না হয় এলে এ ঘরেই থাকব । পূজার ঘরটা পাশেই ফলে তোমার তো ভালই হবে।”
ভালো কিছুই হয়নি । প্রিয়াংশুর বড়দি এলে ও ঘরটাতেই উঠত । ছোট ননদ উঠত পাশের ঘরে । বিয়ের প্রথম বছর তেমন অসুবিধা না হলেও একবছর পর থেকেই সব বদলের শুরু । বিশেষ করে পূজোর সময় । বাড়ি ভর্তি লোক, একগাদা কাচ্চাবাচ্চা। ওরা গিয়ে দেখত ওদের কোন ঘর নেই । দু’জনকে দু’জায়গায় অ্যাডজাস্ট করে থাকতে হত । তাতানের জন্মের পর আবার চার পাঁচ বছর শাশুড়ির ঘরটা ওদের জন্যে বারাদ্দ থাকত । সে পূজোর সময় হলেও ওরা ওই ঘরটাই পেত । কিন্তু শীতাংশুর বিয়ের পর আবারও বদল । ছুটিতে বাড়ি ফেরা মানে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া যেন । সারাদিন বিতান আর তাতানের দৌরাত্ম্যে ঘুমানো যেত না । রাতে ছোটো ননদের নাসিকা গর্জনে । বাবা-ছেলে ওদিকের ছোট ঘরটাতে আর শুচিস্মিতার জায়গা হত ননদদের সঙ্গে ।
প্রিয়াংশু এ সব ব্যাপারে কোনদিন গা করেনি । অবশ্য ও কতক্ষণই বা বাড়িতে থাকত । শুধু আড্ডা আর আড্ডা । ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতেই যেন ওর আসা । ছেলেদের ছেলেবেলা আড্ডার আসরে ফিরে আসে স্মৃতির সরণি বেয়ে কিন্তু মেয়েদের ছেলেবেলা আর বোধহয় কোনদিনই ফেরে না । মেয়েদের ছেলেবেলা ছেলেবেলাতেই হারিয়ে যায় । আর বিয়ের পর প্রায় সব মেয়েদের জগতটাই পাল্টে যায় । নতুন জগতটা গড়ে ওঠে ঘরোয়া পরিবেশে । মেয়েদের আড্ডা মানে ঘর গৃহস্থালি আর শাড়ি-গয়না, ফ্যাশান কিংবা ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত ভাবনা । যদিও প্রিয়াংশু ওকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছিল তবু মনে হয় জীবনটা এভাবে কাটাতে চায়নি ও। একটা চাকরি করার খুব ইচ্ছে ছিল । কলেজ, ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী কোন কাজেই এল না। আর পাঁচটা সাধারণ গৃহবধূর মতোই কেটে গেল জীবনটা । প্রিয়াংশু বলত, “বিয়ের আগে যখন চাকরি পাওনি তখন আর চাকরির চেষ্টা করতে হবে না । বিয়ের আগে চাকরি পেলে তোমার জীবনটা হয়ত অন্যভাবে অন্য কারোর সঙ্গে কাটাতে পারতে। সেটা যখন হয়নি তখন আমার সঙ্গেই কাটাতে হবে এবং সেটাও আমার ইচ্ছেয় । চাকরি করা চলবে না তোমার । আমি আমার বউয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছি রীতিমতো শপথ করে।”
শুচিস্মিতা কষ্টের মধ্যেও মুখে হাসি ফুটিয়ে জবাব দিয়েছে, “না না, চাকরি করলেও তোমার সঙ্গেই বিয়ে হত । এটা তুমি মানো আর নাই মানো আমি বিশ্বাস করি বিয়েটা কপালের লিখন।” প্রিয়াংশু ওসব মানে না, তবু সে চুপ করে যেত । শুচিস্মিতা জানে প্রিয়াংশু বউয়ের চাকরির পয়সা খাবে না বলেই চাকরি করা মেয়ে বিয়ে করেনি । চাইলে চাকরি করা কোন মেয়েকে বিয়ে করতেই পারত সে। চাকরিরতা অনেক বান্ধবী ছিল প্রিয়াংশু’র ।
তাতানকে বড় করতে করতে কখন যে এতগুলো বছর কেটে গেল বুঝতেই পারল না সে । তাতান কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই ওর হঠাৎ কাজ কমে গেল । টিভি সিরিয়াল দেখে আর পূজাপাঠ নিয়ে কাটছিল দিনগুলো । তাতান চাকরি পেয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল । খুব একা একা লাগতে শুরু হল তখন থেকে । নিঃসঙ্গতা কাটাতে প্রথম প্রথম খুব ফোন করত পুরানো বন্ধুদের । দেখল ওরা প্রায় সবাই ব্যস্ত । কেউ চাকরিতে, কেউ অন্য প্রফেশনে । ওর তখন মনে হতে লাগল ও একাই বেকার । হতাশা গ্রাস করতে শুরু করেছিল ওকে । মিশনে যাতায়াত শুরু করল । সঙ্গে পূজো আর টিভি সিরিয়াল তো ছিলই । প্রিয়াংশু অফিস থেকে ফিরলেও খুব বেশি কথা হত না । গল্প করতেও ভাল লাগত না । সিরিয়ালের নেশা ওকে এমনই বদলে দিয়েছিল । দু’জন দুটো দ্বীপের মতো ভেসে রইল ওরা ওদের ছোট্ট সংসারে ।

।। তিন ।।

আজ ১৫ই আগস্ট । স্বাধীনতা দিবস । প্রিয়াংশুর নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে । সারাজীবন ধরে সৎ থেকে সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছে । কোনদিন ভাবেনি শেষ বয়সে এসে এমন বিড়ম্বনায় পড়বে । ক’দিন ধরেই ভাবছে কোলকাতায় ফিরে যাবে কিনা । দীপ্তিমান বলছিল, ভাল করে ভেবে ডিসিশান নিস । তুই ফিরে এলে আমার ভালো লাগবে কিন্তু বন্ধুবান্ধবের চেয়ে সংসারের শান্তি আগে । ছোটোবেলার বন্ধু ভালই পরামর্শ দিয়েছে । দীপ্তিমান আর প্রিয়াংশুকে সবাই বলে হরিহর আত্মা । এত বছরেও ওদের সম্পর্কে এতটুকু ফাটল ধরেনি ।
গতকাল আড্ডা মেরে ফেরার পথে একটা ঘটনায় আরো বেশি করে বিচলিত হয়ে পড়েছে ও । বিতানের বয়সী একটা ছেলে কানে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে দেশলাই চাইছিল । কায়দাটা অভিনব । ঘাড় কাত করে মোবাইলটা কাঁধ আর কানের মাঝে চেপে ধরে দু’হাত দিয়ে কাঠি আর দেশলাই ঘর্ষণের ঈশারায় সে জানতে চাইছিল দেশলাই আছে কিনা । ছেলেটার মুখ দেখেই মনে হয়েছিল ছেলেটা সম্ভবত তুষ্টর ছেলে । তুষ্টর দিদি তনিমা প্রিয়াংশুর প্রাইমারী স্কুলের সহপাঠী ছিল । ছোটবেলা থেকেই তুষ্ট খুব দুষ্টু ছিল । বিড়ি খেত খুব । কিন্তু বড় হওয়ার পর যখনই দেখা হয়েছে প্রিয়াংশুকে দেখলে হাতের বিড়ি লুকিয়ে ফেলেছে বা ফেলে দিয়ে এসে কথা বলেছে । আর সেই তুষ্টর ছেলে কিনা দেশলাই চায় । প্রিয়াংশু ভাবছিল, ওকে শুধু এখন কেউ চেনে না, জানেনা তাই নয়। কেউ কেউ হয়ত আউটসাইডারও ভাবে । বাড়িতে ফিরে বিতানকে বলার পর বিতান হেসে বলেছিল, “ওটা বোটন, তুষ্টকাকুর ছেলে । বদমাশ একটা । সবার কাছেই দেশলাই চায় । পার্টি করে তো ।”
পার্টি করে তো কী ! পার্টি করলেই যাকে তাকে অপমান করা যায় ? মানুষের মূল্যবোধ, শিষ্টাচার এগুলো কি সব হারিয়ে গেল ?
সকালের আকাশটা কেমন যেন পানসে হয়ে আছে । আকাশে বাদল মেঘের আনাগোনা চলছে । নর্থ বেঙ্গলে এখন মধ্য বর্ষা । যে কোন মুহূর্তে আকাশ পুরোপুরি মেঘে ঢেকে গিয়ে বৃষ্টি নেমে যেতে পারে । একটা ছাতা সঙ্গে নিয়ে বের হলে ভালো হত ।
পাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল প্রিয়াংশু । রাস্তায় মানুষ জন জটলা করছে । হয়ত ১৫ই আগস্ট বলে রাস্তায় বেরিয়েছে মানুষ। স্বাধীনতা দিবসের উন্মাদনা এখনও তাহলে আছে ! ৭০ বছর হয়ে গেল স্বাধীনতার । অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনও শুধুমাত্র দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্যের জন্য লড়াই করছে । শিক্ষা, স্বাস্থ্য এখনও অধরা তাদের জীবনে । দেশের মানুষ এখনও জানে না স্বাধীনতা দিবসের মানে কী ! লালকেল্লা থেকে অফিস-আদালত,স্কুল-কলেজে এমনকি পার্টি অফিসেও পতাকা উত্তোলিত হয় । কিন্তু একজন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জীবনে তার কী মূল্য ? মানুষকে এখনও দেশাত্ববোধের কথা শেখাতে হয় । দেশাত্ববোধের গুলি খাইয়ে দিলেই কি দেশাত্ববোধ জেগে ওঠে ? অনাহার, দারিদ্র, বেকারত্ব, দেশাত্ববোধের প্রধান অন্তরায় । অত্যাচার, শোষণ, ঘেন্না, বঞ্চনা মানুষকে দেশবিরোধী করে তোলে । অর্থ, স্বাচ্ছন্দ্য, লোভ কৃত্রিম দেশাত্ববোধের সৃষ্টি করে । মধ্যবিত্তের সুখ-দুঃখ থেকে জন্ম হয় অকৃত্রিম দেশাত্ববোধের । জীবনের এতগুলো বছরের অভিজ্ঞতায় সে উপলব্ধি করেছে এইগুলো । কেউ মানুক না মানুক এগুলোই চরম সত্য। এসব কথা প্রিয়াংশুর মাথায় ঘুরপাক খায় আজকাল । একসময় সে দেশাত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কত কবিতা লিখেছে । এখন আর কবিতা আসে না মাথায় । কবিতা লিখতে প্রেরণা চাই । স্বাধীনতা চাই মনের, স্বাধীনতা চাই কলমের । ঘরে বাইরে সর্বত্রই সে যেন নিজেই আজ পরাধীন ।
মোড় ঘুরতেই একজন মহিলা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছেন মাস্টারমশাই ?”
কিছু বলার আগেই টুক করে প্রণামটাও সেরে নিল সে । প্রিয়াংশু বাঁধা দেওয়ার সময়ই পেল না । চেনা চেনা মনে হলেও চিনতে পারল না সে । যথেষ্ট বয়স হয়েছে মহিলার । পঞ্চাশের উপরেই হবে বোধহয় । এ বয়সী একজন মহিলা হঠাৎ প্রণাম করায় একটু বিব্রতও বোধ করছিল সে । আশেপাশে নানা বয়সী মহিলাদের জটলা । সবাই এখন ওদের দিকে তাকিয়ে ।
– চিনতে পারছেন না মাস্টারমশাই! আমি রিনা ।
– রিনা ! তুই ! বেড়াতে এসেছিস বুঝি ? কেমন আছিস ? তোর বাবা কেমন আছে ? মা ? তোর কোথায় যেন বিয়ে হয়েছে ?
ওর এতগুলো প্রশ্ন শুনে রিনা কেমন যেন থমকে গেল । প্রিয়াংশু ভাবছিল সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা এখন একজন মধ্যবয়সী মহিলা । কত বদলে গেছে । শান্ত, লাজুক ছিল খুব । কথাও কম বলত । পড়া বোঝানোর সময় হাঁ করে তাকিয়ে থাকত প্রিয়াংশুর মুখের দিকে । মাঝে মাঝে প্রিয়াংশুর অস্বস্তি হত । প্রিয়াংশু জিজ্ঞেস করত, “কিরে বুঝতে পারছিস তো নাকি ?” সে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে উত্তর দিত, “হ্যাঁ, মাস্টারমশাই।”
রিনা খুব রোগা হয়ে গেছে । চুলে পাক ধরেছে । সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পরা দেখে মনে হয় খুব একটা সুখে নেই । চোখদুটো এমনভাবে নিচের দিকে নামিয়ে রেখেছে যে প্রিয়াংশু ওর মুখটা ভালভাবে দেখতে পারছে না । বীণার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ভাবল রিনা ওর আগের কথাগুলোর উত্তরই এখনও দেয়নি । হয়ত ইচ্ছে করেই উত্তর দিচ্ছে না । একদিন হঠাতই ওদের পড়ানো ছেড়ে দিয়েছিল প্রিয়াংশু । সেদিন কোন কারণে ওদের পড়াতে যায়নি প্রিয়াংশু । পরদিন পড়াতে যেতেই বীণা বেশ রাগতস্বরেই জিজ্ঞেস করেছিল, “কাল কেন আসেননি মাস্টারমশাই ?” ওর কথা শুনে প্রিয়াংশুর মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল । “তোর কাছে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে কেন আসিনি ? তোর বাবাকে বলিস অন্য মাস্টার ঠিক করতে। আমি আর পড়াব না ।” কথাগুলো বলে একমিনিটও অপেক্ষা করেনি সে । চেয়ার ঠেলে উঠে পড়েছিল । রিনা আর্তনাদ করে উঠেছিল প্রায়, “না মাস্টারমশাই ! যাবেন না আপনি ।” প্রিয়াংশু দাঁড়ায়নি, চলে এসেছিল ওদের বাড়ি থেকে ।
ভালো প্রাইভেট টিচার বলে প্রিয়াংশুর তখন খুব নামডাক । বীণার কথায় খুব অপমানিত বোধ করেছিল সে । রিনার বাবা বাড়িতে এসে অনুরোধ করেছিলেন সে তবু যায়নি । তার অবশ্য অন্য আর একটা কারণ ছিল । রিনার বাবার অনুরোধটা ঠিক অনুরোধের মতো ছিল না । বলেছিলেন, “বাচ্চা মেয়ে, হয়ত কি বলতে গিয়ে কি বলেছে, তুমি ওসব ভুলে যাও । আজ থেকে আবার এস ।”
ব্যবসায়ী লোক, সবকিছু হয়ত টাকায় বিচার করেন । তাই মেয়ে যে ভুল করেছে, তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে একটু শাসন করা উচিত সেটাই ওনার মনে হয়নি । প্রিয়াংশুর মনে হয়েছিল ওদের একটা ধাক্কা দেওয়া উচিত ।
রাগ পড়ে এলে রিনার কথা মনে পড়ত মাঝে মাঝে । ডাগর ডাগর দুটো মায়াবী চোখ ছিল ওর । কখনো প্রিয়াংশুর হাসিও পেত মেয়েটার চোখদুটো গরুর মতো ভেবে । সেই মেয়েটা আজ অনেকদিন পর আবার ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে । এখনও প্রিয়াংশুর একটা প্রশ্নেরও জবাব দেয়নি সে । পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষছে মাটিতে । হয়ত সেদিনের কথা মনে পড়ে গেছে ওর। ওর তো সেদিন কোন দোষ ছিল না । সেদিনের কথা মনে পড়ে হয়ত অভিমানে বাকরোধ হয়ে গেছে ওর । প্রিয়াংশু দেখছে দুঃখ-দারিদ্রমিশ্রিত একনারী মূর্তি বাঙময় হয়ে উঠতে গিয়েও বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । প্রিয়াংশুর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন পথ নেই এই মুহূর্তে ।
নীরবতা ভেঙে রিনা খুব আস্তে আস্তে বলল, “আমি এখন এখানেই থাকি । আসুন না একদিন আমাদের বাড়িতে । বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ । বয়স হয়েছে তো ।”
একটু সময় চুপ করে থাকল সে । তারপর মুখ তুলে বলল, “সামনের ক্লাবে একটা গণ্ডগোল হচ্ছে । কারা যেন কাল রাত্রে ক্লাবে ঢুকে ভাঙচুর করেছে । সকালে পতাকা তুলবে বলে নেতাজীর ছবি, ফ্ল্যাগ সব গুছিয়ে রেখেছিল । সেগুলো বাইরে বের করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে । আপনি ওদিকে যাবেন না এখন । বাড়ি চলে যান।”
প্রিয়াংশু ভাবল এ অবস্থায় বাজারে না যাওয়াই ভালো বোধহয় । ও এখন এ শহরের থাকে না । পাড়ার নবীন প্রজন্মের প্রায় কেউই ওকে চেনে না । কী দরকার গণ্ডগোলের মধ্যে গিয়ে । বাড়ি ফিরেই বা কী করবে সে । তাই বলল, “চল, তোদের বাড়ি যাই ।”
প্রিয়াংশু ভেবেছিল রিনা খুব খুশি হবে । একটু আগে সেই বলেছিল একদিন ওদের বাড়িতে যেতে । কিন্তু এখন ইতস্ততঃ ভাব ওর মধ্যে । কি যেন ভাবছে সে । শেষে বলল, “আজ থাক মাস্টারমশাই । অন্য কোনদিন আসবেন । আজ বাড়ি চলে যান ।” সে আর দাঁড়াল না । দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে চলে গেল ।
প্রিয়াশুর বুকে জোর একটা ঝটকা লাগল । ওর গর্বের বর্মটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে আর অপমানে কান দুটো লাল হয়ে উঠছে । হ্যাঁ, এটাই ওর প্রাপ্য ছিল । সেদিন একজনের দোষে আর একজন নির্দোষীকে সাজা দিয়েছিল সে । একজন শিক্ষক হয়ে সে যে অন্যায়টা করেছিল তার কোন ক্ষমা হয় না । আজ বুঝতে পারছে সে অত্যন্ত অহংকারী । আর তার সেই অহংকারের দুর্গে আঘাত হেনেছে সেদিনের নিরপরাধ ছাত্রীটি, যাকে সে শিক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত করেছিল । অনুতাপের আগুনে প্রিয়াংশু’র অহংকার গলে যেতে লাগল ক্রমশঃ ।
বাড়িতে ফিরে দেখল দাদা-বৌদি, ভাই-ভাইবউ, বিতান সবাই একসাথে চিৎকার করছে । ঈশান দাঁড়িয়ে মজা দেখছে । শুচিস্মিতা বারান্দায় বসে আছে চুপচাপ । অন্যদিনের মতো ওদের থামানোর কোন চেষ্টা করছে না । বিতান কেন ক্লাবের গণ্ডগোলের মধ্যে গিয়েছিল সেটাই সবার বক্তব্য । বিতান বার বার প্রতিবাদ করে জানাচ্ছে সে গণ্ডগোলের মধ্যে কোনভাবেই ছিল না । সে শুধু দেখতে গিয়েছিল ।
প্রিয়াংশু জানে বিতান রাজনীতি বা ক্লাবের অন্য কোন গণ্ডগোলে নিজেকে জড়াবে না । বিতানের বীরত্ব শুধু বাড়িতেই । এ বাড়ির ধাতটা জানে সে । ঘরে না হলেও বাইরে প্রত্যেকেই শান্তিকামী । শুধু প্রিয়াংশু ঘরে বাইরে দু’জায়গাতেই শান্তিকামী ।

ফেরার দিন এসে গেল দেখতে দেখতে । কালই ফেরার ট্রেন । ট্রেনের জন্যে কি খাবার আনবে জিজ্ঞেস করতে ঠাকুর ঘরের দিকে যাচ্ছিল প্রিয়াংশু । এমনিতে লুচি তরকারি বা রুটি মাংস করে দেয় বাড়ি থেকে । তাতান সঙ্গে থাকলে ক্যাডবেরি, চানাচুর, বিস্কুট এসব লাগে । ট্রেনে থাকলে ওর মুখ সবসময় চলতে থাকে । এবার ওরা দু’জন শুধু । কিছুই লাগার কথা নয়, তবু একবার জিজ্ঞেস করা উচিত শুচিস্মিতাকে । ক’দিন ধরে তো ওর সঙ্গে বাক্যালাপই প্রায় হয় না । শুচিস্মিতা দিনের অনেকটা সময় এখন ঠাকুর ঘরে কাটায় ।
ঠাকুর ঘরে শুচির পাশে বসে আছে পাশের বাড়ির মিল্টনের ছেলে বুল্টন । বছর তিনেক বয়স । শুচির খুব নেওটা হয়েছে এই ক’দিনেই । শুচির পূজো বোধহয় শেষ হয়ে গেছে । বুল্টন হাত পেতে বলছে, “ও ঠাম্মাম, চিনির পোহাত দাও ।“
ঠিক যেন ছোট্ট শীতাংশু ফিরে এসেছে । কাকিমার পাশে বসে হাত পেতে বলছে, “ও কাকিমা, চিনির পোহাত দাও ।“
সজলকাকা বাবার দেশের ছেলে । ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় বাবা এপারে চলে এলেও সজলকাকারা আসেননি সে সময় সজলকাকার বাবা-মা আসতে চাননি বলে । সজলকাকা যখন এপার বাংলায় আসেন তখন ভায়ের জন্ম হয় । বাবা সজলকাকাকে পাশেই জায়গা দিয়ে বলেন, তোকে এই জায়গাটা লিখে দিলাম, তুই ঘর করে থাক । এসব মায়ের কাছে শুনেছে প্রিয়াংশু । সজলকাকাদের কোন সন্তান ছিল না । কাকিমা তাই দিনের অনেকটা সময়ই ঠাকুর ঘরে কাটাতেন । প্রিয়াংশুকে খুব ভালবাসতেন । শীতাংশুকেও খুব আদর করতেন । শীতাংশু একটু বড় হতেই কাকিমার পেছনে পেছনে ঘুর ঘুর করত । পূজোর প্রসাদের জন্যে ঠাকুর ঘরে বসে থাকত । বাবার মৃত্যুর পর সজলকাকা বাড়ি বিক্রি করে অন্য পাড়ায় চলে যান । কিছুদিন পর কেরোসিনের স্টোভ ফেটে গিয়ে মৃত্যু হয় কাকিমার ।
অনেকদিন পর কাকিমার কথা মনে পড়ল । মানুষের মন একটা নদীর মতো । নিরন্তর বয়ে চলেছে । নদীর মতো পলিও জমে মনের উপরে । নদীর মতো মজে যায় মনও । বন্যায় যেমন মজে যাওয়া নদীর দু’কুল ছাপিয়ে ছোটে জলের ধারা তেমনি দুঃখের দিনে মনের কুলও ছাপিয়ে যায় ।
প্রিয়াংশুর মনে হল বাড়ির মানুষগুলোর প্রতি সেই অন্যায় করে এসেছে এতকাল । চেষ্টা করলে সেই বেঁধে রাখতে পারত সবার সঙ্গে সবাইকে । সে শুধু কিছু দিয়ে সবাইকে খুশি রাখতে চেয়েছে । মহান হতে চেয়েছে । ফলে সবার সঙ্গেই তার একটা দুরত্ব তৈরি হয়ে গেছে । আজ বুঝতে পারছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা নির্ভর করে দেওয়া এবং নেওয়ার উপর । শুধু দিয়ে গেলে হয় না নিজেরটাও বুঝে নিতে হয় । সে তো সবার চেয়ে উপরে থাকতে চায়নি, দূরেও থাকতে চায়নি । তাদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছে । প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে কাটাতে চেয়েছে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত । কত প্রিয়জনের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি। এই পাড়া । এই শহর । এখানকার মাটির মধ্যে মিশে রয়েছে মা বাবা আর অন্যান্য গুরুজনদের পায়ের ধূলো । বাতাসে ভেসে আসে সবার শুভেচ্ছা । নিজের অধিকার সে কেন ছাড়বে ? শেষ শ্বাসটুকু সে এখানেই নিতে চায় । তবু মনটাকে সে বাগে আনতে পারছে না কেন ? সে তো লোভকে জয় করেছিল কবেই । ত্যাগেই শান্তি একথা জানে সে । তবে ? সবাইকে ভালোবেসে সে কারোর কাছেই প্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি, না বাড়িতে না বাইরে ।
স্কুল স্পোর্টস শেষ হত ‘টাগ অফ ওয়ার’ দিয়ে । প্রিয়াংশু’র মনের মধ্যে এখন সেই খেলাটাই চলছে ।
———————————-
কলমে- তপন বিশ্বাস

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post