Sankars Creation

এই  হলো  শরৎচন্দ্রের বাড়ি। না লেখক  শরৎচন্দ্র  না, প্রেরক শরৎচন্দ্র।  জানগুরু ও  বলতে পারিস।

মাস দুয়েক হলো বাবা এখানে ট্রান্সফার হয়েছেন। প্রথম থেকে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে সে হলো আমার ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে  বসা রতন। ওর কথা গুলো এমনই। বেশ খেলিয়ে বলে। আমি যথারীতি ভ্যাবলা হয়ে তাকিয়ে। একটা সুক্ষ তাচ্ছিল্ল্যের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে  রতন বললো-  পোস্ট অফিসের পিয়ন।  মেজাজ টা  অনেক সময় বেসুরে গায়  বটে, কিন্তু মনটা শীতের টাটকা ফুলকপি। আমার মুখটা যে বেঁকেচুরে দ হয়ে গেছে নিজেই বুঝতে পারছিলাম। অর্থাৎ ও বললো পিয়ন হলেও বড় মাপের মানুষ। অদ্ভুত অলংকারে রতন পি.এইচ ডি করেছে।

বাঁশের গেটটা ঠেলে দিয়ে বললো-ভেতরে চল। এক কামরার একটা ছোট ঘর। একটা তক্তপোষে হেলান  দিয়ে বসা ফর্সা -মধ্যবয়স্ক  একটা লোক কাগজ পড়তে পড়তে মুখ না তুলে বললো -ভেতরে আয়। একটু পরে কাগজ টা একপাশে রেখে কেটলি থেকে চা নিজেই ঢেলে একটা বিস্কুট নিলেন। রতনকে একটা ইশারা করে আবার কাগজে মুখ ঢাকলেন। কেটলির  বাকি  চা আরেকটা কাপে ঢেলে দু চামচ চিনি মিশিয়ে  চা টা  সুট  করে মেরে দিলো রতন। আমি যে মায়ের তুলোয় মোড়া একটা ছেলে- তাকালেই না।   ঘরের চারদিকটা দেখতে লাগলাম। ছোট্টো ঘর টা বইয়ে ঠাসা। লোকটার বই?- না বইয়ের দোকান আছে ? রতন যে বললো লোকটা বাড়ি বাড়ি  চিঠি বিলি করা পিয়ন !

পা নাড়াতে নাড়াতে খবরের কাগজ টা পড়ছিলেন আর মাঝে মাঝে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন।  কাগজ টা মুখের থেকে নামিয়ে প্রশ্ন, এবং আমাকেই -জানালা খোলার অভ্যেস আছে ? আসলে আমার খুব ভূতের ভয়। বিছানার পাশেই ওদিকে ঝাঁকড়া গাছ টায় রাত হলেই অনেক ভূতের  চলা ফেরা  দেখতে পাই,  তাই কোনো সময় রাতের বেলা মাকে  জানালাটা খুলতে দি না। মায়ের সঙ্গে কম ঝগড়া হয় ?

আমি মাথা নেড়ে বললাম -না। -তাহলে এখানে এসো না। আবার কাগজে মুখ ঢাকা পরলো।রতন বাড়ি যা। আমি একটু বেরুবো।

লোকটার খুব সাহস না রে রতন? ভূতের  ভয় নেই।  যার ভূতের  ভয় নেই তাকে আমার ভীষণ সাহসী মনে হয়।.-স্লিপে কুমড়ো দিলি তো ? রতন  অদ্ভুত অলংকার আবার যোগ করলো। আমার মুখে কোনো কথা নেই। স্লিপে কখন ক্যাচ ফসকালাম বুঝতে পারলাম না।

– আরে জানালা খোলার মানে বই পড়া বুঝলি ?

-তা সোজা করে বললেই হয়।

-শরৎ দা ওরকমই। দেখলি না কত বই ! সারাদিন বই পড়ে।  কতরকম বই !  আমাকেও না -একটু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললো জোর করে পড়া ধরিয়েছে। প্রথম প্রথম ভালো লাগতো না। আমাদের বাড়িতে ছোটদের চা দেয় না , নিয়ম নেই। তাই চায়ের লোভে রোববার চলে আসতাম।  আর চায়ের লোভেই পড়তে শুরু করি। এখন জানিস আমার বই পড়তে খুব ভালো লাগে।

এবার আমার অবাক হবার পালা।

-জানিস তো, কাউকে বলবি না তো? – চাপা স্বরে রতন আমার কানের কাছে বললো।

আমি ঘাড় নাড়াতে আশস্ত হয়ে বললো – কাউকে বলবি না কিন্তু। আমি R.L.Stevensoner   এর লেখা Treasure Island পড়লাম। .নাম শুনেছিস তো ? সহজ ইংরেজিতে অনেক ছবি দেওয়া বই টা। প্রথমে ছবি গুলো  দেখতাম। তারপর শরৎ দা  পড়ে  মানে বলে শোনাতো  । তারপর নিজেই পড়তে পারলাম। ওহ কি দারুন গল্প না শোন।

রতন গল্প বলে চললো।  কিন্তু আমি শুনবো কি ,আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। কি মারাত্মক ব্যাপার ! এই না শহর না গ্রামে লাস্ট বেঞ্চে বসা রতন ইংরেজি গল্পের বই পড়তে শিখেছে ! আর লেখক তো দূরের কথা বইটা -গল্পটা আমি কোনোদিন শুনিই নি।

সেদিন রাতে রমেন বাবু কাছে অঙ্ক করতে বসে দুবার গাঁট্টা খেলাম। অথচ অংকে নব্বইয়ের ঘরে আমার নম্বর থাকে।

শেষ পর্যন্ত জানালা খুললো। আমার মনের জানালা।শরৎ দার হাত ধরেই। অঙ্ক ভালো করলেও ইংরেজি-বাংলাও আমার ভালো লাগে।  কিন্তু সে তো ক্লাসের পড়া। গল্পের বই আমার দু চারটে আছে। কেউ কিনে দেয়না বলে কি না জানিনা সেভাবে সাহিত্য তাও আবার ইংরেজিতে ! না .. না .. .  রতন টা কি মারাত্মক শয়তান ! এতদিন এত বড়  ঘটনাটা ভালো মানুষের মতো মুখ করে চেপে রেখেছিলো ! আজ যদি সকালে ঘুড়ি  কিনতে গিয়ে দেখা না হতো আর শরৎ দার  বাড়ি না নিয়ে যেত তাহলে তো  ….. নাঃ ভাবতে পারছি না।

রবিবার হলেই একছুটে রতনের বাড়ি-সেখান থেকে শরৎদার বাড়ি। আমাকেও বাড়িতে ছোট বলে চা দেয়  না।  সেটা উপরি পাওনা।

-বুঝলি যতন, রতনের সঙ্গে মিলিয়ে আমার ওই নাম রেখেছেন শরৎ দা।

– “পৃথিবীটা যে বড় তা কি করে বুঝবি বলতো ? এই গাঁয়ের স্টেশন ছাড়িয়ে তুই যাবি  গঞ্জে , সেখান থেকে শহরে। তারপর আরো বড়ো শহরে। কিন্তু কত টা যেতে পারবি তুই ? কিন্তু যাওয়া যায় ,সেরকম গাড়িও আছে। চোখের পলকে তুই গ্রাম-শহর দেশ সব জায়গায় যেতে পারবি। এই দ্যাখ।” একটা মোটা বেশ চওড়া সুন্দর করে বাঁধানো ম্যাপ বই বার করলেন। পাতা খুলে বললেন-এই দ্যাখ আমরা মোটামুটি এই জায়গায় আছি।  এবার অন্য জেলা গুলো দ্যাখ, তারপর পাশের রাজ্য -গোটা দেশ- প্রতিবেশী দেশে চলে যা -পুরো মহাদেশ ঘুরে নে -আরো মহাদেশ গুলোতে চলে যা -সারা পৃথিবীটা তোর হাতের মুঠোয় হয়ে গেলো দেখলি। কিন্তু যে জায়গা গুলো ঘুরে এলি সেখানে  কেমন লোক থাকে, তাদের ভাষা কি, তাদের অতীত কি, তাদের সুখ দুঃখ-জীবনের কথা  এসব কিছুই জানতে পারলি না তো ? পারবি যদি তুই বই পড়িস। ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য সবই সে কথাই বলে। সাহিত্য দেশ -সমাজ -প্রতিদিনের জীবন যাপনের ছবি এঁকে রাখে। একবার একটা জানালা খুলে দেখবি আরেকটা জানালা,  সেটা খুলে পাবি আরেকটা। এভাবেই সব কিছু তো চোখের সামনে চলে আসবে।  বই হচ্ছে আসলে মনের জানালা। আমার ঝাঁকড়া চুলটা একটু নেড়ে দিলেন শরৎ দা।

রবিবার গুলো দারুন কাটে। পড়াশোনা টা ও আগের থেকে বেশ ভালো লাগছে। তবে চমকে রসগোল্লা বানালো রতন। এখন আমি রতনের অলংকার গুলোও শিখে গেছি। যে ছেলের দিকে কোনো মাস্টার মশাই তাকায় না – তারাও অবাক। সব বিষয়ে শুধু পাস্ না , রীতিমতো ৫০/৬০ এর মধ্যে নম্বর। রতন নিজেই পা ভেঙে বসা উট এর কুঁজ হয়ে গেছে।

-চল শরৎ দার বাড়ি।দুজনেই ছুট  লাগলাম।  দরজা খোলা।  অবশ্য সেটা সব সময়ই খোলা থাকে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই দুজনে ছেঁচকি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। অনেকগুলো বড় বড় পেটি বাঁধা।  একটা ঢাউস টিনের বাক্সের ওপর বসে বিড়ি খাচ্ছে শরৎ দা।

-তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ট্রান্সফার হয়ে গেলো যে। তোদের আগে বলিনি, মন খারাপ করবি সেই জন্য। আজ তোদের রেজাল্ট বেরোবে জানি বলে গাড়িটা একটু পরে আসতে বলেছি। দেখা তোদের মানপত্র। দুজনের মার্কশীট নিয়ে একটু চোখ  বুলিয়ে ফেরত দিলেন।

-নম্বরটি বড়ো কথা নয় রে। আসল হলো তোর জানার ইচ্ছে, জানার চেষ্টা। আমি পেরেছি তোদের মনের জানালাটা খুলে দিতে। এটা সবসময় বজায় রাখিস।

যে রতন এত ডাকাবুকো- সে পর্যন্ত ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। আমি কখন যেন সব ঝাপসা ঝাপসা দেখতে লাগলাম।  একসময় বুঝলাম টুপ টাপ করে বৃষ্টি নেমেছে আমার চোখ থেকে।

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post