Sankars Creation

তপন বিশ্বাস


।। দশ ।।
মাঝরাতে মেঘেরা আবার ফিরে এসেছিল । লেপ-তোশকের জঙ্গলে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া শরীরে ঠাণ্ডার কষ্টটা না পেলেও কেঁপে উঠছিলাম প্রকৃতির তান্ডবে । কেবলই মনে হচ্ছিল জীর্ণ, নড়বড়ে তাঁবুটা উড়ে যাবে যে কোন মুহূর্তে । হাওয়ার দাপটের সঙ্গে ছিল মেঘের ঘন ঘন গর্জন । বৃষ্টি নামলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আসা জলের স্রোতে শয্যা সমেত আমরা যে প্যাং গং লেকে গিয়ে পড়ব সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না ।
অনেকক্ষণ ধরে চলেছিল মেঘের গর্জানি, হাওয়ার মাস্তানি । একসময় শান্ত হয়েছিল প্রকৃতি । যতক্ষণ জেগেছিলাম বৃষ্টি হয়নি এক ফোঁটাও । ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল হব হব করছে । তাঁবুর বাইরে মানুষের আওয়াজ পাচ্ছি। সৌরভদা নেই । সৌম্যশুভ্র ঘুমাচ্ছে ।
বাইরে বেরিয়েই সৌরভদাকে দেখতে পেলাম । ভোরের আকাশ দেখছে । রাতের বিশাল আকাশটা অনেক ছোট হয়ে গেছে এখন । ভোরের আলোয় জেগে ওঠা পাহাড়ের পেছনে পেছনে নেমে পড়েছে মেঘশূন্য ধোঁয়াটে আকাশ । তাঁবুর পেছনে পাহাড়ের মাথার অরুণিমা ।
সৌরভদা আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, “কী সুন্দর সকালটা !”
“হ্যাঁ, রাতের দুর্যোগের কোন চিহ্নই নেই । ডাকাডাকিই সার ছিল ।”
“তুমি জেগে ছিলে !” বিস্মিত সৌরভদা ।
“ছিলাম তো । তোমার ছেলে যদি জেগে যায় তাই তোমাকে কিছু বলিনি । আমি দেখেছি তুমি জেগে আছো । আমারই ঘুম হচ্ছিল না আর তুমি তো বাবা !”
সৌরভদা আমার কথা শুনে হাসল । “ছেলেটার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল । তোমার জন্যেও ভাবছিলাম । নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছিল । কেন যে ভালো কোন টেন্টে থাকলাম না ! কয়েকটা টাকাই না বেশি লাগত ।”
“কিন্তু সৌরভদা অনেককিছুই মিস করতাম তাহলে । এমন রাত কি বারবার আসে ? ভয়ংকর এই রাতটার কথা চিরদিন মনে থাকবে শুধু মেঘের গর্জানি বা হাওয়ার মাস্তানির জন্য নয় । মনে থাকবে রাতের বিশাল আকাশটার জন্য, কোটি কোটি নক্ষত্র’র জন্য, ছায়াপথের মায়াবী সৌন্দর্যের জন্য, অ্যাড্রোমেডা গ্যালাক্সির জন্য । তুমি বল ‘বিত্তবানেরা সুখভোগের অধিকারী’, আমি বলি ওরা সুখভোগ করুক- আমরা প্রকৃতিকে উপভোগ করি । আমরা সৌন্দর্যসাধক । প্রকৃতি আমাদের জন্যই সাজে, আমাদের জন্যেই সৃষ্টি করে নতুন নতুন চমক । নটরাজের তান্ডব নৃত্য ক’জন দেখতে পায় বা দেখতে চায় ? সবাই ভয়ে কাঁপে । আমরাও কেঁপেছি সত্যি কিন্ত উপভোগও করেছি । রাতটা শুধু ভয়ংকর ছিল না, ছিল ভয়ংকরতম সুন্দর !”
“তুমি তো ভালোই বলতে পার দেখছি !”
সৌরভদার কথায় লজ্জা পেয়ে গেলাম । বললাম, “না সৌরভদা । তোমার কাছে আমি কিছুই না । আর তোমার ছেলে তো দারুণ ! হয়ত ওর জীবনের একটা মোড় ছিল কালকের রাতটা ! আজকের সুন্দর সকালটাও এনজয় করুক । ওকে ডাক ।”
সৌরভদা হাসল, “তুমি ঠিকই বলেছো, রাতটা ছিল ভয়ংকর সুন্দর । কিন্তু আমি তো বাবা তাই মন অস্থির হবেই । যাই বাবিকে তুলে নিয়ে আসি ।”
অনেকগুলো সিগাল উড়ছে প্যাং গং লেকের উপরে । লেকের ওদিক থেকে উড়ে এল দুটো । নেমে পড়ল তাঁবুর পেছনে । কয়েকটা চক্রবাক চক্কর কাটছে । অনেকগুলো চক্রবাক মাটিতে নেমে এসে খাবার খুঁটে খাচ্ছে । প্রকৃতির নিয়ম না মেনে চলা মানুষের দলটা ভারী হতে থাকলেও মনুষ্যেতর প্রাণীরা এখনও প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে । উষালগ্নে তাই এত উড়াউড়ি পক্ষীকুলের, আর মানুষ নিশাচর না হয়েও প্রায় নিশাচর এখন । ভোরের আলো দেখতে ভুলেই গেছে অধিকাংশ মানুষ !
সূর্যাস্তের মতো জমকালো নয়, সূর্যোদয় হল আচমকাই । তাঁবুর পেছনের কালো উঁচু পাহাড়টা প্রভাতি সূর্যকে আড়াল করে রেখেছিল এতক্ষণ । ছেলেকে নিয়ে ফিরল সৌরভদা ।
চার –পাঁচ বছরের তাঁবুর মালিকের শিশুসন্তান তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে ছুটছে । ঠাণ্ডা হাওয়ায় ফর্সা গালে লাল লাল গোলাপ ফুটে উঠছে ভ্রুক্ষেপ নেই । মাও ছুটছে শিশুর পেছনে ।
লামা বলল ‘ত্রি ইডিয়েটস’-এর শুটিং স্পটে নিয়ে যাবে । গতকালের লামার সঙ্গে আজকের লামার মিল খুঁজে পাওয়া ভার । আজকের লামা বেশ হাসিখুশি ।
আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে কটেজ তৈরি হচ্ছে পর্যটকদের কথা ভেবে । সীমান্ত অঞ্চল বলে এতদিন নিয়মকানুনের বেড়াজালে আটকে ছিল উপত্যকা ।
প্যাং গং লেকের জলে এখন সামুদ্রিক উচ্ছ্বাস । একের পর এক ঢেউ ভেঙে পড়ছে তটে । বিশাল এই লেক সমুদ্রের ছোট ভাই না হলেই তুতো ভাই যেন । সৌরভদা পকেটে হাত ঢুকিয়ে নায়কোচিত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে । বাবা-ছেলের চেহারার যেমন বৈপরীত্য স্বভাবেও তাই । মিল খুঁজে পাওয়া ভার !
সৌরভদা ফিরল আমার দিকে । বলল, “প্যাং গং লেকটা যে এত সুন্দর তা না এলে বুঝতাম না । ছবিতে একরকম সুন্দর লাগে, দেখতে আর একরকম । তাই ছবি দেখিয়ে বা বলে বোঝানো খুব কঠিন । খনিতে না নামলে যেমন বোঝা যায় না খনি ঠিক কেমন তেমনই প্যাং গং লেকের ধারে একটা দিন না থাকলে প্যাং গং অজানাই থেকে যায় । সোনালি-রূপালি পর্বত, ঘন নীল আকাশ, নীল জলের লেক সব মিলিয়ে অসাধারণ ! এই বর্ণময় ভূপ্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে একটা কথাই মনে হচ্ছে, আর একবার যদি আসা যায় এখানে !”
সৌম্যশুভ্র ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকলেও ঠিক শুনতে পেয়েছে বাবার কথা । বলল, “আমিও আসতে চাই আর একবার । রাতের আকাশটা আর একবার দেখতে চাই । এখানে ছাড়া আর কোথাও কী আর পাওয়া যাবে এত বড় আর এত পরিষ্কার আকাশ ! রাতের আকাশটা এখানে শুধু সুন্দর না, মার্ভেলাস !”
সোনারঙা পাহাড়ে সূর্যের আলো পড়ে চমকাচ্ছে সোনার মতো । প্যাং গং লেকের জলে হীরের দ্যুতি । মহানন্দে সিগাল উড়ছে জলের উপর দিয়ে । সৌম্যশুভ্র বলল, “প্যাং গং এখন সিনেমার ফার্স্ট চয়েস ।
“প্যাং গং লেকের কাছাকাছি বলতে মুগলী গ্রাম । এছাড়া আরো কয়েকটা গ্রাম আছে একটু দূরে । লোকসংখ্যা খুব কম । একে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তার উপর অনুর্বর শক্ত পাথুরে জমি । চাষবাস তেমন হয় না । মটরশুঁটি আর বার্লির চাষ হয় সামান্য । মূলতঃ পশুপালনই এখানকার লোকের জীবিকা । গ্রামের মানুষ সায়ক নদীর দিকে যায় পশু চড়াতে । ওদিকে প্রচুর তৃণভূমি । সায়ক নদীর তীরে অনেক গ্রাম আছে । চাষআবাদ ভালো হয় ওদিকে । তবে ওই তিন-চার মাস । বাকি সময় শীতঘুম ।”
সৌরভদা এত খবর কখন, কার থেকে সংগ্রহ করল ?
সৌরভদা আমার কৌতূহলের জবাব নিজেই দিল, “আমাদের টেন্টের মালিকের সাথে সকালে কথা বলেছিলাম । সেই বলল ।”
প্যাং গং থেকে ফেরার সময় অলিভিয়া ভিডিও করছিল । আমি সরে এলাম ভেতরের দিকে যাতে ওর ভিডিও করতে অসুবিধে না হয় ।
অনেকটা দূরে চলে এসেছি প্যাং গং থেকে । আমেরিকান মেয়েটা ঘুমাচ্ছে । সৌম্যশুভ্র ক্যাডবেরি খাচ্ছে একের পর এক। সকালের ডিম পাউরুটি আমারই ভ্যানিশ হয়ে গেছে, ওর তো হবেই । চাংলা পাসের আগে গাড়ি আর থামবে না । তাংসে পেরিয়ে এসেছি একটু আগে ।
চাংলার আগেই তুষারপাত শুরু হল । তুলোর মতো হালকা বরফের কুচি ভেসে আসছে গাড়ির খোলা জানলা দিয়ে । সৌরভদা খুব খুশি । বলল, “বাবি, বরফ পড়াও তাহলে দেখতে পেলি !”
ছেলের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার ধরণ ভিন্ন । সে উত্তর না দিয়ে হাত বাড়িয়েছে জানলার বাইরে তুষার স্পর্শ পেতে । পাচ্ছেও । গাড়ির উইন্ডস্ক্রীনে দেখতে পাচ্ছি প্রচুর বরফ ছিটকে আসছে । আবেগতাড়িত সৌরভদা বলল, “বাবি কখনো বরফপড়া দেখেনি, এই প্রথম দেখছে ।”
চাংলা পাসে কম বরফ পড়ছিল । জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কয়েকটা ছেলে বাইক চালিয়ে এল প্যাং গং থেকে । খুব ভিজেছে । একটা ছেলে আমাদের সামনেই বাইক দাঁড় করাল । হেলমেট খুলল । সৌম্যশুভ্রর বয়সী । সৌরভদা ওকে বলল, “এক্সট্রা শ্যু হ্যায় তো চেঞ্জ কর লেনা ।”
ছেলেটা মুখ তুলে দেখল সৌরভদাকে । জিজ্ঞেস করল, “আপ কাহাঁসে আয়া ?”
সৌরভদার মুখে ‘ওয়েস্টবেঙ্গল” উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা খুব তাচ্ছিল্য করে বলল, “ওহ ! ইস্ লিয়ে ! হম গুজরাতি, কুছ নেহী হোগা ।”
সৌরভদা খুব আঘাত পেয়েছে মুখ দেখেই বুঝতে পারছি । বললাম, “কেন বলতে গেলে ?”
আহত সৌরভদা বিষন্নস্বরে বলল, “বাচ্চা ছেলে, বাবির বয়সী । খুব ভিজেছিল যে !”
সৌরভদার মতো মানুষরা সবার ভালো চায় । মর্যাদা পায় না ।
আকাশটা মেঘে ঢাকা । চাংলা পাস পার হবার পর বরফ পড়া থেমেছে কিন্তু কুয়াশার জন্য কিছুই দেখা যায় না । সৌরভদা আবৃত্তি করছে । উদাত্তকন্ঠে । “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির !” সৌরভদা রবীন্দ্রনাথকে শুধু মনে নয় বুকেও রাখে । কত কবিতা মুখস্থ রবীন্দ্রনাথের !
আবৃত্তি শেষ হতেই বললাম, “সৌরভদা, তোমার তুলনা নেই !”
পেছন থেকে অলিভিয়া বলল, “এক্সসেলেন্ট ! ‘হোয়ার দ্য মাইন্ড ইজ উইদাউট ফিয়ার’- ইজ ইট নট? ”
বিস্মিত সৌরভদা প্রশ্ন করে, “ডু ইউ নো রবীন্দ্রনাথ টেগোর !”
“ওহ্, ইয়েস । দ্য গ্রেট পোয়েট অফ ইন্ডিয়া । নোবেল লরিয়েট ।” অলিভিয়ার কথা শুনে বুক ফুলে উঠল । অলিভিয়া রবীন্দ্রনাথ পড়েছে !
সৌরভদাও খুব খুশি হয়েছে । জিজ্ঞেস করল, “ডু ইউ নো স্বামী বিবেকানন্দ ?”
অলিভিয়া মাথা নেড়ে বলল, “নো স্যার। হু ইজ হি ?”
“হি ওয়াজ এ গ্রেট ম্যান অফ ইন্ডিয়া, হু ওয়ন আমেরিকা ।” সৌরভদা বোধহয় ইচ্ছে করেই বিবেকানন্দ’র নাম করেছে ।
সৌরভদার সঙ্গে আমিও পেছনে ফিরে তাকিয়েছি । আমেরিকান মেয়েটা ‘আমেরিকা’ শুনেই বোধহয় চোখ খুলেছে ।
সৌরভদা সামনে ফিরে বলল, “শিকাগো ধর্ম মহা সম্মেলনে ভাষণ দিয়ে স্বামীজি আমেরিকানদের মন জয় করে নিয়েছিলেন । কিন্তু আমেরিকানরা বদলাল না । নিজেদের দম্ভের ফলে অন্ধ হয়েই রইল । দরিদ্র দেশটাকে দেখেছে, আসল ভারতবর্ষকে চেনার চেষ্টা করল না ।”
একটু থেমে সৌরভদা বলল, “বিবেকানন্দের বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর ছবিটা দেখেছো ! কী দীপ্ত ভঙ্গিমা ! এভারেস্ট শৃঙ্গ যেন । মানুষকে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন । বহুধাবিভক্ত ভারতবাসীকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রেরণা দিয়েছিলেন । বহুত্ববাদী সমাজটাকে এক করতে চেয়েছিলেন তিনি । আর রবীন্দ্রনাথ হলেন হিমালয় পর্বতমালা । কী বিশাল ব্যাপ্তি ! হিমালয়ের মতোই তাঁর সৃষ্টি । এক জীবনে পড়ে শেষকরা সম্ভব না ।”
সৌরভদার মতো করে কোনদিন ভাবিনি তো ! কী সুন্দর তুলনা ! চেপে ধরলাম সৌরভদাকে, “সৌরভদা কিছু মনে না করলে নেতাজী আর গান্ধীজী’র কথা বল না । তাঁদের সম্বন্ধে কী ধারণা তোমার শুনি ।”
সৌরভদা খুব সুন্দর করে হাসল । সৌরভদা সুন্দর করে হাসতে জানে যেমন কথাও তো বলেন চমৎকার । “নেতা-নেত্রীদের ব্যাপারে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না তুমি জানো । কিন্তু নেতাজী আর গান্ধীজীর ব্যাপারে সে কথা বোধহয় খাটে না । তবে তাঁদের মূল্যায়ন করা আমার মতো মানুষের কাছে ধৃষ্টতা ।”
“আচ্ছা বাবা, তাঁদের মূল্যায়ন না হয় নাই করলে । যেমন বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথকে এভারেস্ট আর হিমালয়ের সাথে তুলনা করলে তেমনই তুলনা কর না !”
সৌরভদা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুমি তো বেশ চালাক ! না শুনে ছাড়বে না তাই না ?” একটু থেমে সৌরভদা বলল, “নেতাজী সারাজীবন লড়াই করেছেন দেশের জন্য । দেশকে স্বাধীন করার জন্য । তিনি আমার কাছে ভারত মহাসাগর । পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক দেশ মায়ের পদতলে বসে তাঁর সেবা করছেন – যতদিন বেঁচে থাকতেন তাই করতেন বোধহয় । গান্ধীজীকে আমার মনে হয় অসহায় পিতা । জাতির জনক তিনি । ত্যাগী, প্রতিবাদী, সমাজসংস্কারক, সংসারের কর্তা কিন্তু কর্তব্য আর স্নেহের টানাপোড়েনে বিভ্রান্ত । বিধ্বস্ত । শেষে নিজের প্রাণ দিয়ে সেটাই প্রমাণ করে গেলেন ।”
সৌরভদার ভাবনাগুলো আমায় চিন্তার খোরাক জোগায় । “সৌরভদা খুব ভালো তুলনা দিলে । আমার বেশ ভালো লাগল । আর একজনের ব্যাপারে জানতে চাইব । আমার প্রিয় লোকের তালিকায় আর একজন আছেন । তিনি হলেন সত্যজিৎ রায় । তাঁর সম্বন্ধে তোমার কী মত বলবে একটু ? প্লীজ ।”
সৌরভদা হেসে বলল, “তিনি আমারও খুব পছন্দের মানুষ । আমার প্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁকেই একমাত্র দেখেছি । তাও আবার একদম সামনা সামনি । নন্দন চত্বরে। পাঞ্জাবি-পাজামা পরা সেই দীর্ঘকায় মানুষটাকে ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়েছিল আমাকে । ওনাকে দেখে আমার কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা মনে হয়েছিল সেদিন । দার্জিলিঙ্গে থাকার সময় ঘর থেকে বেরিয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেতাম রোজ । এই যে আজ তোমাকে বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথের কথা বললাম সেটা কিন্তু সেদিনই ভেবেছিলাম ।”
সৌম্যশুভ্র পেছন ফিরে চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি সত্যজিৎ রায়কে দেখেছো ! আমাকে বলনি তো ?”
“মনে ছিল না । তাছাড়া তুই তো কোনদিন জানতেও চাসনি । আগে তবু অনেককিছু জানার আগ্রহ ছিল। বাবার কাছে আসতিস । এখন তো মোবাইল তোর বন্ধু । বাবার কথা মনেও পড়ে না ।” সৌরভদার কথায় রেগে ছেলে বলল, “বাজে কথা বোলো না তো !”
“বাজে কথা বোলো না তো ! টাকার প্রয়োজন ছাড়া আসিস ? আসিস না । তোর অত সময় কই ?” ছেলে বাবার অভিযোগের উত্তরে কিছু বলে না আর ।
ঘরের কাছাকাছি এলেই সবাই ঘরে ফেরার তাড়া অনুভব করে । লেহ শহরের কাছাকাছি আসতেই লামা দ্রুত চালাচ্ছে গাড়ি । নীল আকাশ হাসিমুখে অভ্যর্থনার জন্য তৈরি । ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে যে ।
প্রায় দুটো দিন একসঙ্গে কাটিয়েও মেয়েদুটোর সাথে বন্ধুত্ব হল না । বন্ধুত্ব সবার সঙ্গে হয় না । গেস্ট হাউসের কাছে লামা আমাদের নামিয়ে দিয়ে অলিভিয়াদের নিয়ে চলে গেল । অলিভিয়া হাত নাড়লেও রুবি চোখ বন্ধ করেই রইল । মার্কিনি গর্বে সে গর্বিত । এতে আমাদের কিছু এসে যায় না । দেশটা আমাদের । ওরা আমাদের অতিথি । অতিথি’র অসম্মান- অনাদর আমরা করিনি । ওরাও এনজয় করেছে ওদের মতো করে । বন্ধুত্ব না হওয়ার দায় আমাদের না ।
প্যাং গং লেকের সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম । এটাই আমাদের বড় পাওনা । পর্বতশিখর জয় করার মধ্যে হয়ত আনন্দ বেশি । গর্বমিশ্রিত আনন্দ । কিন্তু পাহাড়ে বেরিয়ে যে তৃপ্তি তার তুলনা নেই । পাহাড়কে জয় করার চেয়ে পাহাড়কে ভালবাসলে বিনিময়ে পাহাড় উজাড় করে দেয় ।
মুজিবর আজই ফিরেছে শ্রীনগর থেকে । নিখুঁতভাবে দাড়িগোঁফ কামানো বছর ত্রিশের সুদর্শন যুবক । অত্যন্ত ভদ্র আর অমায়িক । আমাদের ঘরের চাবি সৌরভদার হাতে তুলে দেবার সময় জানাল জমীরভাই নমাজ পড়তে গেছে ।
জমীর নিষ্ঠাবান মুসলমান । সকাল-দুপুর- সন্ধ্যেয় পাঁচ ওয়াক্তের নমাজ পড়ে । জমীরের স্ত্রী ব্যবসার কাজ দেখাশোনা করা ছাড়াও সংসারের কাজকর্ম করে । শুধু জমীরের স্ত্রী নয় সব পাহাড়ি মেয়েরাই স্বামী-সন্তানের দায়িত্ব সামলানো থেকে চাষবাস বা ব্যবসার কাজ করে দেখেছি । পর্বতকন্যারা আক্ষরিক অর্থেই দশভূজা ।
জমীরের রেস্টুরেন্টে চা খেতে খেতে রেস্টুরেন্টের কর্মচারী নেপালি ছেলে দুটোর সঙ্গে গল্প করলাম । ওদের দেশে কাজ পাওয়া যায় না । তাই রুজি-রুটির টানে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছে লাদাখে । প্রাণ বাঁচাতে আর রুজি-রুটির প্রয়োজনেই তো মানুষ দেশান্তরি হয় ।
সৌরভদা বৌদিকে টেলিফোন করতে গেছে বাজারের বুথ থেকে । সৌম্যশুভ্র শুয়ে পড়েছে এসেই । বেচারা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে । একটানা এত ধকল নিতে পারে না ছেলেটা ।
স্নান সেরে ঘরের বাইরে চেয়ার পেতে বসলাম । উল্টোদিকের বারান্দায় চেয়ার টেবিল নিয়ে মুজিবর কিছু হিসেবনিকেশ করছে বোধহয় । উপর থেকে দু’জন লোক নেমে মুজিবরের সাথে কথা বলছিল । একজন ফিরে আমাকে দেখল । একটু পরে দু’জনই এগিয়ে এল আমার দিকে ।
একজনের বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে বোধহয় । মাঝারি উচ্চতা । গায়ের রঙ বেশ ফর্সা । পরনে নীল জিনস, লাল টি শার্ট । সঙ্গীর বয়স তুলনায় কম । লম্বা, ছিপছিপে শরীর । গায়ের রঙ মিশমিশে কালো । গালে ক’দিনের না কাটা দাড়ি । সৌখিন গোঁফটা না কাটা দাড়ির জন্য বিসদৃশ লাগছে । গোলগলা হলদে গেঞ্জির সাথে ছ’পকেটের কার্গো প্যান্ট । সেই প্রথমে কথা বলল, “আপনারা প্যাং গং গিয়েছিলেন শুনলাম । কেমন লাগল ?”
-দুর্দান্ত ! উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলাম না । পারার কথাও না । “এত সুন্দর একটা জগত, ঘন নীল আকাশের নীচে নীল জলের লেক, নানা রঙের পাহাড় আর অসাধারণ সূর্যাস্ত । ভাষায় বর্ণনা করা যায় না । আর রাতের আকাশটা ! বিশাল আকাশে কোটি কোটি নক্ষত্র, গ্রহ, গ্যালাক্সি । নাহ্ ! না গেলে বোঝা যায় না ।”
আমার কথা শুনে তার কি আপশোষ ! “ইস ! আপনার মুখে শুনে এখনই যেতে ইচ্ছে করছে।”
কালো মানুষের সাদা চোখে ঘোর বিস্ময় । সঙ্গীর চোখে কিন্তু বিস্ময় তো দূরের কথা কোন আগ্রহও দেখতে পেলাম না । সে একটা প্রস্তাব দিল, “আমরা কাল সাইট সিনে যাব । মুজিবর গাড়ি ঠিক করে দেবে । আপনারা শুনলাম তিনজন আছেন । শেয়ার করে যেতে পারলে খরচ কম । যাবেন ?”
“সৌরভদার সঙ্গে কথা না বলে আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব না । সে এলে কথা বলা যাক ?” বলতেই দেখি সৌরভদা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ।
সৌরভদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম দিব্যজ্যোতি হালদার আর অমিত মন্ডলের। সব শুনে সৌরভদা বলল, “ভালোই তো ! আমিও ভাবছিলাম কাল লোক্যাল এরিয়ায় ঘুরব ।”
আর কিছুক্ষণ কথা বলে ওরা বিদায় নিল । অমিত যাওয়ার সময় বলে গেল, “কাল সারাদিন আপনাদের সঙ্গে থাকব । গল্প শুনব প্যাং গং লেকের ।”
ঘড়িতে সাতটা বেজে গেলেও সন্ধ্যের অন্ধকার নামতে এখনও অনেক দেরি । বনজঙ্গলের মতো ঝুপ করে সন্ধ্যে নামে না এখানে । পাহাড়ে সন্ধ্যে হয় ধীরে ধীরে আকাশের হাত ধরে ।
লামায়ুরু রেস্টুরেন্টে রুটি-মাংস নিয়ে বসতেই পেটটা কঁকিয়ে উঠল । খিদেটা টের পেলাম । মার্তাদের কথা মনে হল । লামায়ুরুর দুর্গম পথে পোল্যান্ডের পিয়ানো শিল্পীর পেছনে ধাওয়া করার জন্য কোন পাপারাৎজি ওঁত পেতে বসে না থাকলেও অনেকরকম বিপদ ওঁত পেতে বসে থাকতে পারে । গুণমুগ্ধ কোন যুবক প্রেমের আকুতি নিয়ে না এলেও পার্বত্যঝঞ্ঝা এগিয়ে আসতে পারে । চাঁদের পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে যেমন সৌন্দর্যের হাতছানি তেমনি জাঁসকার হিলসের হিমশীতল গহ্বর মৃত্যুর দূত । বিজনবিভুঁই পেনসিলা পাস, সুরু নদীর গর্ভগৃহ সাধারণ পর্যটকের জন্য নয় ।
সৌরভদা বলল, “বাবি এম টেকে ভর্তি হলে লামায়ুরুতে যাব । সেখান থেকে ট্রেকিং করে জাঁসকারের পাদুমে । পাদুম থেকে যাব মানালিতে ।”
সৌম্যশুভ্র কিছু বলল না । সে খেতে ব্যস্ত । সৌরভদা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে মনে হল । আপনমনেই গেয়ে উঠলাম,
“দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার !”
সৌরভদা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে খাবারে মন দিল । ছেলেটা খাবার ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কিছু দেখছে না । বোধহয় শুনছেও না । ও অনেক ব্যাপারেই উদাসীন । হয়ত এটাও আজকের দিনের ছেলেমেয়েদের একটা রূপ । কেয়ারলেস বাট কনফিডেন্ট ।

হেমিস গুম্ফা দিয়ে শুরু হবে আমাদের লেহ দর্শন । শহর থেকে তেতাল্লিশ কিমি দূরে হেমিস । সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছি । মারুতি ভ্যানে পেছনের মুখোমুখি সিটে আমরা চারজন । দিব্যজ্যোতি হালদার বমি পায় বলে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে । সৌম্যশুভ্র গজ্ গজ্ করছে, “ট্রেনে উঠেও লোকে বলে, আন্টির তো বমি পায় তাই জানলার সিটটা ওকে ছেড়ে দাও, প্লীজ !”
নামগিয়াল সাম্রাজ্যের অপূর্ব কীর্তি আর অসাধারণ স্থাপত্যের নিদর্শন হেমিস । ১৬৩০ খ্রীষ্টাব্দে সেংগে নামগিয়াল প্রচুর অর্থব্যয় করে এটি তৈরি করান । লাদাখ অঞ্চলের সবচেয়ে ধনাঢ্য গুম্ফা । শোনা যায় যীশুখ্রীষ্ট হেমিসে এসেছিলেন । দীক্ষাও নিয়েছিলেন । এখানকার পুঁথিতে নাকি তার প্রমাণ আছে কাল রাতে বলেছিল সৌরভদা ।
পেছনের পথটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে পথটা দ্রুতবেগে উল্টোদিকে ছুটছে । এ এক অদ্ভুত অনুভূতি । ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকালেও মনে হয় কত তাড়াতাড়ি চলে গেছে অথচ আগামী বড়ই বিলম্বিত !
“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি”- সুরেলা কন্ঠে বলে চলেছে সৌরভদা । সৌম্যশুভ্র থাকতে না পেরে বলল, “তুমি কি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেবে নাকি ?”
সৌরভদা উত্তরে বলল, “নিতেই পারি । অশান্তির দুনিয়ায় শান্তির প্রয়োজন এখন । বুদ্ধতো শান্তির কথাই বলেছিলেন । তাই বুদ্ধের শরণাপন্ন হলে ক্ষতি কী !”
“কিন্তু তুমিই তো বল, তুমি ধর্ম মানো না ! ধর্ম নাকি মানুষকে মিথ্যা বোঝায় ।” ছেলে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয় বাবাকে ।
বাবা হাসে, “ধর্মকে জানতে হলে ধর্মের ভেতরে ঢুকতে হয় । কাল বলেছিলাম না যীশু হেমিসে এসেছিলেন । তুই কি জানিস শ্রীরামকৃষ্ণ মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়ছেন, চার্চে গিয়েছেন ?”
“তুমি যাই বল না কেন, তুমিও ধর্ম মানো । তুমি যে হিন্দু এটা তো স্বীকার কর ?”
“হ্যাঁ, খাতায়-কলমে, বংশ পরম্পরায় আমি হিন্দু । কিন্তু আমি বিশ্বাস করি প্রকৃতিই ঈশ্বর । মানে প্রকৃতির মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের প্রকাশ । তবু মাঝে মাঝে মনে হয় হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে গৌতম বুদ্ধের মতো একজন ধর্মগুরুর আজ বড় প্রয়োজন । মানুষ একজন ধর্মগুরুকে যতটা সহজে গ্রহণ করে একজন পন্ডিতকে তত সহজে গ্রহণ করে না । যুদ্ধবাজ অজাতশত্রু বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়েছিলেন অনেক রক্ত ঝরানোর পর । সম্রাট অশোক চন্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হয়ে উঠেছিলেন কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বুদ্ধকে আশ্রয় করে । মানবকল্যাণে বুদ্ধ এবং বৌদ্ধধর্মের সেই অবদান তো স্বীকার করতেই হয় ।”
“কিন্তু কাকু, বৌদ্ধরা অহিংসায় বিশ্বাসী বলে কি যুদ্ধ-মারামারি করে না ?” অমিত প্রশ্ন করে ।
সৌরভদার মুখে বুদ্ধের হাসি । “হ্যাঁ, করে তো ! সবারই তো আত্মরক্ষার অধিকার আছে । বৌদ্ধ রাজারা যুদ্ধ করেছে অতীতে, তিব্বতের বৌদ্ধরাও চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়েছে । তবে হ্যাঁ, শুধু আত্মরক্ষার জন্যই বলি কেন ! ধর্ম নামক ছাতার নীচে থেকে অপরাধ করাটাও অনেক মানুষের ধর্ম । ধর্মীয় পোশাক পরে কেউ কুকীর্তি করে, কেউ ধর্মকে আশ্রয় করে ঈশ্বরের সন্ধান করে । ধর্মের নামে যারা শক্তি প্রদর্শন করে তারা ধর্মান্ধ ।”
“কিন্তু সব মানুষই তো কোন না কোন ধর্মের । ঈশ্বর যদি একই হন মানে মহাপুরুষরা যা বলেন আর কি ! তাহলে এত মারামারি কেন ? যে, যে ধর্মে বিশ্বাস করে তাই নিয়েই তো থাকতে পারে !”
সৌরভদার মুখটা লাদাখের আকাশের মতোই পরিষ্কার । “এইটাই হল আসল কথা । স্বার্থ । স্বার্থের সংঘাতের জন্যই শান্তি আসে না, শান্তি মেলে না । অশান্তির কালো ছায়ায় মানবসমাজ বারবার বিপন্ন হয়েছে, হচ্ছেও । সভ্যতার আদিযুগে মানুষ প্রথমে ভয়ে প্রাকৃতিক শক্তিকে পূজো করতে শুরু করেছিল । প্রাকৃতিক শক্তিকে সব জীবই তো ভয় পায় । মানব সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরচিন্তারও উন্মেষ ঘটে । সৃষ্টির রহস্য জানতে চায় মানুষ । কৌতূহলী মানুষের সামনে তখন রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে যায় । একটা পথ বিজ্ঞানের আর একটা ধর্মের । এই দুটো পথের যে কোন একটা বেছে নেয় মানুষ । পথ চলতে চলতে কেউ আলোর সন্ধান পায় কেউ পায় না । এটাই চলছে । একদিন দুটো পথ হয়ত আবার একপ্রান্তে এসে মিশে যাবে । কিন্তু তার আগে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে । হয়ত আরো ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে পথ শেষ হবার আগেই ।”
হেমিস গুম্ফায় পৌঁছে গেছে গাড়ি । লাল-হলুদ রঙের বিশাল ছ’তলা বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় সদ্য রঙ করা হয়েছে । ক’দিন আগেই হেমিস উৎসব ছিল । বৌদ্ধগুরু পদ্মসম্ভবের জন্মতিথি উপলক্ষে প্রতি বছর জুন মাসে হেমিস উৎসব হয় ।
প্রার্থনা কক্ষে গুরু পদ্মসম্ভবের বিরাট মূর্তি । মূল মন্দির কক্ষে ভগবান বুদ্ধের বিশাল স্বর্ণমূর্তি মূল্যবান অলংকারে সজ্জিত । লাইব্রেরিতে মূল্যবান বই, থংকাস । পৃথিবীর সবচেয়ে বড় থংকাস আছে এখানেই । প্রতি বারো বছর পর বের করা হয় হেমিস উৎসবের সময় । হেমিস মিউজিয়ামটাও বিরাট । প্রচুর থংকাস, নানা আকারের বুদ্ধ ও দেবদেবীর মূর্তি, আশ্রমিকদের হাতে তৈরি জামা, অ্যাপ্রিকট অয়েল, ধূপকাঠি, পাথরের অলংকার সাজিয়ে রাখা আছে । বিক্রিও হয় ।
সৌরভদা বলছিল, “হেমিস উৎসবে শুধু মুখোশ নৃত্য দেখার জন্যেই দেশবিদেশ থেকে টুরিস্ট আর ফটোগ্রাফাররা ভীড় জমায় । লাদাখিরা জমকালো পোশাক পরে সবাই । ক’দিন আগে এলে দেখতে পেতাম । ইস !”
“সৌরভদা !”
“স্বাতী !” বিস্মিত সৌরভদাকে প্রণাম করছে একজন মহিলা ।
হাইটটা একটু কম হলেও মহিলা এককালে বেশ সুন্দরী ছিলেন । বয়সের ভারে এখন ঈষৎ পৃথুলা । মিউজিয়ামের বাইরে বেরিয়ে মহিলা হৈ হৈ করে স্বামী-পরিবার এক করে ফেললেন ।
“সৌরভদা আমার ম্যাথস টীচার ছিলেন । কী দারুণ অঙ্ক করাতেন সৌরভদা !” প্রাক্তন ছাত্রীর চোখে-মুখে মুগ্ধতা ঝরে পড়তে দেখলাম । সৌরভদার শিক্ষকতা করার ব্যাপারটা জানতাম না । তার মতো মানুষের তো শিক্ষকতাই করা উচিত ।
স্বাতীর স্বামী ছ’ফুটের মতো লম্বা পুরুষ । ফর্সা, ধুনুকের মতো বাঁকা ভারী ঠোঁট, মোটা ভুরু । আই পি এস বা আর্মি অফিসার হলেই মানায় যেন । কিন্তু যখন শুনলাম ইঞ্জিনীয়ার তখন হতাশই হলাম ।
ছেলেমেয়ে দু’জনই লম্বা । মায়ের মতো নয় । মায়ের মতো সুন্দরও হয়নি কেউ । মায়ের চোখদুটো তো অসাধারণ ! চুম্বকের মতো টানে ।
ছেলে ডাক্তারি পড়ছে । মেয়ে ক্লাস নাইনে । স্বাতী একাই কথা বলে যাচ্ছিল । হঠাৎ বোধহয় খেয়াল হল সৌরভদা একটাও কথা বলছে না আর ওর সঙ্গে যে আমি আছি এটাও যেন দেখতে পেল এতক্ষণে। “আমিই শুধু বকে যাচ্ছি ! আমার বরটাও যেমন, আপনিও তেমন। কেউ কথা বলতে চান না । বৌদি কোথায় সৌরভদা ?”
“বৌদি তো আসেনি । আমি ছেলেকে নিয়ে এসেছি । আর আর আমার এই বন্ধু ।” আমি যে হাতজোড় করেছি সেটা দেখল তো নাই উপরন্তু সৌরভদাকে চেপে ধরল স্বাতী, “এটা ঠিক করেননি । খুব অন্যায় । আপনি কোনদিনই মেয়েদের মন বুঝলেন না !” অভিযোগ থেকে গলা ভারী হতে হতে স্বখাতে ফিরে এল, “কোথায় আপনার ছেলে ?”
একটা পাহাড়ের মাথায় ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি দেখতে পেয়ে সে তখন ছবি তুলছে । দিব্যজ্যোতি হালদার আর অমিতকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে । সৌরভদা ছেলেকে ডাকল, “বাবি এদিকে আয় ।”
সৌম্যশুভ্র এসে দাঁড়াল । “এই আমার ছেলে ।” সৌরভদার ছেলে কাউকে প্রণাম করে না তাই বোধহয় সৌরভদা বলল না ওদের প্রণাম করতে । স্বাতী ওর চিবুক ছুঁয়ে বলল, “ভারী মিষ্টি দেখতে । খুব শান্ত ছেলে না ?”
সৌরভদা কিছু বলল না । শুধু হাসল । “আপনার ছেলে পড়াশুনায় নিশ্চয় খুব ভালো ? দেখলেই বোঝা যায় ।” সৌরভদাকে ছেড়ে স্বাতী ছেলেকে প্রশ্ন করল, “কী পড় তুমি ?”
সৌম্যশুভ্র ঘাড় নীচু করে খুব আস্তে করে বলল, “ইঞ্জিনীয়ারিং ।”
সৌরভদা ছেলের অবস্থা বুঝে বলল, “আমার ছেলে একটু লাজুক । তবে কিছুক্ষণ একসাথে থাকলে ও খোলস ছেড়ে বেরবে । এটাই ওর স্বভাব।”
“লাদাখ কেমন লাগছে রে ?” স্বাতী ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করে ।
সৌম্যশুভ্র’র সংক্ষিপ্ত উত্তর, “ভালো ।”
সৌরভদার ছাত্রীর স্বামী, পুত্র-কন্যা অধৈর্য হয়ে উঠেছে । “চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো !” মেয়ে বলল।
সৌরভদার দিকে তাকিয়ে স্বামী বলল, “আপনারা আজ সন্ধ্যেয় আমাদের হোটেলে আসুন না । তখন গল্প করা যাবে । হোটেল লেহ প্যালেসের ২০৫ নম্বর রুম ।”
স্বাতীর চোখ ঝলসে উঠেই নিভে গেল । প্রাক্তন টীচারকে নিয়ে তার এই বাড়াবাড়ি এখন ওরা কেউ পছন্দ করছে না বুঝেছে সে ।
খুব প্রিয় একজন মানুষকে হঠাৎ পেয়ে হারিয়ে ফেললে মুখের যে অবস্থা হয় সৌরভদার ছাত্রীর মুখের অবস্থা তার চেয়েও করুণ । মেয়েদের জীবনে স্বামী আর স্বামীর সংসার ছাড়া কিছু থাকতে নেই ! সব সময় সব অপমানের জবাব দেওয়া যায় না । কখনো কখনো হজম করেও নিতে হয় । সেটা বুঝেই বোধহয় স্বাতী বলল, “সৌরভদা, আসুন না আজ সন্ধ্যায় ।”
সৌরভদা বুদ্ধিমান । ছাত্রীর আকুলতা দেখে বলল, “বেড়াতে এসে ওদের বোধহয় সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না । তুমি যাও । আমি চেষ্টা করব যেতে ।”
“তুমি যাও” –কথাটায় বেশ জোর দিয়েছিল সৌরভদা । স্বাতী কী বুঝল ! আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় !
স্বাতীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সৌরভদা কতকটা আপনমনেই বলল, “মেয়েটা লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল ।”
সিন্ধু দর্শনে মন ভরে গেল । কয়েকদিন আগেই ছিল সিন্ধুদর্শন উৎসব । উৎসবের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে সিন্ধুনদের পথে । এখন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানরা ট্রেনিং করছে সিন্ধুর তীরে ।
সৌরভদাকে একটু আনমনা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল সৌরভদা ?”
সৌরভদা বলল, “কিছু না । ভাবছিলাম ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তবিরোধ, দু’দেশের রাজনৈতিক শত্রুতা সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সিন্ধুনদ । সিন্ধু সভ্যতা যখন গড়ে উঠেছিল তখন না ছিল ভারত নামের কোন দেশ না ছিল পাকিস্তান । আর্যরা এদেশে না এলে না ভারত নামটাই বোধহয় হত না, আর ইংরেজরা না এলে পাকিস্তানের জন্মও হত না।”
“সৌরভদা, ওসব আর ভেবে লাভ নেই । লড়াই তো সর্বত্র । কোথাও বাঁচার লড়াই, কোথাও বাজার দখলের লড়াই, কোথাও ভূমি দখলের লড়াই । এর পর লড়াই শুরু হবে আকাশ দখলের । সিন্দুনদ দেখতে এসেছি, দেখে ফিরে যাই চলো । এখনও অনেকগুলো জায়গায় যেতে হবে ।” দিব্যজ্যোতি হালদার আর অমিতকে দেখলাম জওয়ানদের ট্রেনিং দেখছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ।
সৌরভদা সিন্ধুর পাড়ে উবু হয়ে বসেছে দেখে আমরাও বসলাম । জলের কোন রঙ হয় না কিন্তু এখানে জলের রঙ এখানকার পাহাড়ের মতোই ধূসর সাদা । জলে হাত দিতেই ছ্যাঁকা লাগল । গরম ছ্যাঁকা নয় কনকনে ঠাণ্ডা জলের ছ্যাঁকা । সূর্যের তাপে পাহাড়ের মাথায় বরফ গলছে, বয়ে নিয়ে আসছে সিন্দুনদ । সমৃদ্ধ হচ্ছে সিন্ধুনদের তীর ।
সূর্যের প্রখর তাপে চাঁদি ফাটছে । সৌম্যশুভ্র থাকতে না পেরে বলল, “এবার চলো ।”
বহুদূর থেকেই চোখে পড়ল থিকসে গুম্ফা । অন্যান্য বৌদ্ধমন্দিরের মতো পাহাড়ের শীর্ষে অবস্থান করছে ১৩তলার এই গুম্ফাটি । লাদাখ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গুম্ফা থিকসে । সাদা রঙের বিশাল বাড়িটার গায়ে পায়রার খোপের মতো লালরঙের জানলা । সাদার উপর হলুদ ও লালরঙ দিয়ে সুন্দর কারুকার্য করা মন্দিরের উপরতলাগুলো সহজেই দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।
গুম্ফায় প্রবেশ করতে টিকিট করতে হল । মূল মন্দিরে পদ্মাসনে বসা ধ্যানমগ্ন বিশাল বুদ্ধমূর্তি । অনেকগুলো মন্দির আছে থিকসে গুম্ফায় । অসংখ্য প্রদীপ জ্বলছে মন্দিরে মন্দিরে । নানা দেবদেবীর মূর্তি স্বর্ণালংকারে ও মূল্যবান রত্নে সজ্জিত । প্রচুর থংকাস, দেওয়ালচিত্র ছাড়াও এখানে প্রচুর প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র রাখা আছে । ধর্মীয় আবেগ আর পরিবেশের মধ্যে যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যেন ।
ধাক্কা খেলাম একটা প্রায়ান্ধকার মন্দিরে প্রবেশ করে । বিশালদেহী ভয়াল এক দেবীমূর্তিকে ঘিরে বেশ কিছু দেবদেবী । অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে দুটো প্রদীপের সামান্য আলোকে । আধিভৌতিক পরিবেশে ঢুকে পড়ে মনে হচ্ছে এখনই কোন সিনেমা শুরু হবে রূপকথার গল্পের মতো ।
সৌরভদা বলল, “ইনি তারা । বৌদ্ধদের তন্ত্রের দেবী । দেবীর পায়ের নীচে শুয়ে আছেন বজ্রভৈরব । আমাদের মা কালী আর মহাদেব শিবের কথা মনে পড়ছে তোমাদের ? পড়তেই পারে ! কিন্তু লক্ষ্য করে দেখ দেবীর চারটি নয় চব্বিশটি হাত আর বজ্র ভৈরবের ছ’টি হাত ।”
নীচে রাখা দুটো প্রদীপের সামান্য আলোয় ভালো করে দেখতে পেলাম না দেবীর মুখ । ইনি জিভ বের করা না হলেও অনেক বেশি ভয়ংকরী ।
গুম্ফার অলিন্দ থেকে দেখতে পেলাম অসাধারণ এক ছবি । পরিষ্কার ঝকঝকে নীল আকাশের নীচে ধূসর পর্বতঘেরা এক সবুজ উপত্যকা । নকশীকাঁথার মতো শস্যখেত, ছড়ানো ছিটানো কিছু ঘরবাড়ির মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে সিন্ধুনদ ।
একদল জওয়ান সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে দ্রুত । নীচের চাতালে সেনা বাহিনীর একদল জওয়ান । একটু তফাতে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে মিলিটারি কনভয় ।
(ক্রমশঃ)

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post