Sankars Creation

( ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাসের নবম পর্ব )

তপন বিশ্বাস

।। নয় ।।
বসির খান ভয়ংকর রেগে আছে । বসির খানের সামনে একজন পুরুষ, একজন মহিলা । চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে বয়স । বসির খান চিৎকার করে বলল, “আভি নিকালো ইঁয়াসে । ভাড় মে যায় পৈইসা ।”
সৌরভদা আর আমি পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করি । সৌম্যশুভ্রও চমকে গিয়ে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । বসির খান ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বের করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে সামনের লোকটার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “ফাড় দিয়া তেরা পারমিট । লে -” । একটা পাঁচশ টাকার নোটও ছুঁড়ে দিল মানুষটার মুখে । অসভ্যতার একটা সীমা থাকে ! এই লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর কাছে কোন সীমা-পরিসীমা নেই অসভ্যতার । বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি আমরা । সৌরভদা বাইরে চলে গেল । ওর দেখাদেখি আমরাও বাইরে । বাইরে বেরিয়েই সৌরভদা মাথা ঝাঁকাল, “নাহ্ ! এই লোকটার সাথে কেন যে চুক্তি করলাম ! সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ।”
“লোকটা কিন্তু আমাদের সাথে এখনও কোন খারাপ ব্যবহার করেনি সৌরভদা ।” বললাম ।
“করেনি, কিন্তু করতে কতক্ষণ ?”
“তোমার কথাই তোমাকে ফিরিয়ে দিই । মানুষ যত খারাপই হোক না কেন, আমার দ্বারা তার যদি কোন অনিষ্টের সম্ভবনা না থাকে সে আমার ভালো ব্যবহারের উত্তর ভালো ব্যবহারের মাধ্যমেই দেবার চেষ্টা করবে । তুমিই বলেছিলে একদিন ।”
“আমি বলেছিলাম এটা সত্যি । আমি বিশ্বাসও করি তাই । কিন্তু এই লোকটা যে আমার বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করছে ! কী হিংস্র চাউনি ! কী কর্কশ কন্ঠস্বর !”
“কাহানীর খানের দাদা নয় তো !” আমাদের দু’জনের কথার মধ্যে বলে সৌম্যশুভ্র ।
“ওটা ছিল নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর অভিনয় । এটা অভিনয় নয় । বাস্তব ।” সৌরভদার কথার মাঝেই দেখলাম ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা বের হয়ে গেল খানের অফিস থেকে । বাবুল এসে বলল, “আপনারা ভেতরে যান ।”
“হ্যাঁ, যাচ্ছি । তুমি নিশ্চয়ই খানের সিগারেট আনতে যাচ্ছ ?”
বাবুল হেসে বলল, “হ্যাঁ ।”
লাল হয়ে আছে খানের মুখ । আমাদের দেখে বলল, “বৈঁঠিয়ে ।” আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম খান কী বলে শোনার জন্য । বাবুল সিগারেট এনে না দেওয়া পর্যন্ত খান চুপচাপ রইল ।
সিগারেটে কয়েকটা ঘন ঘন টান দিয়ে গলগল ধোঁয়া ছাড়ছিল স্টীম ইঞ্জিনের মতো খান । অতঃপর সিগারেটের শেষাংশ বাবুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপকো তো কাল জানা হ্যায় । আট বাজে আ আইয়ে । ইন লোগোকে সাথ প্রোগ্রাম সেট কিয়া থা আপকা । দেখতা হু আভি ।” তুড়ি মেরে কিছু একটা উড়িয়ে দিয়ে হাসল খান । একটু আগের খান আর এখনকার খান যেন একজন ব্যক্তি নয় । অদ্ভুত বৈপরীত্য !
শ্যামবাজারের অভিজ্ঞান আর ওর বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় স্টেটব্যাংকের সামনে । ছ’জনের দল । কাশ্মীর হয়ে এসেছে। এখানে এসে মোটর সাইকেল ভাড়া করেছে তিনটে প্যাং গং যাবে বলে । বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদের যুবকরা এগিয়ে গেলেও শ্যামবাজারও পিছিয়ে নেই দেখে বেশ ভালো লাগল । সৌরভদা বলল, “কাল আমরাও প্যাং গং যাচ্ছি । আমরা অবশ্য গাড়িতে যাচ্ছি, দেখা হবে কিনা জানি না । সাবধানে যেও তোমরা । কোথায়ও তাড়াহুড়ো করবে না । দুর্গম পথ, উচ্চতাও কম নয় –আঠারো হাজার ফিটের কাছাকাছি । বাড়িতে তোমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে, ভুলে যেও না তোমরা । জীবনটাকে এনজয় কর মানুষের মতো করে ।”
অভিজ্ঞান দলটার নেতা । কতই বা বয়স ! পঁচিশ- ছাব্বিশ । ভদ্র, শান্ত । কিন্তু দুরন্ত । অভিজ্ঞানের বন্ধুরাও অভিজ্ঞানের মতোই । বয়স প্রায় একই । এমন সব দামাল ছেলে এখনও বাংলার ঘরে আছে দেখে অবাক হই ।
অভিজ্ঞান সৌম্যশুভ্র’র পিঠ চাপড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী কর তুমি ? পড় নিশ্চয়ই ?” সৌম্যশুভ্র বিরক্ত হল ওর পিঠ চাপড়ে দেওয়ায় । একটু সরে গেল । যেন অনিচ্ছাসত্বেও সে উত্তর দিল, “ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ি ।”তারপর বাবার দিকে ফিরে বলল, “আমার ক্ষিদে পেয়েছে।চলো ।”
সৌরভদার মতো আমিও অসন্তুষ্ট সৌম্যশুভ্রের ব্যবহারে । ছেলেটা একটু বেশি রকমের অসামাজিক । সৌরভদা চেষ্টা করছে নানাভাবে ওকে গড়ে তুলতে । কোথায় যেন এসে আটকে যাচ্ছে । চাকুরিজীবি মানুষের ছেলে-মেয়েরা বোধহয় এভাবেই তৈরি হচ্ছে আজকাল। তবু তো সৌরভদার স্ত্রী চাকরি করে না । সৌরভদা যদি দুঃখ করে বলে, “ছেলেটা মানুষ হল না” কথাটা কী ভুল ? কয়েকটা ডিগ্রী নিয়ে একটা ভালো চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হওয়াকেই কী মানুষ হয়ে যাওয়া বলে ! দশজনকে নিয়ে চলতে না পারলে, দশজনের সঙ্গে মিশতে না পারলে সে তো দেশ ও দশের কোন কাজেই আসবে না ।
জমীর একটা প্রস্তাব দিল । কাল সকালে প্যাং গং যাওয়ার আগে আমাদের এক্সট্রা মালপত্র ওদের লাগেজ রুমে রেখে গেলে একটা দিনের ভাড়া কম পড়বে আমাদের । লাগেজ রুমের জন্য কোন ভাড়া দিতে হবে না । রাজী না হওয়ার কোন কারণ নেই।জমীরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে এলাম । সৌরভদা বলল, “ইস ! জমীর যদি আগেরবারও এই প্রস্তাবটা দিত তবে আর একটা দিনের ভাড়া বেঁচে যেত ।”
সৌরভদার সঙ্গে থেকে থেকে আমিও এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করলে মানুষের কাছে থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়া যায় ।
সৌরভদা ছেলেকে তাড়া দিল, “বাবি, শুয়ে পড়।মোবাইল নিয়ে কী করিস এতো? নেটওয়ার্ক তো নেই । আগে জানলে বি এস এন এলের প্রিপেইড ছেড়ে পোস্ট পেইড কানেকশন করিয়ে আনতাম । বাড়িতে ফোন করা যেত অন্ততঃ ।”
সৌরভদা বাজারের বুথ থেকে বৌদিকে ফোন করেছিল । দুটো কথা বলতে বলতেই কেটে যায় লাইন । বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ভালো করে কথাই বলতে পারেনি । বরং সৌরভদা ওর ছোড়দির সঙ্গে একটু বেশীক্ষণ কথা বলতে পেরেছিল । তাই মনটা বেশ ভাল আছে ।
লোডশেডিং হয়ে গেল । অনেকক্ষণ লাইট আসছে না দেখে মোমবাতি খুঁজে নিয়ে আলো জ্বালালাম । সৌম্যশুভ্র ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে ।
মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক নিবিড় । মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির বন্ধন । আর সন্তান হল পিতার আত্মজ । মায়ের অবর্তমানে পিতার বুকে মুখ গোঁজে সন্তান ।
জানলা দিয়ে হালকা হলেও আলো আসছে বাইরের । ঘুম না এলেই যত রাজ্যের আবোল তাবোল ভাবনাগুলো ভীড় করে আসে । বুকের ভেতরে থাকা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি গুড়গুড় করে ওঠে । শরীর কাঁপে । মাথার উত্তাপ বাড়ে । মাথা গরম হলে চুলগুলো নিয়ে বিব্রত হতে হয় । আজও তেমন ফিলিংস হচ্ছে । কেউ একজন বিলি কেটে দিলে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়তাম । সেলুনে চুল কাটাতে গিয়ে কতবার ঘুমে চোখ বুজে আসে দেখেছি ।
শরীর ও মনের ক্লান্তি দূর করতে ঘুমের প্রয়োজন । কিন্তু আজ কোথায় যে পালিয়ে গেছে সেই ঘুমটা ! জানলার ধারে দাঁড়িয়ে লেহ শহরটাকে দেখতে দেখতে মনে হল শহরটাও কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে । শহরটাতে কোন অশান্তি নেই । বেশ আছে শহর আর শহরের মানুষগুলো । অথচ মাত্র তিন চার মাসের জন্যে শহরটাতে খুশির হাওয়া বয়ে যায় । বাকি সময়টাতে তো শুধু বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই । প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেই যুগ যুগ ধরে টিকে আছে এখানকার জীবন । জীবনযাত্রা থেমে যায়নি কখনো।
সেই সবুজ রঙের কোয়ালিশ আর বাহন সেই লামা । খান হেসে জানাল, “ইউ আর সো লাকি ! আপকা সাথী – এ বিউটিফুল আমেরিকান লেডি অ্যান্ড এ চার্মিং অস্ট্রেলিয়ান গার্ল । এনজয় !”
খানের বলার ভঙ্গীতে সৌরভদার সাথে আমিও হেসে ফেললাম । সৌম্যশুভ্র নির্বিকার । সে মোবাইল ঘাঁটছে । বাবুল আসেনি আজ । লামা আমাদের মালপত্র তুলে দিল গাড়ির ছাদে ।
আরো মিনিট পনেরো পরে আমাদের সহযাত্রীরা এল । খান পরিচয় করিয়ে দিল । অস্ট্রেলিয়ান মেয়েটার নাম অলিভিয়া । সত্যিই চার্মিং গার্ল । কুড়ি-বাইশের বেশি হবে না বয়স । বেশ হাসিখুশিও । আমেরিকান মেয়েটার নাম রুবি জোনস । বয়স একটু বেশি হবে অলিভিয়ার চেয়ে । কেমন যেন রুক্ষ চেহারা ! লালচে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে গেল গাড়িতে । পেছনের সিটে গিয়ে বসল রুবি । অলিভিয়াও ওর সাথে পেছনের সিটে বসল । সৌম্যশুভ্র এতক্ষণ লক্ষ্য করছিল ওদের । ওদের পেছনে বসতে দেখে খুব খুশি হয়েছে মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে । মোবাইলটা পকেটে পুরে সামনের সিটে উঠে গেল সে । সৌরভদা আমার দিকে চেয়ে হেসে বলল, “চলো, তুমি আর আমি মাঝে বসি ।”
বাঁদিকে সিন্দুনদ কখন যে আমাদের সঙ্গ নিয়েছে বুঝতেই পারিনি । গাড়িটা যখন পাক খেতে খেতে লেহ শহরের জট ছাড়াচ্ছিল তখন সৌরভদার সঙ্গে কথা বলছিলাম মেয়েদুটোর ব্যাপারে । সৌরভদা বলেছে, “সব আমেরিকানদের মতোই দাম্ভিক মেয়েটা ।”
কারু’তে এসে পথ ভাগ হয়ে গেছে । ডানদিকের পথটা মানালির । এখান থেকেই গিরিপথের চড়াই । গাঢ় নীল আকাশের নীচে ধূসর পাহাড় । দু’একটা মেঘের পালক উড়ে আসছে মাঝে মধ্যে । উপত্যকায় সবুজ আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়ে আকাশ দেখছে ছোট ছোট জনপদ । সৌরভদা সুর ভাঁজছে । কান পেতে শুনে বুঝলাম জনপ্রিয় পুরানো একটা হিন্দি গানের সুর । সুরের সংক্রমণ ঘটে গেল আমার মধ্যেও ।
সুরের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে কখন যেন প্রকৃতির রাজ্যে ছন্দপতন ঘটে গেছে । ধূসর পাহাড়ের জায়গা নিয়েছে বরফে ঢাকা পাহাড়, নীল আকাশের দখল নিয়েছে কুয়াশার মতো মেঘ । শীতের শিরশিরানি টের পাচ্ছি । আবহাওয়া হঠাৎই বদলে গেছে । নীচের উপত্যকায় রোদের আলো থাকলেও পাহাড়ে রোদ নেই । “কার্শিয়াং পাহাড় থেকে রোদ ঝলমলে শিলিগুড়ি শহরটাকে এরকমই দেখায় ।”
সৌরভদার কথায় সায় দিলাম, “ঠিক বলেছো সৌরভদা । তবে এটা কী বেশিক্ষণ থাকবে ? বৃষ্টি নেমে গেলে কিন্তু মুশকিলে পড়ে যাব আমরা । বৃষ্টিতে পাহাড়ে ধস নামতে পারে ।”
সৌরভদা মাথা নেড়ে বলল, “মনে হয় না বৃষ্টি হবে । লাদাখে বৃষ্টি তো হইই না বলতে গেলে !”
একটু পরেই দু’জনকেই স্বস্তি দিয়ে মেঘেরা উধাও । রোদ আর নীল আকাশকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড় আবার হেসে উঠল । তুষার রাজ্যে চক্কর কাটছে গাড়ি । সৌম্যশুভ্র আজ নিজেই জ্যাকেট চেয়ে নিল বাবার কাছে । পেছনের মেয়েদুটো কী করছে কে জানে ! সাড়া শব্দ নেই ওদের ।
মেঘ-রোদ্রের লুকোচুরি খেলা শুরু হয়েছে এবার । গাড়ি পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে চলছে খুব আস্তে আস্তে । লামা ওস্তাদ ড্রাইভার । পাহাড়ের ব্যাপার আমাদের চাইতে ভালো বোঝে নিশ্চয় । হাতের তালুর মতো চেনে রাস্তাঘাট ।
চাংলা পাসে বরফ পড়ছে নিয়মিত । পথের উপরেরও তুষারক্ষত । সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলছে যান নিয়ন্ত্রণ । সেনাবাহিনী আছে তাই আমরা বেড়াতে আসতে পারছি সীমান্তের এই দুর্গম পাহাড়ে । ভারতীয় সেনাবাহিনী সদা তৎপর অতিথি সৎকারে । ক্যান্টিনে ধোঁয়া ওঠা গরম চা, কফি, স্ন্যাক্সসহ নানা রকম খাবারের বন্দোবস্ত সব করে রেখেছে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা ।
“কোথায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না তো ?” মহিলা কন্ঠে বাংলা শুনে পেছনে ফিরলাম । মধ্যবয়স্কা মহিলা তার সঙ্গীকে প্রশ্ন করেছে। তার পুরুষসঙ্গী দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উত্তর দিল, “বলেছিল তো ওরা ।”
“বেশি উচ্ছ্বাস না দেখানোই ভালো বোধহয় । এখানে অক্সিজেনের মাত্রা সত্যিই কম ।” আমার অযাচিত উপদেশে মহিলা ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছেন দেখে আবার বললাম, “না, না।কিছু মনে করবেন না।আপনার ভালোর জন্যেই বলছিলাম- ছোটাছুটি করলে বা অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস দেখাতে গেলেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।আর একবার শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিলে নানারকম অসুবিধে হতে পারে এই অল্টিচ্যুডে ।”
ভদ্রলোক আমার কথা লুফে নিয়ে বলল, “আপনি ঠিকই বলেছেন । ওর একটু মাতামাতি করার স্বভাব । একটু আগেই বরফ তুলে নিয়ে ছুঁড়ছিল ।”
“তোমার মাস্টারি শুরু হল আবার !” চোখ পাকিয়ে তাকাল তাকাল মহিলা । ভদ্রলোকও কম যায় না ! আমাকে সাপোর্টার পেয়ে বলল, “দেখেছেন ! ভালো কথা শোনার মেয়েই না সে ।”
অপরিচিত মানুষের সামনে এভাবে বলায় লজ্জা পেল মহিলা । কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনিও প্যাং গং যাচ্ছেন ?”
“হ্যাঁ । পাহাড়ে আনন্দ করুন, পাহাড়কে উপভোগ করুন কিন্তু কিছু সতর্ক বার্তা মনে রেখে । নমস্কার । আসি ।”সরে আসতে গিয়েও পারলাম না।ভদ্রলোক আটকে দিল।“আপনার সঙ্গে কথা বলে বেশ লাগল । একটা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে এসেছি । কথা বলার মতো তেমন লোক নেই ।”
“ঠিক বলেছো । যা সব এসেছে ! আপনি কি একাই এসেছেন নাকি ? সঙ্গী-সাথী কাউকে দেখছি না তো !”
মহিলার কথার উত্তরে বললাম, “নাহ্, আমার সঙ্গে আরো দু’জন আছে । ওরা ওদিকে ঘুরছে কোথাও । বাবা-ছেলে । আমরা অবশ্য নিজেরাই অ্যারেঞ্জ করেছি সব।” অলিভিয়াদের কথা বললাম না ওদের । অবিনাশ সামন্তকে মার্তাদের কথা বলতেই যা একটা ভাব করেছিলেন !
“তবে ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে এলে খাওয়া, থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না । কবে, কোথায় যাব সেটাও ভাবতে হয় না । হঠাৎ কেউ অসুস্থ হলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয় দেখেছি । লেহতে আসার পর আমাদের দলের একজন মানুষ, তমালদা অসুস্থ হয়েছিলেন । তাকে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে আমাদের ম্যানেজার । প্যাং গং যেতে পারল না ওরা । খুব খারাপ লাগছে ওদের কথা ভেবে । হোটেলে রেখে আসা হয়েছে স্বামী-স্ত্রীকে ।”
ভদ্রলোকের কথার মাঝেই মহিলা বলে উঠল, “আমাদের সাথে বেশ ভাব হয়েছিল ওনাদের । আমার তো শ্যামলীদির জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে ।”
মনের মতো মানুষ পেলে মানুষ কথা বলতে ভালোবাসে । মানস মুখার্জী, স্ত্রী সর্মিতা মুখার্জী দুজনেই কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ফারাকটা একটু বেশি । মানসবাবু স্ত্রীর চাইতে দশ-বারো বছরের বড় তো হবেনই ।
দেখতে দেখতে একটা ভীড় জমে গেল আমাদের ঘিরে । লম্বা-চওড়া পালোয়ানি চেহারার দমদমের গোপাল ঘোষ, স্ত্রী শুক্লা ঘোষ । দমদমেরই দিলীপ সাহা, স্ত্রী কলি সাহা । গড়িয়ার সুন্দরী সুদেষ্ণা, স্বামী প্রতাপ গাঙ্গুলি । যাদবপুরের অভিষেক-সুপর্ণা বিশ্বাস । মানস মুখার্জীই পরিচয় করিয়ে দিল । কথাবার্তার মাঝেই মিশমিশে কালো মোষের মতো চেহারার গোপাল ঘোষ হঠেৎ বলে উঠল, “দাদা, চমরী গাইয়ের দুধ খেয়েছেন ?”
আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই আমার হয়ে আর একজন পাল্টা বলল, “কেন তুই কি প্রমোটারি ছেড়ে আবার দুধের ব্যবসা করবি নাকি ? গরুর জায়গায় ইয়াক ! খাটাল দেখতেই লোকে ছুটে আসবে রে ।” খিক্ খিক্ করে উঠল সে । লোকটাকে দেখলাম । বেশ লম্বা, টাক মাথা, থ্যাবড়ানো নাকের নীচে কাঁচাপাকা গোঁফ । কানের দু’পাশে আর মাথার পেছনে কয়েক গাছা কলপ করা চুল । দমদমের দিলীপ সাহা ।
সঙ্গে সঙ্গে গোপাল ঘোষের জবাব, “হ্যাঁ, ওইরকমই ভাবছি । তোর ট্র্যান্সপোর্টের ব্যবসাও তো ভালো চলছে না, এখান থেকে ইয়াক কিনে তোর ট্র্যান্সপোর্টেই নিয়ে যাব । আমি লাল হই না হই তুই কিন্তু লাল হয়ে যাবি । রাজী আছিস ?”
একজন বলল, “ইয়াকের দুধ কিন্তু খুব ঘন হয় শুনেছি । প্রচুর জল মেশানো যাবে ।” দেখার চেষ্টা করলাম না কে বলল কথাটা । রসিকতা এক জিনিস আর কারো পেছনে লাগা আর এক জিনিস । ব্যাপারটা কোনদিকে মোড় নেবে বুঝতে বুঝতে পারছি না । তবু উত্তর দিলাম, “ইয়াকের দুধ না খেলেও ইয়াকের দুধের চা খেয়েছি । আপনারাও খেয়ে দেখতে পারেন এখানকার লাদাখি বা তিব্বতী চা । ইয়াকের দুধ আর মাখন দিয়ে বানানো হয় ।”
আর কতক্ষণ এভাবে চলত জানি না । সৌরভদা এসে আমাকে বাঁচাল । “কি চা কফি কিছু খাবে না ?”
“হ্যাঁ, খাব তো । চলো ।”
কলি সাহা আমাকে চমকে দিয়ে বলল, “আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি ! আপনি কি অভিনয় করেন ?”
শুক্লা ঘোষ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “হ্যাঁ, আমারও আপনাকে চেনা চেনা লাগছে প্রথম থেকেই ।”
বিড়ম্বনার শেষ নেই । বললাম, “আমার মতো সাধারণ চেহারার মানুষ সব সময়ই দেখছেন রাস্তাঘাটে, তাই হয়ত মনে হচ্ছে চেহারাটা চেনা চেনা ।” কথাটা বলেই পালিয়ে এলাম দলটার থেকে ।
সৌরভদা চেপে ধরল, “মহিলারা তোমাকে চেনে বলছে । কী ব্যাপার বল তো ?”
“সৌরভদা, ওসব ভেবে লাভ নেই । ওরা বোধহয় আমাকে একা পেয়ে মুরগী করতে চাইছিল । দল বেঁধে এসেছে তো ! ভুলটা আমিই করেছিলাম । একটু উপদেশ দিতে গিয়ে যে এমন বিপদে পড়ব বুঝিনি । ভাগ্যিস তুমি সময়মতো এসেছিলে !”
চাংলাপাসে পর্যটকের সংখ্যা নেহাত কম নয় । ১৭৫৮৬ফিট উচ্চতায় ওয়ার্ল্ডের থার্ড হায়েস্ট মোটরেবল রোড ! প্যাং গং যাওয়ার পথে একটু ঘুরে দেখে নেওয়া, ছবি তোলার ফাঁকে চা-কফি খেয়ে জিরিয়ে নেওয়া যায় বলেই সবাই কিছুটা সময় ব্যয় করে । তাই লম্বা লাইন পড়ে গেছে গাড়ির ।
গাড়ি নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে । সংকীর্ণ গিরিপথ । চাকার নীচে বরফ ভাঙ্গার মচ্মচ্ শব্দ । একটার পর আর একটা বিপজ্জনক বাঁক । মাঝে মাঝে দু’একটা সেনাছাউনি । জনবসতি নেই একটাও ।
আকাশ আবার হেসেছে । ঘন নীল আকাশের নীচে একটার পর একটা পাহাড় ঢেউ তুলছে । তুষারাবৃত পর্বতগুলো ধ্যানগম্ভীর ঋষির মতো কঠিন তপস্যায় রত দেখে আমরাও নীরবতা পালন করছি । অলিভিয়া, রুবি কারোরই সাড়া শব্দ নেই ।
সংকীর্ণ গিরিবর্ত্ম, খাড়া পাহাড় থেকে আচমকাই প্রবেশ করলাম ছবির মতো এক উপত্যকায় । সবুজ আঁচল বিছিয়ে প্রকৃতি হাসিমুখে অভ্যর্থনা করছে । সৌরভদা বলল, “দুরবুক উপত্যকা । সামনে বোধহয় তাংসে গ্রাম আসছে । তাংসে থেকে ট্রেক করে সায়ক নদীর তীর ধরে যাওয়া যায় নুব্রা ভ্যালিতে ।”
তাংসে থেকে পথ দু’ভাগ হয়ে গেছে । বললাম, “একবার ট্রেকিং করে এখান থেকে নুব্রা গেলে কেমন হয় সৌরভদা ?”
সৌরভদা হেসে বলল, “সে পথ খুব দুর্গম শুনেছি । বিপদসংকুল । আমাদের জন্য বোধহয় সেফ নয় । তাছাড়া ছেলেটার কথা ভেবে অনেককিছুই তো করতে পারি না ।”
সৌরভদা হঠাৎ স্মৃতিমেদুর । “পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে চটের আসন নিয়ে পড়তে গিয়েছিলাম । টিনের ছাউনি দেওয়া স্কুলবাড়িটা প্রায় ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপ করছিল যেন । দরজা-জানলা বলে কিছু তো ছিল না । তক্তা দিয়ে কিছুটা ঘেরা ছিল শুধু । মাটিতে আসন পেতে বসেছিলাম । কতই বা বয়স তখন ! তবু মনে আছে । তখন কি ভেবেছিলাম এমনভাবে ঘুরতে পারব ? ছোট্ট শহরটা ছেড়ে কোনদিন বাইরের জগতে পা রাখতে পারব এটাই তো ভাবিনি । বড় হয়ে একটা চাকরি পেলে ভালো ভালো খাবার খাব, ভালো জামাকাপড় পড়ব এটাই ভাবতাম তখন । আর ভেবেছিলাম মাকে নিয়ে তীর্থস্থানে বেড়াতে যাব । চাকরি পাবার পরই মাকে পুরীতে নিয়ে গিয়েছিলাম তাই । দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছি । বাবার অকালমৃত্যুর পর সে লড়াই আরো কঠিন হয়েছিল । কষ্ট করেছি।লড়ে গেছি।হারিনি।নিজে কষ্ট পেয়েছি বলে ছেলেটাকে কষ্ট পেতে দিই না । ওর প্রতিভা ছিল, অভাব ছিল না । তবু ছেলেটা হেরে যাচ্ছে ।”
সৌরভদার কষ্টটা বুঝি । কষ্টটা হতাশার। অভিমানেরও । বললাম, “সৌরভদা, তুমি লড়াই করে বড় হয়েছো ছোটোবেলা থেকে।তোমার ছেলে ছোটোবেলা থেকে লড়াই করতে শেখেনি।তুমিই করতে দাওনি । তাই লড়াইয়ের ময়দান দেখেওনি বোধহয় । ওর মধ্যে একটা শিশুমন কিন্তু এখনও আছে । তার জন্য ভেবো না ওর কোন ডেডিকেশন বা ডেস্টিনেশন নেই । একটু দেরি হলেও ঠিক বুঝতে পারবে তোমার ছেলে । একদিনে সাফল্য আসে না । লাগাতার চেষ্টায় আসে । ও ঠিক পারবে ।”
সৌরভদার হাসির মধ্যে বাবার কষ্টটা দেখতে পাই । ভারী হয়ে আসা গলায় সৌরভদা বলে, “নাহ্ ! ওর উপর আমার সে আশা আর নেই । একটা চাকরি ও পেয়ে যাবে জানি, কিন্তু ওর যা পাওয়া উচিত ছিল বা পেতে পারত তা আর কোনদিনই পাবে না । আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেছে আগেই ।”
স্বপ্নভঙ্গ ! কথাটা কানে লাগল খুব।আজকের ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখে না।সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে । কিন্তু সাঁতার না জানলে যে ডুবে যাবে সেটা জানে না । ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে বর্তমানের হাত ধরে । তার জন্যেও স্বপ্ন দেখতে হয় । সব স্বপ্ন সফল হয় না কারণ স্বপ্নভ্রম কিংবা স্বপ্নমায়াও তো থাকে । ইংরেজরা অনেককিছুর সাথে এটাও শিখিয়েছে – বেটার, লেট দ্যান নেভার । অবশ্য আমি এটাকে তেমন গুরুত্ব দিই না । আমি বিশ্বাস করি সময়ের কাজ সময়ে করতে হয় ।
সৌম্যশুভ্র চিৎকার করে উঠল, “ওই যে প্যাং গং লেক !”
বেলা এখন চারটে । অপরাহ্নের রোদও তীব্র এখানে । ঝলসানো রোদ্রে নীল আঁচল বিছিয়ে শুয়ে আছে এক বিশাল সরোবর । ঘন নীল আকাশের নীচে সোনালি-রূপালি পর্বতশ্রেণী ঘিরে রেখেছে নীল সরোবরকে । চেনা পৃথিবীর বাইরে ভিনগ্রহের ছবির মতো অচেনা এক জগত হাতছানি দিয়ে ডাকছে ।
ভারত-চিন সীমান্তে চ্যাং-চেংমো পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল এই সরোবর অভিনব সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে । ১৫০কিমি দীর্ঘ, চওড়ায় দু’ থেকে দশ কিমি বিস্তৃত । মাত্র ৪৫কিমি ভারতের মধ্যে, বাকিটা চিনের দখলে । তিব্বতের মধ্যে । হ্রদের জল নোনা তাই সবুজের জন্ম দেয় না । এশিয়ার সর্বোচ্চ উচ্চতায় সর্ববৃহৎ নোনা জলের হ্রদ । হ্রদের জল নীল আকাশকে ধরে রেখে ঘন নীলরঙা ।
প্যাং গং সো । সো কথাটির অর্থ সরোবর । চারিদিকে নানাবর্ণের পর্বতের সারি । সোনালি পাহাড়ের পেছনে ছাইরঙা ধূসর পাহাড়, আর একটু পেছনে তুষারকিরীট সজ্জিত রূপালি পর্বত । কালচে একটা পাহাড়ের বাঁদিকে আগুনরঙা একটা পাহাড় ভ্রকুটি তুলছে । নীলরঙ তো এখানে দেদার ছড়িয়ে আছে আকাশ থেকে সরোবরের সর্বত্র ।
লামা লেকের দিকে না গিয়ে তাঁবুর দিকে নিয়ে গেল গাড়ি । হুন্ডারের তাঁবুর মতো সারি সারি তাঁবু । এখানে তাঁবুর ভাড়া অত্যন্ত বেশি । লেক থেকে অনেকটা দূরেও তাই আমাদের পছন্দ হল না । লামাকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে বলতে সে জানাল এর থেকে ভালো আর নেই । সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে আমাদের কাছে প্রকৃতির সান্নিধ্য বেশি কাম্য । লেকের খুব কাছে থাকতে চাই । অলিভিয়াও সৌরভদাকে সে কথাই জানাল । লামার সঙ্গে একপ্রস্থ বচসা হয়ে গেল আমার । খানকে বলে দেব বলে ভয় দেখাতে ও আরো আগে নিয়ে গেল । পাথরের কয়েকটা ঘর দেখাল । নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর ঘর । শেষমেশ লেকের ধারে নিয়ে গেল আমাদের জোরাজুরিতে । লেকের খুব কাছে পাহাড়ের ঢালে বেশ কয়েকটা তাঁবু পড়েছে । খুব সাধারণ ছোট তাঁবু । একটা তাঁবুতে জনা চারেক লোক চাপাচাপি করে থাকতে পারে । উচ্চতা কম বলে নীচু হয়ে ঢুকতে হয় । বসে থাকা গেলেও দাঁড়ানো যাবে না । বিছানাপত্র আছে । খাট নেই আগের দেখা তাঁবুগুলোর মতো । একটু জীর্ণও ।
“আমাদের সকলের কাছে স্লিপিং ব্যাগ আছে । একটা তো রাতের ব্যাপার । কাল সকালেই ফিরে যাব আবার । থাকা যাবে না ?” সৌরভদা জিজ্ঞেস করল আমাদের ।
সৌম্যশুভ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ করল দেখে আমিও সম্মতি দিলাম, “হ্যাঁ, হয়ে যাবে ।”
এবার গাড়ির কাছে ফিরে এসে অলিভিয়াদের পাঠাল সৌরভদা । ওরা গাড়িতেই বসে ছিল । নামেনি ।
সৌরভদা বলল, “দাম্ভিক আমেরিকানটার পছন্দ হলে হয় ! যা নাক উঁচু দেখছি ।”
অবাক কাণ্ড ! ফিরে এসে আমেরিকান মেয়েটাই বলল, “ওয়েল, উই ক্যান স্টে হিয়ার ।”
আগের তাঁবুগুলোর তুলনায় এগুলোর ভাড়া অত্যন্ত কম । কম দামে পুষ্টিকর খাবারের মতো । এত কাছে প্যাং গং লেক ! খাবারের দোকানটাও তাঁবুর মালিকের । সপরিবারে আছে এখানে । একটা বাচ্চা আছে । বাচ্চাটা দোকানের সামনে নুড়ি কুড়াচ্ছে দেখলাম ।
পাশাপাশি দুটো তাঁবু নিলাম আমরা । তাঁবুতে ঢোকার মুখে পেছনে ফিরে অলিভিয়া হাত নাড়ল । রুবি আগেই ঢুকে গেছে তাঁবুতে । সে আছে তার মতোই ।
সৌরভদা তাঁবুতে ঢোকার আগে বলল, “মেয়েটা একটু সময়ের জন্য হলেও খোলস ছেড়ে বেরিয়েছিল ভেবেই ভালো লাগছে । ওর পছন্দ না হলে যে কী করতাম ? বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের তো আর একা ছেড়ে দেওয়া যায় না ।”
তাঁবুর সামনে থেকেই দেখতে পাচ্ছি প্যাং গং সো’কে । সরোবরের রঙ এখন তুঁতে নীল । সিগাল উড়ছে লেকের উপর দিয়ে । সৌরভদা তাঁবুর ভেতর থেকে বলল, “বেশি দেরি করা ঠিক হবে না কিন্তু । এক্ষুনি বেরব ।” আমার পেছনে পেছনে সৌম্যশুভ্রও ঢুকে পড়ল তাঁবুতে ।
কাকচক্ষু লেকের স্বচ্ছজলে নানা আকারের আর নানা রঙের নুড়ি পাথর । কয়েকটা হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে লেকের জলে । মাথায় কালো রঙের লম্বা দাগ । সৌরভদা ছেলেকে বলল, “এগুলো পরিযায়ী হাঁস –মাইগ্র্যান্ট বার্ড । বার হেডেড গুজ বলে সম্ভবতঃ । বাংলায় বলে চক্রবাক হাঁস । সুদূর ইথিওপিয়া থেকে নাকি হাঁসগুলো উড়ে আসে এখানে । সোমোরিরি লেকেও যায় । ঘর সংসার পাতে কিছুদিনের জন্য । বাচ্চা বড় হলে আবার ফিরে যায় ।”
ছেলে মন দিয়ে শুনল । বলল, “পরে গুগুলে দেখে নেব ।”
সোনালি পর্বতের গোড়া সরোবরের জলে । নুনের দাগ দেখে মনে হল জল আরো উপরে ওঠে । লেকের জলে ছোট ছোট তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে পাহাড়ি হাওয়ায় । তরঙ্গায়িত প্যাং গং সূর্যকিরণে ঝিক্মিক্ করছে । লেকের মাঝামাঝি জলের রঙ পান্না সবুজ । আকাশে হালকা সাদা মেঘের ওড়াওড়ি শীতের দুপুরের মতো ।
রোদ পড়ে আসতেই হাওয়ার বেগ বাড়ল । বেশ লাগছে লেকের পাড় দিয়ে হাঁটতে । অলিভিয়া একটা পাথরের ওপরে বসে বই পড়ছে । কখন এসেছে জানি না । মনে হয় আমাদের আগেই এসে গেছে । অলিভিয়া আমাদের দেখে হাসল ।
আমেরিকান মেয়েটাকেও দেখতে পেলাম একটু এগিয়ে গিয়ে । জলের ধারে বসে নুড়ি কুড়াচ্ছে বোধহয় । সৌরভদা ওকে ওভাবে জলের ধারে বসে থাকতে দেখে বলল, “মেয়েটার মধ্যে একটা শিশুমন আছে, কিন্তু আমেরিকান বলেই হয়ত ভারতবর্ষের মতো গরীবের দেশে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় না ।”
উত্তরঙ্গ প্যাং গং । নুড়ি পাথর আর শক্ত নোনা মাটির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁবুর দিকে চোখ চলে গেল । তাঁবুর পেছনে পাহাড়ের মাথায় এক টুকরো কালো মেঘ । লাদাখে দেখা প্রথম কালো মেয়ের চোখে সতর্কবার্তা । এই মুহূর্তে কাউকে জানাব কি জানাব না ভাবতে ভাবতেই দেখি সৌরভদা পাথর ছুঁড়ছে হ্রদের জলে । জলের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে চলতে এক সময় ডুবে যাচ্ছে । ছোটবেলায় অনেক ছুঁড়েছি এমন । একটু চ্যাপ্টা পাথর হলে খুব ভালো হয় । আর একটু ঝুঁকে ছুঁড়তে হয় । আমরা বলতাম ‘ব্যাঙ লাফ’- । সৌরভদার সঙ্গে মেতে উঠলাম খেলায় । সৌম্যশুভ্র পারছে না । জীবনে প্রথম এমন আনন্দের স্বাদ পেল বোধহয় । চেষ্টা করছে খুব । মজার খেলাটা এখনও রপ্ত করতে পারেনি দেখে বললাম, “চ্যাপ্টা দেখে পাথর খুঁজে নাও । তারপর এভাবে ছোড় -” দেখিয়ে দিলাম ওকে ।
সোনালি পাহাড়ের কাছে জলের রঙ ময়ূরকন্ঠী নীল । লেকের জলে মেঘমল্লারের সুর । হিমেল বাতাস বইতে শুরু করেছে বেশ জোরে জোরে । দূরের পাহাড়ে কালো কালো ধোঁয়ার মত কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে মেঘ ।
“দার্জিলিঙ্গের টাইগার হিলে দেখেছি সূর্যোদয় । কেরালার কোভালামে দেখেছি সূর্যাস্তের অসাধারণ রূপ । প্যাং গং-এর সূর্যাস্ত মিস করতে চাইনা যাই হোক না কেন !” সৌরভদার গলায় দৃঢ়তা ।
লাল, কমলার ছটায় সব পাহাড়ই এখন রঙিন । আকাশটাতো হোলি খেলছে । আগুন রঙের পাহাড় আরো আগুনে হয়ে ধমকাচ্ছে । ভ্রুক্ষেপ নেই কারো । রঙের খেলায় মেতেছে প্রকৃতি আর প্রকৃতির চিত্রকর । আমরা তো শুধু মুগ্ধ দর্শক ।
সুন্দরের আড়াল থেকে উঁকি মারছে ভয়ংকর । মেঘের রণসজ্জা চলছে দ্রুততালে । সূর্যাস্তের শেষ রক্তিমাভাও শুষে নিল কালো মেঘের সেনাবাহিনী । লেকের নীল শুষে নিয়েছে দীর্ঘায়িত পাহাড়ের কালো ছায়া । পুরো আকাশটারই দখল নিয়ে ফেলেছে কালো কালো মেঘ । অলিভিয়ারা বোধহয় ফিরে গেছে । সৌরভদা বলল, “এবার ফিরতে হবে মনে হয় ।” বলতে বলতেই বিদ্যুৎ চমকালো । মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠল পাহাড় । ঝোড়ো হাওয়া উড়িয়ে নিতে চাইল তিনটে মানুষকে । সিগালগুলো তখনও উড়ছে জলের উপর দিয়ে । কতকটা এলোমেলোভাবে ।
তাঁবুর ভেতরেই রাত নামল মেঘের ডাকাডকি আর ঝোড়ো হাওয়ার হুমকির মধ্যে । ব্যাটারিতে চলা একটা বাল্ব জ্বলছিল তাঁবুর ভেতরে । মিটমিটে আলোয় থমথমে মুখে বসে থাকি দুর্যোগের আশঙ্কায় ।
প্রকৃতি শান্ত হল এক সময় । বাইরে বেরিয়ে দেখলাম আকাশটা তারাদের দখলে । এক ফোঁটাও বৃষ্টি না ঝরিয়ে মেঘেরা নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছে ।
“আকাশটা কত বড় দেখেছিস !” ছেলেকে বলল সৌরভদা । “ব্যাপক !” উত্তর ছেলের ।
সৌম্যশুভ্র সপ্তর্ষিমন্ডল, ধ্রুবতারা খুঁজে পেল । উচ্ছ্বসিত সে । তার মধ্যেই বিরাট একটা চিৎকার, “দেখো, দেখো, ওটা কী ?” একটা চলন্ত আলো । উত্তর আকাশের প্রান্ত ধরে ছুটে যাচ্ছে । সৌরভদা বলল, “রকেট বা স্যাটেলাইট হবে হয়তো !”
সৌম্যশুভ্র এক ধাপ এগিয়ে বলল, “ইউ এফ ও নয় তো ?”
“হতেই পারে ।” পিতার উত্তর ।
হেডলাইট জ্বালিয়ে কয়েকটা মোটর সাইকেল ছুটে গেল সামনের রাস্তা দিয়ে । মোটর সাইকেলের ভট্ ভট্ আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই গাড়ির শব্দ । গাড়িটা আমাদের কাছেই এল । আমাদেরই গাড়ি । লামা কয়েকটা পেটি নামাল গাড়ি থেকে । দোকানির কিছু নিয়ে এল বোধহয় ।
রাতের খাবার খেয়ে আবার আকাশের নীচে দাঁড়ালাম । অলিভিয়ারা খেয়ে চলে গেছে । দুটো পাশাপাশি টেবিলে বসেই খেয়েছি আমরা । অলিভিয়ার সাথে হাসি বিনিময় হলেও রুবির সঙ্গে চোখাচোখিও হয়নি । মাথা নীচু করে চুপচাপ খেয়েছে সে ।
লক্ষ কোটি নক্ষত্রের সমাবেশ হয়েছে আকাশে । একসঙ্গে এত তারা কখনও দেখিনি ।
“আমাদের ছোট শহরটা থেকে বহুবার রাতের আকাশ দেখেছি । রাতের বেলা খেলার মাঠে দাঁড়ালে বিরাট একটা আকাশ দেখতে পেতাম । কিন্তু এত বড় ! কক্ষনো দেখিনি ।” সৌরভদা আপ্লুত ।
কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া । চাঁদ ওঠেনি এখনও । মিল্কিওয়ে খুঁজে পেল সৌম্যশুভ্র । আকাশের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে আমাদের ছায়াপথ- মিল্কিওয়ে । সাদা ধোঁয়ার মতো দেখাচ্ছে আমাদের পরিচিত গ্যালাক্সিটা । বিশাল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে এই নক্ষত্রপুঞ্জ দেখতে ভালো লাগলেও ভালো লাগছে না কনকনে ঠাণ্ডাটা । উন্মুক্ত মুখে ছোবল মারছে তীক্ষ্ণ বাতাস । আঁচড় কাটছে শরীরেও ।
সৌরভদার ছেলে কোলকাতায় বসে আকাশ দেখার তেমন সুযোগ না পেলেও আকাশটা চেনে । প্রায় দুঃসাধ্য সাধন করেছে সে । কালপুরুষ, সিংহ রাশি, ছায়াপথের পর অ্যাড্রোমেডা গ্যালাক্সি দেখতে পেয়েছে সৌম্যশুভ্র । বাবাকে দেখিয়ে বলছে, “আমাদের পৃথিবী থেকে মাত্র বাইশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে । মিল্কিওয়ের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি ।”
সৌরভদা হেসে ফেলল ছেলের কথা শুনে, “মাত্র বল ! আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশি গ্যালাক্সি মাত্র বাইশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে, ভাবা যায় !”
ছেলে বিজ্ঞের মতো বলল, “বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে এই দূরত্ব কিছুই না ।”
বাবা-ছেলের মহাকাশ চর্চা চলছে । বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নানা রহস্যের অনুসন্ধানে ব্যস্ত পিতা-পুত্র । কৃষ্ণগহ্বর, উল্কাপাত, অ্যাস্টারয়েড, কসমিক রে কিছুই বাদ যাচ্ছে না । অবাক লাগছে খুব । যে ছেলেটা আকাশ ভালোবাসে, মহাকাশের এত খবর রাখে সে নাকি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে ! ব্ল্যাকহোলের মতোই মস্তবড় ধাঁধা মনে হয় আমার ।
মহাকাশ চর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়াল ঠাণ্ডা হাওয়া । একটু উষ্ণতার প্রয়োজন এখন । “সৌরভদা, আর কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখলে আমরাই দ্রষ্টব্য হয়ে যাব যে !”
আমার কথায় সৌরভদা বোধহয় এতক্ষণে ঠাণ্ডা টের পেল, “সত্যিই খুব ঠাণ্ডা ! চল বাবি, তাঁবুতে ঢুকি । জমে যাচ্ছে শরীর ।”
(ক্রমশঃ)

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post