Sankars Creation

বৈশাখ মাস শেষ হতে চলল তবু কালবৈশাখীর দেখা নেই । এ বছরে একটাও কালবৈশাখী হয়নি । অফিস থেকে ফিরে স্নান সেরে টিভির পর্দায় চোখ রেখেছিল সে । কৌশিক হত্যার নিন্দায় মুখর মানুষ । চ্যানেলে চ্যানেলে বিদ্বজ্জনদের নিয়ে আলোকিত জমজমাট আসর । মোষ চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে সেই তরুণ ছাত্রটিকে তারই মায়ের সম্মুখে । কী ভয়ঙ্কর ! যারা মারল তাদের কি একবারও নিজেদের মায়ের মুখটা মনে পড়ল না !
অসহায় মা সন্তানকে বাঁচাতে ওদের পায়ে পড়ে আছাড়ি বিছাড়ি করে কেঁদেছিলেন । ওরা মায়ের চুলের মুঠি ধরে হিড় হিড় করে টেনে সরিয়ে দিয়েছিল । কেউ কেউ মাকেও ছাড়েনি । তাঁকেও মেরেছিল নির্মমভাবে । এভাবেই মায়ের কান্নার মুল্য চুকিয়েছে ওরা। এসব অবশ্য সকালেই সংবাদ পত্রের পাতায় পড়েছে সে । মনটা দিনভর মেঘে ঢাকা আকাশের মতোই ছিল তাই । সারাদিন কাজের চাপে ভুলতে পেরেছিল কিছুটা । এখন আবার আতঙ্কে শিউরে উঠল সে । মানুষ কেন যে কোন প্রাণীকেই এভাবে পিটিয়ে মারা অন্যায় । সমাজটা যে কোন পথে চলছে কে জানে ! মানুষের প্রাণের মুল্য নেই, মায়ের সম্মান নেই । মনুষ্যত্বের মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে গেছে সন্ত্রাসের দাপাদাপিতে । তমোগুণের প্রভাবে আচ্ছন্ন মানুষ শুধুই চোখ রাঙায় এখন ।
বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে তার । একটু খোলা হাওয়ার জন্য ব্যাকুল হল সে । চারদিকেই ফ্ল্যাটবাড়ি । নীচের তলায় হাওয়া ঢোকে না তেমন । চারতলা বাড়ির ছাদে উঠতে খুব কষ্ট হয় । হাঁপ ধরে । লিফট নেই । অনেকদিন ছাদে ওঠা হয়নি । আকাশও দেখা হয়নি । রাতের আকাশ দেখতে একসময় খুব ভালবাসত সে । অসংখ্য তারার মধ্যে খুঁজত কালপুরুষকে । খুঁজত ছায়াপথ । এখন ওসব আর দেখা যায়না জানে সে । আকাশ এখন ধোঁয়াশায় ঢাকা থাকে তাই তারারাও ম্রিয়মাণ । ভাবতে ভাবতেই ঝড় উঠল। জোরাল নয়, তবু ঝড় তো । বর্ণালী ছুটে এল , “জানলা বন্ধ কর । এখনই ধুলোয় ভরে যাবে ঘর-” বলতে বলতে সে নিজেই বন্ধ করতে লাগল ।
মানুষটা কথা বলে না । বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় সে । বর্ণালী’র স্থলপদ্ম গাছটায় ঝাপটা মারছে ঝড় । নুয়ে পড়ছে গাছটা । ডালপালাগুলো ছটফট্ করছে হাওয়ার সাথে । তুলসী’র চারাগুলো মা তুলসী’র সঙ্গে দুলছে । অনেক কষ্টে তুলসী গাছটাকে বাঁচিয়েছে বর্ণালী । কয়েকবছর ধরেই তুলসী গাছ লাগাচ্ছে,বাঁচে না একটাও । গতবছর এই গাছটা কি ভাবে যেন বেঁচে গেছিল হঠাৎ । এবার অনেক চারা জন্মেছে । প্রতিদিন সকাল বিকেল জল দেয় বর্ণালী । মায়ের মমতায় লকলক্ করে বেড়ে উঠছে গাছগুলো ।
আকাশের প্রান্তে আলোর ঝলকানির পরই বিরাট শব্দ করে বাজ পড়ল কোথাও । তারপরই শুরু হল ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝলকানি আর শব্দের ধমকানি । ভুটানকে বলা হয় ল্যান্ড অফ থাণ্ডার । কোলকাতা বোধহয় ভুটানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে ইতিমধ্যে ।
বৃষ্টি নামল অবশেষে । ঝমাঝম নয়, ফোঁটা ফোঁটায় । তাতেই গন্ধ উঠছে মাটির । সোঁদা মাটির গন্ধ । মফস্বল শহরের ছেলে সে । ভালো লাগে গন্ধটা । গাঁয়ের গন্ধমাখা শরীর নিয়ে কোলকাতায় এসেছিল বত্রিশ বছর আগে । এখন শরীরে শহুরে গন্ধ, তবু কোথায় যেন ঘাপটি মেরে বসে আছে গ্রাম্য সহজ, নরম, ভেজা ভেজা একটা মন যা ওকে ভাবায় সেদিনের মতো করে ।
বুক ভরে যাচ্ছে সোঁদা মাটির গন্ধে । গন্ধটা এখনও ধুলোটে, তবু ভালো লাগছে । পায়ের তলায় ধুলো, গায়েও কিচকিচ করছে ধুলো। এরই মধ্যে জোলো একটা হাওয়ার ধাক্কায় পিছিয়ে এল সে ।

-আহ্ ! কতদিন পর এল বৃষ্টিটা । বিছানা ধুলোয় ভরে গেছে একেবারে । যাক, শোওয়ার আগে ঝেড়ে নেব । বর্ণালী জানলার একটা পাল্লা একটু ফাঁক করে দেখে বৃষ্টির ছাঁট আসছে কিনা । ওখান থেকেই দেখল মানুষটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল বারান্দায় ।
আশি স্কোয়ার ফিটের একটুকরো মাটি সবুজে ভরে গেছে বর্ণালীর পরিচর্যায় । জল ঝরছে তুলসীতলায় । বর্ণালী স্বামীর পিঠের উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে, “কি সুন্দর হয়েছে তুলসী গাছগুলো ! বৃষ্টি হবে জানলে আজ বিকেলে জল দিতাম না ।”
বর্ণালী‘র কথার উত্তরে কিছুই বলেনা সে । কাঁধের উপর ওর বুক চেপে বসেছে অনুভব করে সে । পুরানো দিনের বাংলা সিনেমার সাদা কালো ছবির মতো ভালো লাগা আছে, উত্তাপ নেই । বুক ঝুলে গেছে বর্ণালী’র । আর ঝুলবে নাই কেন বয়স তো কম হল না।
তবু খারাপ লাগছে না । মনে পড়ে কৈশোর আর যৌবনের দিনগুলো । সে ছিল ভালবাসার যুগ । সাহিত্যের গল্প থেকে সিনেমা তৈরি হত । কী সব প্রেমের ছবি ! কী সব নায়ক নায়িকা আর কী সব প্রেমের গান ! সবই পুরানো হয়ে গেল জীবনের মতো । ফেলে আসা দিন সবসময়ই স্মৃতি দিয়ে ঘেরা আর বর্তমান বড় কাঠিন্যে মোড়া । রস কষ্ট করে নিংড়ে বের করতে হয়। এখন সিনেমা, গল্পে থাকে রগরগে সেক্স, রেপ, ভায়লেন্স । টাকার গন্ধে মিশে থাকে রক্তের গন্ধ । তবু ভালো গল্প কি আর লেখা হয় না বা ভালো সিনেমা কি আর হয় না ? হয় । এখনও অনেক ভালো ভালো সিনেমা তৈরি হয় । জীবন এখন অনেক বেশি ঝকঝকে, বর্ণময় আর গতিশীল ।
ভবিষ্যত সবসময়ই অনিশ্চয়তায় ভরা । খুব ভয় হয় আজকাল । মানুষ অনেক বদলে গেছে । কিছু মানুষ বন্য পশুর মতো হিংস্র হয়ে উঠছে । ষড়রিপু’র তাড়নায় জ্বলছে তাদের শরীর । প্রতিষেধক নেই । মাৎস্যন্যায় চলছে যেন । অনেক মানুষ কাঁদছে , অনেক মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত । দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের মৃত্যুর মিছিল নেই, আছে সন্ত্রাস আর নৃশংসতা ।
ছেলেটা এখনও বাড়ি ফেরেনি । ঝড় বৃষ্টিতে আটকে গেছে বোধহয় । ছাতা নেয় না ছেলেটা । বর্ণালী প্রায়ই বলে, “ছাতাটা নিয়ে যা না ।” কানেই তোলে না মায়ের কথা । বাবার কথাই কত শোনে ! আজকালকার ছেলেমেয়েরা সব এমনই । স্বাধীনচেতা নয় স্বাধীন ।
ছেলেটা না ফেরা পর্যন্ত দুশ্চিন্তা হবেই । মানুষের মন সব সময়ই কিছু না কিছু ভাবে । কাজকর্ম, পড়াশোনা বা টিভিতে হয়ত বা কিছুক্ষণ মনকে অন্যদিকে প্রবাহিত করা যায় কিন্ত তার মধ্যেও মন ছিটকে বেরিয়ে আসে দুশ্চিন্তার পথে । এখন কাজও কিছু নেই, পড়ার মতো মানসিকতাও নেই, টিভিটাও বন্ধ । বৃষ্টি পড়লেই টাটা স্কাই নীরব হয়ে যায় । অস্থির অস্থির লাগছে কেমন । ডাক্তার যতই মানা করে থাকুক “টেনশান করবেন না” – টেনশান হবেই ।
– একটা ফোন করে দেখ না ছেলেটাকে ? টিভি চললে এসময়টা বর্ণালী টিভিতে সিরিয়াল দেখত । এখন রান্নাঘরে ।
আসতে দেরি হলে বর্ণালী নিজেও মাঝে মাঝে ফোন করে খবর নেয় ছেলের ।
– করেছিলাম । পাইনি । নেটওয়ার্কের প্রবলেম ।
মোবাইলটা এখনও হাতেই আছে তার । আর একবার চেষ্টা করে । পায় না ।
জবা গাছটার শুকনো শরীর বেয়ে জল নামছে । একসময় গাছটায় অনেক ফুল হত । এখন আর ফুল ফোটে না গাছটাতে । বর্ণালী নতুন একটা চারা বসিয়েছে জবাগাছের । বড় হচ্ছে গাছটা । সামনের বছরই বোধহয় ফুল ফুটবে গাছটায় । অনেকদিন পর জবাদিকে মনে পড়ল । নার্সের সাদা ইউনিফর্মে কি দারুণ দেখাত জবাদিকে !
জবাদি’র মিষ্টি চেহারার সঙ্গে মানানসই ছিল মিষ্টি হাসি আর মিষ্টি ব্যবহার । যেন সব ভালো নিয়েই জন্মেছিল জবাদি । সবাই প্রশংসা করত জবাদির ।
জবাদির কথা মনে হতেই স্মৃতিতাড়িত হয়ে গেল সে ।
ক’দিন আগে পঁচিশে বৈশাখ গেছে । সেই প্রথম কোন অনুষ্ঠান হয়নি স্কুলে । এমনকি পাড়া বা রবীন্দ্রভবনেও কোন রবীন্দ্র জয়ন্তী’র অনুষ্ঠান হয়নি । সে খুব ভালো আবৃতি করত । স্কুল ছাড়াও শহরের সব অনুষ্ঠানেই ডাক আসত ওর । কত কবিতা মুখস্থ ছিল ।
শহরে থমথমে ভাব । মূর্তি ভাঙা, স্কুল পোড়ানো, বোমাবাজি চলছে । বুর্জোয়া শিক্ষাবাবস্থার পরিবর্তন চাই । সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার ডাক ।
শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবির সঙ্গে স্কুল পোড়ানো কিংবা মনীষীদের মূর্তি ভাঙ্গার কি সম্পর্ক বুঝত না সে । “চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান” – কেন সেটাও মাথায় ঢুকত না । স্কুলের কয়েকজন ছাত্রকে রীতিমতো ভয় পেত ওরা বন্ধুরা । শুনেছিল ওদের কাছে অস্ত্র থাকে । “বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস”- সেটা মনে মনে স্বীকার করতে শিখেছিল । চিন্ময়’দার কাছেও নাকি রিভলবার ছিল একটা ।
এক নাম হলেও ওর সঙ্গে চিন্ময়দার কোন মিলই ছিল না । বন্ধুরা বলত, “তুই সাবধানে থাকিস চিন্ময় । নামের জন্য তুই না বিপদে পড়ে যাস ।”
চিন্ময়দা শুধু পাড়ার দাদা নয় শহরেরও দাদা । রাজনৈতিক দাদা । লোকে বলত, বিধায়কের চামচে । পুলিশের সঙ্গেও নাকি দোস্তি ছিল । সত্তরের দশককে যারা মুক্তির দশকে পরিণত চেয়েছিল তাদের গতিবিধির খবর পুলিশের কাছে সাপ্লাই করত সে বলে শোনা যেত ।
লেখাপড়া তেমন ছিল না চিন্ময়দার । মস্তানি করেই চলত তার । বাড়ির অবস্থা ভালই ছিল । হঠাৎ একদিন শোনা গেল জবাদিকে বিয়ে করেছে । খুব দুঃখ পেয়েছিল চিন্ময় । জবাদির উপর খুব রাগও হয়েছিল চিন্ময়দাকে বিয়ে করার জন্য । জবাদির সঙ্গে কথা বলেনি আর । বিয়ের পরেই জবাদি ট্র্যান্সফার হয়ে যায় শিলিগুড়িতে । শ্বশুরবাড়িতে খুব একটা আসত না জবাদি । চিন্ময়দা রাতের দিকে শিলিগুড়িতে চলে যেত ।
খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল সকালেই । মা বলেছিল, “আহা রে ! যখন সিনেমা দেখে ফিরছিলাম আমরা ও বোধহয় বাসস্ট্যাণ্ডেই বসেছিল গাড়ির জন্যে । বৃষ্টির জন্য রাস্তাঘাট তো ফাঁকাই ছিল তখন । সেই সুযোগটাই নিয়েছিল খুনেগুলো ।”
অমিত ডাকতে এসেছিল চিন্ময়কে । দু’জনে গিয়েছিল দেখতে । ততক্ষণে পুরো শহরটাই ভেঙে পড়েছিল । বাসস্ট্যাণ্ডের প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে তিল ধারণের জায়গা নেই যেন । শহরের বুকে সেই প্রথম খুন । অনেক কষ্টে ওরা ঘটনাস্থলে যেতে পেরেছিল। চিন্ময়দার ডেডবডি দেখতে পায়নি, পুলিশ ডেডবডি তুলে নিয়ে গিয়েছিল । শুধু চাপচাপ রক্ত পড়েছিল পিচঢাকা জায়গাটায় । পাঁঠার মাংসের দোকানে এমনটা দেখেছে চিন্ময় । মানুষের রক্তও পাঁঠার মাংসের মতো জমে যায় ! বমি পাচ্ছিল ওর । রক্তের স্রোত গড়িয়ে গেছে ঢালের দিকে । লোকে বলাবলি করছিল, কয়েকটা চিচিঙ্গার টুকরো নাকি পাওয়া গেছে । তদন্তের স্বার্থে পুলিশ ওগুলোও তুলে নিয়ে গেছে ।
তবে কি চিচিঙ্গা দিয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেছিল চিন্ময়দা ! রিভলবারটা ছিল না সঙ্গে ? তখন মনে হয়েছিল চিন্ময়ের । সত্যিটা কী জানা যায়নি । নানারকম গল্প ছড়িয়েছিল খুন নিয়ে । খুনি এক না একাধিক সেটাও জানা যায়নি । জবাদির মুখটা ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে । একটা ছেলেও হয়েছিল ওদের । শুনেছে একবছরও হয়নি । ওকে দেখেনি চিন্ময়, তবে ওর জন্যেও কষ্ট হয়েছিল । ছেলেটার শৈশব রক্তে ভেসে গেল ।
খুনের কিনারা হয়নি । শক্তিশালী কোন মিডিয়া ছিল না তখন । মিডিয়া বলতে ছিল একমাত্র কাগজ । এখন শক্তিশালী মিডিয়া আছে। কোন ঘটনা এড়িয়ে যায় না । কিন্তু আজও —- “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে” ।
পাঁঠার মাংসের দোকানে যাওয়া তো দূরে থাক, পাঁঠার মাংসই খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল চিন্ময় ।

বৃষ্টিটা থেমে গেছে । টিভিটা আবার চলতে শুরু করেছে । বর্ণালী রান্নাঘর থেকে ঘড়ি দেখল । দশটা বাজে প্রায় । যাতে রান্নাঘর থেকে ঘড়ি দেখতে পায় সেজন্যেই চিন্ময় রান্নাঘরের সোজাসুজি বড় ঘড়িটা লাগিয়েছিল বছর কয়েক আগে ।
– আবার একবার ফোন করে দেখ না । উৎকণ্ঠিত বর্ণালী এগিয়ে আসে । মানুষটার উত্তর নেই । বৃষ্টি হলেই মানুষটা ওখানে গিয়ে বসে । বৃষ্টি খুব ভালবাসে যে ।
-কি গো ফোনটা কর না । আলতো করে ধাক্কা দেয় বর্ণালী । শরীরটা একদিকে হেলে পড়ে চিন্ময়ের । তারপার সশব্দে চেয়ার সমেত দেহটা আছড়ে পড়ে মেঝেতে ।

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post