কথা রেখেছিল
খুব জোরে ছুটছিল ট্রেনটা। অনেক পরপর একটা স্টেশন আসছিলো। দেখতে না দেখতেই সেটা পেরিয়ে যাচ্ছিলো। বহুদিন বাদে ট্রেনে চড়লাম। শেষ কবে ট্রেনে চড়েছি মনে পড়ল না। যদিও মাসের মধ্যে অন্তত দু থেকে তিনবার আমাকে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে তো বটেই বাইরেও ছুটেতে হয়।অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ছে আজ। নীলু ,সমু আর আমার ছেলেবেলার দিন গুলোর কথা। নীলু – নীলাঞ্জন পড়াশোনার ধরে কাছে থাকতো না- বরাবর কোনোরকমে পাস।সমু-সন্ময় মোটামুটি – কিন্তু ফুটবলই তার সব কিছু। আমি দীপায়ন বরাবর প্রথম। তিনজন তিন রকমের হলেও কি করে যেন গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। আমার বাবা যখন নীলুদের আধা গ্রাম আধা শহরে ট্রান্সফার হয়ে এলেন আর আমাকে আশুতোষ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেন – প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব। স্কুল জীবন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার ট্রান্সফার। নীলুদের গ্রামে আর কখন আমার আসা হয় নি।হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো। দেখলাম সমু।
-হ্যাল্লো বল সমু। ……হ্যাঁ রে। না না লেট্ বেশি না। ……ও আচ্ছা।……. ঠিক পৌঁছে যাব। রাখছি।
আইডিয়াটা নীলুর। আমি যেদিন ওদের ওখান থেকে বাড়ির সবাই মিলে বরাবরের মতো চলে আসছি, তিনজনেরই খুব মন খারাপ। সমুটা বাচ্ছা ছেলের মতো কাঁদছিলো। যতই বলি আবার দেখা হবে …. দেখিস ঠিক আসবো। কিন্তু মনে মনে জানি নাও হতে পারে কারণ আমরা পশ্চিমবাংলা ছেড়েই চলে যাচ্ছি। অতদূর থেকে আসা সম্ভব হবে না। বাবা-মা ছাড়বেই না।ছোটবেলা থেকে এরকম আমার কত বন্ধুই যে হারিয়ে গেছে বাবার এই চাকরির জন্য! সমু আর নীলু আমাদের সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত এলো। ট্রেনে ওঠার আগে নীলুর মাথার ভাবনাটা আমাদের দুজনকে চলান করলো। সেই ছেলে বয়সে এটা দারুন বলে মনে হলেও এটা যে বাস্তবে ঘটা অনিশ্চিত সেটা তখন মনে হয় নি।
রাতের খাবার এসে গেছে। টয়লেটে হাত ধুতে গিয়ে মনে পড়ল আমাদের তিনজনের পাউরুটি আর আলুরদমের পিকনিক করা।নচিকেতার একটা গানে আছে না ! ….ফেলে আসা ছেলে বেলা। ট্রেনের দুলুনিটা বেশ লাগছে। চোখটা ভারী হয়ে আসছে ক্রমশঃ
সকালে স্টেশনে নেমে অবাক হয়ে দেখলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ড হয়ে গেছে। আগে তো ভ্যান রিকশা চলত ! সমুকে বলেছিলাম স্টেশনেই আসতে। ও বললো ট্রেনে আসবে না হরিপুর এর দিক দিয়ে আসবে। তাই পঞ্চ সেতুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে। স্টেশনে দিলু কাকুর চায়ের দোকানটা একইরকম আছে। দিলু কাকু নেই একটা উনিশ কুড়ি বছরের ছেলে চা বিক্রি করছে। একটু চা খেয়ে হাটতে শুরু করলাম। পঞ্চ সেতু দশ মিনিটও লাগে না। কতদিন এরকম হাঁটি নি! পঞ্চ সেতু পৌঁছে সমু কে খুঁজলাম। এদিকটা এখনো বেশি ভিড়ভাট্টা হয় নি। ছোট্ট খালের ওপর ছোট্ট সেতু – তা পঞ্চাননের নাম নামকরণ। পাশেই মন্দির। পঞ্চানন এখানকার জাগ্রত দেবতা। শ্রাবন মাসে অনেকে জল ঢালতে আসে। সমুকে ফোন করতে বললো আর দশ মিনিট লাগবে ওর পৌঁছতে। খালটা ছোট কিন্তু গভীর। আমি সাঁতার জানি না একবার বর্ষায় তিনজনে নাইতে এসে আমি প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলাম। সমু আর নীলু আমাকে বাঁচায়।প্রায় মিনিট কুড়ি পড়ে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে বাস আসতে তার থেকে নামলো সমু। যদি বছর তিনেক আগে ও আমার ওখানে না যেত তো এতো বছরের ব্যবধানে চেনা একটু অসুবিধা হতো। যদিও মিডিয়াতে ওকে দেখা যায় হয়তো। কিন্তু আমার সময় কোথায় ! তাছাড়া ফুটবলে আমার কোন আগ্রহ নেই।
– কি রে ? গালাগাল দিচ্ছিলি তো ? আরে এখানকার বাসের কোনো টাইম নেই। চললেই হলো। নীলু আসে নি ?এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছিলো সমু।
-প্রথম কথা গালাগালি দিই নি বরং চা খেতে খেতে চারদিক দেখতে বেশ ভালোই লাগছিলো। আর নীলু এসেছে বলে মনে হয় না। কারণ এতদিন বাদে যদিও তাকে দেখে চিনতে আমার অসুবিধে হতে পারে তবুও যদি খুব কিছু পরিবর্তন না হয় তবে আশেপাশে যে সব লোক আছে তাদের একজনকেও আমার নীলু বলে মনে হয় না।
আশ্চর্য ! আমাকে গত মাসে বললো- ও এখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে !
-তোর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল ?
-না না , ও তো আমার বাড়িতে গিয়েছিল। আমার টিম সেমি ফাইনালে হেরে গেলো বলে আমি দুদিন কোচিং করতে যাই নি। মন ও ভালো ছিল না। একটু হালকা ড্রিঙ্কস নিচ্ছিলাম সন্ধেবেলায়। হঠাৎ বেল বাজলো। আমার কাজের লোকটা বললো একজন দেখা করতে এসেছেন । আমি ভাবলুম প্রেসের লোক জ্বালাতে এসেছে। বলে দিলাম দেখা হবে না। সে ঘুরে এসে আবার জানালো নীলুর কথা। বছর খানেক আগে এসেছিলো। তারপর গত মাসে । অবশ্য কি করছে, কোথায় কাজ করছে কিছুই জানায় নি। খুব যে বেশি যোগাযোগ ছিল তা নয়। আসলে আমি টীম নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকি যে সত্যি বলতে কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে পারি না। তবে কি জানিস নীলুর মধ্যে প্রাণ আছে। গত বছর এসে একবেলা কাটিয়ে গেলো। নিজের কথা কিছুই বললো না। তবে আমার মনে হয় ও সেরকম কিছু সুবিধা করতে পারে নি। তোর নাম , আমার নাম কাগজে বেরোয় নীলুর কথা তো কিছু প্রেসে আসে না। তবু আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম জানিস। ও বললো তেমন কিছু না। পাগল একটা। তা সে দিন যে এলো খুব অন্যমনস্ক। বসলো না। শুধু বললো তোকে খবর দিয়েছি কি না আর তুই আসছিস কি না।
-বছর কয়েক আগে ও আমার সঙ্গেও দেখা করতে একবার আমার কাছে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি তখন দেশে ছিলাম না। তারপর ও আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করে নি।
-আপনারা কি নিলুবাবুর বন্ধু ! একটা খাটো ধুতি পরা , গায়ে ফতুয়া লোক আমাদের সামনে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ। আমরা তো ওর জন্যই অপেক্ষা করছি। আমরা দু জনেই প্রায় এক সঙ্গে বলে উঠি।
– চলুন। বলে লোকটা এগিয়ে গেলো। আমরা তার পিছনে।
– সত্যি নীলুটা মনে রেখেছে কথাটা। আমি বলে উঠলাম।
আমরা হাটতেই লাগলাম।
-তোমার নাম কি ? সমু লোকটিকে জিজ্ঞাসা করে
-আজ্ঞে বৃন্দাবন। নীলু এলো না কেন ?
লোকটি এক ঘোমটা পড়া মহিলাকে ডেকে বলে -“সরস্বতী, বাবুদের হাসপাতলে নিয়ে যা আমি ইস্কুলে আছি।”
-হাসপাতালে কেন ?
-আজ্ঞে আমাদের এই আধা শহরের আশেপাশে তো কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। সেই সদরে যেতে হতো। একটা হাসপাতাল হয়েছে।নীলু বাবু করেছেন।
হাসপাতালে ঘুরে আমরা স্কুলে গেলাম। বৃন্দাবন ঘুরিয়ে দেখালো। বোর্ডিং স্কুল। গরিব ছেলেরা বিনা খরচে থাকে খায়। বৃন্দাবন বলে নীলু বাবু করেছেন।
বৃন্দাবন আমাদের এরপর নিয়ে যায় অন্য একদিকে একটা ছোট্ট দুতলা বাড়ি -লাইব্রেরী নিলুবাবু করেছেন।
– কিন্তু বৃন্দাবন তুমি এসব দেখাচ্ছ কেন সে কোথায়?
– আজ্ঞে তিনি তো নাই।
-তার মানে ? আমরা দুজনে চেঁচিয়ে উঠি।
-আজ্ঞে তিনি বলে গেছেন যে আপনি যেদিন এখন থেকে বরাবরের মতো চলে যান, তখন নাকি তিনি আপনাদের বলে ছিলেন যে আপনাদের তিনজনের বয়স পঞ্চাশ পুরো হবে তখন এইখানেতেই আপনারা একত্রিত হবেন। নিজেদের কথা , ঘর সংসার , নিজেদের কাজের কথা একজন আর একজন কে জানাবেন। দরকারে একজন আরেকজনকে সাহায্য করবেন। সেটা আমাকে তিনি বলে গেছেন। আমি জানি আপনারা আসবেন। আমি তাই আপনাদের সব দেখাচ্ছি।বাবা মারা যাওয়ার পর উনি ওনার সব কিছু বিক্রি বাটা করে, লোকের কাছে চেয়ে চিনতে এইসব গড়ে তুলে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য। উনি মানুষ না বাবু দেবতা।
সমু ধপ করে লাইব্রেরি ঘরের চেয়ারটাতে বসে পড়লো। তাহলে গত মাসে যে এসেছিলো আমার কাছে ………
-আজ্ঞে ওই দিনই তাকে মুম্বাই ক্যান্সার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আপনার সঙ্গে তিনি দেখা করেন ? হয়তো যাবার আগে ……….. আর ফেরেন নাই।
সত্যি , নীলুদের খবর প্রেসে আসে না।
–
View Comments
নীল যেখানে দেদার ছড়িয়ে
খুব জোরে ছুটছিল ট্রেনটা। অনেক পরপর একটা স্টেশন আসছিলো। দেখতে না দেখতেই সেটা পেরিয়ে...