অপরাধী
অবশেষে ছেলেটাকে ধরা গেলো। ভেতরে ভেতরে জ্বলছিলাম ঘটনা টা ঘটার পর থেকেই।যেটা কিনা ঘটেছিলো আমাদের থানার এলাকাতেই। নিজে একটা মেয়ের বাবা বলেই বোধহয় রেপ কেস – বিশেষত অল্প বয়সি মেয়েদের রেপ হলেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে যায়।
ছেলেটা কোথায় আছে জেনেও ধরতে যেতে পারি নি। ওপরওলার নির্দেশ ছিল পারমিশন না আসা পর্যন্ত পাশ কাটাতে। ছেলেটার কোন এক আত্মীয় হাই প্রোফাইল লোক। একেবারে ওপরতলায় চলাফেরা। আমি কে ! সামান্য মাইনের পুলিশ। আসলে নেতাদের আন্ডারে কর্মচারী বলাই ভালো। কত সিনেমায় দেখায় পুলিশ আর নেতারা হাত মিলিয়ে কেমন কুকর্ম করে। সেটা যে কতটা সত্যি তা আমরা ছাড়া কেউই বুঝবে না। এতো কিছু দেখেও লোকে খ্যাপে না কেন বলুন তো ? আসলে আমাদের একটা international দল থাকে -পি.পি.পি.-পুলিশ,পলিটিশিয়ান ,পার্টি। সব দেশে ,সব রাজ্যে এটা থাকে।পৃথিবীর কোনো মানুষের মানে মুক্তি নেই। মুক্তি ছিল না, হবেও না। দু চারটে লোক দেখানো শাস্তি সব দেশেই হয়। শুধু যখন অনেক পাবলিক একসাথে ক্ষেপে কোনো কিছু ঘটায় তখন কিছু নাড়া চাড়া পরে। নেতা পাল্টায় ,দল পাল্টায়। যাঁরা একদম নতুন আসে তাঁদের কিভাবে আস্তে আস্তে সিস্টেমে মানে পি.পি.পি.তে ফিট করে দিতে হয় তা আমরা ভালোই জানি।
এই কেস টাও সেরকমই। চারদিক থেকে এতো শোরগোল হলো যে শেষ পর্যন্ত পার্টি কে রক্ষা করতেই পলিটিশিয়ানরাই পুলিশ পাঠাতে বাধ্য হলো. সেই পি পি পি। ওপরতলার নির্দেশ ছিল ছেলেটার গায়ে যেন হাত না পড়ে। যেহেতু ছেলেটাকে একটা ফাঁকা বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলো সেই সুযোগে ছেলেটাকে সপাটে একটা লাঠি,শুধু একটি লাঠি মারতে পেরেছিলাম। পরে বলে দিলেই হবে যে ছেলেটা আমার হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে আমাকে মারতে এসেছিলো তাই……. .
ছেলেটাকে দেখে গুন্ডা বা মস্তান না, রোমিও মনে হলো. বড়লোকের ছেলে। আতুপুতু মার্ক।আমাদের এসব দেখে অভ্যেস হয়ে গেছে।কিন্তু আনপড় লোকে ভাবতেও পারবে না যে এই ছেলেটাই নিজের কলেজের একই ক্লাসের মেয়ে বন্ধু কে ক্লোড ড্রিঙ্কস এর মধ্যে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রেপ করেছে।একটই ভুল করেছিল -বোধহয় বেশি মদ খেয়েছিলো তার ফলে রেপ এর পর পালিয়ে না গিয়ে পাশেই শুয়ে ছিল। মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে চিৎকার করায় লোকেরা এসে ধরে ফেলে। থানায় খবর এলে আমাকে পাঠানো হলো arrest করতে। কিন্তু পৌঁছনোর আগেই ফোনে নির্দেশ এলো পালানোর সুযোগ করে দিতে। প্ল্যান মতো পালিয়ে যায়। আমিই চাপে পড়লাম। সেদিন রাতে বাড়িতে ঢোকার সময় মনে হলো মুখে চাপা দিয়ে ঢুকি। অন্তত নিজের মেয়ের চোখের দিকে তো দৃষ্টি পরবে না। আমার মেয়ে তো একই কলেজে পড়ে। ও ঠিকই ধরতে পেরেছে আমরা ওকে পালতে দিয়েছি। হটাৎ মনে হলো আমি থানায় পোস্টেড্ আছি বলেই বোধহয় আমার মেয়েকে টার্গেট করে নি। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো নাকি !
ছেলেটাকে কোর্টে তোলার আগে কেস রেডি করতে করতে জিজ্ঞাসা করলাম এরকম কাজ সে করলো কেন? ছেলেটা একটু ত্যাড়া আছে। বড়োলোকের ছেলে। ওর বাবার সাদা কালো অনেক রকমের ব্যবসা আছে। ও জানে ওদের অনেক কর্মচারি আমার থেকে বেশি মাইনে পায়। শালাকে তো মারধর করা যাবে না। অবশ্য আমরা অনেক রকম কায়দা জানি। আমার ওপর বিশ্বাস তৈরী করতে একটু সময় দিতে হলো। একসময় ছেলেটা ভেঙে পড়লো। শেষ পর্যন্ত আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলো।
– এরকমটা করলে কেন?
-শুধু চার্ম আর চ্যালেঞ্জের জন্য।
-তার মানে !
-আসলে কি জানেন শুধু আমি না , আমার যে সব বন্ধু অতি সাধার ঘরের তারাও দেখবেন চাইলেই প্রায় সব কিছু পেয়ে যায়। আমার একটা বন্ধু-আসলে চামচা ওর ও একটা ভালো বাইক আছে। আমি জানি ওদের এমন অবস্থা না যে ওই বাইক টা কিনতে পারে। ওর বাবা ব্যাংকে গিয়েছিলো লোন এ কিনবে বলে। কিন্তু পায় নি কারণ নিয়মে হয় না, হবে না। ওর মা কে সুইসাইডের ভয় দেখিয়ে বাইক টা আদায় করেছে। আসলে বাজারে রোজ অনেক রকম জিনিস আসে ,হাতছানি দিয়ে ডাকে আমাদের। ওগুলো আমাদের পেতেই হবে। আর বাবা মায়েরা সেগুলো দিয়েও দেয়। না দিলে ব্ল্যাকমেল করি, সেন্টিমেন্ট এর। সেক্স টাও এখন পাওয়া খুব সহজ। আমাদের গার্ল ফ্রেন্ড না থাকলে স্টেটাস থাকে না। আর সেটা হামেশাই ফিজিক্যাল হয়।
আসলে একটা চামচা আমাকে এমন বার খাওয়ালো যে মালের ঝোঁকে করে ফেলেছি। একবার এই ঝামেলা থেকে বেরোই ড্যাডি কে বলে ওর হাল কেলো করে দেব। একটানা কথা বলে ছেলেটা হাঁফাচ্ছিলো
-তোমাদের বাবা মায়েরা কি জানে তোমরা বাইরে কি করে থাকো?
-বোঝে না কি আর সবই বোঝে। আসলে এখন বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদের বাবা-মা দুজনে চাকরি করে। সারাদিন খুব ছোট থেকেই একা থাকতে হয় আমাদের। যে সব মায়েরা চাকরি করে না তারা হয়তো কলেজ ইউনিভার্সিটি পাস করা ,কিন্তু তারাও নিজস্ব জগতেই বাস করে।শুধু খবরদারি করে। মন খুলে আমরা কেউ কথা বলতে পারি না। তাছাড়া ভাই-বোন তো নেই যে কারোর সঙ্গে শেয়ার করবে। তাই ছোট থেকেই বন্ধু ভরসা। কিন্তু আসলে কেউ বন্ধু না। আজ একটা গ্রুপ-কাল একটা গ্রুপ, যেখানে যতদিন ভালো লাগে আর কি।
ক্রমশঃ অবাক হচ্ছি। ভালো চিন্তা করার -বলার ক্ষমতা আছে তো !
-তোমরা তো খুব পয়সাওলা।তোমার মা তো চাকরি করে না, তাছাড়া তোমার তো নিজের বোন ও আছে তবুও তুমি এমন কাজ করলে কি করে ?
-আমাদের জগৎ আরো ভয়ঙ্কর , আমরা কেউ কারোর না। খাবার টেবিল এ সবসময়ে একসাথে বসা হয় না। যে যার মতো কাটাই। আমার বোন জামা কাপড়ের মতো বয় ফ্রেন্ড পাল্টায়। আচ্ছা বলুন তো বাবা-মায়েরা কি শুধু ছেলেমেয়েদের পেছনে খিটখিট করবে আর চাইবে তাদের ছেলেমেয়েরা অমর্ত সেন, সচিন, হবে! আমরা কি স্ট্যাটাস সিম্বল হবো? আমাদের রকি ডগি টার মতো বা আমাদের গ্যারেজের গাড়িগুলোর মতো হবো ! হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত রেজাল্ট খুব ভালো না হলেও ভালো ছেলে ছিলাম। তারপর ড্যাডির টাকার জোরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকলাম। এখানে নেশা করার জিনিসের অভাব নেই। মেয়েদের হোস্টেলে ঢুকলেও একই ছবি দেখবেন। কোথাও কোনো কিছু আর লুকোনো নেই। জীবনের সব কিছুই খোলামেলা। সময়ের আগে থেকেই সব কিছু পেতে পেতে মনটা অসাড় হয়ে গেছে। তাই কোনো কিছুই এখন খারাপ মনে হয় না। সবচেয়ে সত্যি কথা বলবো? আমাদের বাবা-মায়েরা কেবল মাত্র বায়োলজিক্যাল পেরেন্টস। তারা আমাদের কাছ থেকে রেস্পেক্ট আদায় করতে পারে না। কারণ তারা নিজেরাই সব দিক দিয়ে নিঃস্ব। তাদের কোনো আদর্শ নেই। তারা চায় আর্থিক ভাবে সফল সন্তান। সাধারণ মাপের ছেলেমেয়েরাও যে সমাজের কোনো ভালো কিছু করতে পারে সে সব তারা চায় না। চায় ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার অথবা অন্য যে কোনো দিকে নাম করা সন্তান। কিন্তু তার জন্য যে ভিত টা গড়ে দিতে হয় সেটাই তারা জানে না। আমি চেয়েছিলাম ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে পড়তে। কিন্তু ড্যাডির স্ট্যাটাসে আটকালো। আমাকে এই কলেজে পাঠিয়ে ভাবলো আমাকেও রকি বানাবে।
একটু জল দেবেন ?
ছেলেটা হাঁফাছিলো। এখন ছেলেটার জন্য আমার মনে একটা দুঃখ বোধ ধীরে ধীরে তৈরী হচ্ছে।আমার পুলিশি অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি ও একদম মনের ভেতর থেকে কথা বলছে।
ছেলেটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। সত্যি তো আমি আমার মেয়ের জন্য কি দিতে পারছি ! মাইনের বাইরে টাকা ঘরে নিয়ে যাই সেটা ও বোঝে। এমনিতে পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ছবিটা কি -ও জানে। আমার স্ত্রী গ্রাজুয়েট। কিন্তু টি.ভি.সিরিয়াল, মল, কেনাকাটা, বন্ধুদের আর রিলেটিভ দের সাথে মোবাইল এ কথা ছাড়া কোনো ভালো কাজের সঙ্গে জড়িয়ে নেই। আমি নিজে সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রি করেছি, কিন্তু শেষ কবে বই পড়েছি বা মেয়েকে বই কিনতে-পড়তে উৎসাহ দিয়েছি মনে পড়ে না। আমার স্ত্রীর ও কলেজের সার্টিফিকেট ছাড়া পড়াশোনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। সত্যি ত’ আমি মেয়ের সামনে দাঁড়াবো কোন জোরে। কি করে বলবো তুই মানুষ হ ! আমরা কোনোদিন কি চেয়েছি আমার সন্তান তার জীবিকা যাই হোক না কেন -আসলে একটা সুন্দর মনের মানুষ হোক ?
View Comments
KEY TO SUCCESS
অবশেষে ছেলেটাকে ধরা গেলো। ভেতরে ভেতরে জ্বলছিলাম ঘটনা টা ঘটার পর থেকেই।যেটা কিনা...