নাম নিয়ে
একটু বেলা হলেই মন খারাপ হয় পাত্রবাবুর। গত ৩৪ বছর ধরেই হচ্ছে। খুব ছেলেবেলার একমাত্র বন্ধু গদাই -একসঙ্গে এখন যাদবপুরে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন, বলছিলো একটা ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে । কিন্তু পাত্র বাবু জানেন এটা কোনো মনের ডাক্তার ঠিক করতে পারবে না। কারণ গোড়ায় গলদ। অর্থাৎ ভুলটা জন্ম থেকেই। এ আর শোধরানো যাবে না। পৈতৃক সম্পত্তি বেচা যায় , নতুন কেনা যায় , প্লাষ্টিক সার্জারি করে ভগবানের দেওয়া মুখ – তাও পাল্টে ফেলা যায়, কিন্তু নাম ! ঠিক সময়ে না পাল্টালে যে কি মারাত্মক হয় !
পাত্র বাবুর ছোটবেলায়, বিশেষত পঞ্চাশ বছর আগে লোকেরা এত নাম সচেতন ছিলো না। কিন্তু বাবার ভুলে যে এতো টা কষ্ট সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে তা আগে বোঝেন নি। পাত্র বাবুর স্কুলের রমাপদ অনেক বুদ্ধিমান। একটু বড়ো হতেই বুঝে গেছিলো চিরকাল তাকে মেয়েদের নাম- “রমা” বয়ে বেড়াতে হবে। কেউই রমাপদ বলার কষ্ট স্বীকার করবে না। কায়দা করে কলেজে অফিস সর্বত্র ডাকনাম চালু করে এ যাত্রা বেঁচে গেলো। পাত্র বাবু যে কি ভুল করেছেন ! কলেজের সময় যদি এই কায়দাটা চালাতে পারতেন তবে এই কষ্ট সারাজীবন বয়ে বেরতে হতো না। যে বাবা ছেলের নামে বাঁশ দিয়েছেন তার নিজের নামটা কিন্তু সব কালেই মানান সই। এখন মনে হয় দাদু মানে ঠাকুরদা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে নাতির নামকরণের দায়িত্ত্ব কখনই নিজের ছেলের হাতে ছেড়ে দিতেন না। কারণ ১৯২০ সালে তার মেজো ছেলের নাম রেখেছিলেন পরিমল।
কলেজে ঢোকার পর প্রথম ধাক্কা টা খেলেন পাত্র বাবু। তখন সময় টা মারাত্মক। রাজেশ খান্না রুপালি পর্দায় গাইছেন -মেরে স্বপ্ন কি রানী কব আয়েগি তু , হেমামালিনী ওয়ারিশ গানের সঙ্গে নেচে নেচে সবার বুকে ঝড় তুলছেন, নন্দা গাইছেন -এ শমা শমা হ্যায় প্যার কি , আর তখন উঁকি মেরে তাকিয়ে আছেন শশী কাপুর। ঠিক এই ভয়ংকর সময়েই চোখ মেলে দেখলেন কলেজে বন্ধু বিনয়ের বোন্ শ্রীময়ী কে। বিনয় -বিনয় রায় আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। ফটফট ইংরেজি বলে, ভালো ফুটবল -ক্রিক্রেট খেলে, পড়াশোনায় ভালোর দিকে , ঝকঝকে চেহারা , খোলামেলা মনের মানুষ্ বিনয়ের অনেক কিছুর বিপরীত হওয়া স্বত্তেও দুজনে জমে গেলো।
সিনেমা দেখে ভেলপুরি খাওয়া হচ্ছিলো। ভীষণ একটা মন মাতানো অনুভূতিতে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিলেন পাত্র বাবু। হটাৎই কেউ কাঁধে হাত দিয়ে বলে উঠলো – এই শালা হারা, তুই কি একা এসিছিস ? একটা ঠান্ডা স্রোত মাথা থেকে নামতে লাগলো। কান লাল হয়ে গেলো। চোখের ইশারায় দেখালেন শ্রীময়ীকে। মদন কোনো কথা না বলে পিঠে একটা ঠেলা মেরে চোখে একটা ইঙ্গিত করে হাঁটতে শুরু করলো। পাত্র বাবু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একটু যাওয়ার পর মদন পেছন ফিরে হাত নেড়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লো। পাত্র বাবুর চোখে “অমর প্রেম” এর ইশারা বুঝতে পেরে একদিন একাই সিনেমা দেখতে এলো। পূরবী তে চলছিলো -“গোলমাল”, প্রথম দিনের প্রথম শো। দুটো প্রেস্টিজ টিকিট অনেক কায়দা করে জোগাড় হয়েছে। ভালো জামা -প্যান্ট , হাতে জামাই বাবুর থেকে চেয়ে আনা দামি বিদেশী ঘড়ি। এর মধ্যে টেনশনে দুটো সিগারেট শেষ। ঘন ঘন এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন শ্রীময়ীকে দেখতে পাওয়ার চেষ্টায়। হটাৎ একদিকে চোখ পড়ে ভয়ে মুখ চোখ শুকিয়ে গেলো। শালা মদন ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। সর্বনাশ -কোনরকমে শ্রীময়ীকে নিয়ে ঢুকে পড়তে পারলে বাঁচা যায়। এতো পাজি মদন যে তার আসল নাম বা পদবি টাকে একটা চালু গালাগালের সাথে মিলিয়ে হামেশাই সবার সামনে ডাকে। পড়াশোনা তে যেমন তুখোড় বাদমাইসিতেও তেমনি। ভিড়ের ফাঁকে টুক করে লুকিয়ে ফেললেন নিজেকে। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে একসময় দেখলেন ট্যাক্সি থেকে নামছে শ্রীময়ী। কপাল ভালো আশেপাশে মদন নেই.। খুব স্বস্তি বোধ করলেন পাত্র বাবু। হলে ঢুকতে যাওয়ার সময় বললেন –
-শ্রীময়ী তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
-বলুন না। খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো শ্রীময়ী
– এখন না ফেরার সময়।
হাফ টাইমে বাদাম খেতে খেতে পাত্র বাবুর হাথে হাত রেখে আবারও জানতে চাইলো শ্রীময়ী।
– এখন বলুন।
– না পরে। যাবার সময়। না শুনে যেও না কিন্তু।
-পাগল, আপনি জানেন না মেয়েদের কৌতহল খুব বেশি। মিষ্টি হেসে শ্রীময়ী বললো।
সিনেমা দেখে ভেলপুরি খাওয়া হচ্ছিলো। ভীষণ একটা মন মাতানো অনুভূতিতে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিলেন পাত্র বাবু। হটাৎই কেউ কাঁধে হাত দিয়ে বলে উঠলো – এই শালা হারা, তুই কি একা এসিছিস ? একটা ঠান্ডা স্রোত মাথা থেকে নামতে লাগলো। কান লাল হয়ে গেলো। চোখের ইশারায় দেখালেন শ্রীময়ীকে। মদন কোনো কথা না বলে পিঠে একটা ঠেলা মেরে চোখে একটা ইঙ্গিত করে হাঁটতে শুরু করলো। পাত্র বাবু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একটু যাওয়ার পর মদন পেছন ফিরে হাত নেড়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লো।
– আপনার বন্ধু ? শ্রীময়ী ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো।
– হ্যাঁ – না -মানে একই কলেজে। খুব অপ্রস্তুত হয়ে কোনোরকমে ফ্যাঁস ফেসে স্বরে উত্তর দিলেন পাত্র বাবু।
-সুযান আপনাকে ছেলেটা ওরকম একটা বিচ্ছিরি নাম ডাকছিলো কেন ? আপনার পুরো নামটা কি বলুন তো ?
-পাত্র বাবু ভ্যাবাচাকা খেয়ে শুনতে পেলেন কেউ একজন তার নিজের গলার চেনা স্বরে তারই মুখ ব্যবহার করে বলে উঠলো
– হারাধন লাল পাত্র।
শ্রীময়ীর মুখটা কি লাল হয়ে গেলো ! পাশে দাঁড়ানো ছেলে মেয়ে দুটো কি হেসে উঠলো !
এক ঝটকায় শ্রীময়ী ঘুরে গিয়ে একটা খালি ট্যাক্সির দিকে হাত তুলে ডাকলো- “ট্যাক্সি”।
View Comments
একা -একা …..
একটু বেলা হলেই মন খারাপ হয় পাত্রবাবুর। গত ৩৪ বছর ধরেই হচ্ছে। খুব ছেলেবেলার একমাত্র...