নীল যেখানে দেদার ছড়িয়ে
তপন বিশ্বাস (ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাসের অষ্টম পর্ব)
।। আট ।।
গাড়িতে ওঠার সময় ওরা সামনের সিট অফার করেছিল।আসার সময় ওরা আমাদের সহযাত্রী ছিল মাত্র- এখন বন্ধু । তাছাড়া মহিলা বলে অগ্রাধিকার ওদের প্রাপ্য । আমরা-ওরার বিভেদ ঘুচে না গেলেও অতিথি হিসেবে ওদের এটুকু সম্মান দিতেই পারি । এটা আমার মত হলেও সৌরভদা সিনিয়র, তার মতটাই নেওয়া উচিত । তাছাড়া সৌম্যশুভ্র’র দিকটাও দেখতে হয় । বেচারি সামনে বসতে চেয়েছিল আসার সময় । সৌরভদার দিকে তাকাতেই সে মার্তার দিকে চেয়ে ওদের সবার উদ্দেশ্যে বলেছিল, “নো, নো । নো নীড টু চেঞ্জ সিট্স। লেট্স হ্যাভ দ্য সেম সিট্স অ্যাজ উই কেম । ইউ আর নট অনলি গেস্ট অফ আওয়ার কাউন্ট্রি বাট অলসো আওয়ার ফ্রেন্ড্স ।”
মার্তা সৌরভদার দিকে সুন্দর করে হেসেছিল কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, “থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কেল ।”
সৌম্যশুভ্র এবার আর মনঃক্ষুণ্ণ হয়নি মনে হল । সে খুশি মনে মেনে নিয়েছে বাবার সিদ্ধান্ত ।
আমাদের তিনজনেরই নতুন নামকরণ হয়েছে । আমাকে মার্তা ডাকছে ‘বাউনডু’ বলে । মারজেনা আর ক্যাটারিনা ডাকছে ‘ফ্রেন্ড’ । সৌম্যশুভ্র হয়ে গেছে ‘সৌউম্মাশুভ্রা’ । ক্যাটারিনা অবশ্য ডাকছে ‘ব্রাদার’ বলে । কখনো কখনো ‘বাই’ । ক্যাটারিনা সৌরভদাকে মার্তার মতো আংকেল বললেও মারজেনা সৌরভদাকে ‘ফাদার’ বলে সম্বোধন করছে । সৌরভদার কাছে জানতে পারলাম মারজেনা ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় মা-বাবা দু’জনকেই হারিয়েছে । শুধু অদ্ভুতভাবে বেঁচে গিয়েছিল সে । ওর বয়স তখন মাত্র তিন । এক কাকার কাছে থেকে খুব কষ্টে মানুষ হয়েছে মারজেনা । সৌরভদার কাছে অনুমতি চেয়েছিল সে ‘ফাদার’ বলে ডাকতে পারে কিনা । “ওকে অনুমতি না দিয়ে পারি কখনো !” বলতে গিয়ে সৌরভদার চোখ জলে ভরে গেল ।
মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল আমার । দেশের গন্ডী পেরিয়ে, সাদা-কালোর ভেদাভেদ ভুলে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ভুলে পৃথিবীর সব মানুষ যদি এমনভাবে মানুষকে আপন করে নিতে পারে তবে পৃথিবীতে যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাত, নৃশংসতা কিছুই থাকবে না । কবে আসবে সেদিন ?
সৌরভদা ছেলেকে বলল, “শার্টটা খুলে শুধু গেঞ্জি পরে বস না । দেখ ভাল লাগবে।”
সৌম্যশুভ্র বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে আকাশ দেখতে লাগল গম্ভীর মুখে । “একটা কথাও যদি শুনত ছেলেটা !” হতাশ হয়ে বলল সৌরভদা ।
কখনো কখনো বেশ ভাল লাগে বাবা-ছেলের হার মানা না মানার এই দ্বন্ধ । এখানে সম্পর্কের টানাপোড়েন নেই । আছে স্নেহ-বাৎসল্যর সঙ্গে অবাধ্যতা, খুনসুটি । “শুনবে, একদিন দেখবে তোমার ছেলে তোমার সব কথা শুনছে, তুমিই ওর কথা শুনছো না । সৌরভদা, তোমার ছেলে খুব ভাল ছেলে ।” বাবা নয় ছেলেকে বোঝাতেই কথাগুলো বলি । ছেলেটা ভাল হলেও বেশ অবাধ্য সেটা তো আমি দেখছি ।
সৌরভদা ঠোঁট উল্টিয়ে বেশ রাগতস্বরে বলে, “ভাল ছেলে না আর কিছু ! অবাধ্য গোঁয়ার একটা । মা-বাবার কথা শুনতে ওর বয়েই গেছে ।”
মার্তারা তিনজনই হাল্কা গোলগলা হাফশ্লিভ গেঞ্জি আর ঢোলা পাজামা পরেছে । আমরা তিনজনই জিন্সের প্যান্ট, ফুলহাতা শার্ট । সৌম্যশুভ্র’র আবার শার্টের নীচে একটা গোলগলা গেঞ্জি আছে তাই সৌরভদা ওকে শার্টটা খুলতে বলেছিল ।
সৌম্যশুভ্র শুধু গেঞ্জি পরে থাকবে না । আবার সবার সামনে গেঞ্জি খুলে শার্ট পরবে না । স্থূল গড়ন । তার উপর আবার লাজুক । সিক্স প্যাক মার্কা চেহারা হলেও হয়ত উদোম হতে পারত না ওর স্বভাবের জন্য ।
দুম করে একটা শব্দ হল । গাড়ি থেমে গেল । লামা লাফিয়ে নামল তৎক্ষণাৎ । হতচকিত হয়ে আমরাও নেমে পড়লাম । টায়ার ফেটেছে একটা । পাল্টাতে হবে । লামা সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে গেল । আমরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। কাছে পিঠে কিছু আছে কিনা দেখছি । একটু দূরে একটা বাড়ি দেখতে পেলাম । মিনিটখানেকও লাগবে না পৌঁছাতে ।
দল বেঁধে একসঙ্গেই গেলাম আমরা । কালকের দিনটা আর আজকের দিনটায় যে অনেক ফারাক । বাড়িটার কাছে পোঁছাতেই দেখলাম পাশাপাশি দুটো বাড়ি । একই রকম । কোলকাতায় একটা পাড়ায় একই রকম দুটো বাড়ি দেখেছিলাম । শুনেছিলাম দুই বন্ধু পাশাপাশি বাড়ি করেছে । সে দুটো ছিল ধনী মানুষের সৌখিন বাড়ি । এ বাড়ি দরিদ্র মানুষের । পপলারের কান্ড থেকে খুঁটি, পপলারের ডালপালা থেকে বেড়া আর ঘাস ও পপলারের সরু শাখাপ্রশাখা দিয়ে আচ্ছাদন । বাড়ি না বলে আস্তানা বা ছাউনি বলাই ভাল । দুটো বাড়ির উঠানেই পপলারের ডালপালা জড়ো করে রাখা । বাড়ির সীমানা ঘিরে পপলারের ছায়ায় বেড়ে উঠছে ফুলের গাছের চারা । একটা গাছে হলদে রঙের ফুল ফুটেছে সামনের বাড়ির উঠানের পাশে । যেন সিয়াচিনের নিষ্ঠুর প্রকৃতির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করছে হাসিমুখে।বাড়ির বাইরে কাউকে দেখতে পেলাম না।বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করব কিনা ভাবছি। দেখি বছর দশেকের একটা বাচ্চা মেয়ে জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছে আমাদের । আর অপেক্ষা করা গেল না । ঢুকে পড়লাম বাড়ির ভেতরে । ঘরের দাওয়ায় রঙিন কাপড়ে মোড়া একটা শিশু হাত পা ছুঁড়ছে । “হ্যালো, “হ্যালো” করে চিৎকার করেও কারো সাড়া মিলল না । বিস্মিত বাচ্চা মেয়েটির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম আমরা । ভাষা সমস্যায় জমল না । সৌরভদা ছেলেকে বলল, “বাবি, একটা চকোলেট দে তো।” সৌম্যশুভ্র পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করে দিল বাবাকে । সৌরভদা চকোলেটসহ হাতটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিতেই মেয়েটার মুখে হাসি ফুটল । দু’হাত পেতে উপহার গ্রহণ করল । উপহার দু’হাত পেতে নিতে হয় সেটা আমরা ভুলে গেলেও গরীবেরা ভোলে না ।
পাশের বাড়িতে আর একটা বাচ্চা ছেলে এই মেয়েটার চেয়ে বছরখানেকের বড় হবে বোধহয়, কৌতূহলী চোখে দেখছিল সব । দুটো বাড়ির মাঝখান দিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ি ঝরণা নাচতে নাচতে নেমে যাচ্ছে ঢালের দিকে । ঝরণাটা আছে বলেই বাড়ি বানিয়েছে মানুষ । আকাশে কালেভদ্রে মেঘ দেখা দিলেও বোধহয় বৃষ্টি হয় না এখানে । পাহাড়ে বরফ পড়ে, রোদ্রের তাপে বরফ গলে ঝরণা হয়ে নেমে আসে । এটাই এখানকার প্রকৃতি । লাদাখ ভূমির ধমনী, শিরা-উপশিরা বয়ে ছুটে চলে শীতল জলের স্রোত । জীবন বেঁচে থাকে বরফগলা জলে । আশ্চর্য এক জগত । শীতলতা আর উষ্ণতা হাত ধরে চলে । সৌম্যশুভ্র নিজেই আর একটা চকোলেট বের করে ছেলেটাকে ডাকল । ছেলেটা দৌড়ে চলে এল । মাথা ঝুঁকিয়ে দু’হাত পেতে গ্রহণ করল উপহার । খুশিতে উজ্জ্বল হল কচি মুখখানা । মুখে কথার খই ফুটছে এখন । দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলছে বোঝা না গেলেও এটা বোঝা গেল ওকে এ বাড়ির উপর লক্ষ্য রাখতে বলেছে কেউ । দু’বাড়ির বড়রাই কাজে গেছে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে ।
গাড়ির হর্ণ বাজছিল । হাত নেড়ে বিদায় জানালাম । ওরাও প্রত্যুত্তরে হাত নাড়ল । গাড়ির কাছে পৌঁছে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম দুটিতে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে । সৌম্যশুভ্র’র মুখটা খুশিতে ঝলমল করছে । এ যেন অন্য এক সৌম্য। সৌরভদাও লক্ষ্য করেছে ছেলেকে ।
খুশি কিনতে পাওয়া যায় না পৃথিবীর কোন দোকানেই । কিন্তু উপহার পেলে খুশি হয় অনেকেই । আর উপহার দিতে পেরে খুশি হয় খুব কম মানুষ । সৌম্যশুভ্র আজ সে দলে । সৌরভদা ছেলের খুশিতে নিজেও খুশি তাই ।
এই পৃথিবীর শিশুরা জানেই না বাকি পৃথিবীর মানুষগুলো যারা বেড়াতে আসে গাড়ি করে তারা কোথায় থাকে, কী করে ! ওরা ছোট থাকতে থাকতেই শিখে যায় কীভাবে লড়াই করে বাঁচতে হবে । প্রকৃতির খামখেয়ালীপনার সঙ্গে পরিচিত হতে হতে চিনতে শেখে পাহাড়, বন, নদী, আকাশ, জীবজন্তু থেকে মানুষকেও । আমাদের মতো শহুরে মানুষকে বোধহয় মানুষ বলে ভাবতে পারে না । হয়ত ঈশ্বর ভাবে ! সুখ আর দুঃখের বোধটা জন্মায় আরো পরে ।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে নিতে কখনো কখনো একঘেয়ে লাগে । তখন একটা ব্রেক হলে ভালো হয় । গাড়ির টায়ার ফাটা, স্বল্প ক্ষণের জন্য হলেও নির্জন প্রান্তরে শিশুদের সান্নিধ্য মনটাকে আপ্লুত করেছে । ব্রেকটার দরকার ছিল । সৌরভদাকে এখন অনেক ফুরফুরে লাগছে । গুনগুন করছে খুশিমনে ।
সরু একটা স্রোতস্বিনীর ওপারে কয়েকটা ইয়াক চরছে ঘন সবুজ আঁচলে ঢাকা উপত্যকায় । উপত্যকার সীমানা ঘেঁসে বরফমোড়া পাহাড় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে । লামাকে গাড়ি থামাতে বলব কিনা ভাবছি । মার্তাই দাঁড় করিয়েছে । গাড়ি থামার অপেক্ষা মাত্র । ক্যাটারিনা আর সৌম্যশুভ্র ছুটল ক্যামেরা হাতে । সৌরভদা দৌড়াতে মানা করলেও ওরা শুনল না ।
সৌরভদা আর মারজেনা পাশপাশি হাঁটছে । পেছনে মার্তার সঙ্গে আমি । মার্তা ওদের দেশে এভাবে রাস্তায় হাঁটতে পারে না । সর্বত্রই গাড়িতে যায় কাঁচ তুলে দিয়ে । মার্তা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল । “উই আর লাকি এনাফ । থ্যাংকস টু গড ।” শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছি, ও উত্তর না দিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল । রূপসীরা যে কত ছলা কলা জানে !
দুটো বড়সড় চেহারার ইয়াক পরস্পরের দিকে তেড়ে যাচ্ছে।ঝাঁপাল দুটোই । পরস্পরের মাথা লক্ষ্য করে। একটু পেছোয়, আবার ঝাঁপায় । রক্ত ঝরছে সবুজের বুকে । ওদের ভ্রুক্ষেপ নেই । এ লড়াই বাঁচার লড়াই না মৃত্যুর লড়াই ? অন্য ইয়াকগুলো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ।
ইয়াকের দল স্রোতস্বিনীর ওপারে । এপারে দাঁড়িয়ে একটা করুণ ঘটনার সাক্ষী থাকতে হচ্ছে দেখে খুব খারাপ লাগছে । কিছু তো করার নেই ! মানুষের সাথে মানুষের লড়াই থামাতে পারি না পশুর সাথে পশুর লড়াই থামাব কী করে ? ক্যাটারিনা আর সৌম্য ছবি তুললেও মার্তা বা মারজেনা ছবি তুলল না । মারজেনা বসে পড়ল সৌরভদার পাশে । একটা পাথরের উপর সৌরভদা আগেই বসে পড়েছিল । ইয়াকের রক্তে সবুজ ঘাস লাল হয়ে গেছে দেখে ওরা দুজনই বোধহয় সহ্য করতে পারছিল না ।
লড়াই থামল অবশেষে । একটা ইয়াক ভূমিশয্যা নিয়েছে । বিজয়ী বীর রক্তাক্ত শরীরে টলতে টলতে এগিয়ে গেল দলের দিকে । হঠাৎ কী যে ঘটল ! ইয়াকের দলটা ছুটতে লাগল । বিজয়ী ইয়াকটাও ছুটছে । ক্যাটারিনা – সৌম্যশুভ্র ছুটছে ক্যামেরা হাতে । ছোট্ট নদীটাকে মাঝে রেখে এপার- ওপারে ছুটছে মানুষ- ইয়াক । সমতলের মানুষ ইয়াকের সঙ্গে পারবে কেন ? সৌম্যশুভ্র আর ক্যাটারিনা লুটিয়ে পড়ল ঘাসের উপর । ইয়াকের দল চলে গেল অনেকদূরে । বিজয়ী ইয়াকের অবস্থাও শোচনীয় । সে আর ছুটতে পারছে না তেমনভাবে । টলতে টলতে একসময় লুটিয়ে পড়ল মাটির বুকে । ক্যাটারিনা আর সৌম্যশুভ্র নাক-মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে । পাহাড়ে দৌড়ানো খুব কঠিন । সৌরভদা বকাবকি করছিল খুব । “এখানে অক্সিজেন খুব কম । এভাবে কেউ দৌড়ায় !”
ক্যাটারিনার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে পিতৃপ্রতিম মানুষটার কথায় অন্যায় স্বীকার করে নিচ্ছে । সৌরভদা ওদের পাশে বসে পড়েছে । খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে মানুষটাকে । ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে । ওরা স্বাভাবিক অবস্থায় না ফেরা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই । কেউ গরম পোশাক পরে আসিনি । গাড়ির সিটেই রাখা আছে।সৌরভদাকে বললাম,“তোমরা অপেক্ষা কর । আমি গরম জামাকাপড় নিয়ে আসি ।” মার্তা আমার সঙ্গী হল নিজে থেকেই । ও কাঁপছিল ঠাণ্ডায় । পাতলা একটা গেঞ্জি পড়েছে শুধু । মারজেনা কখন যেন একটা শার্ট চাপিয়ে নিয়েছিল ।
গাড়ির কাছাকাছি আসতেই একটা লোক আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল । লাদাখের মানুষ নয় । শহুরে মানুষ । গালে একটা কাটা দাগ । মার্তার হাত চেপে ধরলাম । মার্তা অবাক হল না মোটেই । লোকটার দিকে নজর রেখে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম । কঠিন দৃষ্টি আর মৌনতা কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে হতভম্ব করে দেয় । লোকটা স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে রইল ।
সবার জন্য গরম কাপড় নিয়ে ফিরে আসার সময় দেখি লোকটা একটা পাথরের উপর বসে পড়েছে । চারজনের একটা দল একটু দূরে নিত্যানন্দর মতো হাত তুলে নাচছে । ভাবাবেগে নয় মাতাল হয়ে । এরা কী পিকনিক করতে এসেছে নাকি ! যে কোন মুহূর্তে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে সে বোধটুকুও নেই । বোঝা উচিত সমতলের প্রমোদক্ষেত্র নয় এটা । হিমালয় ও কারাকোরামের দুর্গম জনবিরল বধ্যভূমি ।
প্রায় সব ড্রাইভারের মতোই লামা সঙ্গীতপ্রেমী । ওর গাড়ির রেকর্ডারে সারাক্ষণই গান বাজছে । একটা গান প্রায়ই শুনতে পাচ্ছি । জনপ্রিয় শিল্পী কিশোরকুমারের একটা হিন্দী গান । “মেরে সঙ্গ সঙ্গ আয়া তেরি ইঁয়াদো কি মেলা- ”।
ভারতের পপুলার আর্টের জগতে কিশোরকুমার এক অবিস্মরণীয় নাম । অসাধারণ ট্যালেন্টেড গায়ক ছিলেন তিনি । কত বছর আগে চলে গেছেন তবু তাঁর গান রয়ে গেছে । আধুনিক প্রজন্মও তাঁর গানের ভক্ত । কিশোরকুমারের মনমাতানো কন্ঠ, তাঁর গায়কি ঢং, তাঁর গাওয়া অসাধারণ গান মানুষকে এখনও মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে । বিশাল ভারতবর্ষের নানা ভাষী, নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন তিনি তাঁর গান দিয়ে । শিল্পের সাথে শিল্পীও অমর হয়ে আছেন তাই । মার্তাদের জানালাম সে সব । ওরা চমকিত । মার্তা বলল সে শুনবে কিশোরকুমারের গান । ফেরার সময় সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে কিশোরকুমারের গানের সিডি ।
মার্তারা এখান থেকে ফিরে যাবে লামায়রুতে । ওখান থেকে ট্রেকিং করে জাঁসকার, পাদুম । খানই ব্যবস্থা করে রেখেছে । আমরা একদিন পরে যাব প্যাংগং লেকে । আর কিছুক্ষণ মাত্র আমরা একসাথে আছি ।
খারদুংলা পাশ পেরিয়ে এলাম এই মাত্র । এবার আর নামিনি । সৌম্যশুভ্র এখনও ঘুমাচ্ছে । বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে । সৌরভদাকেও খুব মনমরা লাগছে । মনটা আমারও ভারাক্রান্ত । প্রায় দুটো দিন একসঙ্গে ছিলাম । মার্তার ঠিকানা না হোক ইমেল অ্যাড্রেস লিখে নেব কিনা ভাবছি । সংকোচ কাটিয়ে পকেটে হাত দিয়েছি, মার্তা পেছন ফিরে একটা ছোট নোটবই আর পেন বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “প্লীজ, গিভ ইয়োর ইমেল অ্যাড্রেস ।”
আমার ইমেল অ্যাড্রেস লিখে দিয়ে ওরটার জন্যে আমার নোটবুক এগিয়ে দিলাম । ওরা তিনজনই একে একে লিখে দিল । পোল্যান্ডে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল । আমিও কোলকাতায় আসার নিমন্ত্রণ জানালাম । এবারে হবে না জানাল মার্তা, তবে একবার আসবে ।
সৌরভদার কাছে শুনলাম মারজেনা আগেই জানিয়েছে সে আসবেই কোলকাতায় । তার প্রিয় মাদার না বেঁচে থাকলেও তাঁর ‘নির্মল হৃদয়’ আছে । মাদারের অনুপ্রেরণায় সে নিজেকে তৈরি করছে । ভবিষ্যতে অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করার তার খুব ইচ্ছে । ক্যাটারিনার খুব শীঘ্রই বিয়ে । ওর বয়ফ্রেন্ড কানাডায় আছে । বিয়ের পর সেও হয়ত কানাডায় চলে যাবে ।
সৌরভদার কাছে এইটুকু শুনেছিলাম । মার্তার কথা কিছু বলেনি সৌরভদা । হয়ত জানে না ।
মাত্র একদিন আগে যারা একেবারেই অচেনা ছিল তারা এখন খুব চেনা । আপনও । সৌরভদাও একদিন আমার অচেনা ছিল । আজ সৌরভদার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক সেটা আমিই জানি । সৌরভদা আর আমার মধ্যেকার বন্ধন আজ এত দৃঢ় যে সেটা কোনভাবেই আর ছিন্ন হবার নয় ।
সৌরভদা এমন বিষন্ন হয়ে আছে সম্ভবতঃ মারজেনার জন্য । মারজেনা যখন ফাদার বলে ডাকে তখন দেখেছি সৌরভদার মুখে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি । সৌরভদার ছেলে কখনো সৌরভদাকে বাবা বলে ডাকে না, অন্ততঃ আমি শুনিনি । কিন্তু বাবার কথা বলতে গেলে বলে ‘আমার বাবা’ । ছেলেটা বোধহয় বোঝেই না ‘বাবা’ ডাকটা শোনার জন্য ওর বাবা কতটা উৎকর্ণ ।
সৌম্যশুভ্র ক্যাটারিনার ‘ব্রাদার’ সম্বোধনে জেগে উঠল । ক্যাটারিনা ওর ইমেল অ্যাড্রেস চাইছে । সৌম্য লাজুক মুখে ওর ইমেল অ্যাড্রেস জানাল । ক্যাটারিনার লিখে নিল । সৌম্যশুভ্র’র বোধহয় ওরটা চাইতে লজ্জা করছিল । ক্যাটারিনা সেটা বুঝতে পেরে নিজেই জানাল ।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলেও এখনও রোদ্রের বড় তেজ । লেহ শহরটা রোদ্রে জ্বলছে দেখতে পাচ্ছি উপর থেকে । সৌম্যশুভ্র আবার ঘুমিয়ে পড়েছে বাবার কাঁধে মাথা রেখে । গিরিসংকটের নীচে আলপনার মতো সুন্দর একটা হলুদ-সবুজের সর্ষেখেত। বাতাস ঢেউ তুলে তুলে চলচ্চিত্রের রূপ দিচ্ছে । খেতের পাশে পপলার গাছের ছায়ায় ছোট একটা কুটির । দুর্দান্ত কোলাজ !
সৌরভদা হঠাৎ নস্ট্যালজিক । নিজের সম্বন্ধে সৌরভদা খুব একটা কিছু বলে না । কী জানি আজ কেন বলতে লাগল । “বহুদিনের পুরানো একটা বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল । আমাদের বাড়িটাও এমন ছোটই ছিল । বাবা-মা আর আমরা সাত ভাইবোন থাকতাম সেখানে । কষ্ট করে থাকতাম । কিন্তু শান্তি ছিল । দুঃখ ছিল, সুখও তো ছিল ! দারিদ্র ছিল, ভাগ করে খাওয়াও ছিল । বাবা অকালে চলে গেলেও মা ছিলেন । বড় হতে হতে মাও চলে গেলেন । মায়ের প্রতিনিধি হয়ে রয়ে গেছে ‘আমার ছোড়দি’ । ছোড়দি স্কুলে পড়ায় এখনও । ছোড়দির নিজের কোন সংসার হল না । এ দেশে কত মেয়েরই তো সংসার হয় না, কিন্তু ক’জন আমার দিদির মতো ভাইদের সংসারের দায়িত্ব নেয় ? ভাইদের সংসারের দায়ভার আর ব্যয়ভার বহন করতে করতে এতটুকু ক্লান্ত হয় না কখনো ! মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলেই বোধহয় এত সহ্যশক্তি । ও বাড়ির সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক । কিন্তু মানসিক সম্পর্কটা আলগা হয়ে গেছে বেনো জলের তোড়ে। তবু বাঁধনটাকে উপেক্ষা করতে পারি না । এখনো যাই মাঝে মাঝে । ছোড়দির জন্যেই যাই । ছোড়দি ছাড়াও আমার অতি প্রিয়জনদের সান্নিধ্য পেতে ভালো লাগবে ভেবে যাই । দূরে থাকলে অনেককিছু ভাবা যায়, কাছে গেলে বদলে যায় সব । ভালো লাগে না । মন বিক্ষিপ্ত হয় নানা কারণে । বাড়িটার পরতে পরতে বাবা-মায়ের স্মৃতি । বাবা-মা’র নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই যেন । তবু হাঁপিয়ে উঠি বাড়িটাতে গেলে । বাবা-মায়ের গায়ের গন্ধটাই পাই না যে ! বাতাসে অন্য এক কটু গন্ধ । অনেকগুলো ঘর এখন বাড়িতে।প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ঘর।শুধু আমার কোন ঘর নেই । আমি যে প্রবাসী ! বাড়িতে গেলে ছোড়দি ওর ঘরটা ছেড়ে দেয় । রাতে নিজে কোথাও একটা জায়গা খুঁজে নেয় ঘুমানোর জন্য । খুব খারাপ লাগে । যতটা আগ্রহ নিয়ে যাই ফিরে আসার জন্য তার চেয়ে বেশি ব্যাকুল হয়ে পড়ি । ফেরার সময় ছোড়দির চোখ জলে ভরে যায় । আমার চোখে জল আসে না । বুক ফাটে । ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী’- । সেকালটা বড় ভালো ছিল- সবাই কাছাকাছি থাকতাম মিলেমিশে ।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থামল সৌরভদা । ছেলের মাথাটা একটু বেশি হেলে গিয়েছিল দেখে ঠিক করে দিল ।
স্বগতোক্তির মতো শোনাল তার কন্ঠস্বর, “মায়ের ছবিটা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে । আমার প্রথম কেনা ছোট্ট ক্যামেরাতে তোলা । মায়ের মৃত্যুর পর বড় করা হয়েছিল । ওরা কেউ মালা দেয় ছবিটাতে । মানুষটাকে মনে রাখেনি । মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ালে মা কেমন করুণার চোখে দেখে আমাকে ! তখন কষ্টটা বেশি হয় । মা আমার কাছে চলে আসতে চেয়েছিল – তখন পারিনি নিয়ে আসতে । এখন মনে হয় তখন মাকে নিয়ে এলে কয়েকটা বছর বেশি কাছে পেতাম । বাবার মুখটা খুব ভালো করে মনে পড়ে না । মৃত্যুর পরের ছবি ছাড়া আর কোন ছবি নেই বাবার । ও বাড়িতে গেলে বাবার গায়ের গন্ধটা পাই । বাবা যে আমাকে বুকের কাছে নিয়ে শুতেন । তখন কী জানতাম অকালেই বাবা চলে যাবেন ! ভাইটাতো বাবাকে সে ভাবেও পায়নি । ছোট্ট মফস্বল শহরটা এখন অনেক বড় হয়েছে । বন্ধুবান্ধব অনেকেই ছড়িয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে । বিদেশেও চলে গেছে কেউ কেউ । যারা এখনও আছে তারা অনেকেই অন্য জগতের মানুষ । সময়ের দীর্ঘতায় চেহারার সাথে স্বভাবও বদলে যায় । দু’একজন অবশ্যই ব্যতিক্রম । তারা এখনও খুশি হয় আমাকে দেখে । তবু পাকাপাকিভাবে ফিরে যাওয়া যায় না । যেতে পারি না ।”
সকালে একটু দেরি করেই উঠেছি । আজকের দিনটা আবার লেহ’তে থাকব । সকাল থেকেই আড্ডার মেজাজ । সৌরভদা ছেলেকে বলছিল, “লাদাখ হল ল্যান্ড অফ পাসেস । খারদুংলা, চাংলা, টাংলালা, ফাটুলা কত যে পাস ! পাস মানে জানিস তো গিরিবর্ত্ম – একটা পাহাড়ের এপার থেকে ওপারে যাওয়ার পথ বা এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে যাওয়ার পার্বত্য পথ । তিব্বতী ভাষায় পাসকে বলে ‘লা’ । তাই এত লা’ এর ছড়াছড়ি বুঝলি ? বিশ্বের হায়েস্ট মোটরেবল রোড তো দেখা হল এবার দ্বিতীয়, তৃতীয়ও দেখব আমরা ।”
একটু থেমে সৌরভদা আবার বলল, “আমরা বাংলায় লাদাখ বা লাদাক বলি, ওরা বলে লাদ্দাখ বা লাড্ডাক। ডাক মানে দেশ । ইংরাজীতে এল এ ডি এ কে এইচ লেখা হয় দেখেছিস তো। আসলে স্থান, কাল ভেদে মানুষের ভাষা বদলে যায়, উচ্চারণ তো বদলাবেই । বাঙালীও তাই বাঙালি, বিঙ্গালি, বেঙ্গলি।”
ইন্টারনেট, গুগল ঘাঁটা সৌম্যশুভ্র সব জানে নিশ্চয় । সৌরভদার কাছেই শুনেছি সৌম্যশুভ্র কম্পিউটারে খুব দক্ষ । ওর কলেজের শিক্ষকও তাই বলেছেন, “তুই তো দারুণ ট্যালেন্টেড রে !” সৌরভদা তবুও চিন্তা করে দেখে বলেছি,“তুমি অত বেশি ভেব না ওকে নিয়ে।দেখবে তোমার ছেলে একদিন খুব নাম করবে ।”
সৌরভদা তবুও হতাশ, “ততদিনে আমার নামের আগে চন্দ্রবিন্ধু বসে যাবে । মোবাইলের নেশা না ছাড়লে ওর কিচ্ছু হবে না । ওটাই ওকে গিলে খাচ্ছে ।”
ক্যাটারিনাও বলেছে ওর ব্রাদার একদিন ফেমাস হয়ে যাবে । বাবা তবু ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত । সব বাবারাই কী তাই !
ভারী একটা ব্রেকফাস্টের পর বাজারে ঘুরতে শুরু করেছি । বাজারের পথে বড় বড় কিউরিও শপ । কাপড়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট, ফ্রুটজুসের স্টল, বইয়ের স্টল কী নেই ! একটা বড় বইয়ের দোকানে ঢুকল সৌরভদা । পেছনে পেছনে আমরাও । প্রচুর বই সাজানো রয়েছে । লাদাখের উপরে লেখা ইংরাজী বইগুলো ঘাঁটছিল সৌরভদা । দাম সব পাউন্ড বা ডলারে । ভারতীয় টাকায় হাজারের নীচে নেই কোন বই ।
ফুটপাত ঘেঁসে সবুজ শাকসবজি, দুধ নিয়ে বসেছে গ্রাম্য মানুষ । গার্ডেনফ্রেশ সবজি । মনে হচ্ছে এইমাত্র তুলে এনেছে।হিন্দীও বলতে পারে না তারা। দো আঁশলা ভাষায় আকারে ইঙ্গিতে দামটা বলতে পারে শুধু । সৌরভদা মটরশুঁটি আর মুলো কিনল । “রান্নার ব্যবস্থা থাকলে পালংশাকও নেওয়া যেত । মটরশুঁটি আর মুলো কাঁচাই খাওয়া যাবে তাই নিলাম ।” হাসল সৌরভদা ।বিক্রেতা লাদাখি মহিলা । দুটো আলাদা আলাদা কাগজের ঠোঙায় ভরে দিল সে । লাদাখে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ ।
একটা মটরশুঁটি ভেঙে মুখে দিল সৌরভদা । পরম তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে মুখ । আমাকে একটা এগিয়ে দিতে দিতে ছেলেকে বলল, “বাবি, একটা খেয়ে দেখ । কী দারুণ !” সৌম্যশুভ্র মুখ ঘুরিয়ে নিল অবজ্ঞায় ।
সত্যিই দারুণ ! মটরশুঁটির স্বাদে জাদু আছে । সিন্ধু নদের বরফগলা জলের স্বাদ ভরে দেওয়া আছে যেন । আর কী মিষ্টি ! সৌরভদার জহুরীর চোখ ।
সৌরভদার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে দেখে আমি সৌম্যশুভ্রকে বললাম, “খেয়ে দেখ না, খুব ভালো খেতে ।” ছেলেটা সত্যিই অবাধ্য । খেল না একটাও ।
সূর্য তার গন্ গনে আঁচে পোড়াচ্ছে শহরটার সঙ্গে আমাদেরও । ছায়া খুঁজে খুঁজে পথ চলি । ধূলিধূসরিত পথে উজানের দিকে চলেছি পুড়তে পুড়তে । বেড়াতে এসে ঘরে বসে থাকার মানেই হয় না । কিন্তু শরীর মনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কখনো কখনো । ফিরতেই হল ঘরে । ফেরার পথে অবশ্য অ্যাপ্রিকট জুস খেয়েছি । সৌম্যশুভ্র খায়নি । বাধ্য হয়ে কোল্ড ড্রিংকস কিনে দিয়েছে সৌরভদা ।
আমরা মটরশুঁটি আর মুলোতে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম । পেটের সাথে মনও ভরে গেছে । সৌম্যশুভ্র কয়েকটা বিস্কুট খেয়েছে শুধু ।
সৌরভদা ঘরে আসার পর একটাও কথা বলেনি । মুখের আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে আমিও ঘাঁটাইনি । ছেলেটাকে একটু বোঝানো দরকার । বড়দের কথা শুনতে হয় । মা-বাবার কথা তো অবশ্যই ।
বাইরে এসে বসলাম । গরম হাওয়া বইছে । তবু ছায়াতে বসে থাকা যায় । রোদ মাথায় না লাগায় সহ্যের মধ্যেই আছে গরম । একটু পরে সৌরভদাও এসে বসল আমার পাশে । অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে কাটানোর পর সৌরভদা বলল, “দেখলে, ছেলেটাকে এত করে বললাম আমার কথা শুনল না । ডোমিনোজ, কে এফ সি ওকে গিলে খেয়েছে । এখন তো ঘরের খাদ্যেও রুচি নেই । আমরা যে জিনিস আনন্দ করে খাচ্ছি সেটা যে বিষ বা অখাদ্য নয় এটা বুঝল না ! একটা দিন না খাইয়ে রাখি । বুঝুক ঠেলা ।”
রোদ পড়ে এলে বললাম, “চলো সৌরভদা, শান্তিস্তূপ থেকে ঘুরে আসি ।”
-চলো । সৌরভদা উঠে দাঁড়াল । ঘরে ঢুকে চমকে উঠলাম । সৌম্যশুভ্র মটরশুঁটি প্রায় শেষ করে এনেছে । সৌরভদা দেখেও কিছু বলল না । আমাদের জুতো পরতে দেখে সৌম্যশুভ্রও জুতো পরতে লাগল খাট থেকে নেমে ।
সৌরভদা আমার দিকে ফিরে খুশির হাসি হাসল না মনের কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করল বুঝতে পারলাম না, কিন্তু যা বলল সেটা যে ছেলের উদ্দেশ্যেই বলল সেটা বোঝা গেল । “অজাতশত্রু বিম্বিসারকে বন্দী করে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়ে রাজা হয়েছিল । নিজে যখন সন্তানের পিতা হল তখন বুঝতে পারল পিতা-পুত্রের রসায়ন । অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ছুটেছিল কারাগারে । কারাগার শূন্য । অনেক আগেই সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন পিতা । ভয়ে দোর্দন্ডপ্রতাপ অজাতশত্রুকে পিতার মৃত্যু সংবাদও দেয়নি কেউ ।”
রাত নামার আগে লাদাখের সূর্য ক্লান্ত হবে না বোধহয় । একটু হেলে পড়েছে তাই রক্ষা । কখনো পথের ধারে বড় বাড়ির ছায়ায়, কখনো পপলারের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে শান্তিস্তূপের দিকে হাঁটছি । পথে বেশ চড়াই । গলা পিচের রাস্তায় গাড়ি চলার সময় চড় চড় করে আওয়াজ হচ্ছে । আশমানি রঙের আকাশটা হাসছে মাথার উপরে ।
একটু পরে বুঝলাম আকাশটা এবার আরো মজা করে হাসবে । বাড়িঘর তো দূরের কথা একটা গাছও নেই আর । সামনে আরো চড়াই, আরো পিচগলা রাস্তা । রাস্তার পাশে শুকনো ঘাস আর পাথুরে পথ বেছে নিয়ে এগোতে লাগলাম । রাস্তায় আমাদের মতো এমন পাগল ভ্রমণ রসিক আর একটাও নেই । যারা শান্তিস্তূপে যাচ্ছে তারা সবাই গাড়িতে করেই যাচ্ছে ।
বড় কোন পাথর পেলেই তার আশ্রয়ে যাচ্ছি । তাতে কী আর স্বস্তি মেলে ! সব তো তেতে পুড়ে উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে । সৌরভদা পাথরের মধ্যে কিছু খুঁজছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কি খুঁজছো সৌরভদা ?”
সৌরভদা রহস্যময় হাসি হাসল । “এই পাহাড়ে মূল্যবান অনেক পাথর ছিল শুনেছি, তাই খুঁজে বেড়াচ্ছি । যদি একটা পেয়ে যাই ।”
সৌরভদার কথা বুঝতে পারি না মাঝে মাঝে । এখন মজা করছে না সত্যি সত্যিই মূল্যবান কিছু খুঁজছে জানি না । পাহাড়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন প্রচুর । পাহাড় কেটে কেটেই তৈরি হয়েছে শান্তিস্তূপের পথ । নানা রঙের পাথর পাহাড়ে । সৌরভদাকে দেখছি খুব মন দিয়েই খুঁজছে । পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে হাত দিয়ে দেখছে । উৎসাহিত হয়ে সৌরভদাকে অনুসরণ করছি । সৌম্যশুভ্রও নীরবে অনুসরণ করছে আমাদের । সেও খুঁজছে । যদি কিছু একটা পেয়ে যায় । আমরা ওর সাথে একটাও কথা বলছি না ।
কিছু পাথর সংগ্রহ করলাম । স্ফটিকের মতো । অজস্র আছে, তবে বড় পাথর পেতে গেলে পাথর ভাঙতে হবে । হাতের চাপে যতটা ভেঙে নেওয়া যায় তাই নিয়েছি ।
মেডিটেশন সেন্টার মন্দিরের আগেই । মন শান্ত হোক না হোক শরীর কিন্তু জুড়িয়ে গেল । ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ । কয়েকজন লামা বসে কিছু পড়ছে সুর করে । একজন লামা তিব্বতী ঢাকে আস্তে আস্তে ঘা মারছে । “ওঁ মণিপদ্মে হুম” মন্ত্রটাই যেন মৃদু মিষ্টি ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ তুলে ছড়িয়ে পড়ছে মেডিটেশন সেন্টারের প্রতিটি কোণে । সৌরভদা বলল, “আমদের হয়ত এই সুন্দর পরিবেশ থেকে পাওয়ার কিছু নেই কিন্তু শিক্ষার অনেককিছু আছে । মেডিটেশনে মুক্তি না মিললেও মনটাকে শান্ত করা যায় অবশ্যই । ধ্যান করবে নাকি একটু ?”
“রক্ষে কর সৌরভদা । চলো, এবার শান্তস্তূপটা দেখি ভালো করে ।” আমার কথার উত্তর না দিয়ে সৌরভদা বসে পড়ল মেঝেতে । ধ্যানে করতে নয় বিশ্রাম নিতে । আমি বসলেও সৌম্যশুভ্র বসল না । ঘুরে বেড়াতে লাগল মন্দিরের ভেতরে ।
শান্তিস্তূপের গায়ে বুদ্ধের জন্ম থেকে শুরু করে গৌতমবুদ্ধের বুদ্ধ হয়ে ওঠার কাহিনী, জাতকের কাহিনী আঁকা রয়েছে । রয়েছে বুদ্ধের মহানির্বাণের কাহিনীও । বিশাল ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি । মূর্তি বলেই বোধহয় ক্লান্ত হন না কখনো । জগতের শোক- দুখঃ নিবারণ করা কী চাট্টিখানি কথা !
শান্তিস্তূপের রেলিং ঘেরা চাতাল থেকে দেখা উপত্যকা যেন একটা ছবি ! নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী অন্য এক পৃথিবী । ধূসর পাহাড়ের গায়ে মাটির বাড়ি, উপত্যকায় আধুনিক স্থাপত্যে নির্মিত আধুনিক শহর, পপলারের সারি । সিন্ধু নদ আছে পপলার সারির পেছনে লেহ শহরকে বেষ্টন করে । ধূসর পাহাড়ের পেছনের সারিতে শুভ্রতুষার কিরীটিনী ।
শান্তিস্তূপ সংলগ্ন ক্যান্টিনে ঢুকেই সৌরভদা বলল, “আজ লাদাখি চা খাব । তুমি খাবে তো ?” ছেলেকে কিছু বলল না সৌরভদা । একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসলাম । সৌরভদা কাউন্টারে গেল অর্ডার দিতে । ফিরে এল দু’প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে । একটা প্যাকেট টেবিলের মাঝামাঝি রেখে আর একটা প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিল । সৌম্যশুভ্র ছোঁ মেরে টেবিল থেকে প্যাকেটটা তুলে নিয়েছে ততক্ষণে । আহা ! বেচারার খুব ক্ষিধে পেয়েছে । উঠতি বয়সের ছেলে । আমাদের মতো হাবিজাবি খেয়ে ওর পেট ভরে ! সৌরভদার চোখ ছল ছল করে উঠল । আড়াল করতে উঠে গেল জানলার ধারে । পুরুষ মানুষের চোখে জল মানায় না । পুরুষ কঠিন, পুরুষ অভঙ্গুর এই মিথটাই যে সত্যি হয়ে উঠেছে মানুষের মনে ।
চা দেবার পর সৌরভদাকে ডাকলাম । সৌম্যশুভ্র বিস্কুটের প্যাকেট শেষ করে নাক সিঁটকে দেখল লাদাখি চা ।
নুন, মাখন, দুধ দিয়ে তৈরি চা । বেশ খেতে । সৌরভদা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “এখানকার রুক্ষ আবহাওয়ায় খুব উপকারী ।” একপ্লেট চাউমিন এল । ভেজ চাউমিন । চিকেন নয় তবু ক্ষুধার্ত বলেই বোধহয় সৌম্যশুভ্র’র চোখে খুশি উপচে পড়ল । বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা খাবে না ?”
“না, তুই খা ।” ধরা গলায় বলল সৌরভদা । বাবার মনের কষ্ট ছেলে বুঝল কিনা জানি না, কালক্ষেপ না করে খাওয়ায় মন দিল সৌম্যশুভ্র ।
ক্যান্টিনের গা ঘেঁসে সিঁড়ি নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে । শর্টকাট হবে ভেবে ওই পথটাই ধরলাম । একটু পরেই মালুম হল শর্টকাট মানে মৃত্যুর কাছে পৌঁছানোর শর্টকাট পথ । অত উঁচু থেকে প্রায় খাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামাটা শুধু কষ্টকর নয়, বিপজ্জনকও । তার উপর সিঁড়িটা আমাদের মতো টুরিস্টদের জন্য তৈরি হয়নি । স্থানীয় লোকের জন্য তৈরি করা হয়েছে বোধহয় তাই ধাপগুলো তেমন চওড়া নয় । সাবধানে পা না ফেললে আমাদের মতো মানুষের কাছে মৃত্যুর সিঁড়ি।পা কাঁপার সঙ্গে মাথা ঘুরতে লাগল । সৌরভদা ছেলেকে বলল, “তুই আমার পেছনে পেছনে আয় ।”
সিঁড়ি দিয়ে নামার বুদ্ধিটা আমারই তাই অগ্রদূত হয়ে আমিই রয়েছি । পথটা দুর্গম হলেও প্রকৃতির কাছাকাছি।রোদটাও কম। মাঝে মাঝে একটা দুটো ফুলগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে । হলুদ রঙের ফুল । লাদাখি বসন্তে বাসন্তিকা পাহাড়ি হাওয়ায় হাসছে মাথা দুলিয়ে । লাদাখে হলুদ রঙের ফুলের ছড়াছড়ি । এক জায়গায় ওরকম অনেক ফুল ফুটে আছে দেখে সৌরভদা বলল, “বাবির সাথে আমার একটা ছবি তুলে দাও তো ।”
পিতা-পুত্রের যুগলবন্দীর ছবি তুলতে গিয়ে মনে হল মূল্যবান পাথর না পাই, একটা মূল্যবান সম্পর্কের খোঁজ নতুন করে পেলাম । শাসন- অনুশাসনের সাথে অকৃত্রিম ভালোবাসার সুদৃঢ় বন্ধন । তবু সবাই কেন যে শুধু মায়ের কথা বলে !
(ক্রমশঃ)
View Comments
নীল যেখানে দেদার ছড়িয়ে
তপন বিশ্বাস (ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাসের অষ্টম পর্ব) ।। আট ।। গাড়িতে ওঠার সময় ওরা...