নীল যেখানে দেদার ছড়িয়ে
তপন বিশ্বাস
(ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাসের সপ্তম পর্ব)
।। সাত ।।
সুন্দর একটা রিসর্টে নিয়ে এল লামা । মরুভূমি থেকে বেশ কয়েক কিমি দূরে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় চমৎকার মরুদ্যান । ঋজু পপলার আর কাঁটা ঝোপে ঘেরা ঘাস জমির উপর সারি সারি তাঁবু । ধবধবে সাদা তাঁবুগুলো দৃষ্টিনন্দনও । উঁচু ভিতের উপরে প্রত্যেকটা তাঁবু । সবুজ ঘাসজমির বুক চিরে তির তির করে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলের ধারা । নালার পাশে একটা বড় গাছ । মাটি থেকে একটু উপরে উঠে ইংরাজীর ওয়াই আকৃতির মতো হয়ে ভাগ হয়ে গিয়ে দু’দিকে ছড়িয়ে পড়েছে । কান্ড বেশ শক্ত । শাখাপ্রশাখা প্রচুর কিন্তু পাতা খুবই কম । চেনা কোন গাছ নয় । গাছের নীচে আমাদের গাড়ি পার্ক করে লামা গেল কেয়ারটেকারের খোঁজে । আমরা সবুজ ঘাসের গালিচায় বসব না দাঁড়িয়ে থাকব ভাবতে ভাবতেই কেয়ারটেকারকে নিয়ে লামা ফিরে এল । তাঁবু দেখে পছন্দ না হওয়ার কোন কারণ নেই । তাঁবুর ভেতরে সবুজ-হলুদ ফুল তোলা নক্সা । মেঝেতে কার্পেট বিছানো । ফোল্ডিং খাট, বিছানা, চেয়ার-টেবিল, ইলেকট্রিক লাইট, আধুনিক ওয়াশরুম সবই মজুত । ভারতবর্ষের এক প্রান্তিক ভূখণ্ডে প্রায় মরুভূমির মধ্যে এমন একটা টেন্ট পাওয়া যাবে কল্পনাতেও তো ছিল না আমার । সম্ভবতঃ বিদেশী অতিথিদের কথা ভেবেই এসব ব্যবস্থা । হোটেল বা গেস্ট হাউসে না উঠে তাঁবুতে থাকার সিদ্ধান্ত নেবার জন্য প্রাপ্য ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না সৌরভদাকে ।
লামা কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলছিল । ওদের কথার এক বর্ণও বুঝতে পারছিলাম না । লামা ওর পূর্ব পরিচিত এটা বুঝতে পারছিলাম । আজ রাতের ডিনার ও আগামীকালের ব্রেকফাস্ট সহ একদিনের ভাড়া যা বলছে তা খুব বেশি । তার উপর একটা টেন্টে দু’জনের বেশি থাকতে দেবে না । এটাই নাকি নিয়ম এখানে । আমরা ঠিক করেছি তিনজনেই একটা টেন্টে থাকব । দু’জনের বিছানা হলেও তিনজন করে থাকা যায় । মার্তাদের জিজ্ঞেস করে জানলাম ওদেরও তেমনই ইচ্ছে ।
সৌরভদা বলল, “এখনও পুরোপুরি সিজন শুরু হয়নি। তাছাড়া লাদাখে আসা পর্যটকদের অনেকেই দেসকিটে হোটেলে থাকে । হুন্ডারে এসে তাঁবুতে থাকে না । ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে আসা মধ্যবিত্ত বাঙালিরাও দেসকিটে থাকে । দেখছো না সারি সারি তাঁবু ফাঁকাই পড়ে আছে । আমাদের সাথে বিদেশীনি দেখে রেট বাড়াচ্ছে মনে হয় । দেখি একটু বাজিয়ে ।”
সৌরভদা দরদাম করতে লাগল । তখন লামা কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলে একটা নতুন প্রস্তাব দিল । আমাদের জন্য ফিফটি পারসেন্ট কমাতে রাজী আছে যদি ওদের দুটো তাঁবু ওই রেটে নেওয়াতে পারি আমরা । সৌরভদা স্ট্রেইট না করে দিল । “ওরা আমাদের অতিথি । ওদের সামনে এভাবে বেইমানি করতে পারি না আমরা ! যা হবে একই হবে ।” লামাকেও সেটাই বলে দিল সৌরভদা । লামা কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলল আবার । লামা কেয়ারটেকারের সাথে কী কথা বলছে সেটা যেমন আমরা বুঝছি না মার্তারাও বুঝতে পারছে না আমাদের সাথে লামার কী কথা হচ্ছে । আবার লামা ইংরজী জানে না । মার্তারা হিন্দী জানে না । আমি মার্তাদের পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম । মার্তাই বুদ্ধিটা দিল । আমরা এখান থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার ভান করলে হয়ত ওরা আমাদের শর্তে রাজী হয়ে যাবে । বন্ধুদের সাথেও কথা বলল মার্তা । সৌরভদাকে বলে দিলাম, “সৌরভদা, আমরা একটা করে তাঁবুতেই থাকব আর রেটটা সবার জন্যেই কমাতে হবে এইভাবেই কথা বল, নাহলে আমরা অন্য কোন তাঁবু খুঁজি চলো ।”
সৌরভদার কথায় লামা রাজী হচ্ছে না সেটা লামার মাথা নাড়া দেখে মার্তারা বুঝে গেল । ক্যাটারিনা গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়ল আচমকাই, “ও কে ! লামা, স্টার্ট ।” লামা ইংরাজী না বলতে পারলেও এটুকু বোঝে । বুঝতে পারল বিদেশীনিরা অন্য কোথাও যেতে চায় । ক্যাটারিনার অভিনয়ে কাজ হল । লামা প্রথমে কেয়ারটেকার তারপরে সৌরভদার সঙ্গে কথা বলে শুধু আমাদের শর্তে রাজীই হল না, রেটও কমিয়ে দিল ।
নালার পাশে দুটো পাশাপাশি তাঁবুতে আমরা ঢুকে পড়লাম । অবস্থান অনুযায়ী এই তাঁবু দুটোই সবচেয়ে ভাল জায়গায় । তাঁবুর সামনে গাছটার দুটো কান্ডের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় অনেকটা দূর অবধি ।
সৌম্যশুভ্র শরীরটা ছুঁড়ে দিল শয্যায় । তাঁবুর পেছনে কাঁটাঝোপে দুটো গাধা খাবার খেতে খেতে খাওয়া থামিয়ে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে । অচেনা মানুষ দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে হুন্ডারের গাধা ! “গাধারা কি সত্যিই বোকা ?” আমার কথায় সৌরভদা হেসে বলল, “মানুষের মতো অতটা নয় ।”
তাঁবুর বাইরে দুটো চেয়ার পেতে বসলাম সৌরভদা আর আমি । টুনটুনির চেয়ে একটু বড় আকারের একটা পাখি সামনের গাছটায় নাচানাচি করছে । একটা পাখি উড়ে এসে বসল গাছের নীচে । গাছের পাখিটাও নেমে এল পাশে । সম্ভবতঃ ওর জুড়িদার । দু’টোতে মিলে পোকামাকড় খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে বোধহয় । সৌরভদা শব্দ না করে উঠে গেল তাঁবুর ভেতরে । ফিরল সৌম্যশুভ্রকে ধরে নিয়ে । সৌম্যশুভ্র ছবি তুলছে দেখে আমিও ক্যামেরাটা আনতে গেলাম ।
যাঃ, পাখিদুটো পালিয়ে গেছে !
মার্তারা তিনজনে বেরিয়ে কেয়ারটেকারের তাঁবুর দিকে যাচ্ছে । প্রত্যেকের কাঁধেই একটা করে ছোট ব্যাগ । কেয়ারটেকারের তাঁবু থেকে বেরিয়ে ওরা পপলার গাছের নীচে বসল । চেয়ার-টেবিল পাতা আছে ওখানে । দেখতেই পাইনি আগে ।
জোড়া কান্ডের ফাঁক দিয়ে ওদের পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল । কেয়ারটেকার চা বা কফি এনে দিল একটু পরে । ওরা চা বা কফি খেতে খেতে গল্প করছে দেখতে পাচ্ছি । তিনটিতে বেশ এনজয় করছে । ওরা শুধু টুরিস্ট নয়, প্রকৃতি প্রেমিক আমাদের মতোই ।
বেড়াতে এসে বসে থাকার কোন মানে হয় না । মার্তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই আমরা গিয়ে বসলাম ওদের ছেড়ে যাওয়া জায়গায় । চা খেয়ে আমরাও বেরব । সৌম্য চা খায় না । ওর জন্যে কোল্ড ড্রিংকস বলেছে সৌরভদা ।
হলদে বিকেলে পাহাড়গুলো বিষন্নভাবে তাকিয়ে আছে নীচের উপত্যকার দিকে । উপত্যকায় অল্প হলেও সবুজ আছে কিন্তু ওদের শরীরে শুধুই কাঠিন্য । মাথার উপরে মেঘশূন্য নীল আকাশ । পাহাড়গুলো সারাদিন উত্তপ্ত হয়েছে সূর্যের তাপে ।
রিসর্টের বাইরে পথের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নালার জল । পথের ওপারের আর একটা বড় নালায় মিশে স্বকীয়তা হারিয়ে কোথায় পাড়ি দিচ্ছে কে জানে !
ডানদিকের পথটা চলে গেছে মরুভূমির দিকে । বাঁদিকের পথটা গ্রামের দিকে । গ্রামের পথটা আবার দু’ভাগ হয়ে গেছে একটু এগিয়েই । সেখানে অদ্ভুত একটা বৃক্ষ । কুৎসিত দর্শন কোন জন্তু বা বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে যাওয়া কোন দানবের অবয়ব !
বাঁদিকের পথটা রিসর্টের গা ঘেঁসে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেছে । ডানদিকের পথ গেছে সবুজের সাথে । পপলার গাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে পাহাড়ি হাওয়ায় । ডানদিকের পথটাই ধরলাম । খাল বেয়ে স্বচ্ছ জলের ধারা বয়ে চলেছে পথের ডানদিক দিয়ে । জল আছে তাই সবুজ আছে । সে বৃষ্টির বা ভূগর্ভের না হয়ে বরফগলা হলেও । সবুজ আছে তাই প্রাণ আছে । মানুষ আছে বলে মানুষ আসে ।
মাঝে মধ্যে দু’একটা বাড়ি । সবজি খেত । ফলের গাছ, ফুলের বাগান । মানুষের হাতের স্পর্শে লক্ লক্ করে বেড়ে উঠছে গাছপালা । খুশির হাওয়ায় দুলছে ।
গ্রামের পথ ধরে চলতে চলতে ধাক্কা খেলাম বাউন্ডারি ঘেরা একটা উপত্যকায় । গেট খোলাই ছিল । ফল-ফুলের বাগানের পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বড় সড় একটা রিসর্টে । আমাদের রিসর্টটার চেয়ে অনেক বড় এটা । আপেল গাছে দোলনায় বসে বই পড়ছে এক বিদেশীনি । তাঁবু ছাড়াও কয়েকটা কটেজ আছে । আছে রেস্টুরেন্ট, টী স্টল । হুন্ডারের গ্রাম্যপ্রকৃতির মাঝে আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া । একটু এগিয়ে চা-বাগান, সবজি খেত, গমের খেত । রিসর্টটা বেশ কস্টলি । সৌরভদার ভাষায় ‘বিত্তবানের প্রমোদ ভবন’ ।
সৌম্যশুভ্র দেখে শুনে মন্তব্য করল, “রিসর্টটা খুব সুন্দর কিন্তু আমাদের রিসর্টের মতো ন্যাচারাল না । খোলা আকাশের নীচে পাহাড়- জঙ্গল ঘেরা বন্য প্রকৃতির মধ্যে রাতটা অনেক বেশি এনজয় করতে পারব আমরা ।”
সুন্দরের কোন ব্যাখ্যা হয় না । এক একজনের কাছে এক একটা জায়গা সুন্দর । ভাললাগাটাও নির্ভর করে ব্যক্তিগত রুচির উপর, চোখে দেখার উপর । আমরা তো দেখতেই এসেছি, প্রমোদ ভ্রমণে আসিনি । সৌম্যশুভ্র’র কথায় তাই সায় দিলাম, “ঠিক বলেছো সৌম্য, আমাদের রিসর্টের প্রকৃতি অনেকটাই বুনো । কৃত্রিম নয় ।”
গ্রামের পথে দেখা হল গ্রামের মানুষের সাথে । হেসে অভিবাদন করছিল সবাই । পিঠে ঘাসের বোঝা নিয়ে পথ চলছে কেউ কেউ । পাহাড়ি ঝরণার জলে চাষ হচ্ছে বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, গম । চাষের জমির ধার ঘেঁসে মাঝে মাঝে কাঁটা ঝোপ । হরেকরকম পাখি । গাধা চরছে কাঁটা ঝোপের পাশে ।
গ্রামের পথে লামারা মালা জপতে জপতে পথ চলছে । দুর্বোধ্য ভাষায় হেসে কিছু বলছে আমাদের । ভাষা দুর্বোধ্য হলেও হাসি সব সময় দুর্বোধ্য নয় । হাসিতে মানুষ চেনা যায়, হাসি মানুষকে মানুষের কাছে এনে দেয় । গ্রামের পথে একটা প্রেয়ার হুইলের পাশে এক সুন্দরী যুবতী, সন্তান পিঠে ঝোলানো মা আর দুই কিশোরকে পেয়ে গেলাম । কৌতূহলী চোখে ওরা আমাদের দেখছিল । সৌরভদা এগিয়ে গিয়ে আলাপ জমালো । প্রেয়ার হুইলের পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তুললাম আমরা । ওরা খুব খুশি । যুবতী দেখলাম বেশ হিন্দি জানে । ইংরাজীও জানে অল্প স্বল্প । স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা ইরা ।
দু’জন লামা মালা জপ করতে করতে যাচ্ছিল । সৌম্যশুভ্র ওর বাবাকে ধরল, “ওদের ছবি তোলা যাবে ?”
সৌরভদা ছেলের ইচ্ছে দেখে ইরাকে ধরল । মেয়েটা লামাদের রাজী করিয়ে নিয়ে এল ধর্মচক্রের পাশে । সৌম্যশুভ্রর সাথে আমিও ছবি তুলে নিলাম লামাদের ।
ইরা সৌরভদার কাছে আবদার করল ওর ছবি পাঠিয়ে দেওয়ার । ঠিকানা জানতে চাইলে ও জিজ্ঞেস করল আমরা কোথায় উঠেছি । জেনে নিয়ে বলল রিসর্টের ঠিকানায় পাঠালেই ও পেয়ে যাবে । গ্রাম্য সভ্যতায় অনেক বাধা নিষেধ থাকতে পারে তাই হয়ত ঘরের ঠিকানা দিল না । ইরার কাছেই আমরা জানতে পারলাম ছেলেমেয়েরা অনেকেই হিন্দী, ইংরাজী পড়ছে বাইরে গিয়ে। নিয়মিত না হলেও বাচ্চারা ওর স্কুলে আসছে ।
ছোট্ট একটা কুটির । পাথরের । পাশে অনেকগুলো চ্যাপ্টা পাথর সাজিয়ে রাখা । কিছু লেখা আছে পাথরের উপর । শিলালিপির বর্ণ অজানা তাই অজানাই রয়ে গেল শিলালিপির বক্তব্য ।
ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে ফেললাম আমরা । দিনের আলো কমে আসছে । পথ জনশূন্য । গাধারা দখল নিয়েছে গ্রামের পথের । ওদের থেকে চুরি ছিনতাইয়ের কোন ভয় না থাকলেও অন্য ভয় তো আছেই । তেড়ে আসতে পারে অচেনা সভ্যসমাজের মানুষগুলোর দিকে । এগুলো গৃহপালিত না বুনো তাও জানি না । সুমুরে বুনো গাধা দেখতে পাওয়া যায় বলেছিল সৌরভদা । সেই সৌরভদাই বলল, “চল, আমরা যে পথে এসেছি সে পথেই ফিরে যাই । সব গাধারাই যে নিরীহ তারও নিশ্চয়তা নেই । তাছাড়া একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে । একটা লাইটও সঙ্গে আনিনি । চাঁদ এই ঝোপে-ঝাড়ে পথ দেখাতে আসবে কিনা কে জানে !” সৌরভদার কথায় হাসি পেলেও একটা ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার কথা মনে হল । চোখের সামনে ভেসে উঠল শুষ্ক চার হাত মেলা সেই বীভৎস গাছটার অবয়ব । দিনের বেলায় ভয় দেখাতে না পারলেও রাতে ভয় দেখাতেই পারে এমন কোন গাছ বা জন্তু । শুধু ভয় দেখানো কেন ক্ষতিও তো করতে পারে । সৌরভদার মুখেও দুশ্চিন্তার ছায়া । সৌম্যশুভ্র বলল, “আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি । তাঁবুতে ফিরব কী করে ?”
“পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ ?” এই বলে কপালকুণ্ডলা এগিয়ে না এলেও একজন এগিয়ে এল । এক গ্রাম্য যুবক উল্টোদিক থেকে আসছিল । ওর সহায়তায় খুঁজে পেলাম ঘরে ফেরার পথ । সেই পৌঁছে দিল আমাদের তাঁবুর রাস্তায় ।
গ্রামের পথে আলো কমে এলেও রিসর্টে বেশ আলো রয়েছে তখনও । আমাদের তাঁবুর উল্টোদিকে পরপর পাঁচটা তাঁবু । পেছনে কাঁটা ঝোপ । সৌরভদা বলল, “ওদিকে কয়েকটা লে বেরি গাছ আছে দেখছি । ফুল ধরেছে লে বেরি গাছে ।”
এগিয়ে গেলাম । লে বেরির ফুল চাঁপা ফুলের মতো, তবে একটু ছোট । পাতাগুলো মোটা আর বেশ রসাল । মাথাগুলো সূঁচালো । ঘন সন্নিবেষ্ট পাতা লালচে রঙের কাণ্ড জুড়ে ।
“লে বেরি গাছের পুরোটাই নাকি অষুধিগুণ সম্পন্ন।” বলল সৌরভদা । একটা খচ্খচ্ আওয়াজ কানে ঢুকেছিল অনেকক্ষণ থেকে । এবার দেখলাম একটা লোক কাঁটা ঝোপের মধ্যে কিছু খুঁজছে । কাঁটা ঝোপের মধ্যে একটা পায়ে চলা পথ । খুব নীচু হয়ে যাওয়া যেতে পারে । তাতেও অবশ্য দু’একটা কাঁটার আঁচড় খেতে হবে । সেখানেই লোকটা উঁকি ঝুঁকি মারছে । আমাদের দেখে হাসল, “একঠো খরগোশ থা- ভাগ গিয়া শালা ।”
উচ্চারণেই বাঙ্গালিত্ব ধরা পড়ে গেল তার । শুকনো দড়ির মতো পাকানো কালো শরীরটা দেখে বয়স অনুমান করা খুব শক্ত । টিকালো নাকের পাশে ছোট ছোট চোখ । উচ্চতা মাঝারি । হাতে নিকনের দামী ক্যামেরা । বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলাম, “খরগোশ আছে এখানে ?”
-আপনি বাঙালি ?
-অবশ্যই, না হলে বাংলায় উত্তর দেবো কেন ! হেসে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করি ।
মাতৃভাষার অমোঘ আকর্ষণে দুরত্ব কমে গেল অনেকটাই । আমরা পরিচিত হলাম একে অপরের সাথে । অবিনাশ সামন্ত ব্যাঙ্কের রিটায়ার্ড চীফ ম্যানেজার । সেটা জানানোর সময় স্পষ্টতই অহংকার প্রকাশ পেল । ষাটোর্ধ বয়সেও বেশ ঘন কাঁচা পাকা চুল । জিজ্ঞেস করলাম, “একাই এসেছেন নাকি ?”
-না, আমার দু’জন সঙ্গী আছে । ওরা তাঁবুতে রেস্ট করছে । আপনারাও দেখছি তিনজন !
-হ্যাঁ, আমরাও তিনজনই তবে আরো তিনজন বিদেশীনি আছে আমাদের সাথে ।
অবিনাশ সামন্ত এবার অদ্ভুতভাবে তাকালেন । পরক্ষণেই রহস্যময় হাসি দেখা দিল ওর মুখে । বললেন, “বেশ, বেশ । বেশ ভালোই হচ্ছে সফর তাই না ? মজা করে ঘুরুন ।”
সৌম্যশুভ্র উঁকি ঝুঁকি মারছিল ঝোপের মধ্যে । সৌরভদা ছেলেকে ডেকে বলল, “বাবি, চলে আয় । কিছুই পাবি না ।”
অবিনাশ সামন্ত ক্যামেরা হাত থেকে কাঁধে ঝোলাতে ঝোলাতে বললেন, “এখানে ম্যাগপাই আছে প্রচুর ।”
অবিনাশ সামন্ত এগিয়ে গেলেন । আমরাও ঝোপের দিকে নজর রাখতে রাখতে এগোই । কিছুই দেখতে পেলাম না । সৌরভদা কেয়ারটেকারের জানতে চাইল সত্যি সত্যিই খরগোশ আছে কিনা । কেয়ারটেকার বলল মাঝে মাঝে দু’একটা খরগোশ ওপারের জঙ্গল থেকে চলে আসে । সেটা শোনার পর থেকেই বুড়োবাবু খরগোশ খুঁজে বেড়াচ্ছে ।
সৌরভদা হাসল । “মানুষ বড় হীন্যমনতায় ভুগছে আজকাল । তার থেকেই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস । প্রত্যেকেই তাই নিজেকে আলাদা প্রমাণের চেষ্টা করছে । সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেলে রাজনৈতিক নেতা থেকে অভিনেতা- অভিনেত্রী সবাই নিজেকে তুলে ধরতে ব্যস্ত । অবিনাশ সামন্তও চেষ্টা করছে একজন ব্যতিক্রমী মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে । ওনার টাকা আছে, কিন্তু-” এটুকু বলে সৌরভদা থেমে গেল । আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বলল, “তবে উনি যে স্বাভাবিক প্রকৃতিপ্রেমিক নন সেটা বোঝার জন্য মনস্তত্ববিদ হওয়ার দরকার পড়ে না ।”
-কেন সৌরভদা ? তোমার এমন কথা মনে হল কেন ?
-না, এমনিই মনে হল । চল এবার তাঁবুতে ফেরা যাক । সৌরভদা কখন যে কী ভাবে বুঝি না !
ছোট্ট একটু আকাশ উঁকি মারছে পাহাড় আর গাছপালার মধ্য দিয়ে । আঁধার ঘনাচ্ছে কাঁটা ঝোপে, লে বেরির ঘন পাতায় । পপলার পাতার ফাঁক দিয়ে একটা দুটো করে তারা ফোটা দেখতে দেখতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম হুন্ডারের আকাশে । সৌরভদা ছেলেকে বলছিল, “বাবি, ইয়াকের দুধ খাবি ?” সৌম্যশুভ্র নাকমুখ কুঁচকে উত্তর দিল, “ছ্যাঃ !”
সৌম্যশুভ্র চা খায় না । দুধও খায় না । আমাদের জন্যে চা বলে সৌরভদা থম মেরে বসে রইল ।
সময় এখানে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে । রাত নামছে তাই গড়িয়ে গড়িয়ে । আজ আষাঢ়ি পূর্ণিমা । কোলকাতার আকাশে এতক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে বোধহয় । গ্রামবাংলা ভাসছে জ্যোৎস্নায় যদি না আকাশে মেঘ থাকে । বাংলায় তো এখন ভরা বর্ষা । এখানে বর্ষা আসে না ভুলেও । দুটো ঋতু । শীত ও বসন্ত । গ্রীষ্মের উপস্থিতি ক্ষণিকের ।
পাহাড়ের মাথা ধুইয়ে দিয়ে চাঁদের আলো পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে । সৌরভদা উচ্ছ্বসিত, “কী দারুণ লাগছে পাহাড়গুলোকে !”
সৌম্যশুভ্র বলল, “চাঁদটা যে কোথায় কে জানে ! চাঁদের একটা ছবি তুলতাম ।”
বেশিক্ষণ অবশ্য অপেক্ষা করতে হল না । মস্তবড় একটা রূপোর থালার মতো তিনি দেখা দিলেন পপলারের ফাঁক দিয়ে নিষ্কলঙ্ক আকাশের কপালে টিপের মতো । পপলারের ভীরু পাতা থেকে কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদের বুকে । আমাদের পেছন থেকে ভেসে আসছে কিশোরীর পায়ের নূপুরের আওয়াজের মতো ঝরণার সুরেলা ধ্বনি । মিঠে হাওয়ায় মধুর অনুভূতি ।
“বাবি, এ দৃশ্য বারবার পাওয়া যাবে না । ছবি তোল ।” সম্বিত ফিরে পেলাম সৌরভদার কথায় । সৌম্যশুভ্রর সাথে আমিও ছবি তুলে রাখি দুর্দান্ত চাঁদের । শুধু অন্যকে দেখানোর জন্যে নয়, নিজেকে দেখানোর জন্যেও । পপলারের পাতার ফাঁকে উকি মারা চাঁদ আর কোথায় পাব !
সময়ের সাথে সাথে নরম জ্যোৎস্না ছড়িয়ে যাচ্ছে কাঁটা ঝোপে, লে বেরির শরীরে । একটু পরে ঘাসের বুকেও লুটোপুটি খেতে লাগল চাঁদের আলো । ক্যাটারিনা, মার্তা, মারজেনা এসে যোগ দিল আমাদের সাথে । এমন রূপসী চাঁদের সান্নিধ্য কে না চায় !
মারজেনা ওর টেলিলেন্স লাগান বহু মূল্যবান ক্যামেরায় চাঁদকে বন্দী করতে ব্যস্ত । ক্যাটারিনা, মার্তা ছোট ক্যামেরায় ছবি তুলছে ।
চাঁদের আলোয় স্নান করে প্রকৃতি এখন আরাধনায় রত । বিহ্বল মুগ্ধতায় দেখা ছাড়া আমাদের আর কোন কাজ নেই । দেখার সাথে পরম প্রাপ্তিতে ভরে উঠছে মন ।
মার্তাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে । চাঁদের আলো ওর মুখে পড়ে যেন থমকে গেছে । নরম জ্যোৎস্নায় আরো নরম হয়েছে রূপসীর ঝলসান রূপ । পরীর মতো লাগছে ওকে । সে চেয়ার টেনে বসে পড়ল আমাদের পাশে । ওর দেখাদেখি ক্যাটারিনা আর মারজেনাও এসে বসল আমাদের আসরে ।
হুন্ডারের বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়েছিল ওরা । বিদেশী পর্যটকরা বেড়াতে এলে অনেক বেশি প্রস্তুতি নিয়ে আসে । ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক । আমরা তো জানতামই না এখানে কোথায় কী আছে ।
মার্তা খুব ভালো পিয়ানো বাজায় । পোল্যান্ডের একজন নামকরা পিয়ানো শিল্পী সে । মারজেনা ওর পিয়ানো বাজানোর ভিডিও এনেছিল । চালিয়ে দিল ভিডিওটা । পিয়ানোর মিষ্টি সুরে জ্যোৎস্না আরো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিল শীতল মরুর মরূদ্যানে ।
মারজেনা মাদার টেরিজার ভক্ত । একবার কোলকাতায় সে যাবেই । ভবিষ্যতে মাদারের বিশাল কর্মকাণ্ডের শরিক হতে চায় । ক্যাটারিনাকে ছেলেমানুষ মনে হলেও সে অতটা ছেলেমানুষ নয় । মারজেনার মতোই পোল্যান্ড দূতাবাসের কর্মী ।
আমাদের সৌহার্দ্য বিনিময়ের মাঝে অবিনাশ সামন্ত তার দল নিয়ে এসে ছন্দপতন ঘটাল । এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও এড়ানো গেল না ওদের ।
অমিতাভ মুখার্জী আর সুদেষ্ণা মুখার্জী । স্বামী-স্ত্রী । দুজনেরই চল্লিশের কোঠায় বয়স । অবিনাশ সামন্তের সঙ্গে রিলেশনটা কী বুঝলাম না । অমিতাভ বেশ লম্বা, ফর্সা কিন্তু বেঢপ আকৃতির একটা ভুঁড়ি । লাল লাল চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সে সুরাতে আসক্ত । এই মূহুর্তেও সে মদিরার নেশায় বেশ বেসামাল । সুদেষ্ণা সুন্দরী । গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা । চোখদুটো কিন্তু বেশ ঢুলু ঢুলু । বেশ মস্তিতে আছে দলটা ।
অমিতাভ ওর ঠোঁট দুটো সূঁচালো করে অদ্ভুতভাবে মার্তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে দেখে স্থির থাকতে পারলাম না । মার্তারা আমাদের অতিথি । ওদের সম্মান রাখা আমাদের কর্তব্য মনে করে উঠে দাঁড়ালাম । মার্তা আর অমিতাভ’র মাঝে চলে গিয়ে অমিতাভকে বেশ কঠিনস্বরেই বললাম, “বেড়াতে এসেও এসব করছেন ! লজ্জা করে না আপনার ?”
সে মুখ দিয়ে অসভ্যের মতো একটা আওয়াজ করল । ভুরু কুঁচকে তাকাল আমার দিকে । ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি । “হু আর ইউ ?”
এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল । “বেশি বাড়াবাড়ি করছেন কিন্তু । আপনি এখান থেকে না গেলে আমি কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব । গেট লস্ট !” শেষের শব্দদুটো উচ্চারণ করতে গিয়ে রীতিমতো চিৎকার করে ফেলেছি নিজেই বুঝতে পারছি ।
সুদেষ্ণাকে বুদ্ধিমতী মনে হল । সে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল মাতাল স্বামীকে । অবিনাশ সামন্তও ফিসফিস করে কিছু বলল অমিতাভকে । টলতে টলতে চলে গেল দলটা ।
মাথাটা দপদপ করছে । ছোটবেলায় বাবা একটা কথা বলতেন প্রায়ই । “ধন-ধনী ঠন ঠনাঠন, শিক্ষা-রুচি মনের দান ।” মার্তাদের দিকে তাকাতেও লজ্জা করছে এখন । কী ভাবছে ওরা ! সৌরভদা আমার হাত ধরে টেনে বসাল । মার্তা হঠাৎ আমার ডানহাতটা চেপে ধরল । মুখে কিছু না বললেও বুঝলাম সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে তার অন্তরের । ক্যাটারিনা, মারজেনার মুখে স্বস্তির হাসি । সৌম্যশুভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে । এখন মনে হচ্ছে কেন যে ওভাবে রিঅ্যাক্ট করলাম ! হিরোগিরি দেখিয়ে ফেললাম নাতো ! লজ্জা লাগছে এখন । অবশ্য রিঅ্যাক্ট না করলে বড় কিছু ঘটনা ঘটে যেতে পারত । তাতে লজ্জার শেষ থাকত না বিদেশীনিদের কাছে ।
মার্তার হাতের স্পর্শে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আমার । অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে এখন । মার্তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম । মার্তার মুখে স্বস্তির হাসি ।
অবিনাশ সামন্তরা খেয়ে চলে যাওয়ার পর আমরা একসাথে খেতে গেলাম । একটা তাঁবুর ভেতরে চারটে ডাইনিং টেবিল, বড় একটা টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখা আছে । আমরা পাশাপাশি দুটো টেবিলে বসলাম ।
খাবারের মেনুতে বিশেষ কিছু নেই । ভাত, রুটি, ডাল আর আলুমটরের তরকারি । সারাদিনের পর ক্ষুধার্ত পেটে তাই অমৃত । তবু মনে হল মুসুরডালের স্বাদ বা আলুমটরের তরকারির স্বাদ অসাধারণ । আর রুটির কথা বোধহয় কোনদিন ভুলতে পারব না । আমার জীবনে এমন নরম হাতে গড়া রুটি কোনদিন খাইনি এর আগে এটা হলপ করে বলতে পারি ।
সৌম্যশুভ রুটি পছন্দ করে না একদম । ও ভাত খাচ্ছে । সৌরভদা ছেলেকে বলল, “বাবি দুটো রুটি খেয়ে দেখ না । কী নরম আর টেস্টি !”
ছেলে নীচু গলায় বলল, “তোমার ইচ্ছে হলে দুটো বেশি খেয়ে নিতে পার । আমি খাব না ।”
সৌরভদা আর আমি রুটিই খেয়েছি । মার্তারাও ।খাওয়ার পর সবাই আবার ফিরে এলাম পপলার গাছের নীচে । আমি একটু দূরে গিয়ে সিগারেট ধরাব বলে এগোচ্ছি সৌরভদা বলল, “সিগারেট খাবে তো ? আমাকেও দিও একটা । তোমাকে সিগারেট খেতে দেখলেই তো উসখুস করব একটু পরে । জানি ঠিক করছি না, তবু -” থেমে গেল সৌরভদা । ওর মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করে সিগারেট ছেলের সামনে ধূমপান করতে গিয়ে । আমারও মনে হয় ছেড়ে দিতে পারলেই ভালো হয় । আবার এও ভাবি- এতদিনের বন্ধুকে এক ঝটকায় ত্যাগ করব !”
সিগারেট শেষ করে ফিরে এসে সৌরভদার সঙ্গে আমিও বিস্মিত । মুখচোরা সৌম্যশুভ্র, স্বল্পভাষী সৌম্যশুভ্র চুটিয়ে গল্প করছে ক্যাটারিনার সাথে ! গাড়োয়াল পাহাড়ের গল্প । মার্তারাও শুনছে মন দিয়ে । সৌম্যশুভ্রর পেছন দিক দিয়ে এসেছি আমরা । প্রথমে দেখতে পায়নি আমাদের । যখন দেখতে পেল তখন থেমে গেল । গুটিয়ে নিল নিজেকে ।
“থামলে কেন ? বেশ তো হচ্ছিল ! আমরাও শুনি একটু ।” আমার দেওয়া উৎসাহেও সে উৎসাহিত হল না মোটেই । বাবা ছেলের সম্পর্কের মধ্যে যতই বন্ধুত্ব থাকুক কোথায় যেন একটা গন্ডি টানা রয়েছে । ছেলেটা কিছুতেই মুখ খুলছে না দেখেই হয়ত সৌরভদা তাঁবুতে ফিরে গেল । আমি না বসে একটু এগিয়ে গিয়ে চাঁদকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছি । চাঁদটা এখন আমাদের মাথার উপরে । জ্যোৎস্নায় ভাসছে হুন্ডারের পাহাড়, বন-জঙ্গল, ঘাসজমি । ঝরনার দিক থেকে হাওয়া বইছে বেশ জোরে । পপলার গাছের পাতাগুলো দুলছে । সাথে সাথে চাঁদও যেন দুলছে ।
ক্যাটারিনার সাথে সৌম্যশুভ্রর বেশ ভাব হয়েছে । সাদাকালোর ব্যবধান ঘুচে গেছে কিনা জানি না – তবে সময়ের প্রয়োজনেই হয়ত ওদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে । সকাল থেকে সারাদিন একটা গাড়ির মধ্যে থেকেও যা হয়নি তা হয়েছে এখন । এতে চাঁদের তো একটা ভূমিকা আছেই ।
মার্তা কখন উঠে এসেছে দেখিনি । “হাই ফ্রেন্ড ! আর ইউ এনজয়িং ? রিয়েলি ইটস এ বিউটিফুল নাইট !” চমকে পেছনে তাকিয়ে তাকে দেখলাম । খুশিতে ডগমগ সে ।
“ওহ্ ! ইয়েস ম্যাম ।”
“ডোন্ট কল মী ম্যাম ! উই আর ফ্রেন্ড । কল মী মার্তা ।” মার্তার ধমকানি, বন্ধুত্বের স্বীকৃতি, আকুতি তিনটে ছোট্ট বাক্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেল এভাবে । মুহূর্তের মধ্যে মাঝের দেয়ালটা যেন সরে গেল । আমরা কাছাকাছি চলে এলাম ।
চাঁদ আমাদের সাথে আড্ডা না মারলেও হাসিমুখে আকাশ ভ্রমণ করছে । রাত লুকোচুরি খেলছে চাঁদের আলোয় কাঁটাঝোপে ।
তাঁবুতে ফিরে দেখি সৌরভদা জেগে আছে । আমাদের দেখে বলল, “কাল সকালে আবার লং জার্নি । শুয়ে পড় সবাই । লাইট নিভিয়ে দেখি ঘুম আসে কিনা ।” সৌরভদার কথার মাঝখানেই আলো নিভে গেল । জেনারেটর বন্ধ হল বোধহয় ।
সৌরভদা বিড়বিড় করে বলল, “একটা ফোনও লাগছে না । টাওয়ার নেই । সে কী করছে কে জানে !” সৌরভদা বৌদিকে মিস করছে খুব ।
সৌম্যশুভ্র বলল, “তুমি অত চাপ নিচ্ছো কেন ? মাম্মাম ভালই আছে ।”
খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল । পাখি ডাকছে । একটা শিসের মতো আওয়াজ শুনে লাফিয়ে নামলাম ফোল্ডিং খাট থেকে । তর সইছিল না । পায়ে পায়ে কাঁটা ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলাম পাখির ডাক লক্ষ্য করে ।
সকাল সব সময়ই নতুন কিছু নিয়ে আসে । লে বেরি গাছের মাথায় একটা পাখি । আগুন রঙের শরীর । পালকে একটু ছাই রঙের ছোঁয়া । চড়ুইয়ের চেয়ে আকারে একটু বড় । চুনীর মতো টকটকে লাল গোলাকার দুটো চোখ। অসাধারণ ! আনন্দ ভাগ করে নিতে পারলে আনন্দের স্বাদ মধুর হয় । সৌম্যশুভ্র আর সৌরভদাকে ডাকতে গেলে যদি পাখিটা উড়ে যায় ? আর একজনের কথাও মনে হল- মার্তা । ক্যামেরাটাও আনিনি । ইস !
সৌম্যশুভ্র ক্যামেরা হাতে আসছে দেখে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করলাম । সে বুঝতে পেরে পা টিপে টিপে এগিয়ে এল । আনন্দে চিক্ চিক্ করে উঠল ওর চোখের তারা । নাহ্ ! ভুল করেনি সে । লেন্সবন্দী করতে পেরেছে সৌম্যশুভ্র । আর তখনই পাখিটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল কাঁটা ঝোপ পেরিয়ে, পপলারের মাথা ডিঙিয়ে দূরে – অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে ।
-কী পাখি ওটা ?
-জানি না । আমি জীবনে প্রথম দেখলাম এমন একটা পাখি ।
-আমার বাবাকে দেখাতে হবে । দেখি চেনে কিনা ।
সৌম্যশুভ্র’র দিকে তাকিয়ে মনে হল সে ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে খুব । বললাম, “পৃথিবীতে কত রকমের পাখি আছে ! সব কী আর চেনা বা জানা ! কত রকমের ঈগল আছে জানো ? সাদা কাক দেখেছো কখনো ?”
সৌম্যশুভ্র মাথা নাড়াল । সে ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে পাখিটা দেখতে লাগল মন দিয়ে । ডিজিটাল ক্যামেরা । ভালই উঠেছে ছবিটা ।
কাউকেই ডাকতে পারিনি । ডাকার প্রয়োজনটাও ফুরিয়ে গেছে পাখিটা উড়ে যাওয়ায় । তবু ওরা একে একে সবাই এল । প্রথমে সৌরভদা । পেছনে পেছনে মার্তা, মারজেনা, ক্যাটারিনা । সৌম্যশুভ্র সবাইকে দেখাল পাখির ছবি । কেউ চেনে না । কেউ দেখেনি আগে । আপশোষ হল প্রত্যেকের এমন একটা পাখি কেউ দেখতে পেল না বলে ।
অবিনাশ সামন্তদের গাড়িটা নেই । চলে গেছে কিনা জানি না । থাকলে একবার দেখিয়ে জেনে নেওয়া যেত ।
পাগলের মতো খুঁজছি আর একটা আগুনে পাখির যদি দেখা মেলে । আনন্দটা ভাগ করে নিতে পারছি না বলে খুব কষ্ট হচ্ছে । লে বেরি গাছে সূর্যের আলো এসে পড়েছে । সকাল সব সময় সুন্দর । তবে রাতের স্নিগ্ধতা নেই সকালের আলোয় । সূর্যের আলোয় ঝলকানি আছে । উষ্ণতা আছে । পুড়িয়েও দিতে পারে তাই ।
ঘুরতে ঘুরতে আমরা কখন যেন জোড়ায় জোড়ায় হয়ে গেছি । ক্যাটারিনার সাথে সৌম্যশুভ্র, মারজেনার সাথে সৌরভদা আর মার্তার সাথে আমি । মার্তা স্বল্পভাষী । আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে চোখ রেখে চলছে ঝোপের দিকে ।
রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ছে । মার্তার ফর্সা মুখে রোদ পড়ে লাল হয়ে উঠছে । ঝলসানো সুন্দরী, কিন্তু ওকে এখন আর দাম্ভিক মনে হচ্ছে না এতটুকু ।
হাসলে মার্তাকে আরো ভালো লাগে । আজ সে খুব হাসিখুশি । মাঝে মাঝে একটা দুটো কথা বলছে । যেমন সৌরভদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী, বাংলায় ফ্রেন্ড শব্দের প্রতিশব্দ কী এইসবের সঙ্গে আমাদের দেশ, বাংলা ও কোলকাতার কথাও জানতে চাইছে ।
পোলিশ সুন্দরীর সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে ভাবছিলাম একদিন প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে ভালোবেসে প্রকৃতির সাথে গাঁটছাড়া বেঁধেছিলাম । আমার জীবনে শুরু হয়েছিল এক নতুন অধ্যায় । প্রকৃতিপাঠের সঙ্গে জীবনকে বুঝতে শেখা । আসল শিক্ষার শুরু তো সেদিন থেকে । প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধের সাথে তার খামখেয়ালিপনা, প্রকৃতিকে ঘিরে জীবজগতের রহস্য, মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসা সব কিছুই আমাকে গভীরভাবে ভাবায় । জীবনটাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বুঝেছি পৃথিবীতে সবাইকেই সবার উপর নির্ভর করতে হয় । কোন একজন বিধাতার দ্বারাই হোক বা প্রকৃতির বিবর্তনের মাধ্যমেই হোক যে জীবজগৎ সৃষ্টি হয়েছে তাতে কেউই স্বয়ং সম্পূর্ণ নয় । অতি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র জীব থেকে উদ্ভিদ হয়ে মানুষ পর্যন্ত সবাই একটা শৃংখল মেনে চলছে একে অন্যের উপর নির্ভর করে ।
নারী ও পুরুষ সৃষ্টির অঙ্গ । একজন পুরুষের যেমন প্রয়োজন নারীর তেমনি নারীর প্রয়োজন পুরুষকে । শুধুমাত্র ভোগ বা বংশগতির ধারাকে বহন করার জন্য নয় মনের প্রয়োজনেও নারী-পুরুষ একে অপরের কাছে আসে ।
আজকাল অনেককিছুই ভাবি । ভাবনার কি আর শেষ আছে ? ভাবতে ভাবতে মনে হয় আত্মকেন্দ্রিকতা, লোভ, ইর্ষা মানুষের জীবনে শান্তির প্রধান অন্তরায় । সবল-দুর্বল, শোষক-শাষিত, খাদ্য-খাদকের মতো বিপরীত ধর্মী দুটো শব্দের ন্যায় নারী- পুরুষও বিপরীত ধর্মী শব্দ । স্বাভাবিক নিয়মে বিরোধটাও তাই আছে । সৃষ্টির চরম সত্য হল আবহমান কাল ধরে এটাই চলে আসছে । চলবেও । জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে আমরা নতুন কিছু ভাবার চেষ্টা করতে পারি । নতুন কিছু গড়তেও পারি । বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা, সহযোগিতা তো মানুষ মানুষের কাছেই আশা করে ।
ভাবতে ভাবতে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। কখনো কখনো মনটা ক্ষতবিক্ষতও হয় । তখন একজন বন্ধুই পারে ক্ষতের যন্ত্রণা লাঘব করতে । বন্ধু মানে নারী বা পুরুষ যে কেউ হতে পারে । তবু মনে হয় পুরুষের জীবনে নারী বা নারীর জীবনে পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক । মন দেওয়া নেওয়ার মধ্যে নারী-পুরুষের মুক্তি ।
মার্তার সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া করতে করতে খুশিতে ভরে উঠছে মন । নিজের মনেই হাসছি এখন । যাদের মন আছে তারাই তো মন দেওয়া নেওয়া করে । মন দেওয়া মানেই প্রেম নয় । প্রেম হয় শরীর এবং মনের মিলনে । একটাকে ছেড়ে শুধু একটায় আর যাই হোক প্রেম হয় না । সেটা আমি এতদিনে ভালোই বুঝেছি ।
সৌরভদা ডাকছে । জানি বেশি দেরি করা যাবে না । রেডি হতে হবে এখুনি । ব্রেকফাস্টের পরই আমরা রওনা দেব । অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে আবার । পাহাড়ের সকাল যত সুন্দরই হোক দুপুরের পর পাহাড়ের প্রকৃতিকে বিশ্বাস করা যায় না । পাহাড়ের বিকেল-সন্ধ্যা কখনো কখনো সকালের চেয়ে রঙিন হলেও ভয়ংকরও হতে পারে । কখন কীভাবে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসবে কেউ বলতে পারে না ।
(ক্রমশঃ)
View Comments
নীল যেখানে দেদার ছড়িয়ে
তপন বিশ্বাস (ধারাবাহিক ভ্রমণ উপন্যাসের সপ্তম পর্ব) ।। সাত ।।সুন্দর একটা রিসর্টে নিয়ে...