হায়দার আলীর হাভেলীতে একরাত -ভাস্কর ব্যানার্জী
১৯৯২ সালের মে মাস, অফিসে বসে কাজ করছি, হঠাৎ লাহিড়ী, আমার বাল্য বন্ধু সুনির্মল লাহিড়ী, এসে উপস্থিত ।লাহিড়ী সকলের কাছেই খুব প্রিয় কারণ ওর মধ্যে অনেক ভালো গুণ আছে। হাসি খুশি, পরোপকারী, ভালো গাইতে পারে আর একটা অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য আমরা রীতিমতো ওর ফ্যান -সেটা হলো ও খুব ভালো গল্প বলতে পারে। কোনো সামান্য ঘটনাও ওর বলার গুনে অসাধারণ হয়ে ওঠে। দেখলাম খুবই অন্যমনস্ক ।প্রশ্নকরি, “কিরে কি হয়েছে ?” ও বলে, “আজ সকালে আমি হায়দরাবাদ থেকে ফিরেছি ।এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম , তাই তোর সাথে দেখা করতে চলে এলাম।আসলে তোকে একটা ঘটনা না বলে থাকতে পারছি না।” তখন লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে আমি ওকে নিয়ে ক্যান্টিন এ বসলাম। ওকে বসিয়ে চা-জলখাবার দিয়ে জানতে চাইলাম
– তোকে এরকম লাগছে কেন ? কিছু সমস্যায় পড়েছিস নাকি ?কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো
– তুই ভূত, প্রেত মানিস?
-ছোটবেলায় ভূতের ভয় যথেষ্টই ছিল। কারণ তখন বাড়ির আসে পাশে ঝোপ ঝাড় ছিল, অন্ধকার ছিল, বড়ো বড়ো গাছ ছিল , অতএব ভূত আর সেটা নানা রকমের ,নানা গোত্রের হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এখন সেসব কবেই হারিয়ে হয়েছে মানুষের ভিড়ে। তাই ভূতের থাকার জায়গাও নেই, আর ভূত দেখার সেই ছোটোবেলা টাও নেই।
-আসলে আমার এমন একটা ঘটনা ঘটলো না -আমি কাউকে বলতেও পারছি না। জানি কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না।
লাহিড়ী তখন আমাকে সবিস্তারে ঘটনাটা বলে।
লাহিড়ী কলকাতার একটি নামি চার্টার্ড ফার্মে চাকরি করে এবং অডিটের কাজে প্রায়ই সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ায় ।এইবারে ওরা গিয়েছিলো অন্ধ্রপ্রদেশ ।অন্ধ্রের অনেক জায়গায় অডিট করে ওরা যাবে হায়দরাবাদ ।লাহিড়ীর জবানিতে ঘটনাটি বলি –
আমরা তিনজন – সুকেশ জৈন, মনোহর সিংহ এবং আমি |আমরা বিজয়ওয়াড়া থেকে একটা ট্রেনে উঠে হায়দরাবাদ স্টেশনে নামি ।ট্রেনটা বেশ লেট করেছে ।স্টেশনের বাইরে এসে আমাদের গন্তব্যের খোঁজ করতে জানতে পারি জায়গাটা শহরের বাইরে এবং বাসে যেতে হবে । দিনের শেষ বাসে উঠে পরে প্রায় ঘন্টা দুই চলার পর একটা প্রায় নিঝুম স্থানে আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে যায় বাসটা ।
বাসস্ট্যান্ডের পাশেই একটা পান-চায়ের দোকান।দোকানের মালিকের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম এখানে কোনো থাকার হোটেল নেই । তবে একটা বহু পুরোনো হাভেলি আছে সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে ।অগত্যা আমরা ওর দোকান থেকে কটা মোমবাতি এবং সিগারেট কিনে, লোকটির সঙ্গে হাভেলির উদ্দেশ্যে চলি ।হাভেলিতে ঢোকার বিশাল লোহার গেটটা ভাঙা।
আমাদের টর্চের আলোতে যেটুকু দেখলাম মনে হলো একসময় এটা একটা প্রাসাদ ছিল, এখন পরিত্যক্ত ।লোকটি আমাদের নিয়ে দোতলায় উঠলো এবং হাভেলির কেয়ারটেকারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো ।কেয়ারটেকার কিছু টাকা নিয়ে আমাদের থাকার জন্য একটা ঘরের তালা খুলে দিলো ।স্বল্প আলোয় দোতলায় ওঠবার সময় দেখলাম হাভেলির সিঁড়িগুলো প্রায় কুড়িফুট লম্বা আর দেড়ফুট চওড়া – মনে হয় পুরো হাভেলিটা সাদা মার্বেল পাথরের তৈরী । দোতলার দালানটা এতটাই চওড়া যে পাশাপাশি তিনটে লরি যেতে পারে ।আর আমাদের থাকার ঘরটা প্রায় একটা টেনিসকোর্টের সাইজ ।ঘরের দরজা – জানালাগুলো প্রায় বারো ফুটের মতন লম্বা ।জানালাগুলো পুরো কাঁচের তৈরী ।হাভেলিতে কোনো ইলেক্ট্রিক আলোর ব্যবস্থা নেই ।ঘরের মেঝে ধুলোয় ভরা । কেয়ারটেকার মেঝেটা পরিষ্কার করে দিলেন এবং বললো ঘরের দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়তে, যদি কোনো প্রয়োজন হয় তবে ওকে ডাকতে, ও দরজার বাইরেই থাকবেন ।আমরা তিনটে মোমবাতি জ্বালিয়ে , সঙ্গে আনা খাবার, জল খেয়ে শোবার প্রস্তুতি নি ।খাবার জলের ব্যাপারে আমি খুব খুঁতখুঁতে ।তাই ট্যুরে আসার সময় হাওড়া স্টেশন থেকে একটা পাঁচ লিটারের ওয়াটার বোতল কিনে নিই ।ওটা সবসময় আমার সঙ্গে থাকে ।হায়দরাবাদ স্টেশনে নেমে ওটা জলভর্তি করে নিই,কারণ অজানা জায়গায় কোথায় জল পাব কিনা তাই ।
একটা মাত্র মোমবাতি জ্বালিয়ে, মাথার কাছে জলের বোতল আর টর্চটা রেখে আমরা তিনজন শুয়ে পড়লাম – তখন ঘড়িতে বাজে রাত ১২টা বেজে ২০ মিনিট।
আমরা সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম তাই শোবার কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি ।হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙেযায় ঘুঙুরের আওয়াজে।কান পেতে শুনি, মনে হয় ঘরের বাইরে অনেক নর্তকী সুললিত ছন্দে নাচছে । আমি সুকেশ এবং মনোহরকে ডাকি ।ওরাও শুনতে পায় ঘুঙুরের আওয়াজ ।আমরা তিনজনে টর্চ এবং মোমবাতি নিয়ে, বেশ উত্তেজিত ভাবে দরজার কাছে আসি দরজা খুলতে।দরজাটা খুলতেই কেয়ারটেকার বলে, “বাবুসাব, যো শুনা ও ঠিকই শুনা ।আপলোগ শো যাইয়ে। ও লোগ আপলোগকো কোই হানি পৌঁছেগে নেহি । ম্যায় বাহারমে শো রহা হুঁ । আপলোগ মত্ যাইয়ে ।” কিনতু আমাদের বদ্ধ ধারণা এটা কেউ আমাদের ভয় দেখাবার জন্য করেছে । আমরা টর্চ এবং মোমবাতি নিয়ে এগিয়ে চলি বিশাল বারান্দা ধরে ।বারান্দার দুপাশে বন্ধ বিশাল বিশাল ঘর । ঘরগুলোর কাচের জানালায় আলো ফেলে দেখতে চেষ্টা করি ঘরের ভেতর কি আছে । অস্পষ্ট ভাবে নজরে আসে বিশাল বিশাল বাধানো অয়েলপেইন্টিং, পুরোনোদিনের আসবাবপত্র ।সব ধুলায় ধূসরিত ।বেশ কিচ্ছুক্ষণ হাঁটার পর দালানের শেষেপ্রান্তে এসে পৌঁছই, দেখি একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি জঙ্গলাকীর্ণ বাগানের মধ্যে নেমে গেছে । আমরা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরেআসি ।কেয়ারটেকার বিলাপ করে বলে সে জানতো আমরা কিছু পাবো না , শুধু শুধু হয়রানি….. ইত্যাদি ।
আমরা ঘরে ঢুকে দরজা, জানালাগুলো ভালো ভাবে বন্ধ করে দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে শুয়ে পড়ি ।হঠাৎ আমাদের ঘুম ভেঙে যায়, মনে হচ্ছে একদল অদৃশ্য নর্তকী আমাদের ঘিরে নেচে চলেছে ।প্রথমে আমরা থমকে যাই , টর্চ জ্বালিয়ে কিছু দেখতে পাই না ।টর্চ নেভালে আবার শুরু হয় নাচ । আমাদের শরীরের লোমকূপগুলো খাড়া হয়ে ওঠে, শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা কিছু নাবছে অনুভব করি । আর এক মুহূর্ত দেরি না করে যে যার ব্যাগ, চাদর নিয়ে ঘরের দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করি ।কেয়ারটেকার অনেক চেষ্টা করে আমাদের থামাতে ।সব থেকে অবাক ব্যাপার , তাড়াহুড়োতে আমার পাঁচ লিটারের জলের বোতলটা আনতে ভুলে যাই, ওটা ঘরেই থেকে যায়, জলের বোতলটা কে যেন সিঁড়ির শেষ ধাপে যত্ন করে বসিয়ে রেখে গেছে । ভয়ে আমরা কেউ বোতলটা স্পর্শ করি না । বাকি রাতটা আমার হাবেলীর বাইরে রাস্তায় বসে কাটিয়ে দিই ।
সকাল হতে আমরা স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে জানতে পারি, ওটা ছিল টিপু সুলতানের বাবা, হায়দার আলীর প্রাসাদ ।হায়দার আলীর অনেক বাঈজী এবং বিবি থাকতো ওই প্রাসাদে । হায়দারআলীর নাচ পছন্দ না হলে বাঈজীদের জ্যান্ত গেথে দিতো ওই প্রাসাদের দেয়ালে । এরকম অনেক অনেক বাঈজীদের কঙ্কাল আছে ওই অভিশপ্ত হাভেলিতে ।তাদের অতৃপ্ত আত্মার ঘুঙুরের আওয়াজ আজও শোনা যায় ওই অভিশপ্ত প্রাসাদের অলিন্দে অলিন্দে, যেমন আমরা তিনজন শুনলাম ।
এটা কি তুই বিশ্বাস করতে পারবি? না বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবি ?
View Comments
প্রবাহ- তপন বিশ্বাস (শেষ পর্ব)
১৯৯২ সালের মে মাস, অফিসে বসে কাজ করছি, হঠাৎ লাহিড়ী, আমার বাল্য বন্ধু সুনির্মল...