Sankars Creation

তপন বিশ্বাস

।। পাঁচ ।।

ব্রেকফাস্ট পিৎজা দিয়ে সারলাম সৌম্যশুভ্রর জন্যে । ওর পছন্দের খাবার । লাদাখের স্পেশাল মিন্ট-টী ভাল লাগল না । চা-পাতা, পুদিনা পাতার সঙ্গে আর কি কি দিয়েছে কে জানে !
বাজারের শেষপ্রান্তে মসজিদ । রাজা সেংগে নামগিয়াল মুসলিম মায়ের জন্য তুর্কি আর ইরানী স্থাপত্যে গড়িয়েছিলেন এই মসজিদ । মসজিদে এখন ধোয়ামোছার কাজ চলছে । ভেতরে ঢোকা গেল না । মসজিদের সামনের রাস্তা দিয়ে লেহ প্রাসাদে যাবার একটা পথ আছে । অনিয়ন্ত্রিত বাড়ি নির্মাণের ফলে সরু ঘিঞ্জি হয়ে গেছে সে পথ । একটু এগোতেই বুঝলাম এ পথটা শুধু ঘিঞ্জি নয় চড়াই ভাঙতে হবে । একটার গায়ে একটা বাড়ি লেপ্টে রয়েছে । আর এক বিপদ হল কুকুর । লোমশ আর ভয়ংকর চেহারার কুকুরগুলো রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে । সৌম্যশুভ্র ওর বাবার পেছনে পেছনে চলছে । “ও কুকুরকে খুব ভয় পায় ।” বলল সৌরভদা ।

সৌম্যশুভ্রর ভয়ার্ত মুখ আর আমাদের অস্বস্তির মধ্যে কুকুরগুলো নিরুত্তাপ । আমাদের দেখা কুকুরদের মতো চিৎকার করছে বা তেড়ে আসছে না । ওরা বোধহয় অতিথিদের বিড়ম্বনায় ফেলতে চায় না । রোদের তাপ বাড়ার সাথে শরীর আর্দ্রতা হারাচ্ছে বুঝতে পারছি । টুপি বা ছাতা কিছুই সঙ্গে আনিনি । কোথাও এক টুকরো ছায়া তো দূরের কথা মাথার উপর এক টুকরো মেঘেরও দেখা নেই । এতটা এসে ফেরার কথা না ভেবে আশায় আশায় এগোই।ক্লান্ত সৌম্যশুভ্র পথের উপরেই বসে পড়তে চায় দেখে বাবা পকেট থেকে রুমাল বের করে ওর মাথায় ধরে।সৌম্যশুভ্রর তাতেও আপত্তি, বাবার হাত সরিয়ে দেয় সে।
প্রায় দু’ঘন্টা পথের সাথে লড়াই করে রোদ্রে চাঁদি গরম করে রাজপ্রাসাদে পৌঁছানো গেল অবশেষে । তিব্বতের রাজধানী লাসার বিখ্যাত পোটালা প্রাসাদের অনুকরণে এটিরও নির্মাণ করান রাজা সেংগে নামগিয়াল। পাহাড়ের মাথায় প্রায় দূর্গের আকারে তৈরি ন’তলা এই প্রাসাদ নামগিয়ালের স্মরণীয় কীর্তি । কাঠ আর মাটি দিয়ে গড়া হয়েছিল এই প্রাসাদ । ডোগরা রাজাদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই রাজপ্রাসাদের দেয়াল, অলিন্দ ।
প্রাসাদের প্রত্যেকটি কক্ষে ঢুকতে হয় মাথা নীচু করে উচ্চতা এতটাই কম দরজার । এটা রাজভক্তি প্রদর্শনের জন্য করা হয়েছিল না অন্য কোন কারণে জানি না।প্রাসাদের ভেতরটা গোলোক ধাঁধার মতো । আধুনিক মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং-এ যেমন অনেক ঘর থাকে এক একটা ফ্লোরে তেমনি আর কি । ঘরের সামনে টানা বারান্দা হঠাৎ হঠাৎই টার্ন নিয়েছে ডাইনে বাঁয়ে । কোন একটা জায়গা থেকে হঠাৎ সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের তলে ওঠার । হয়ত শত্রুদের বিভ্রান্ত করার জন্যেই এসব ব্যবস্থা করা হয়ে থাকবে । অনেক ঘরই ভেঙে পড়েছে কালে কালে । ধুলো, মাটি আর কাঠের স্তূপ । রাজদরবার কক্ষটা প্রায় অক্ষত আছে বা সংস্কার করা হয়েছে । রাজ সিংহাসন, পাত্রমিত্র, অভ্যাগতদের বসার আসন সবই সঠিক জায়গায় রয়েছে । দেয়ালে সুন্দর সব অয়েল পেন্টিং, মেঝে কার্পেটে মোড়া।দরবার কক্ষের ভেতরটা অন্যান্য ঘরের তুলনায় ঠাণ্ডা,হয়ত দরবার কক্ষের গুরুত্ব ভেবেই এই ঘরের স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল ।
প্রাসাদের অনেক কক্ষেই দেয়ালে অয়েলপেন্টিং, দেয়াল জুড়ে আঁকা বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা সযত্নে রক্ষা করা হচ্ছে পর্যটকদের কথা ভেবে । প্রাসাদ শীর্ষে বৌদ্ধমন্দির । অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের বিশাল স্বর্ণমুর্তি । থংকাস, বৌদ্ধপুঁথিও পান্ডুলিপির সংগ্রহও দেখার মতো ।
প্রাসাদ শীর্ষ থেকে নেমে ধূলিধূসরিত পথে চলতে চলতে রাজপ্রাসাদের অলিন্দে উপস্থিত হলাম । কয়েকজন বিদেশী ঘুরে ঘুরে দেখছে । একজোড়া যুবক- যুবতী পাশাপাশি বসে গল্প করছে । কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে অতিথিদের জন্য । অলিন্দের ছাদ, প্রাসাদের বাতায়ন সবই পপলারের । সরু সরু ডাল পাশাপাশি সাজিয়ে তৈরি । শুকিয়ে গেলে বেতের মতো হয় পপলারের শাখাগুলো । পপলারের কাণ্ড ব্যবহার হয় কাঠামোর জন্য । এখানে পপলার ছাড়া বড় গাছ হয় না তেমন, পপলারই ভরসা বাড়ি নির্মাণে ।
লেহ শহরটাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এখান থেকে । নীল আকাশের নীচে ধূসর পাহাড়ের গায়ে প্রাচীন মাটির ঘরবাড়ি শহরের প্রাচীনত্ব থেকে ইতিহাসকেও মনে করায় । পাহাড়ের নীচে উপত্যকায় আধুনিক শহর লেহ আধুনিক স্থাপত্যে গড়ে উঠেছে । যেখানে এয়ারপোর্ট, বাজার, স্কুল কলেজ সবই আছে ।
বাঁদিকের রুক্ষ এক পাহাড়ের মাথায় পদ্মাসনে বসা বুদ্ধমুর্তি । শুধু লাদাখ নয় পৃথিবীর প্রায় সব বুদ্ধমুর্তিই সোনালি । কোনটা সোনার, কোনটা গোল্ডপ্লেটেড, কোনটা বা সোনালি রঙ করা ।
ডানদিকে আর এক পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল শান্তিস্তূপ । প্যাগোডাধর্মী এই শান্তিস্তূপ তৈরি হয়েছে জাপানী সহায়তায় । রাজগীরের শান্তিস্তূপ আর লেহ’র শান্তিস্তূপ একই আদলে তৈরি ।
শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে পপলার গাছে ঘেরা ছোট ছোট গ্রাম, শস্যক্ষেত আর সিন্দুনদ । নীল, সবুজ,সাদা আর ধূসরের এক অপূর্ব মেলবন্ধন । মনে গেঁথে গেল ছবিটা ।
সিংগেচু হল সিন্ধুনদের লাদাখি নাম । সিংগেচু’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল লেহ। লাদাখের রাজধানী। লাদাখ এক সময় সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল । আক্রান্ত হয়েছে বারবার । কখনও তিব্বত, কখনও কাশ্মীর দখল নিতে চেয়েছে লাদাখের । লুঠ করতে এসেছে বালতিক, তুর্কিরা । মোঘলরা এসেছে । আক্রমণকারীদের সবাই ফিরে যায় না, কেউ কেউ থেকে যায় আক্রান্তদের মাঝে । সেভাবেই হিন্দু, বৌদ্ধ আর ইসলাম ধর্মের মিলন ঘটেছে কালক্রমে ।
লেহ’র রাজপরিবার লেহ প্যালেস বিক্রি করে দিয়েছে ভারতের প্রত্নতাত্তিক বিভাগকে । রাজপরিবারের উত্তরপুরুষেরা লেহ শহর থেকে একটু দূরে স্টক প্যালেসে বাস করছে এখন । ভারতীয় প্রত্নতাত্তিক বিভাগ ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে । সংরক্ষণ করছে প্রত্নতাত্তিক সামগ্রী । ইতিহাস কথা বলে অলিন্দে, রাজদরবারে, কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে । গৌতম বুদ্ধের বাণী ছড়িয়ে দেয় আগত মানুষের মধ্যে । পীড়িত মানুষের শান্তির সন্ধানে একদিন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন কপিলাবস্তুর যুবরাজ । কঠিন তপস্যায় লাভ করেছিলেন বোধিজ্ঞান । একসময় লাদাখও গ্রহণ করেছে তাঁর বাণী । লাদাখের সিংহভাগ মানুষ এখনও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । লেহ শহর থেকে লাদাখের গ্রামে গ্রামেও তাই গুম্ফার ছড়াছড়ি ।
সৌম্যশুভ্র বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে । জিজ্ঞেস করলাম, “ইতিহাস খুঁজছো ? তুমি তো বাবা ইতিহাসের ছাত্র নও !”
-নাহ্ ! খুব কৌতুহল হচ্ছে তাই দেখছি । এক সময় রাজারানী, রাজপুত্র-রাজকন্যারা এই মাটির প্রাসাদে বাস করত । হয়ত এসব ঘর ভাল করে খুঁজে দেখলে অনেককিছু পাওয়াও যেতে পারে । উপরের বৌদ্ধ মন্দিরে কত মূল্যবান জিনিস রয়েছে । আচ্ছা, বুদ্ধদেবের মুর্তিটা কি সোনার ? আংকেল, লেহ-লাদাখের উপরে একটা গোয়েন্দা কাহিনী লেখ না । আমি শুনেছি বৌদ্ধমঠ- মন্দিরে সোনা, দামী পাথর, সোনার জলে লেখা মুল্যবান বই থাকে । তিব্বত আর তিব্বতের কাছাকাছি অঞ্চলের বৌদ্ধগুম্ফাগুলোতে নাকি বেশি । কি একটা গোয়েন্দা কাহিনীতে পড়েছিলাম প্রজ্ঞাপারমিতার কথা । মনে পড়ছে না এখন । প্রজ্ঞাপারমিতা কী ?
সৌরভদা ছেলের কথা শুনছিল । ওর কথা শেষ হতেই বলল, “হ্যাঁ, যা শুনেছিস তার অনেকটা ঠিক । স্বর্ণ বুদ্ধমুর্তি অনেক আছে । আবার গোল্ডপ্লেটেড তামা বা ব্রোঞ্জের মুর্তিও প্রচুর আছে।মুল্যবান পাথর আছে । তবে গুম্ফার সবচেয়ে বেশি মুল্যবান জিনিস হল বৌদ্ধপুঁথি, থঙ্কাস, পেন্টিং এসব । অ্যান্টিক ভ্যালু প্রচুর । সোনা, রুপো আর ভেষজ কালিতে লেখা হত তখন । বহু পেন্টিং আছে যা কী দিয়ে আঁকা হয়েছিল তা নিয়ে গবেষনা চলছে এখনও । আর প্রজ্ঞাপারমিতা হল কীভাবে নিম্ন মেধা থেকে উচ্চ মেধায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়, জীবনের এক স্তর থেকে আর এক স্তরে উত্তীর্ণ হওয়া যায় তেমন এক সূত্র । সবই সোনার জলে লেখা । সোনা ছিল তিব্বতে সহজলভ্য । সম্ভবতঃ লাদাখেও সোনা সহজলভ্য ছিল । তাই সোনার কাহিনী কিছুটা সত্য তো বটেই । তবে আমাদের সোনার সংসারের উপর মোহ থাকলেও কারোর স্বর্ণতৃষ্ণা নেই নিশ্চয়ই ? চল, আমরা বরং বর্তমানে ইতিহাস খুঁজি বেড়াই । কতকিছু এখনও দেখা হয়নি ।”
সৌরভদা কতকিছু জানে ! আমি জানি না এসব । শুধু ভাবি, শাসক বদলায়, ধর্মেও বদল ঘটে । রাজ্য-রাজনীতি পাল্টায় । মানুষ বেঁচে থাকে বাঁচার তীব্র ইচ্ছেকে সম্বল করে । কঠিন লড়াই করতে হয় শাসক ও প্রকৃতির সঙ্গে ।এখানকার রুক্ষ-শুষ্ক প্রকৃতির সাথে লড়ে বেঁচে আছে মানুষ।বৃষ্টি প্রায় হয়ই না লাদাখে । বছরের চারমাস- জুন থেকে সেপ্টেম্বর বাদে বাকিটা তীব্র শীতের কবলে থাকে লাদাখ । আটমাস ধরে চলা শীতকালে পাহাড়, ঘরবাড়ি ঢেকে যায় বরফে । নদীর জল জমে বরফ হয়ে যায় । মানুষের তখন কী ভীষণ কষ্ট ! বাকি চারমাসে তাই লাদাখিরা চাষবাস করে । দোকান-বাজার জমে ওঠে । নানা উৎসব পালন করে । জমকালো পোশাক পরে নাচে লাদাখের নারী-পুরুষ । টিভির পর্দায় দেখেছি সেসব ।
লেহ প্যালেস থেকে জ্বলন্ত সূর্যকে মাথায় নিয়ে ফিরলাম আবার । তবে এবারের পথটা ছিল অনেক স্বস্তির । সূর্য কিছুটা হেলে পড়ায় বাড়ির ছায়ায় ছায়ায় উৎরাই পথে গড়গড়িয়ে নেমেছি । মনটাও বেশ তৃপ্ত । অপার্থিব একটা আনন্দ অনুভব করছি।সম্পূর্ণ ভিন্ন নতুন এক জগতের সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ কাটানো গেছে। ভ্রমণে এটাই তো মজা ।
শুকনো কাঠ, ধুলো-মাটি আর বর্ণময় প্রাসাদের শীর্ষে অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের প্রসন্নহাসি হৃদয় ছুঁয়ে গেছে । ধর্ম-অধর্ম জানি না, মানুষের জীবনে চাই শান্তি । এক টুকরো পৃথিবী নিয়ে বাঁচা যায় না । বাঁচতে গেলে সমগ্র পৃথিবীকেই বাঁচাতে হবে ।
সৌম্যশুভ্র কিছুতেই অ্যাপ্রিকট জুস খাবে না । সৌরভদা রেগে গেছে ভীষণ, “খেয়ে দেখ না,ভাল লাগবে ।” ছেলে বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমরা খাও না ! আমি কোল্ড ড্রিংক্স খাব ।”
-চিনেছিস এক কোল্ড ড্রিংক্স ! শরীরে ফ্যাট বাড়া ছাড়া আর কোন উপকার আছে ? তোকে কিন্তু আগেই বলেছিলাম, বেড়াতে গিয়ে সেখানকার খাবার খাবি । প্রকৃতি জীবনের রসদ জুটিয়ে রাখে । ডিফারেন্ট আবহাওয়ায় খাবারও তাই ডিফারেন্ট হয় । লাদাখ অঞ্চলে অ্যাপ্রিকট প্রচুর কেন হয় জানিস ? এই রকম ওয়েদারে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে । তাই খাদ্য হিসেবে, পানীয় হিসেবে এমনকি স্কিন কেয়ারেও ব্যবহার করা হয় । খেয়ে দেখ শরীরের জ্বালাও মিটে যাবে তেষ্টা মেটার সঙ্গে সঙ্গে । সৌরভদার এত কথার পরও সৌম্যশুভ্র ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল ।
বড় একগুঁয়ে তো ছেলেটা ! একগুঁয়েমি মানসিকতা অনেক সময়ই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । ছেলেটার বোঝা উচিত বাবা ছেলের ভালর জন্যে বলছে । ছেলেটার দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা দেখে সৌরভদা খেপে গেল আরও, “বুক টান করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিস না নাকি !”
আমার খাওয়া হয়ে গেছিল । যা তেষ্টা পেয়েছিল ! ক্ষুব্দ পিতাকে শান্ত করতে এক গ্লাস অ্যাপ্রিকট জুস নিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম, “একটু খেয়ে দেখ না । বাবা এত করে বলছেন । বাবার কথা রাখতেই না খেলে ।” আমার নরম অনুরোধে কাজ হল। সৌম্যশুভ্র হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা ধরল । নাকের কাছে নিয়ে গুন্ধ শুঁকল প্রথমে । তারপর নাক-মুখ কুঁচকে চুমুক দিল গ্লাসে ।
আমার কিন্তু বেশ ভাল লেগেছে অ্যাপ্রিকট জুস । সৌরভদা বলল, “বেশ খেতে কিন্তু । সুস্বাদু । আপেল জুসের মতোই কনসেনট্রেটেট জুসে জল মিশিয়ে তৈরি । বাবি কিন্তু আপেল জুস খুব পছন্দ করে । কেন যে এটা খেতে চাইছিল না !”
সৌম্যশুভ্র যেন অতিকষ্টে জুসটা পুরো শেষ করল । সত্যিই ভাল লাগেনি না প্রথম থেকে না করছিল বলে বাবাকে দেখাচ্ছে ভাল লাগেনি, বোঝা দায় আমার পক্ষে । কোল্ড ড্রিংক্স কিন্তু ছাড়ল না । বাবাকে বলল, “একটা কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল নাও । ঘরে নিয়ে যাব।” নিতেই হল ছেলের আবদার রাখতে । শুধু সৌরভদা নয় প্রায় সব বাবারাই বোধহয় এমন হয় !
ঘরে এসে সৌম্যশুভ্র শরীরটাকে ছুঁড়ে দিয়েছে বিছানায় । কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া সৌম্যশুভ্রর দেখার চোখ আছে, প্রকৃতির রূপ-রস গ্রহণ করার ইচ্ছে আছে, সামর্থ্য কম । অশক্ত, নড়বড়ে শরীর । সৌরভদা তাই গজগজ করছিল, “ক’মাস আগে থেকেই বলছিলাম একটু শরীর চর্চা করতে । শুনলি না তখন । পারবি তো শেষে ?” ছেলে উত্তর দিল না এবার । আমার মনে হল বাপ-বেটার মধ্যে একটু পার্সোনাল কথাবার্তা হোক । এটার প্রয়োজন আছে । যা ভাবা তাই । বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । নাহ্, একটু ওপরে কেমন হয় ! সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম ছাদে ।
সামনে ধূসর পাহাড়ের মাথায় দুধসাদা শান্তিস্তূপ । খুব কাছে মনে হচ্ছে । সোনালি- সবুজ রঙের কারুকাজ করা মাঝে । সূর্যের ঝলসান রোদ্রে পুড়ছে শান্তিস্তূপ । বিষন্ন দুপুর উদাসীনকে আরো বেশি উদাসী করে দিতে ভালই জানে । লেহ শহরটা যেন নীরবতা পালন করছে এখন । গাড়ির আওয়াজ নেই, মোটর সাইকেল বা অন্য কোন যানবাহনও বোধহয় চলছে না । বেড়াতে এসে ভরদুপুরে এভাবে ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হবে ভাবিনি । এক দু’দিন লাদাখের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেবার জন্য এটুকু সহ্য করতেই হবে । আজ আমাদের অ্যাক্লিমেটাইজেশন ডে ।
ছাদে যে জায়গায় একটু ছায়া পড়েছে জলের রিজার্ভারের সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম । জমীর কখন ছাদে এসেছে টের পাইনি । নিঃশব্দে চলে লোকটা । “সেলাম বাবুজী”- চমক ভাঙল ওর কন্ঠস্বরে । বেশ সুন্দর করে কথা বলে জমীর । বসির খানের চেয়ে অনেক টাফ চেহারা কিন্তু কন্ঠস্বর মোলায়েম । “বড়ী ধুপ । এক হপ্তা পহলে ইঁহা বহুত বারিষ থা । ছে’দিনসে চলা বারিষ । এত্না বারিষ ম্যাঁয় নে তো কভী নেহী দেখা লাদ্দাখ মে ।” লাদাখিরা লাদ্দাখ উচ্চারণ করে । “বহুত ঠণ্ডা থা ।” বলল জমীর ।
কয়েক বছর আগে হড়পা বানে লাদাখের প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল । টিভির নিউজে দেখেছি । সারা পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে । যেখানে বৃষ্টি হবার কথা সেখানে তো মাঝে মাঝেই বৃষ্টির আকাল ! যেখানে বৃষ্টি কম হয় সেখানে বন্যা ! উষ্ণতা বাড়ছে মেরু অঞ্চলের । গলে যাচ্ছে হিমবাহ । পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে প্রতিবছর । সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, কমছে ভূগর্ভের জল ।
হঠাৎ একটা হাল্কা মেঘের পালক উড়ে এল শান্তিস্তূপের মাথায় । লেহ’তে দেখা প্রথম মেঘ । তবু তো মেঘদূতের দেখা মিলল ! সৌরভদা আর সৌম্যশুভ্রকে দেখাতে পারলে ভাল লাগত । ডেকে আনব কিনা ভাবছি । জমীরকে একা ফেলে রেখে যাওয়াটা অশোভন দেখাবে কী যে করি ! জমীরকে বলাও যায় না । আমার বালখিল্য আচরণে হাসবে সে ।
সৌরভদাকে ডাকতে হয়নি।আমার অনেকক্ষণের অনুপস্থিতিতে সে নিজেই এসেছে আমার খোঁজে “আহ্ !” দেখা মাত্রই বিস্ময় সূচক আওয়াজ বেরিয়ে এল সৌরভদার মুখ থেকে । বলল, “বাবিকে ডেকে আনি । দেখুক ছেলেটা । খুশি হবে ।” সৌরভদা ছুটল ছেলেকে ডেকে আনতে । জমীর হেসে বিদায় নিল । ও হয়ত ভাবছে, সব ক’টা পাগল !
রোদ একটু নরম হতেই বের হওয়ার তোড়জোড় শুরু করলাম আমরা । সৌম্যশুভ্রর একটু সময় বেশি লাগে । ওয়াশরুমে গিয়ে জামাকাপড় পাল্টায় সে । কীসের যে ওর এত লজ্জা !
বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য খুব ব্যস্ত ছিলাম । কিছু খাওয়া দরকার । তাছাড়া খানের অফিসেও যেতে হবে । পথে নামতেই মুক্তির স্বাদ বয়ে নিয়ে এল বাতাস । হোক না গরম হাওয়া, মাথায় রোদটা তো লাগছে না ।
হলুদ রোদ্দুরে লেহ এখন আড়মোড়া ভাঙছে । পর্যটক মরসুম এখনও তেমনভাবে শুরু হয়নি । পথে ভিড় নেই । দু’চারজন বিদেশী-স্বদেশী টুরিস্ট ছাড়া লোকাল লোকই পথে বেরিয়েছে । ফোর্ট রোডে যারা দোকানে দোকানে ঘুরছে তারা বেশির ভাগই বাঙালি । তিব্বতী রিফিউজি সেন্টারে সারি সারি দোকানে ওদের হাতের তৈরি কার্পেট, পর্দা, অলঙ্কার, পেতলের বাসন, বুদ্ধের মুর্তি, রকমারি অস্ত্রশস্ত্র সাজিয়ে রেখেছে টুরিস্টদের কাছে বিক্রির আশায় ।
লাদাখের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও মুসলিম জনসংখ্যা খুব একটা কম নয় । লাদাখি ভাষার সঙ্গে তিব্বতী, উর্দু, হিন্দীও চলে লাদাখে । তিব্বতী ভাষা আর লাদাখি ভাষার মধ্যে মিল খুব ।
খান বেশ উৎফুল্ল আজ । সাদরে গ্রহণ করল আমাদের । জানাল, কাল সকাল আটটায় গাড়ি । পোল্যান্ডের তিনজন যাচ্ছে আমাদের সাথে । খানের ভাষায়, “থ্রী বিউটি ফুল লেডী আর গোয়িং উইথ ইউ !”
ইনার লাইন পারমিট হয়ে গেছে । পাঁচ-ছটা কপি করে সঙ্গে রাখতে হবে । সাউথপুল ও নর্থপুলে দুটো কপি তো লাগবেই, এছাড়া অন্যত্র আরো লাগতে পারে । ভারতীয়দের জন্য অবশ্য তেমন কড়াকড়ি নেই । বিদেশীদের ব্যাপারে কড়াকড়ি একটু বেশি তাই সঙ্গে যেহেতু বিদেশীরা আছে তাই পারমিটের কপি বেশি রাখাই ভাল । এটা খানের অভিমত । খানকে যতটা অসভ্য মনে হচ্ছিল ততটা এখন মনে হচ্ছে না । বলার ধরণটা খুব ভাল না হলেও কথায় একেবারে পাক্কা । টাকা পয়সা সবই মিটিয়ে দিতে হল আজ । এ ব্যাপারেও খান পাক্কা ব্যবসায়ী ।
ফোর্ট রোডের মোড়ে বাংলা শুনে দাঁড়াতেই হল । মাতৃভাষার টান এমনই । সেই অনেকদিন আগের ঘাটশিলার পথে পরিচয় হওয়া অনিকেত জানার কথা মনে পড়ে গেল । “দেশের মাটিতে যতই আমরা পরস্পরের সাথে লড়াই করি না কেন, বিদেশে আমরা বন্ধু হয়ে যাই । তখন মনে হয় আমরা একই মায়ের সন্তান । আমাদের মাতৃভাষা এক ।”
দলে পাঁচজন । সবার বয়সই পঞ্চাশের কোঠায় । প্রত্যেকের গায়ে জ্যাকেট । বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত না হলেও সতর্ক ওরা । সাবধানের মার নেই । দিনের বেলা রোদের তাপে জ্বললেও সন্ধ্যের পর তেমন গরম নেই । তাছাড়া এটা লাদাখ । যে কোন মুহূর্তে আবহাওয়া খারাপ হয়ে যেতে পারে ।
সৌরভদার সাথে খুব জমে গেছে ফর্সা চৌকো মুখের ভদ্রলোকের । ওরা আজই এসেছে কারগিল থেকে । শ্রীনগর থেকে একটা জাইলো গাড়ি ভাড়া করে এসেছে । হুণ্ডার, প্যাং গং লেক সোমোরিরি রয়েছে ওদের ভ্রমণ তালিকায় । লাদাখ থেকে মানালি হয়ে শিমলা । একই অফিসে চাকরি করে ওরা । ভ্রমণের শখ ও সামর্থ দুইই আছে । লাদাখের দুর্গম পথে কেউ ফ্যামেলি আনেনি । “বউ বলেছিল, যেখানে আমাদের নিয়ে যেতে পার না, সেখানে না গেলে কি হয় ?” চৌকো মুখের উক্তি ।
সৌরভদা উত্তরে বলল, “আনতে পারতেন । অনেক মহিলাই তো আসে ।”
“মেয়েরা কেউ যাচ্ছে না, আমি একা যাব কী করে ! তাছাড়া বান্টিও যেতে চাইছে না । ওর তো পাহাড়ে বমি হয় জান । বউ এই কথা বলেছিল । তাই ওদের না নিয়েই চলে এসেছি । ওদের জন্য লাদাখ ঘোরা মিস করতে চাইনি ।” চৌকো মুখের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে আমার অংশুমানের কথা মনে হল ।
বন্ধুদের মধ্যে থেকে একজন মন্তব্য করল, “পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, নইলে খরচ বাড়ে ।” ওনার কথায় পাত্তা না দিয়ে চৌকো মুখের ভদ্রলোক সৌরভদাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে ভাল ভাতের হোটেল কোথায় আছে জানেন ?”
-ভারতবর্ষের কোন টুরিস্ট স্পটে বাঙ্গালির প্রিয় ভাতের হোটেল থাকবে না তা তো হয় না।আছে নিশ্চয় । খোঁজ করা হয়নি এখনও। কারণ আমার ছেলের প্রিয় খাবারের তালিকায় ভাতের নাম নেই । ওর যে সব প্রিয় খাবার সে সব খাবারের প্রচুর রেস্টুরেন্ট আছে এখানে । যস্মিন দেশে যদাচার – আমরা সে কথা মনে রেখে চলছি ।”
সৌরভদা বেশ কায়দা করে বললেও ভদ্রলোকের ঠিক মন ভরল না বোধহয় । বললেন, “আমাদের আবার ভাত না হলে চলে না । ভাতের হোটেল না পেলে গেস্ট হাউসের মালিককে বলব আলুসেদ্ধ আর ভাত ফোটানোর ব্যবস্থা করে দিতে কাল থেকে । আজ রাতটা না হয় কিছু একটা দিয়ে চালিয়ে নেব । পাঁচ কেজি চাল আর পাঁচ আলু নিয়ে এসেছি । নর্থবেঙ্গলের নামকরা সুগন্ধী কালো ননীয়া চাল । আলুসেদ্ধ দিয়ে মেরে দেব, ব্যস !” হাসিতে উদ্ভাসিত ফর্সা চৌকো মুখ ।
খাঁটি বাঙালি মার্কা চেহারা না হলেও কথায় পুরো বাঙ্গাল । চৌকো মুখের সঙ্গে মানানসই চওড়া কপাল মুখের কাঠিন্য বজায় রাখলেও ভদ্রলোক বেশ রসিক মনে হয়।শরীরটা এখনও বেশ ছিপছিপে রেখেছেন । মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোকের গলার আওয়াজটা বেশ জোরালো । বাজখাই গলা । মিষ্টতা নেই । দাড়িগোঁফ বিহীন মুখে যা বেমানান । সৌরভদার মতো মানুষের সাথে কী করে জমে গেল কে জানে ! চুম্বকীয় তথ্য মেনে জুড়ে গেছে বিপরীত মেরুর দুটো মানুষ ।
“ভাতের হোটেল পেলেও মাছ বোধহয় পাবেন না ।” ওরা দুজনই শুধু কথা বলছে আর আমরা শুধু শ্রোতা তাই ভেবে কথাটা বলা । আমার কথা শুনে আমার দিকে এক ঝলক দেখে কোন পাত্তা না দিয়ে বাজখাই গলায় কাউকে লক্ষ্য করে বলল, “সন্দীপ, দেখ তো চায়ের দোকান আছে নাকি আশেপাশে ?”
সৌরভদা মাথা দোলাল, “কাছাকাছি চায়ের দোকান একটাও নেই । ইনফ্যাক্ট এখানে শুধু চায়ের দোকান একটাও দেখিনি । চা খেতেও রেস্টুরেন্টে ঢুকতে হয় ।”
“চা ছাড়া আমাদের চলবে কী ভাবে ?” মুহূর্তের মধ্যে রাজ্যের বিতৃষ্ণা সব তার মুখে ছড়িয়ে পড়ল ।
“এখানে কয়েকটা জিনিসের টেস্ট নিতে ভুলবেন না কিন্তু । অ্যাপ্রিকট জুস, তিব্বতী চা, লাদাখি চা আর মিন্ট-টী। সব কটাই এই ওয়েদারে খুব উপকারী । আমরা অ্যাপ্রিকট জুস আর মিন্ট-টী খেয়েছি । জুসটা খুব ভালো লেগেছে কিন্তু মিন্ট-টী ভালো লাগেনি । লাদাখি চা আর তিব্বতী চা দুটোই মাখন, নুন, ইয়াকের দুধ দিয়ে বানানো হয় । খাওয়া হয়নি এখনও । তবে শীঘ্রই খাব ।” সৌরভদার কথা শেষ হতে না হতেই সৌম্যশুভ্রর, “ছ্যাঃ !”
চৌকো মুখের ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে বেশ কড়াভাবে বললেন, “তুমি ছ্যা’ করলে কেন ?”
সৌম্যশুভ্র উত্তর দিল না কোন।সৌরভদা পুত্রের অসভ্যতার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে বলল, “ও এরকমই । চিকেন ছাড়া সবই অখাদ্য ওর কাছে ।”
ভদ্রলোক সহজে ছাড়ার লোক নন বোঝা গেল ওনার কথায়, “কোন খাবারকে ছ্যা করতে নেই । যা তোমার কাছে অপছন্দের তা হয়ত আর কারোর কাছে পছন্দের । এই তো আমিই সব খাবার পছন্দ করি না । তাই বলে অন্য খাবারকে তো তাচ্ছিল্য করি না । ‘আপ রুচি খানা’ কথাটা সঠিক, কিন্তু না পেলে যেখানে যা পাওয়া যায় তাই তো খেতে হয় । না খেয়ে তো থাকা যায় না ? ওরা যখন খাচ্ছে তখন সেটা নিশ্চয়ই খাবার, বিষ নয় ।” ভদ্রলোক বেশ কড়া ধাতের বোঝা গেল । অবাধ্য ছেলেদের শাসন করতে জানেন ।লজ্জায় সৌরভদার মাথা কাটা যাচ্ছে অথচ সৌম্যশুভ্রর কোন হেলদোল নেই।একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়াল । পিতার বদনামে পুত্রের বদনাম হতে পারে কিন্তু পুত্রের বদনাম ও দায় পিতারই । হায় রে অভাগা পিতা !
স্টিয়ারিং নিজের হাতে নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার চেষ্টা করি আমি, ‘কাশ্মীর দিয়ে লাদাখে আসতে কেমন লাগল ?”
মুহূর্তে ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিত, “অসাধারণ ! কাশ্মীর দিয়ে আসতে গিয়ে যদি কোন ঝামেলায় পড়ি- সেই ভেবে মানালি দিয়ে এসে মানালি দিয়েই ব্যাক করব ভেবেছিলাম । এক বন্ধু বলল, কাশ্মীর দিয়ে যেতে কোন ঝামেলায় পড়তে হবে না । ঝামেলা হলে বড়জোর একটা দুটো দিন নষ্ট হতে পারে, তার বেশি কিছু না । আরে ! কাশ্মীর দিয়ে জোজিলা পাস, দ্রাস, কারগিল হয়ে লাদাখে না গেলে এরোপ্লেনে যাও । আনন্দ পেতে হলে কাশ্মীর হয়ে গিয়ে লেহ-মানালি পথ ধরে ফিরতে হবে । ওর কথা না শুনলে খুব ভুল করতাম ।”
–ঠিকই করেছেন । বললাম ।
“দ্রাসে বৃষ্টির জন্য নামা হল না বলে টাইগার হিলটা দেখা হয়নি । কী ঠাণ্ডা দ্রাসে !” ভদ্রলোকের কথা শুনে আমরা দুজনেই অবাক । সৌরভদা বলল, “আমরা যেদিন এসেছিলাম সেদিন কি রোদ ! আর কি গরম ! এই হল লাদাখের প্রকৃতি! কখন যে কী রূপ নেয় জানা যায় না আগে থেকে । লামায়ুরু কেমন দেখলেন ?”
“লামায়ুরু দারুণ ! আলচি গ্রামটাও সুন্দর । বেশ ভালো লেগেছে।”
“আমাদের আলচিতে যাওয়া হয়নি । সোমোরিরিও যাওয়া হবে না । আপনারা সোমোরিরি যাওয়ার আগে খোঁজ নিয়ে নেবেন । ক’দিন আগে চিনা সৈন্যের একটা দল ঢুকে পড়েছিল ওখানে । এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে ঝামেলাও হয়েছিল ।”
“ওসব কিচ্ছু না । সব নাটক । আমাদের ড্রাইভারটা খুব ভালো । ওই সব দায়িত্ব নিয়েছে । এখন পর্যন্ত যা দেখছি তাতে চিন্তার কিছু নেই ।” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন উনি ।
“আমার খুব খিদে পেয়েছে।” সৌম্যশুভ্র খুব বিরক্তির সঙ্গে জানাল । অবশ্য ওর যা বয়েস তাতে খিদে লাগারই কথা । বাবা আর দেরি না করে ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল, “হ্যাঁ, চল । আসি দাদা । ভালো করে ঘুরুন ।” দুটো দল আলাদা হয়ে গেল ।
গেস্ট হাউসের ঘরটা ছাড়ছি না জমীরকে জানিয়ে দিয়েছি । দুটো ব্যাগে তিনজনের প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিলাম । ঠাণ্ডার জিনিসই বেশি । খারদুংলা পাস পেরোতে হবে । প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা এ পথের নিত্যসঙ্গী । কোথায় থাকব জানি না তাই স্লিপিং ব্যাগগুলো নিয়ে নিলাম ।
সৌম্যশুভ্র আজ খোশমেজাজে আছে । রাতের ভুঁড়িভোজ ভালই হয়েছে । ওর পছন্দের চিলি চিকেন আর চিকেন চাউমিন । আমরা দু’জন অবশ্য হাতে গড়া রুটি খেয়েছি চিকেনকারি দিয়ে । সৌরভদা ছেলের জন্য বেশ কয়েকটা ক্যাডবেরি আর সবার জন্য কেক কিনে নিয়েছে । সৌরভদাই সব খরচ করছে । বলেছি হিসেবটা রাখতে । সমান তিনভাগ করে টাকা দিয়ে দেব আমি । যদিও জানি সৌরভদা অনেককিছুই হিসেবে ধরবে না । সৌরভদাকে তো চিনি !আসার আগে টাকা দিতে চেয়েছিলাম । নেয়নি । বলেছে দরকার পড়লে চাইবে ।
লোডশেডিং চলছে । বারান্দায় প্লাস্টিকের চেয়ারে সৌরভদা আর আমি পাশাপাশি বসে লেহ’র আকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়া জ্যোৎস্না উপভোগ করছি । আজ চতুর্দশী, কাল পূর্ণিমা । সৌরভদাও আমার মতো জ্যোৎস্না ভালবাসে, তাই তো দেখেই দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছিল । জ্যোৎস্না রাতে শীতল মরুর প্রান্তরে থাকব বলে ।
পাহাড়ী রাতে চাঁদের আলো যখন লুটোপুটি করে বরফের চাদরের উপর তখন কেমন মায়াবী লাগে পাহাড়কে । সুনসান চাঁদনী রাতে বৈদিনী বুগিয়ালে রাত কাটিয়ে দেখেছি জ্যোৎস্নার রূপ । অমরনাথের পথে পঞ্চতরণীতে পূর্ণিমার সন্ধ্যায় দেখেছি কিশোরী জ্যোৎস্নার জলকেলি । সেদিন সময়ের সাথে জ্যোৎস্নার যৌবনে পদার্পনের সাক্ষী থাকতে পারিনি ঠাণ্ডার জন্য । ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স থেকে ফেরার সময় পথ দেখিয়েছিল চাঁদ । সেদিন ভরা যৌবন নিয়ে দেখা দিয়েছিল চাঁদ । সৌরভদাকে পেয়েছিলাম রাস্তার মাঝে । পরিচয় থেকে হৃদ্যতা । বন্ধুত্ব । সৌরভদা আর আমি মানেই সঙ্গে পূর্ণিমার চাঁদ । পাহাড়ের প্রকৃতি কখন ক্ষেপে উঠবে তা আগে থাকতে জানা যায় না । পূর্ণিমা কবে সেটা জানা যায় । তাই দেখেই বেরই । দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কোথাও আটকে গেলে চাঁদ পথ দেখাতে পারে ।
সৌরভদাও আমার মতোই ভাবছিল বুঝতে পারলাম ওর কথায় । “সুন্দরী সব সময় রূপে ভোলায় না কখনো পথও দেখায় । মনে আছে তোমার ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স থেকে ঘাংঘারিয়ায় ফিরতে পেরেছিলাম চাঁদের আলো ছিল বলে ? অন্ধকার রাত হলে সেদিন যে কী হত !”
-কী আশ্চর্য ! সৌরভদা আমিও সে কথাই ভাবছিলাম । জানি না কালকের পূর্ণিমা কী নিয়ে হাজির হবে । বরফে ঢাকা পাহাড়ই হোক বা হুণ্ডারের মরুই হোক নতুন কিছু তো পাবই । জ্যোৎস্না রাতে ধু ধু প্রান্তরেই থাকি অথবা বরফ রাজ্যেই থাকি রাতটা যেন বৃথা না যায় ।
সৌরভদা হাসল, “আমার কাছে প্রকৃতির সবই সুন্দর । প্রথম দেখাতে সব কিছুই ভালো লাগে । পরে হয়ত সব ক্ষেত্রে খুশিটা অত থাকে না তবে ভালোবাসাটা থেকে যায় । এই যে রুক্ষ ধূসর পাহাড় তারই তো একটা সৌন্দর্য আছে । এই যে নীল আকাশ – মুগ্ধ হয়ে দেখি আর দেখি । খারাপ লাগে না তো ! তবে রোদে দাঁড়িয়ে দেখতে একটু কষ্ট তো হয়ই । ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালবাসতাম । এখন সর্দি হয়। জ্বর হয় । কিন্তু ঘরে দাঁড়িয়ে যখন দেখি বৃষ্টির জল গাছের পাতা থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে মাটিতে- তখন শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে ! বৃষ্টির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বদলে গেছে, ভালোবাসা রয়ে গেছে তেমনই । একটুকু কমেনি । চাঁদের আলোতে ভেজা না গেলেও চাঁদের আলো গায়ে মাখা যায় । সেভাবে চাঁদকে না পেলেও তার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হবে না এ গ্যারান্টি আমি তোমাকে দিতে পারি ।”
এই জন্যেই সৌরভদাকে এত ভালো লাগে । সৌরভদা কখনও নিরাশ হতে দেয় না । সব সময় পাশে থেকে আশার কথা শোনায় ।
আলো এসে গেছে । ঘরে ঢুকে দেখি সৌম্যশুভ্র মোবাইল টিপছে । “বাবি, এবার শুয়ে পড় বাবা । কাল কিন্তু তোর কঠিন পরীক্ষা ।” সৌরভদার গলায় স্নেহ যতই গাঢ় হোক ছেলে একইরকম । মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “তুমি অত চাপ নিও না তো !” এ যুগের ভাষা ! সৌরভদার এবার আর সহ্য হল না । কড়া হল । “মোবাইল বন্ধ করে ঘুমা এখন । আমরাও শোব ।” এবার কাজ হল ।
আমার ক্যামেরাটা চার্জে বসিয়ে দিলাম । আসার সময় চার্জ করাতে ভুলে গেছি । এ’কদিন মনে পড়েনি । একটা ছবিও তুলিনি । ক্যামেরা চার্জে বসিয়ে খাটে এসে বসতেই সৌরভদা বলল, “বাবি কিন্তু ভালই ছবি তোলা শিখে গেছে !”
সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বলি, “ হ্যাঁ, দারুণ হাত ওর ! আমার কিন্তু একটা আপশোস থেকে গেছে সৌরভদা, ফটোগ্রাফিটা ভাল করে শিখতে পারলাম না !”
সৌরভদার উত্তর রেডি, “তুমি তো মনেই ছবি তুলে রাখ, ফটোগ্রাফি শেখার দরকার কি !”
ঘড়িটা হাত থেকে খুলে বালিশের পাশে রেখে বললাম, “সৌরভদা, জীবনের সুন্দর সুন্দর মুহূর্তগুলো হয়ত মনে রাখি, সাজিয়েও নিতে জানি পরপর, কিন্তু প্রকৃতির দুর্দান্ত সব ছবি, প্রতিটা মুহূর্তের সুখস্মৃতি ভালো ফটোগ্রাফাররা যেভাবে তুলে রাখে আমি তা পারি না,পারি না বলেই কাউকে দেখাতে বোধহয় লজ্জা পাই । আমার জীবনের সব ভালমন্দ, সুখদুঃখ সবই আমার –কিন্তু আমার বিশেষ কোন অনুভূতি, চিন্তার ফসল তো মানুষের জন্যেও । মানুষের অধিকার আছে আমার অর্জিত সম্পদে ।”
সৌরভদা মাথা চুলকাচ্ছে এখন । বোধহয় ভাবছে কি বলা যায় । এও ভাবতে পারে, রাত দুপুরে না ঘুমিয়ে এখন এলেন ফটোগ্রাফি নিয়ে কথা বলতে ! উত্তরের অপেক্ষা না করে শুয়ে পড়ি লাইট নিভিয়ে দিয়ে ।
-হুম, প্রত্যেকের জীবনেরই কিছু কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না । সব দুঃখের কথা শেয়ার করাও যায় না । কিন্তু সব আনন্দ’ই শেয়ার করা যায় । শেয়ার না করতে পারলে আনন্দ আর আনন্দ থাকে না । ঠিক তেমনই নিজের হাতে তোলা ছবিও কাউকে দেখাতে না পারলে ছবি তোলার আনন্দই মাটি । ছবি তো তোলাই হয় সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত বা দৃশ্যকে ধরে রেখে কাউকে দেখানোর জন্য । বল তো তেমন কতজন আছে তোমার ? সৌরভদা এমন করে আমাকে “বাপি বাড়ি যা” করে দেবে শেষে- বুঝতেই পারিনি ।
(ক্রমশঃ)

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post