Sankars Creation

পূজোর ক’টা দিন নিজেকে প্রায় ঘরে বন্দী করে রাখল তমোজিৎ । পূজো মাত্র তিনদিনের তবু মনে হচ্ছিল অনেকদিন যেন ঘরে বসে আছে । সৃজনীকে নিয়ে অনুপমা দিদির বাড়ি গেছে । দিদি জামাইবাবু আর দিদির মেয়েদের সঙ্গে মজা করে ঠাকুর দেখছে ।
তমোজিৎ সারাদিন গল্পের বই পড়ে, টিভি দেখে সময় কাটিয়েছে এ’কদিন । পূজোসংখ্যাও পড়েছে । এমনিতে তো আজকাল কিছু পড়া হয়না । অফিস আর সংসারের জাঁতাকলে পড়ে জীবন থেকে কত কিছুই তো হারিয়ে গেল । খুব কষ্টের একটা দীর্ঘশ্বাস ঠিক বুকের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এল ওর । দুটো বছর আগেও এভাবে নিজেকে ঘরে বন্দী করে রাখার কথা ভাবতেও পারত না।
পূজোর কয়েক মাস আগে নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনের টিকিটের লাইনে দাঁড়ানো দিয়ে শুরু হত পূজোর গন্ধ । সেই কোলকাতায় আসার পর থেকে একবারও বাদ যায়নি এতদিন । একটু বড় হওয়ার পর সৃজনী ঠিক হিসেব করে বলে দিত কবে টিকিট কাটতে হবে । পঞ্চমী, ষষ্টি মেয়েকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বের হত । সপ্তমীতে ট্রেনে চাপা । ট্রেন ফারাক্কা ব্যারেজ না পার হওয়া পর্যন্ত জানলার ধারে ঠায় বসে থাকত সৃজনী ।
পাট পচানোর পরিচিত গন্ধে ভরা ভোরের আকাশ যখন ফুটছে তখন ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে পড়া । হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা সবুজ প্রকৃতি আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে । রেল লাইনের ধারে নয়ানজুলিতে শাপলা উঁকি মারছে একটু একটু করে । তিস্তার ওপারে তখন সূর্যোদয়ের প্রস্তুতি ।
ছোটোবেলার পূজো ছিল বাঁধনছাড়া খুশির পূজো । চাকরি পেয়ে কোলকাতায় চলে আসার পর পূজোটা হয়ে গেল ঘরে ফেরার পূজো। প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দে মেতে ওঠার পূজো । পূজো মানে দুর্গাবাড়ির পূজো মণ্ডপে বসে বন্ধুদের সঙ্গে ম্যারাথন আড্ডা । পূজো মানে আরো অনেক কিছু । পূজো মানে মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী । পূজো মানে সবার জন্যে জামাকাপড় কেনা । পূজো মানে পূজোবার্ষিকী । সব কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেল চৈত্রের দুপুরের মতো । মনটা হয়ে গেল মেঘমেদুর আকাশের মতো ভারী ।
রেলের বুকিং কাউন্টারের কাছে বেশ কয়েক বছর আগে কেউ একটা বটগাছ লাগিয়েছিল । একদিন বটগাছের গোড়ায় কেউ কালো একটা লম্বাটে পাথর বসিয়ে দিল । অফিসে যাওয়া আসার পথে পড়ে বলে তমোজিৎ লক্ষ্য করত । সেবারই শিবরাত্রির আগের দিন ফুল আর আলো দিয়ে সাজানো হল জায়গাটা । শিবরাত্রির দিন মেয়েদের খুব ভিড় হল ।
ভোলানাথের জন্ম হল ফুটপাতে । এক বছরের মধ্যেই মন্দির হল ভোলানাথের । পরের এক বছরের মধ্যে জোড়া মন্দির । মা কালী ভোলানাথের সঙ্গী হলেন । সাদা জামা, সাদা প্যান্ট পরা রেলের টিকিটের দালালটা লাল কাপড় পরে, কপালে সিঁদুরের টিপ আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলিয়ে কালী সাধক হয়ে গেল । পূজোয় বাড়ি যাওয়ার টিকিট নিজেই কাটত তমোজিৎ । একবার এক এজেন্টকে টিকিট কাটতে দিয়ে কি বিপদেই না পড়েছিল । সেবার ওদের ষষ্টির দিন যাওয়ার কথা । সারা বছরে ষষ্টির দিনের টিকিট নিয়ে সবচেয়ে বেশী কালোবাজারি হয় জানে সে । রেলের বুকিং কাউন্টারের লোক থেকে পুলিশ পর্যন্ত জড়িয়ে থাকে এই কালোবাজারির সঙ্গে । প্রথমে ভেবেছিল দালালটাকে দিয়ে টিকিট কাটাবে, কিন্তু ভরসা পায়নি । এজেন্ট ধরেছিল । এজেন্ট ভুল করেই হোক আর অন্য ট্রেনে টিকিট না পেয়েই হোক কামরূপ এক্সপ্রেসে টিকিট কেটেছিল । ষষ্টির দিন অফিস করে কামরূপ এক্সপ্রেস ধরা খুব কঠিন ওর পক্ষে । অনুপমা ছোট্ট সৃজনীকে নিয়ে ট্রেন ধরতে গিয়ে কী নাজেহালই না হয়েছিল সেবার । তমোজিৎ নিজেও পৌঁছেছিল প্রায় ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে । সেদিন থেকে আবার নিজেই ভোরে গিয়ে লাইন দেয় টিকিট কাউন্টারে । লাইনের প্রথম কয়েকজন দালালটার লোক জানে সে । দালালটা আপাদমস্তক সাদাতে ঢেকে রাখে । মায় জুতোটাও সাদা । সে লাইন নিয়ন্ত্রণ করে এখনও । সেই সাদা পোশাকেই ।
আজ নবমী । পঞ্জিকা মতে দশমীও । ঘট বিসর্জন হয়ে যাবে তাই । বনেদী বাড়ির ঠাকুর বিসর্জন হয়ে যাবে আজই । টিভিতে দেখল বনেদীবাড়ির পূজোমণ্ডপে সিঁদুর খেলা হচ্ছে । বারোয়ারি পূজোর বিসর্জন কাল । দুর্গা বাড়ির মেলাটা কবে কে জানে। সেই কতদিন আগের কথা তবু সালটা এখনও পরিষ্কার মনে আছে । ইংরাজির ১৯৭৬ সাল । কলেজে পড়ে সে । সেবারই মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুর মর্দিনীর পরিবর্তে মহানায়ক উত্তমকুমারকে দিয়ে দেবী দুর্গতিহারিণীম বা ওই জাতীয় কোন অনুষ্ঠান প্রচার করেছিল আকাশবাণী । সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল ।
ওদের উঠানে শিউলি গাছে সেবারও প্রচুর ফুল ফুটেছিল । নদীর ধারে কাশের গুচ্ছও ছিল । কিন্তু মহালয়ার ভোরে যেন পূজোর গন্ধটাই পাওয়া যায়নি । গন্ধটা ফিরে এসেছিল ষষ্টির দিন রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার পর । আজকের মতো যখন তখন মহিষাসুরমর্দিনী শোনার সুবিধেতো ছিল না ।
দশমীর দিন দুর্গা বাড়ির মাঠে প্রথম দেখা । শারদীয়া মেলায় বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে প্রজাপতির মতো উড়ছিল সে । দেবতোষ মন্তব্য করেছিল, মালটা দারুণ তো !
কান লাল হয়ে উঠেছিল তমোজিতের । কিশোরী মেয়েটা কঠিন দৃষ্টিতে দেখছিল ওদের । তারপর তাচ্ছিল্য দেখিয়ে চলতে শুরু করেছিল আবার ।
মরমে মরে যাচ্ছিল সে, তাই দেবতোষ যখন বলেছিল, “চল, ওদের ফলো করি” – তখন ও রাজি হয়নি । দেবতোষ একাই মেয়েটার পিছু নিয়েছিল । একটু পরে ফিরে এসে বলেছিল, বাড়ির লোক আছে সঙ্গে ।
মেলায় ঘুরতে আর ভালো লাগছিল না । একটু পরেই সে বলেছিল, না রে দেবতোষ, আমার ভালো লাগছে না আমি বাড়ি যাব।
অতি উৎসাহী দেবতোষ বিস্মিত, সে কি রে ! এখনই ? বেশ রাগতস্বরেই জবাব দিয়েছিল সে, হাঁ, এখনই । তোর সঙ্গে ঘোরা যায় না । তুই মেয়েটাকে মাল বললি কেন ? তোরও তো দুটো বোন আছে । মেয়েদের একটু সম্মান করতে শেখ, আর যেদিন সেটা পারবি – মুখের কথা বোধহয় ওখানেই আটকে গিয়েছিল সেদিন । মেয়েটা পাশ দিয়ে যাচ্ছিল যে ।
একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল কিশোরী । চার চক্ষুর মিলন হয়েছিল বিদ্যুৎ চমকের মতো ক্ষণস্থায়িত্বে । অশনি সংকেতের মধ্যেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা দিয়েই মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছিল । তবু মনে হয়েছিল হাসিটা যেন আবাহনের, প্রশ্রয়েরও । এগিয়ে যেতে যেতে ফিরেও তাকিয়েছিল একবার । দেবতোষ হাত ধরে টেনেছিল, চল তো পিছু নিই । যায়নি সে । মেলার ভিড় ছেড়ে একাই বেরিয়ে এসেছিল ।
সেই প্রথম প্রেমের সলতে পাকানো শুরু । পথে ঘাটে মেয়ে দেখলেই তাকানো, মনের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগা । নাহ্‌,কাউকেই ভালো লাগে না ! রাতের বেলায় চোখ বন্ধ করলে একটা মুখই ভেসে ওঠে সামনে । কঠিন দৃষ্টিতে তাকানো, আবার বঙ্কিম ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি । তার গভীর চোখে অতলের আহ্বান দেখতে পেয়েছিল সে । খুঁজতে থাকে তমোজিৎ । চোখে লেগে থাকা বাসন্তী রঙ ফিকে হয়ে যায় তবু ।
মৌলি,শীলারা বন্ধুত্বের বেড়াতেই আটকে যায় আর সুচেতার মতো মেয়েরা দূরত্ব ঘোচাতে পারে না ওর আপাত নিঃস্পৃহ স্বভাবটার সঙ্গে ।
তমোজিতের পরের বছরের পূজো শুরু হয়ে গিয়েছিল মহালয়ার অনেক আগেই । মহালয়ার ভোরের প্রতীক্ষায় ছটফট করছিল রাতজাগা পাখির মতো । ঘরে ঘরে তখনও রেডিও আসেনি । পাড়ার পূজো মণ্ডপে মাইকে মহিষাসুরমর্দিনী’র রেকর্ড বাজত । মহালয়ার ভোরে ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত । অনেক প্রেমের সূত্রপাত হত সেদিন থেকে ।
পাড়ার পূজো মণ্ডপে মাইকে মহিষাসুরমর্দিনী শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য পাড়ার রাস্তা ধরেছিল সে । এপাড়া ওপাড়া ঘুরে ক্লান্ত হয়ে অনেক বেলায় ঘরে ফিরেছিল । বুকের মধ্যে তখন ঢাক বাজছে- ঢ্যাং কুরকুর –ঢ্যাং কুরকুর ঢ্যাং । পূজো এসে গেল । পূজো চলে গেল । দশমীর মেলায় একা একাই সে ঘুরে বেড়ালো রাত ন’টা পর্যন্ত ।
বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল একেবারে । পড়াশুনায় মন নেই । রেজাল্ট খুব ভালো হল না । চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতেই আর একটা পূজো এসে গেল । মহালয়ার ভোরে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ালো সে । একাই । শিউলির দেখা পেল না । নামটা ওরই দেওয়া । বাড়ির উঠানে শিউলি গাছটা ফুলে ভরে ওঠে শরতের শুরুতেই । মাটির বুকে ঝরে পড়ে টুপ টুপ করে । শুধু ওর বুকটাই হাহাকার করে একটু ভালবাসার জন্যে ।
পূজো চলে গেল, দশমীর মেলাও । ছোট্ট শহরটার সব পাড়াতেই বন্ধু থাকে । প্রায় বিকেলেই কোন না কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায় যদি কোথাও শিউলির দেখা মেলে । মনে মনে ভাবে, শিউলির দেখা পেলেই এবারে কথা বলবে ।
একদিন অনেক ভেবে চিঠিও লিখে ফেলল একটা । নিজের জন্যে লেখা ওর প্রথম প্রেমপত্র । লিখেছিল, তোমাকে মেলায় যেদিন প্রথম দেখলাম তখনই তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি – তুমি কি আমায় ভালবাসতে পারবে ? পারলে কাল বিকেলে পাঁচটার সময় পার্কে এসো । আরও অনেককিছু লিখেছিল সে সব এখন আর মনে নেই । এর আগে বন্ধুদের জন্য অনেক প্রেমপত্র লিখেছে সে । বন্ধুরা বলত ও অসাধারণ প্রেমপত্র লেখে । কতজনের প্রেমের শুরু ওর লিখে দেওয়া সে সব প্রেমপত্রের মোক্ষম বাণে ।
চিঠিটা পকেটে থেকে থেকে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়তে শুরু করল । বার বার হাতের ছোঁয়ায় নরম হয়ে যায় কাগজ । একদিন খুব মন খারাপ করা এক বিকেলে হলদে ছেঁড়া ছেঁড়া কাগজটা টুকরো টুকরো করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিল সে ।

সৃজনী আর অনুপমা ঘরে ফিরল । ধপ করে ওর পাশে বসে পড়ল সৃজনী । টিভিতে সিঁদুর খেলা চলছে । কী আশ্চর্য ! পূজো তো শেষই হয়নি ! বিস্মিত সৃজনী বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, সিঁদুর খেলছে কেন ?
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে । ওগুলো বনেদী বাড়ির পূজো তো ওদের আজই বিসর্জন । ওরা আচার অনুষ্ঠান মেনে, রীতি মেনে চলে কিনা ।
– কী করলে আজ সারাদিন ? অনুপমা পাশের ঘরে যেতে গিয়ে ফিরে আসে আবার । সোফাতেই বসে । তমোজিতের আর এক পাশে । ছবিটা এতক্ষণে সম্পূর্ণ হল । ওর মন খুশিতে ভরে উঠল । নিঃসঙ্গতা বড্ড বেশি ভাবায় মানুষকে । হাসিমুখে অনুপমার দিকে ফেরে সে, আজ শুধু টিভিই দেখলাম । কত ঠাকুর দেখাচ্ছে । এখনতো ঠাকুর দেখতে আর বাইরে যাওয়ার দরকার নাই ।
-ধুর, ঘরে বসে কি পূজো দেখা হয় ! চলনা বাপি, একটু ঠাকুর দেখে আসি । এবার তো সাউথের ঠাকুর দেখাই হয়নি একটাও। সৃজনী বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ।
-বেশ তো ঘুরছিস সেই ষষ্টি থেকে, এবার একটু রেস্ট নে । আর এখনও শখ না মিটলে ঘুরে আয় মাকে নিয়ে । কথাগুলো খুব ক্যাজুয়ালিই বলেছিল সে । অনুপমা যে ওটাকে খোঁচা বলে ভেবে নিতে পারে ভাবেওনি ।
ফুঁসে ওঠে অনুপমা, হাঁ, খুব ঘুরেছি ! দিদি নিমন্ত্রণ করেছিল তাই গিয়েছিলাম । তুমি গেলে হয়ত ঘোরা হত । তুমি তো গেলে না । সজলদা বের হতেই চায়না । অষ্টমীর দিন একটু বেরিয়েছিলাম মাত্র । সপ্তমীর দিন বাড়িতে কত লোক । খাওয়া দাওয়ার পাট চুকতে চুকতেই বিকেল হয়ে গেল । আর বেরনো যায় ?
মুহূর্তের মধ্যেই বদলে যায় আবহাওয়া কোন পূর্বাভাস ছাড়াই । ওর অনুভূতির চেয়ে অনুপমার ক্ষোভ বেশি । আক্রমণ করে সে, বিয়ের পর একবারওর পূজোতে বাপের বাড়িতে যাইনি । প্রত্যেকবারই তোমাদের বাড়িতেই গেছি । গত বছর বোনের বাড়িতে গিয়েছিলাম আর এবার দিদির বাড়ি গেলাম ।
তমোজিৎ যুদ্ধে যায়না । শান্তিপ্রিয় মানুষ সে । তাছাড়া স্বামী- স্ত্রীর ঝগড়ায় স্বামী কখনো জিততে পারেনা সেটা ওর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না । অবশ্য অনুপমার কিছু ক্ষোভ তো আছেই । বিয়ের পর সত্যি সত্যিই পূজোতে অনুপমা বাপের বাড়ি যেতে পারেনি শ্বশুরবাড়িতে যেতে হত বলে । এ দু’বছর পূজোয় কোলকাতায় থাকলেও বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা মনেও হয়নি বোধহয় । কয়েকবছর আগে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে অনুপমার মা-বাবা দু’জনেই গত হয়েছেন । দাদা-বৌদির সংসারে বোনেরা এখন ব্রাত্যই ।
অনুপমা গজ গজ করতে করতে পাশের ঘরে চলে যায় । সৃজনী বাবার কাঁধ ধরে ঝাঁকায়, ও বাপি, চল না । সামনের বছর তো কোলকাতায় নাও থাকতে পারি । দু’বছর যাওয়া হয়নি বাড়িতে । সামনের বার কিন্তু যেতেই হবে । আমি জানি তোমার মন খুব খারাপ হয়ে আছে । আমারও খুব খারাপ লাগে । পূজো এলেই সবাইকে খুব মিস করি । দাদাই, মামন, জেঠান, কাকিন সবাইকে।
মেয়েটা কি মায়ের চেয়েও চালাক হয়েছে নাকি সত্যি সত্যিই ওরও মন খারাপ হয় ? ছোটবেলায় পূজোয় বাড়ি যাওয়ার আগ্রহ তমোজিতের চেয়ে ওর কম হত না, কিন্তু ও এখন বড় হয়েছে । ওর এখানে একটা জগত তৈরি হচ্ছে বন্ধুদের সাথে । ওখানে বাড়ির লোক ছাড়া তো কোন বন্ধু নেই ।
পূজোর ক’টা দিন সবাই প্রিয়জনদের কাছে পেতে চায় । বাড়ির সবাই বার বার ফোন করে জানতে জানতে চেয়েছে এবারও কেন গেল না ওরা । হয়ত কষ্টও পেয়েছে কেউ কেউ । পাক । কয়েকবছর ধরে আকারে ইঙ্গিতে সবাই তো বোঝাতে চেয়েছে রিটায়ারমেন্টের পরও যেন ওরা কোলকাতাতেই থাকে ।
সৃজনী বাবার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে । তমোজিৎ মেয়ের মাথায় হাত বোলায়, তুই তো জানিস থিম পূজো টুজো আমার ভালো লাগে না । যা না মায়ের সঙ্গে ঘুরে আয় ।
অনুপমা পাশের ঘর থেকে শুনতে পেয়েছে । ব্যঙ্গ্যোক্তি করে, তোমার পূজো মানে তো দুর্গামণ্ডপে আড্ডা মারা আর বন্ধুদের বউয়ের সঙ্গে গল্প করা ।
বউয়ের কথার উত্তর দেয় না সে । অনেক সাধ্য সাধনা করে একটু নয় অনেকটাই বেশি বয়সে ওরা মেয়েটাকে পেয়েছে । খুব অভিমানী মেয়ে । মেয়ের মন রাখতে বের হতেই হয় তাই । দূরে নয়, কাছাকাছি । তবু মন খারাপের মেঘটা কেটে যায় । নবমীর পাগলপারা ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে থাকে ওরা ।

রেলের বুকিং কাউন্টারের সামনে দালালটা কয়েকটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে । লোকটার বয়স যেমন বেড়েছে তেমন মোটাও হয়েছে অনেক । সিল্কের পাঞ্জাবী, সাদা পাজামার সঙ্গে ম্যাচিং সাদা চপ্পল । চোখে সানগ্লাসও আছে । বেশ দামীই মনে হয় । হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না সে । সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষও তো বদলে যায় ।
তিনদিন ছুটির পর অফিস । আগামী তিনদিন আবার ছুটি । ভেবেছিল ব্যাঙ্কে খুব ভিড় হবে, হয়নি । সবাই পূজোর আনন্দে মেতে আছে । শুধু সেই যেন জেলখানার কয়েদির মতো কাটাল তিনটে দিন । মেয়ে, মা ফিরে এসে মুক্তি দিয়েছে জেলখানার জীবন থেকে। অফিসটাও আজকে ডানা মেলতে সাহায্য করেছে ।
ফেরার সময়ও রাস্তাঘাট ফাঁকা । গাড়িও কম চলছে পথে । পাড়ার পূজোমণ্ডপে সিঁদুর খেলা চলছে জোর কদমে । সঙ্গে সঙ্গে ভাসানের প্রস্তুতিও ।
হঠাৎ খুব কান্না পেল ওর । কান্নাটা বুকের গভীরতম অংশ থেকে উঠে এল আগ্নেয়গিরির লাভার স্রোতের মতো । কিন্তু উদ্গীরন হল না । এত বছর দুর্গাবাড়ির মণ্ডপে বসে কাটিয়ে দিয়েছে শিউলির জন্যে, যদি পূজোমণ্ডপে আসে সে । দশমীর মেলায় ঘু্রে বেরিয়েছে, যদি দেখা পাওয়া যায় । পায়নি দেখা ।
উমা বাপের বাড়ি এসেছিল । চলেও গেছে । সব মেয়েরাই পূজোয় বাপের বাড়িতে যেতে চায় । অনুপমাও চাইত ।
উমা আগামী বছর বাপের বাড়ি আসবে আবার । কাশফুলের সঙ্গে শিউলিও ফুটবে । মাটিতে ঝরে ঝরে পড়বে লাল সাদা শিউলি । মেয়েরা সকালে শিউলি কুড়াতে নামবে । পূজোর ক’টা দিন সবাই আবার আনন্দে মেতে উঠবে আর বউয়েরা সিঁদুর খেলায় মাতবে দশমীতে ।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি জন্ম জন্মান্তরের । অনুপমা বিশ্বাস করে । কিন্তু তমোজিৎ এখনও খুঁজে বেড়ায় সেই কিশোরীকে । কেন জানে না । দেখতে ইচ্ছে করে খুব । ও জানে হয়ত শিউলির কালো চুলেও পাক ধরেছে । দেখলে হয়ত চিনতেও পারবে না কেউ কাউকে । ওর নিজের বিয়ের পর অনেকবার সালংকারা শিউলিকে কল্পনায় আনার চেষ্টা করেছে, পারেনি । কিশোরী শিউলির ছবিটাই ভেসে উঠে আবার হারিয়ে যায় । তবু সামনের বছর যাবে সে । অদৃশ্য বন্ধনটাকে ছিঁড়তে পারেনি আজও । মনে হয় পারবেও না কোনদিন ।
মণ্ডপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকবছর পরে দু’ হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করল । বিড়বিড় করে বলল, আবার এসো মা ।
দিনের শেষে সব ঠিক থাকলে দিনটা ভালো । জীবনটাও ।
………………
কলমে – তপন বিশ্বাস
Mobile no.- 7595943557
Copyright protected .

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post