অভিনয় নয়
ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। মোনালি নিজের ওপরেই বিরক্ত হলো। এক্ষুনি গাড়ি এসে যাবে। বিছানা থেকে নেবেই টুক করে বাথরুমে ঢুকে পড়লো। সাধারণত দিনের প্রথম কাপ চা টা বাপির সঙ্গে একসাথেই খায় , কিন্তু আজ আর সময় নেই. -বাপী তুমি চা খেয়ে নাও। আজ আমার দেরি হয়ে গেছে। ব্রেকফাস্ট একসাথেই করবো।
স্নান করতে করতে ভাবলো-ধুর! ভাল্লাগছে না। অন্য চাকরি খুঁজতে হবে। আজ এখনই দিকশূন্যপুর মার্কা জায়গায় যেতে হবে।
মাস্টার্স করার পর বাপীর বন্ধু ফিল্ম প্রোডাকশন ম্যানেজার অঞ্জন কাকুর ইউনিট এ ঢুকে পড়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সম্পর্কে কৌতুহলের বশে । প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগতো ,কত সেলেব্রেটি দের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় !
যখন শুটিং স্পটে পৌঁছলো তার আগেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর,আর বাকি টেকনিশায়নরা এসে গেছে। খুব বড় ইউনিট তো মনে হলো না। কি ফিল্ম, কাস্টিং এ কারা আছে কিছুই জানে না মোনালি।অবশ্য ওর জানার প্রয়োজন ও নেই। ওর কাজটার মধ্যেই ও থাকতে ভালো বাসে। আসলে মোনালির মন জুড়ে থাকা এই রুপালি জগৎ টাকে খুব কাছ থেকে দেখে বুঝে গেছে বিস্ময় আর স্বপ্নের দুনিয়াটায় কোনো রূপকথার চমক নেই। বেশিরভাগ নামী বিখ্যাতরা গড়পড়তা একই টাইপের। বাইরে থেকে যতই হাসিখুশি , রিলাক্সড দেখাক না কেন , সবসময় অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তার শিকার। মাত্র এই কয়েক বছরে কত জনকে হারিয়ে যেতে দেখলো ! না বিখ্যাত হওয়ার লোভে না পড়াই ভালো। এমনিতে চিরকালই শিল্পীর জীবন খুব অনিশ্চিত সারা পৃথিবীতেই। না মোনালির বিখ্যাত হয়ে দরকার নেই।
ছেলেটাকে আগে কোনদিন দেখেনি। কিন্তু ছেলেটা মোনালির চোখে লেগে গেলো অদ্ভুত আচরণের জন্য। ভীষণ ছটফটে , কোনো টেনশন আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। না কি এটাও ওর অভিনয় !
হঠাৎ করে ক্যামেরা , এতো গাড়ি দেখে গ্রামে মানুষের ভীড় বেড়েই চলেছে। চেঁচামেচি তে অসুবিধা -সেটাও নতুন কিছু নয়। শুট হচ্ছে গ্রামের এক জমিদার বাড়িতে। বেশ বড় -যদিও পুরোনো। মোনালি বুঝলো আজ মূলত এই ছেলেটারই পার্ট টা শুট হবে। ছেলেটার মুখের আদল অল্প বয়েসের সঞ্জয় দত্তের মতো। মোনালি লক্ষ্য করলো ছেলেটা নতুন -কিন্তু আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। জানতে পারলো কাজ টা একদম নতুন এক ডিরেক্টরের। আর গল্পটা মধ্যপ্রদেশে র কোলিয়ারি সমাজের জীবন পাল্টে দেওয়ার চেষ্টায় একা লড়ে যাওয়া এক বাঙালি -শংকর গুহ নিয়োগীর জীবনের গল্প, যাকে মাফিয়ারা পরে খুন করে। কারণ কোলিয়ারির মজদুররা ধীরে ধীরে নিজেদের পশুর জীবন থেকে শংকরের নেতৃত্বে মুক্তির পথ খুঁজে নিচ্ছিলো। বাপির কাছে শুনেছিলো বটে -মনে পড়ে মোনালির। কেউই এমন কি কোনো বাঙালীই আর তাকে মনে রাখে নি।
কেটে কেটে শট নিচ্ছিলো অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায়। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে ছেলেটাকে বারবার সিগারেট টানতে হচ্ছিলো। মোনালি বুঝলো ছেলেটা সিগারেট অভ্যস্ত না। মাঝে মাঝে কাশি চাপার চেষ্টা করছিলো। আজকের দিনের শুটিংএ যে মেয়েরা শট দিচ্ছে – সবে ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন পা রাখতে যাচ্ছে সেটা মোনালির অভিজ্ঞ চোখে স্পষ্ট। শট দেবার ফাঁকে ছেলেটা একমনে স্ক্রিপ্ট দেখছিলো , আর বোধহয় চরিত্র টার মধ্যেই থাকার চেষ্টা করছিলো। যদিও হাসি ঠাট্টার সুযোগ ছাড়ছিলো না। ছেলেটা মোনালিকে ক্রমশঃ টানছিলো। মোনালি কি হঠাৎ করে বৃষ্টির শব্দ পাচ্ছে !না কোনো এক বিষন্ন বিকেলে একটা অজানা পাখীর ডাক তাকে একটু একটু করে একা করে দিছিলো ।
ফেরার সময় অভি -মানে শংকরের ভূমিকায় অভিনয় করা ছেলেটি এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অতীনদা কে বললো -অতীনদা আমাকে একটু কামালগাজি মোড়ে নামানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারেন !
– আমাদের গাড়ি তো ওদিকে যাবে না অভি। তুমি তা হলে এক কাজ করো…….
– অতীনদা আমাকে সাদার্ন বাইপাসে একটু যেতে হবে আমি ওকে নামিয়ে দিতে পারি, হঠাৎ বলে ফেললো মোনালি। যদিও চিত্রলেখার বাড়ি আজই যাবার দরকার ছিল না।
-শুটিং স্পট থেকে শর্টকাটে আসার রাস্তা ড্রাইভারের জানা ছিল বলেই বেশি সময় লাগলো না. আর অভি গাড়িতে উঠেই মোবাইল নিয়ে যে ভাষায় কথা বলছিলো সেটা না জানলেও সেটা স্প্যানিশ ভাষা সেটুকু মোনালি বুঝতে পারলো । অভি ওকে এড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে স্প্যানিশে কারোর সঙ্গে কথা বলছে ! ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না। কিন্তু অভির সঙ্গে কথা বলার তীব্র ইচ্ছে নিজের মধ্যে অনুভব করছিলো মোনালি।
-আমাকে ওই মিষ্টির দোকান টার সামনে নামিয়ে দিলেই হবে ম্যাডাম। মোবাইল হাতে রেখেই অভি বললো। অভি সঙ্গে সঙ্গে মোনালিও নামলো।
– চলুন একটু চা বা কফি খেয়ে নেওয়া যাক। মোনালি সামনের বড় দোকানটার দিকেই এগোতে চাইলো।
কয়েক সেকেন্ড এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অভি বলে উঠলো
– মাফ করবেন ম্যাডাম। যে কোনো ভালো লাগা টা গরম চায়ের কাপে তাড়াতাড়ি শেষ না করে আইসক্রীম এর মতো বেশি সময় নিয়ে আয়েশ করতেই বেশি ভালো লাগে, তাই না ?
– আমার এখানে কয়েক দিনের কাজ বাকি আছে। তারপর স্পেনে যাচ্ছি ম্যানুয়েল গোমেজ এর কাছে ওয়ার্কশপ করতে। এসেই আপনাকে ফোন করবো। আপনার মোবাইল নম্বর অতীন দার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছি।
আর একবারও না তাকিয়ে অভি দৌড়ে একটা অটোরিকশায় উঠে পড়লো।
View Comments
হায়দার আলীর হাভেলীতে একরাত -ভাস্কর ব্যানার্জী
ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। মোনালি নিজের ওপরেই বিরক্ত হলো। ...