Sankars Creation

ভবানীপুরে ছোটোবেলায় রোববার আমাদের বেড়াতে যাওয়ার একমাত্র জায়গা ছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। হেটে দশ মিনিট বড়জোর। আমরা ভিক্টোরিয়ার দক্ষিণের গেট দিয়ে ঢুকতাম। আমাদের কাছে ওটাই ছিল মেইন গেট। আর বের হতাম উত্তরের গেটটা দিয়ে। উল্টোদিকে ময়দান। প্রতিবার বেরোবার সময় লোলুপ দৃষ্টিতে উল্টোদিকে দাঁড়ানো ভেলপুরির হলুদ রঙের গাড়িটার দিকে তাকাতাম। হলুদের উপর লাল দিয়ে লেখা ভেলপুরি, মশালামুড়ি, বাটাটাপুরি। ঝালমুড়ির নামই যে মশালামুড়ি সেটা বুঝতেই অনেকদিন লেগেছিল। যাই হোক, পিতৃ আদেশে ফুচকা বা মশালামুড়ি গলধ:করণ করে (যদিও মন ভেলপুরির জন্য আকুল) হেটে হেটে বিড়লা তারামন্ডলের দিক দিয়ে ফেরা। এই ভিক্টোরিয়ার পাচিল ধরে বিড়লা তারামন্ডল অবধি পুরো রাস্তাটা আমি বাদিকে ঘাড় বেকিয়ে সেই সব বিক্রেতাদের অচেনা পসরার দিকে তাকাতে তাকাতে ও যুগপৎ নজর দিতে দিতে আসতাম। হলুদ রঙের বড় গাড়ি, তাতে একদিকে বিশাল চাটু, তার উপর এমঅব্যাংকমেন্ট এর মত করে প্রচুর রঙিন এক রকমের তরকারি রাখা। সামনে সাজানো লাল টমেটো, সবুজ ক্যাপ্সিকাম, লাল, হলুদ বেলপেপার(এই নামটাও বড় হয়েই জানা), ফুলকপি আর একদিকে প্রচুর বানরুটি।খাবারটার নাম জানতাম না। কিন্তু খুব লোভ হতো।ভাইও খাবারটার নাম জানতো না। দুজনেই অপু দুর্গার মতই করুণ চোখে যারা ওই বস্তুটা খাচ্ছে তাদের দেখতাম আর নিশ্চই তাদের পিতৃভাগ্যে নজর দিতাম। বেশ বড় হয়ে জানলাম ওই ধনীভোগ্য খাদ্যটির নাম পাওভাজি। নামটা শুনে ভক্তি ছুটে গেলেও কৌতূহল গেলনা।উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা এলো, সিট পড়ল সাখাওয়াত স্কুলে। বড়লোক পাড়ায় স্কুল। পরীক্ষার মাঝে আমার মা এসি মার্কেটে ঢুকে এপ্রিলের গরম এড়াতো আর আমায় রোজ গল্প শোনাত এসি মার্কেটের দোকানগুলোর নানা বিজাতীয় পসরার যার বেশিরভাগের নাম, অস্তিত্ব বা ব্যবহার আমাদের অজানা ছিল।মার চোখেও সেই সময় আমার পাওভাজি না পাওয়ার মতই কোনো একটা দু:খ দেখতে পেতাম। পরীক্ষা শেষ হতে হতে মা বুঝল এসি মার্কেট থেকে মার বাজেটে কিছুই কেনা যাবেনা আর আমি দেখলাম মায়ারামের পাওভাজির দোকান। কোনো একটা পরীক্ষার পর আমি মাকে টেনেটুনে পাওভাজির দোকানে ঢুকলাম। তার আগে আমি সুমিতার সাথে গ্লোবের সামনে থেকে এই বস্তুটি খেয়েছি।কিন্তু মা তখনো এটি খেয়ে দেখেনি। আর আমি মাকে নতুন কিছু শেখানোর জন্য ব্যস্ত। দোকানে ঢুকে অর্ডার দিয়ে বসে আছি, বসে আছি, বসেই আছি… দুজনেরই জামাকাপড় পরিষ্কার, টাকা দিতে পারবনা এমন ভাবারও কারণ নেই তাও মিনিটের পর মিনিট পেরিয়ে গেলেও আশেপাশে সবার সামনে প্লেট পৌঁছে গেল আমাদের সামনে ছাড়া।আধঘন্টা হয়ে যাওয়ার পর মা একমুখ অপমান আর আমি একমাথা রাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ওই রাস্তাটায় গেলেই এখনো এই স্মৃতিটাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তারপর বহুবার এটা খেয়েছি, আমি আর মা দুজনেই। কিন্তু মা আর আমি সেদিনের কথা কেউ কেন ভুলিনি জানিনা। প্রতিবার আমার এই খাবারটা খাওয়ার সময় এই অবাধ্য স্মৃতিটাই জেগে ওঠে…বার বার।আজ বানাবার সময়ও মনে পড়ল উপেক্ষার অপমানের কথাটা…

View Comments

There are currently no comments.
Next Post