Sankars Creation

সুজাতা দাস

 

8:42 এর ব্যান্ডেল লোকাল। আপ ট্রেন। সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন, তবু ফাঁকা ফাঁকা। সুনন্দা তরুণ উঠেই সীটে বসে পড়ে। মাত্র কয়েকটা স্টেশন। তবুও…
—আপনার ঠান্ডা বোধ কম বুঝি?
—ওর ঠান্ডা লাগে না। সোয়েটার আর ছাতা —দুটোতেই এলার্জি।
এক সৌম্য দর্শন বয়স্ক ভদ্রলোক। একমুখ হাসি, অচেনা মুখে চেনা চোখের ছোঁয়া।
—ঠান্ডা কোথায়? সোয়েটার পড়ব? একটু ঠাণ্ডা পরতে না পরতে সোয়েটার, সামান্য রোদ – বৃষ্টিতে ছাতা —অসহ্য!!!
সুনন্দার বাঁকা কথায় একমুখ বিরক্তি নিয়ে তরুণ ঝাঁঝিয়ে উঠল।
—আপনি দেখছি আর পাঁচটা বাঙালির থেকে আলাদা! তা মশাই কী করা হয়?
অহেতুক কৌতুহলে তরুণ ভ্রূ কোঁচকালো।।
—রিটায়র্ড ।
—কোথায় সার্ভিস করতেন?
—প্রাইভেট সেক্টরে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
—অফিস কোথায়?
—পার্ক সার্কাস।
—আমার বাড়ি।
—আপনি কলকাতায় থাকেন?
—আমি গ্রামের ছেলে। জন্মসূত্রে কালনার। শিক্ষা ও কর্মসূত্রে কলকাতার। আর এখন…আপনারা তো চন্দননগরের। বাড়ি না ফ্ল্যাট?
—বাড়ি। ফ্ল্যাট আমার অপছন্দ।
—আমারও। যত ছোটোই হোক। বাড়ির আলাদা সুবাস। ফ্ল্যাট —বড়লোকের বস্তি।
—একদম ঠিক।
—আপনি? গৃহবধূ না চাকরি?
সুনন্দা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে হাসি মুখে তাকাল।
—আমি স্কুলে আছি।
—সরকারি না বেসরকারি।
—আধা সরকারি।
—তবু ভালো। বেসরকারি স্কুলে দারুণ জ্বালা। শুধু পড়াশোনা নয়, টিচারদের আচরণ – পোশাক – সাজগোজ সব নিয়েই স্টুডেন্ট গার্জেনদের বড় মাথাব্যথা। আমার পুত্রবধূ কলকাতার এক নামী স্কুলের টিচার।
—হ্যাঁ, এব্যাপারে আমাদের চাপ তেমন নেই।
—খুব ভালো। ওরা সবসময় তটস্থ ।রান্নাবান্না করতে হয় না নিশ্চয়ই!
—না না, আমিই করি।
—স্কুল করে?
—কাছে স্কুল, অসুবিধা হয় না।
—কর্তা বুঝি কিছুই পারে না? রান্না কিন্তু আর্ট। সবার জানা দরকার।
তরুণ বেশ উত্তেজিত।
—রান্নায় আমার ন্যাক নেই। তবে চা, ভাত —এগুলো পারি।
সহাস্যে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। ব্যান্ডেল স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে। তরুণের হাতটা ধরে সজোরে ঝাঁকালেন।
—খুব ভালো লাগলো young Couple.
—Young? 61years old.
—তাতে কি? আমার থেকে ন’বছরের ছোটো।
—আপনি তো সত্তর বছরের যুবক।
সুনন্দা বেশ উচ্ছ্বসিত।
—আমাদের ভীষণ ভালো লাগলো। একটা কথা বলি, আপনি কোনোদিন বুড়ো হবেন না।
—তা-ই।
—বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষ নেগেটিভ ওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা। শুধু হয় না, হচ্ছে না, হবে না। এক একজন অসুস্থতার বিশ্বকোষ।
হো হো করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক।
—না, ম্যাডাম! শুধু বয়স্কদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। young generation! মুখে হাসি নেই। একটা বার্গার – পিৎসা মুখে গুঁজে শুধু দৌড়চ্ছে। কাদের জন্য? বাবা – মা? উঁহু! পারলে তাদের গলা টিপে বা সুপারি কিলার দিয়ে মেরে দেয়…
—সবাই কিন্তু এক নয়।
এক হাতে তরুণের কাঁধ জড়িয়ে ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নামলেন।
—কী.. গায়ে লাগলো? অবশ্যই এক নয়।
—আপনার মতো আলাপী মানুষ খুব কম দেখেছি।
সুনন্দা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। তরুণ হাতটা জড়িয়ে ধরে।
—দু-একজন ছাড়া আমার বন্ধু অনেক। আপনারও আমার বন্ধু হলেন। আজ আসি।
—কোথায় যাবেন?
—রাজহাট…
বলতে বলতে ভদ্রলোক জনসমুদ্রে মিশে গেলেন।
—যাঃ! ওনার নামটা জানা হলো না!
দুজনেই বেশ হতাশ হলো। এমন একজন মানুষের পরিচয় সেভাবে জানা হলো না। তবে ইনি সাধারণ নন। আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা কে জানে?
বাড়ির পাশে আরশিনগর দেখতেই বেড়িয়েছে দুজনে। দেবানন্দপুর, হংসেশ্বরী মন্দির, রাজহাটের এক আশ্রম। টোটো ভাড়া করে এগিয়ে চলল গন্তব্যে।
শরৎ বাবুর জন্মভিটে ছুঁয়ে শ্রীকান্ত – রাজলক্ষী – অন্নদাদিদি – ইন্দ্রনাথ – অভয়া – মহিমের শ্পর্শ নিতে ঘুরে বেড়ালো দেবানন্দপুরের পথে – ঘাটে। টোটো ছুটে চলে হংসেশ্বরী মন্দিরের পথে। অপূর্ব টেরাকোটার শিল্পকর্ম ।সুনন্দা মন্দিরে পুজোর থালি নিয়ে লাইনে দাঁড়াল। তরুণের চোখ মন্দিরের আনাচে কানাচে টেরাকোটা শিল্পকলায়। চক্ষু – মন সার্থক করে রাজহাটের আশ্রমে পৌঁছল। বেলা তখন তিনটে।
চারিদিকে শুধু সবুজ – সবুজ – সবুজ। আম জাম লিচু কাঁঠাল জামরুল কলা —কী নেই? সঙ্গে জানাঅজানা নানান রংবেরং ফুলের বিছানা। শীতের মরসুমে রকমারি সব্জি বাগান। অদ্ভুত প্রশান্তি। তরুণরা আগেও এসেছে। সাধারণত ছুটির দিনে লোকজনের ভীড় থাকে। সপ্তাহের কর্মব্যস্ত দিনেও বেশ ভীড়। যদিও সবাই ফিরছে।
—কী ব্যাপার? কোনো উৎসব?
সামনের একটা জটলা থেকে এক মাঝবয়সী লোক তরুণের প্রশ্নে ফিরে তাকাল।
—না না! আজ ডাক্তারবাবু এয়েছেন। মঙ্গলবারই আসেন। ভগবান গো! কত দূর থেকে সবাই আসে। যান না! এখনও আছেন।
আশ্রমের মূল মন্দির ছাড়িয়ে কিছু দূর যেতেই বাঁ-দিকে একটি একতলা বাড়ি। দাতব্য-চিকিৎসালয়। বাড়ির সামনে উঠোন। মাথায় টিনের শেড। এককোণে একটি টেবিল – চেয়ার। বসে আছেন একজন মধ্যবয়সী সৌমকান্তি ভদ্রলোক। তাঁর সামনে শ’খানেক চেয়ার।আপাতত জনা-কয়েক মানুষ।
—আরে! উনি না?
—কে?
—সেই ভদ্রলোক! আজ ট্রেনে আলাপ হলো? ভুলে গেলে…
—তাই তো?
প্রায় এক ছুটে দুজনে ভদ্রলোকের সামনে এসে দাঁড়াল।
—আপনারা?
—আপনি? এখানে? আপনাকে এখানে দেখব… ভাবিনি…
—পৃথিবীটা গোল। দেখা তো হবেই!
—আপনি একজন খ্যাতনামা ডক্টর? আপনার পরিচয়টা…
—তাতে কী? আমার পরিচয় ছাড়া আমাকে বন্ধু ভাবতে আপত্তি আছে?
—তবুও… আপনার মতো একজন মানুষ…
দুজনেই বেশ লজ্জিত।
–এই নিন আমার পরিচয়। দেখুন আপত্তি আছে কিনা?
হাসতে হাসতে তরুণের হাতে ভিজিটিং কার্ডটি দিলেন।
Dr. D. Kumar
M. B. B. S. (Gold Medalist & Hons)
M. S. (General Surgery) M. Ch (Urology)
EX. Professor & HOD.
Dept. of Urosurgery. Medical College. Kolkata.
—অমন চোখ গোল গোল করে কী দেখছেন? এবার ভিরমী খাবেন! ছাড়ুন ওসব…
—আমি ভাবতে পারছি না… আপনি… ছি ছি… কত কী বলেছি…
লজ্জায় সুনন্দার চোখমুখ লাল হয়ে যায়। তরুণেরও একই অবস্থা। দুজনেই ডাক্তারবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।
—আরে! আরে! করেন কী? উঠুন। ওসব বাইরের খোলস। আপনারা চাইলেন তাই দিলাম। আমার আসল পরিচয় চা—ই?
—আসল পরিচয়?
—মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক।
আর কিছু নয় —
এই হোক শেষ পরিচয়।
ডাক্তারবাবুর সশব্দ নির্মল হাসিতে ভরে উঠল আশ্রম প্রাঙ্গণ।

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post