Sankars Creation

তপন বিশ্বাস



।। এক ।।


ছাদে উঠে একটু হাঁপ ছাড়ল দেবেশ । মাথাটা এখনও দপদপ করছে । সাম্প্রদায়িকতা একটা সামাজিক ব্যাধি । সংক্রামক রোগের মতো দ্রুত ছড়ায় । সীজন চলে গেলে যেমন রোগের প্রকোপ কমে যায় তেমনি নতুন কোন ইস্যু এসে গেলে স্তিমিত হয়ে যাবে সাম্প্রদায়িকতার মতো জ্বলন্ত ইস্যুও । উস্কে দেওয়া আর উস্কে যাওয়ার মধ্যে সংযোগটা যেমন দ্রুত ঘটে শুভবুদ্ধির উদয় হতে সময়টা অনেক বেশি লেগে যায় । তার মধ্যেই ক্ষতি হয়ে যাবে অনেক ।
এর মধ্যে সারাদেশে কয়েকশ’ লোকের মৃত্যু হয়েছে । হাজার হাজার মানুষ গৃহছাড়া । কাগজে কাগজে দাঙ্গার খবর । আজ আমেদাবাদ তো কাল মীরাটে । বোম্বে, দিল্লীসহ দেশের অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে দাঙ্গার আগুন । আগুন নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত যারা তারাও ভীত, সন্ত্রস্ত । সন্দেহের ভাইরাস চোখে চোখে বংশবৃদ্ধি করছে । মনে ছড়াতে কতক্ষণ ?
শহরে কার্ফু জারি করা হয়েছে । দু’দিনেই নাভিশ্বাস উঠে গেছে কল্লোলিনীর । সকালে দু’ঘণ্টার জন্য বসা বাজারে আগুন । জাতে উঠে গেছে পোকায় কাটা আলু, কানা বেগুন । মাছ তো সোনার মতো দুর্মূল্য । চড়া দামে বিকোচ্ছে ডিম । গরীব ও উচ্চবিত্তের হেঁশেলের কথা জানে না দেবেশ । মধ্যবিত্তের হেঁশেলের অবস্থা বোঝে । পকেটে টান পড়লেও মোটামুটি জোগাড় হয়ে যাচ্ছে । প্রায় সব মধ্যবিত্তেরই অমূল্য সময় কাটছে খবরের কাগজ, রাজনীতির আলোচনায় ।
একটু আগেই তেমন এক পারিবারিক জমজমাট আড্ডা থেকেই উঠে এসেছে সে । বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত শীত করলেও কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে এখন । আকাশে অপটু হাতে তৈরি লাল আটার পোড়া রুটির মতো লালচে চাঁদ । গতকালই বোধহয় পূর্ণিমা ছিল । আজও নরম জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে চরাচর । চাঁদের অনুজ্জ্বল আলোর স্নিগ্ধতা আছে চোখ ধাঁধান বিচ্ছুরণ নেই । নারকেল গাছের পাতায় ঢেউ খেলে খেলে গড়িয়ে পড়ছে দেয়ালের ওপারে ।
চাঁদ হিন্দু-মুসলমান সবারই প্রিয় । চাঁদ নিয়ে ছড়া কাটে মা, ঠাকুমা, দিদিমারা । চাঁদ দেখে পরব করে মুসলমান । হিন্দু শিশুর চাঁদমামা, মুসলমান শিশুর ঈদের চাঁদ । চাঁদের কি কোন জাত আছে ? নিজের আলো নেই তবু সূর্যের আলো ধার করে পৃথিবীর মানুষকে আলো দেয় । তাইতো চাঁদ সুন্দর । সুন্দর তো সেই যে সবাইকে সুন্দর চোখে দেখে ।
মায়ের মুখটা মনে পড়ে । আটপৌরে শাড়ি পরা অম্বলে ভোগা রুগ্ন শরীর । মায়ের কম বয়সের মুখটা মনে করতে পারে না । বাবার মুখটাতো মনেই পড়ে না । তবে কথাগুলো খুব মনে পড়ে । মা-বাবার শেখান কথাগুলো ভোলেনি দেবেশ ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী না থাকলেও বাবা খুব বিদ্বান ছিলেন । প্রচুর পড়াশুনা করতেন । মা তেমন লেখাপড়া জানতেন না । মায়ের প্রায় সব কিছুই বাবার কাছে শেখা । অবশ্য মা তাঁর বাবার কাছেও অনেককিছু শিখেছিলেন । মায়ের বাবা ডাক্তার ছিলেন । হিন্দু-মুসলমান সব ধরণের রুগীই আসত দাদুর কাছে । রোগ যেমন ধর্ম দেখে হয় না ডাক্তারও তেমনি রুগীর ধর্ম দেখে চিকিৎসা করেন না । তবে সমাজের রীতি মেনে ব্রাহ্মণ ও হিন্দু-মুসলমানের জন্য আলাদা আলাদা হুঁকো রাখা থাকত দাদুর চেম্বারে । রুগীরা চলে গেলে দিদিমা চেম্বারে জল ছিটাতেন । দাদু হেসে বলতেন, “কী হয় জল ছিটিয়ে ? মুসলমানের গায়ের গন্ধ কি তাতে ঢাকা পড়ে ?”
দিদিমা হেসে বলতেন, “হিন্দুর বাড়িতে এটা করতে হয় । কাউকে ঘৃণা করে নয়, মনের শুদ্ধতা বজায় রাখতে এটা করি । তুমি ডাক্তার । তোমার বুদ্ধি কী বলে ? জল ছিটালে মানুষের পায়ে পায়ে আসা ধুলোগুলোও তো মরে ।”
দাদু হো হো করে হেসে উঠতেন তখন । “গিন্নী, তোমার সঙ্গে পেরে ওঠা আমার আর হল না । মেয়েগুলোকে কিন্তু এসব শিখিও না, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিপদে পড়বে । দিনকাল পালটাচ্ছে।”
নারীশিক্ষার চেয়ে নারীর বিবাহ দেওয়া অনেক বেশি জরুরী মনে করে দিদিমা মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বেশি জোর দিয়েছিলেন । একে একে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল । মা চতুর্থ কন্যা । দাদু মনের মতো জামাই পেয়েছিলেন । খুব ভালোবাসতেন বাবাকে ।
ছে’চল্লিশের দাঙ্গার সময় বাবা উত্তরবঙ্গে চলে এসেছিলেন । বাবার প্রিয় বন্ধু ছিল নুরুল চাচা । তিনিই বলেছিলেন, “অবস্থা ভাল না দেখতেই তো পাচ্ছিস । কয়েকজন ধান্দাবাজের জন্য রাজনীতির শিকার হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ । কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে যে লড়ব সাহস পাই না । তোদের কোলের মেয়েটার জন্য আমার খুব ভয় করে । তুই এখান থেকে চলে যা । যদি কোনদিন শান্তি ফেরে তখন ফিরে আসিস ।” শান্তি ফেরেনি । দেশভাগ হয়েছিল ।
বাবা জেল খেটেছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়ে । স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য পেনশন চালু হল । বাবা নেননি । তখন খুব অভাব ছিল সংসারে । মা বলেছিলেন, “আবেদন কর না ।”
বাবা বলেছিলেন, “স্বাধীনতার নামে যে বিষ পান করেছি সেটাই তো পেনশন । নেতারা গোলটেবিলে বৈঠক করে নীতি নির্ধারণ করে আর আমরা বন্ধুরা পরস্পরের শত্রু হয়ে বেঁচে আছি কোনরকমে । আমার নিজের দেশটাই তো বিদেশ এখন । কী হবে আর স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিচয় দিয়ে ?”
বাবা বলেছিলেন মাকে, “জাতের নামে বজ্জাতি করে দেশটাকে ভাগ করেছিল ওরা ব্রিটিশদের তৈরি ফাঁদে পা দিয়ে । এর মাশুল দিয়ে যেতে হবে যতদিন না মানুষ বুঝবে ধর্মের চেয়ে মানুষ বড় আর দেশ গড়ে মানুষ – ততদিন ।”
দেবেশও বাবার মতোই ভাবতে শিখেছে । বাবার দেওয়া শিক্ষাই পেয়েছে মায়ের কাছে থেকে । কিন্তু এ বাড়ির শিক্ষাদীক্ষা সবই ভিন্ন ধরণের । অথচ সবাই উচ্চশিক্ষিত । নিজেদের শিক্ষিত বলে জাহির করে । বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর ভারে অহংকারী হয়ে পড়েছে । আবার মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষও । ওরা দাঙ্গা করে না । করার সাহসও নেই । ঘরে বসে ঘৃণা ছড়ায় ।
শ্বশুরমশাই প্রায়ই মুসলমানদের লক্ষ্য করে বিষোদ্গার করেন । পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার যন্ত্রণা তিনি ভুলতে পারেননি আজও । দেশবিভাগের পর হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চলেছিল অবাধে । ওদেশের মুসলমানদের ঔদ্ধত্য আর চোখরাঙানি তিনি দেখেছেন । এমনকি শিক্ষক বলে তাঁর প্রাক্তন ছাত্ররাও রেয়াত করেনি তাঁকে । পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রাণের ভয়ে ।
শ্বশুরমশাই উচ্চশিক্ষিত কিন্তু দেবেশের মনে হয় তিনি এক চক্ষু দৈত্যের মতো একটা দিকই দেখতে পান । বাড়ির বাকি সদস্যরাও যেন স্বার্থপর দৈত্য । দেবেশ তাই চুপচাপই ছিল । “মুসলমানরা দাঙ্গাবাজ” শ্বশুরমশাইয়ের এই কথার উত্তরে সে শুধু বলেছিল, “বাবা, আপনি যে দাঙ্গার জন্য শুধু মুসলমানদের দায়ী করছেন এটা কিন্তু ঠিক নয় । দাঙ্গা হিন্দুরাও করে । কখনো প্রাণ বাঁচাতে কখনো নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য।”
শ্বশুরমশাই গর্জে উঠেছিলেন, “এটা হিন্দুদের দেশ । ওরা থাক না ওদের দেশে । একদিন আমরাও তো ভিটেমাটি ছেড়ে এদেশে পালিয়ে এসেছিলাম ওদেরই ভয়ে ।”
“তার জন্যে ও দেশের কিছু মুসলমান দায়ী হতে পারে এদেশের মুসলমানরা তো নয় । বরং ওরাও সেদিন অবিচারের শিকার হয়েছিল । অনেকে ওপারে চলেও গিয়েছিল ভয়ে । কিন্তু যারা চলে না গিয়ে থেকে গিয়েছিল তারা তো এদেশটাকেই নিজের দেশ ভাবে ।” দেবেশ অত্যন্ত নরমভাবেই বলেছিল । শ্বশুরমশাই ওর নরম স্বরকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “ওরা এদেশটাকে নিজের দেশ ভাবে ? কক্ষনো না । ওরা বেইমান । এদেশের মাটিতে বাস করে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায় । এদেশে ওদের কোন জায়গা হতে পারে না ।”
দেবেশ জানে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলার সময় এদেশের অনেক মুসলমান পাকিস্তানের হয়ে গলা ফাটায় । এর একটা কারণ বোধহয় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে গড়ে ওঠা পারস্পারিক বিদ্বেষ আর একটা কারণ অশিক্ষা । এদেশের মুসলমানদের বিরাট একটা অংশই শুধু অশিক্ষিত নয় দরিদ্রও । হিন্দুদের আচরণও তাদের দূরে ঠেলে দেয় । ওরা ভাবতে শেখে এটা হিন্দুস্তান – হিন্দুদের দেশ, আর পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ । ওরা তাই মুসলমান বলে মুসলিম দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে । দেবেশের ইচ্ছে করছিল না এই নিয়ে কথা বলতে । তবু বলল, “হিন্দু-মুসলমানের বিবাদের সুযোগ নিয়ে ফায়দা তোলে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ । আপনি পণ্ডিত মানুষ । ভেবে দেখুন তো এদেশের মানুষ হয়েও যারা দেশটাকে ধংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে শুধু নিজেদের মুনাফার লোভে, দেশটাকে দেউলিয়া করে দিচ্ছে । কিংবা যারা হেরোইন, ব্রাউন সুগার সহ আরো সব নেশার জিনিস ছড়িয়ে দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে তাদের চেয়েও এই মুসলমানরা খারাপ ? ওই মানুষগুলোর কোন জাত বা ধর্ম হয় না । আমরাই শুধু জাত ধর্ম নিয়ে পড়ে আছি ।”
শ্বশুরমশাই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বড়জামাই সিদ্ধার্থ বলেছিল, “তুমি যাই বল না কেন ওদের খুব বাড় বেড়েছে, একটু শিক্ষা হওয়ার দরকার ছিল । যা হয়েছে বা হচ্ছে ভালই হচ্ছে ।”
সিদ্ধার্থ’র সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্যালক সুপ্রিয় বলেছিল, “ঠিক বলেছেন সিদ্ধার্থদা । এবার থেকে যদি মুসলমান তোষণ বন্ধ হয় ।”
সুপ্রিয় ডাক্তার । দেবেশের মনে হয় সুপ্রিয় ডাক্তার নয় কসাই । মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করবে না ডাক্তার আর শিক্ষক । এটাই তো এতকাল জেনে এসেছে সে । মাথার মধ্যে কেমন যেন করে ওঠে দেবেশের । বুকটাও টনটন করে ওঠে । বাবার খুব ইচ্ছে ছিল দেবেশকে ডাক্তারি পড়াবেন ।
বাবার অকালমৃত্যুতে অনেক লড়াই করতে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য, লেখাপড়া করার জন্য । রাজনীতি করার সময়ও পায়নি, ইচ্ছেও করেনি । তাই সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরেই থেকে গেছে দেবেশ । রাজনীতি ছাড়া মানুষ নাকি থাকতে পারে না । রাজনীতিহীন জীবন নিস্তরঙ্গ জলাশয়ের মতো । আবার রাজনীতির জগতটা তো কর্দমাক্ত পুকুরের মতো । ধান্দাবাজির রাজনীতি থেকে শুধু ওর মতো মানুষ নয় শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর মতো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারও দূরে থাকে । গরীব মানুষগুলো রাজনীতির বোড়ে হতে বাধ্য হয় ।
সারা পৃথিবী জুড়েই অশান্তির আগুন । জাতিদাঙ্গার বীভৎস রূপ নগ্ন হয়ে পড়ছে । ইউরোপ, আমেরিকাও ব্যতিক্রম নয় । তবে সমস্যাটা বোধহয় এই উপমহাদেশেই বেশি । এদেশে মুসলমানদের কিছু হলে ওপারে হিন্দুর ঘর পোড়ে । পাকিস্তান এদেশের মুসলমানদের শোকে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দেয় । মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে সোরগোল তোলে ।
শাশুড়ি হঠাৎ মন্তব্য করেছিলেন, “মুসলমান জাতটাই খারাপ । সারা পৃথিবীতে ওরাই গণ্ডগোল পাকাচ্ছে । পাকিস্তানে তো সবই প্রায় মুসলমান, ওদের দেশে সব মুসলমান কি সুখে আছে ?”
দেবেশ হেসে বলেছিল, “মা, কোন জাত বা ধর্ম নয় । ধর্মের নামে, জাতের নামে বজ্জাতি করে মানুষ । জাত, ধর্ম এগুলো ব্যবহার করে মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ সৃষ্টি করা যায় এটা বোঝে ধান্দাবাজরা । সেই সুযোগটাই নেয় তারা । আপনারা তবু একটা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে থাকেন ।”
শ্বশুরমশাই তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিলেন, “একটু পড়াশুনা কর, ইতিহাস জানো, দেখবে ওদের ইতিহাসটাই বেইমানির । বাইরে থেকে এসে বেইমানি আর হত্যা করে দেশটাকে দখল করেছিল একসময় । জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে এদেশের মানুষকে । হিন্দুরা অনেক সহিষ্ণু আর উদার। তাই সবাইকে স্থান দিয়েছে ।”
শিক্ষিত মনের অহংকার থাকে না । মনের শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী না হলেও চলে । এদের ডিগ্রীর ভার রয়েছে কিন্তু মনের ভেতরটা এখনও অন্ধকারে আচ্ছন্ন। দেবেশ স্বশুরমশাইয়ের তাচ্ছিল্যের জবাবে হেসে বলেছিল, “বাবা, এদেশে আর্যরাও কিন্তু বহিরাগত । শক, হুণ, মোগল, পাঠান সবাই । দেশটা সবাইকেই স্থান দিয়েছে । তাই এদেশের সব মানুষের দেশ এটা । এদেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক কখনো কখনো ঘৃণার হলেও সম্প্রীতির উদাহারণও কিন্তু কম নেই । সুতরাং হিন্দু-মুসলমানের বিবাদের জন্য শুধু মুসলমানকে দায়ী না করে আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে সম্প্রীতি বজায় রাখা যায় ।”
শ্বশুরমশাই স্থান, কাল, পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠেছিলেন, “তোমাদের মতো লোকের জন্যেই হিন্দুধর্মের এই অবস্থা ।”
দেবেশ শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বলেছিল, “হ্যাঁ, আমার কাছে ধর্ম নয় মানুষই আগে । হিন্ধু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ শব্দগুলো আমার কাছে কোন ধর্মীয় মানুষ নয় ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর এক একটা পদ্ধতি । সত্যিই যদি আমি ঈশ্বরের সন্ধান করতে শুরু করি কোনদিন তবে নতুন কোন পদ্ধতির সাহায্য নেব । তার আগে না হয় মানুষের কথাই ভাবি । মানুষই যদি না থাকে তবে ধর্ম কোথায় থাকবে ?”
“সেটা কি শুধু আমরাই ভাবব ? হিন্দু ধর্ম তো সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে চিরকাল । আর ওরা শুধু আগ্রাসন দেখিয়েছে । সারা পৃথিবীর সন্ত্রাসের মূলে ওরা । এবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসে গেছে । যা হচ্ছে ভালই হচ্ছে ।” শ্বশুরমশাইয়ের কথার পৃষ্ঠে কথা লাগিয়ে শাশুড়ির উক্তি, “ঠিক । রামকৃষ্ণদেব তো বলেছিলেন যত মত তত পথ । ওরা তো সেটা মানে না । ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করে নিল । আমরা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম ভিটেমাটি ছেড়ে ।”
ঈশিতা বাবা-মায়ের পক্ষ নিয়ে বলেছিল, “ঠিকই তো । আমরাই শুধু কেন ত্যাগ স্বীকার করব ?”
দেবেশ স্ত্রী’র কথায় মাত্র একবার তাকিয়েছিল । একটা শিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করে ভেবেছিল একজন ভালো বন্ধু পেল । ঈশিতা বন্ধু হতে পারেনি, বউ হতে পেরেছিল । এ ক’বছরেই সে বুঝে গেছে ঈশিতা তাবিজ-কবজ আর কুসংস্কারে মোড়া একটা জীবন্ত বিভীষিকা । কিছু উত্তর দিলেই ওর খনখনে গলা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত তক্ষুনি । দেবেশ পেরে উঠত না ওর সাথে । যে নিজের ঘর ঠিক করতে পারে না সে অন্যের ঘর কী করে ঠিক করবে ? উঠে পড়েছিল । এ বাড়ির সবাই জানে দেবেশ সিগারেট খেতে মাঝে মাঝে ছাদে যায় ।
সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়ছে বুকের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ । এই বাড়ির পরিবেশে ও ঠিক খাপ খায় না । ছেলেটার কথা ভাবে । ছেলেটার কোমল মনটাও কেমন বিষিয়ে দিচ্ছে এরা ! গতকালই ছেলেটা জিজ্ঞেস করেছিল, “মুসলমান কারা বাবাই ? ওরা কি মানুষ মারে ?” সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়েছিল কোন মুসলমান বাড়িতেও হয়ত ছোট একটা ছেলে বা মেয়ে জিজ্ঞেস করছে তার বাবাকে, “হিন্দু কারা আব্বা ? ওরা কেন আমাদের বাড়িতে আগুন দেবে ?”
দেবেশ সস্নেহে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, “কে বলেছে ওরা মানুষ মারে ! ওরাও তো মানুষ বাবা । মানুষ কি কখনো মানুষকে মারতে পারে ? দৈত্য –দানবরা মানুষকে মারে ।”
“দৈত্যদানবের তো বড় বড় দাঁত থাকে তাই না বাবাই ? ইয়া বড় বড় লাল লাল চোখ”- ছোট ছোট হাত দিয়ে দেখিয়েছিল ছেলেটা । দেবেশ ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল, “না বাবাই, এখন দৈত্যদানবেরা খুব চালাক হয়ে গেছে । ওরা ওদের বড় বড় দাঁত, নখ, লাল চোখ সব লুকিয়ে ফেলেছে । ওরা যন্ত্র দিয়ে মানুষের রক্ত শুষে নেয় । মানুষ বুঝতেও পারে না ।”
ছেলে ঘাড় কাত করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “দৈত্যদানবকে তাহলে চিনব কী করে বাবাই ?”
“ওদের চেনার জন্য অনেক পড়াশুনা করতে হবে তোকে । অনেক জায়গায় ঘুরতে হবে । অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে । তখন বুঝতে পারবি কে মানুষ আর কে দানব ।” বুঝিয়েছিল দেবেশ ।
“কিন্তু মা যে বলে সবার সাথে মিশবি না !” ছেলে দ্বিধাগ্রস্ত । দেবেশের ভুরু কুঁচকে উঠেছিল । “মা এ কথা বলে বুঝি ! আসলে মা ভয় পায় দুষ্টু ছেলেদের সাথে মিশতে গেলে তারা যদি তোমাকে মারে । তুমি তো এখনও ছোট তাই মা মানা করে ।” এও এক যন্ত্রণা ! ঈশিতা ছেলেটার মাথায় আজে বাজে চিন্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছে ছোট থেকেই । ছেলেটা এখন অনেক কিছুই জানতে চাইবে । ওকে সেভাবে বোঝাতে হবে । ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করেছিল, “বাবাই, তুমি তো অনেক পড়েছ, অনেক জায়গায় গিয়েছ, অনেক লোকের সাথে মিশেছ, তুমি দৈত্যদানবদের চেনো ? আমাকে দেখাবে একটা দৈত্য ?”
“দেখাব । তুমি ভালো করে পড়শুনা করে বড় হও তখন দেখাব । ওরা ছোটদের খুব ভয় দেখায় তো তাই এখন দেখলে ভয় পেয়ে যাবে ।” ছেলেকে বোঝাতে হিমশিম খায় দেবেশ ।
“আচ্ছা বাবাই, মুসলমানরাও কি খারাপ ? দাদু যে বলে ওরা পাজি !” ছেলের কথায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সে । এতটুকু বাচ্চার মাথায় এখনই ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ । ঠিক হয়ত এভাবেই একটা মুসলমান বাচ্চার মাথায়ও ঢুকে যায় হিন্দুরা তাদের শত্রু।
ছাদ থেকে নেমে দেখতে পায় এখনও জোর আলোচনা চলছে সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে । ধর্ম আর জাতপাত নিয়ে আলোচনার সময় এই উচ্চ শিক্ষিত মানুষরাও ভুলে যায় বিজ্ঞান । ভুলে যায় সত্যকে । অদ্ভুত একটা সময়ের গর্তে প্রবেশ করছে মানুষের ভবিষ্যৎ । দেবেশ ভয় পায় । ওর ভবিষ্যৎ ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই । ও বসার ঘরে না ঢুকে শোবার ঘরের দিকে যায় । ঘুমন্ত ছেলেটার ভ্রু’র মাঝে একটা ত্রিকোণাকার ভাঁজ পড়েছে । ঠিক ওর মতো । বুক দুলে ওঠে দেবেশের । কাল থেকে কার্ফু শিথিল হবে । ওর মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে । এই মুহূর্তে বাবার কর্তব্যবোধটা বেশি মনে হচ্ছে ওর ।

।। দুই ।।
রবিবারের সকালে একটু দেরি করেই ওঠে দেবেশ । শনিবার রাতেই বাজার করে রাখে ফলে বাজারের তাড়া থাকে না । শুধু মাংস আনতে একবার বের হতে হবে । স্কুল থাকলে ছেলেটাকে টানাটানি করে ওঠানো যায় না –আজ নিজেই উঠে পড়েছে । উঠেই টানাটানি করে তুলেছে বাবাকে । তারপর খাটের উপরে দাঁড়িয়ে দেবেশকে সামনে দাঁড়াতে বলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে । “এবার চোখ বন্ধ কর।” দেবেশ চোখ বন্ধ করে । ছেলে বাবার হাত দুটো ধরে দু’পাশে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, “এবার চোখ খোল ।” দেবেশ হেসে চোখ খোলে । ছেলে মহা উৎসাহে বাবার ছড়ানো হাতের পেছনে হাত নিয়ে বলে ওঠে, “আই অ্যাম ফ্লাইং ।” এ এক নতুন খেলা ছেলের । টাইটানিক সিনেমা দেখে শিখেছে ।
টাইটানিক সিনেমাটা ছেলের খুব ভালো লেগেছিল । পুরোটা না বুঝলেও কিছুটা বুঝেছে । প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল সিনেমা হল থেকে বেরিয়েই । টাইটানিক জাহাজটা কোথা থেকে ছেড়েছিল, কোথায় যাচ্ছিল, বরফের পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ওভাবে ডুবে গেল কেন, জ্যাকের কী হল – এসব ।
ছুটির দিন প্রায়ই বাবাকে নিয়ে এই খেলাতে মেতে ওঠে ছেলেটা । জাহাজ ডুবে যাওয়ার চেয়ে জাহাজের ডেকের সামনে দাঁড়িয়ে সামনে চোখ মেলে সমুদ্র আর আকাশের মাঝে বিরাট ফাঁকা অথচ চলন্ত পৃথিবীটাই বোধহয় ওকে বেশি টেনেছিল । শিশুমন তো উড়তে ভালোবাসে ।
“বাবাই, আমাকে পোলিও খাওয়াতে নিয়ে যাবে না ? আজ তো পোলিও রবিবার ।” পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে বাবাই ।
“না, তোর তো পাঁচ বছর হয়ে গেছে । এখন তুই পড়তে বস । আমি বাথরুমে যাব এখন । ছাড় ।
ঈশিতা কিচেন থেকে বলল, “চা খেয়ে যাও।”
দেবেশ কাগজটা নিয়ে বসে । আজ সব রাজনৈতিক দলেরই কিছু না কিছু কর্মসূচি আছে । পাতাজুড়ে সেই খবর । কোন দল কর সেবকদের সংবর্ধনা দেবে, কোন দল আবার কালা দিবস পালন করবে । কোন দলের কর্মসূচিতে আছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মিছিল ও সমাবেশ ।
ক’বছর আগে মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা কাজ করেছিল তা এখন অনেকটাই স্তিমিত । শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এখনও এই দিনটার বিশেষ মূল্য আছে ।
কলিংবেল বাজল । বাবাই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল । ‘ভাইয়া’, ‘ভাইয়া’ । মমতাজ এল । মমতাজ বাড়ির ঠিকে ঝি । ঈশিতা অবশ্য ওকে মমতা বলে ডাকে । ঈশিতা ওকে মমতা মানিয়েছে দুটো কারণে । এক- সংস্কার । আর দুই- অতিথিদের জানতে না দেওয়া যে মেয়েটা মুসলমান । তবে ওর নাম মমতা হলেই ভালো হত । মমতাজ বাবাইকে ভাইয়া বলে ডাকে । বাবাই ওর সাথে খাবার জল আনতে যাবে এখন । ঈশিতা কতদিন আটকে রাখতে চেয়েছে । বলে, “মেয়েটার টিবি আছে কিনা কে জানে !” কিন্তু ছুটির দিন বাবাইকে আটকানো যায় না ।
রোগা হাড় জিরজিরে শরীর মমতাজের । বয়স কুড়ি না তিরিশ বোঝা যায় না । দারিদ্র আর অপুষ্টির জীবন্ত বিজ্ঞাপন মেয়েটা । চার বোন আর মা-বাবার সংসার ওদের । মমতাজের মা আর মমতাজ বাড়ি বাড়ি কাজ করে । ওদের বাবা রাস্তার ধারে বসে ফল বিক্রি করে । পোখরানের মরুভূমিতে কিংবা চাঘাই পাহাড়ে বোমা বিস্ফোরণের খোঁজ ওরা রাখে না ।
বেশ কয়েকঘর মুসলমান পরিবার এখনও টিঁকে আছে এই অঞ্চলে । হাইরাইজ ফ্ল্যাট বাড়ির চাপে কতদিন থাকবে জানে না । প্রোমোটারের কালো থাবা অচিরেই হয়ত গরীবগুর্বো মানুষগুলোকে ভিটেমাটি ছাড়া করবে । প্রোমোটাররা দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে যেন । হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ করে না প্রোমোটাররা ।
শীতটা পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না । বর্ষা এবার দেরি করে বিদায় নিয়েছে । মাত্র কয়েকদিন আগেই গেছে নিম্নচাপের ধাক্কা । প্রকৃতি বোধহয় নির্মম প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে ।
পাড়ার ক্লাবে পালস পোলিও খাওয়ানো চলছে । বড় বড় ফেস্টুন ঝুলছে গেটে । স্থানীয় এক সমাজসেবিকা দেবেশকে দেখে বলল, “কী দাদা, ছেলেকে কখন আনবেন ?”
দেবেশ হেসে উত্তর দিল, “ওর বয়স তো পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে ।”
সমাজসেবিকা সুমধুর হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে বলল, “ওহ, তাই তো !” দেবেশ জানে এরা সবাই সব খবর রাখে । তবু জিজ্ঞাসা করে । খাতিরটা রাখে । ভোট আর চাঁদার জন্য যেতে হয় যে । জনসংযোগটাও রাখা জরুরী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষের ।
ভর দুপুরে ছেলে বায়না ধরল, “চলো, ক্রিকেট খেলি ।” ছুটির দিন । ছেলেটার মাথায় শচীন-সৌরভ-জাদেজারা ভর করে আছে সকাল থেকেই । দেবেশ একটু পেপারটা ভালো করে দেখবে বলে নিয়ে বসেছে সবে । ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “রোদটা একটু কমুক তারপর খেলিস । এখন একটু শুয়ে থাক ।”
ছেলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “না, আমি এখন ঘুমাব না । তুমি খেলবে চলো । নাহলে তোমার সব ধূপকাঠি ফেলে দেব কিন্তু ।”
দেবেশ চোখ পাকায়, “খুব সাহস হয়েছে দেখছি ! কিছু হলেই আমার সিগারেটের উপর নজর তোদের । তোর মাও কথায় কথায় আমার সিগারেট নিয়ে পড়ে । যা। এখন একটু শুয়ে থাক । আমি ঠিক চারটের সময় খেলতে নিয়ে যাব ।”
পাশের ঘর থেকে ঈশিতা খনখনে গলায় বলে, “খাওয়া ছেড়ে দিলেই তো পার । কতগুলো ধোঁয়া গিলে কী লাভ ? আয় বাবাই, একটু শুবি আয় । কখন থেকে তো বলছি । মমতা এ বেলা এল না এখনও । আসবে কিনা কে জানে ! ভাতটা ঢাকা দিয়ে রেখেছি ওর । এলে বলে দিও । আমার ঘুম পেয়ে গেছে । আয় বাবাই ।”
অন্যান্য কাজের বাড়িতে চা-মুড়ি বা চা-রুটি দেয় । ঈশিতা মমতাজকে দুপুরে ভাত-ডাল, তরকারি দেয় খেতে । একপিস মাছ বা মাংসও দেয় । ঈশিতা বুদ্ধিমতী । জানে ওই ভাতের জন্যেই মমতাজ কামাই করে না ।
ছেলে গেল না মায়ের কাছে । ছুটির দিন বাবাকে ছাড়তে চায় না ও । বাবার কাছেই দাঁড়িয়ে ব্যাট নিয়ে শ্যাডো প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে লাগল সে।
বিকেলে ফ্ল্যাটের সামনে বাপ-বেটায় ক্রিকেট খেলছিল । মমতাজ বাবাকে নিয়ে রিক্সা করে ফিরছিল । রিক্সা থামিয়ে চিৎকার করে ডাকল, “ভাইয়া” । ছেলে ওর মমতা দিদির ডাকে ছুটে গেল । দেবেশ রিক্সার দিকে এগিয়ে গেল । মমতাজ পরম মমতায় ওর বাবার মাথাটাকে বুকে চেপে ধরে বসে আছে । কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, “বাবা আজ বাজারে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে । লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল । খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম । আজ আর আসতে পারব না । কাল সকালে আসব ।”
।। তিন ।।
যে কাজে বেরিয়েছিল দেবেশ সে কাজটা হল না । চশমার কাঁচটা পাল্টাতে হবে । বদরুদ্দিন আজ দোকান খোলেনি । ওর বাড়ি উলুবেড়িয়ার দিকে কোথায় যেন । ওদিকে ক’দিন ধরেই গণ্ডগোল চলছে । বোধহয় সেজন্যেই আসেনি বদরুদ্দিন । বহুবছর ধরে ওর দোকানে চশমা বানায় দেবেশ । একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে ওর উপর ।
স্টেশনে এসে দেখল ট্রেন চলছে না । কখন চলবে জানে না । ক’দিন ধরেই চলছে এ রকম । কখন চলবে তার কোন ঘোষণাও নেই । বাড়ি থেকে বের হলে মানুষ বাড়ি ফিরবে কিনা জানে না । বাসে-ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে । অবরোধ, ভাঙচুর তো আছেই । যারা এসব করে তারা দেশ তো বটেই মানুষেরও শত্রু । আগামীদিনে মানুষ কীভাবে বাঁচবে, কী খাবে তার চিন্তা করতে করতেই চিন্তাবিদদের মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে যাচ্ছে । মায়েদের চোখে ঘুম নেই । বাবার স্বস্তি নেই । শাক-সবজির বাজারে আগুন । পিঁয়াজ গরীবের পাতে পড়তে রাজী নয় আর । মধ্যবিত্তের সঙ্গেও দর কষাকষি করছে এখন । সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দেখে আর বাজার থেকে আনা দুটো পিঁয়াজের গন্ধ শুঁকে চলছে নিম্ন মধ্যবিত্তের সংসার । উত্তর- পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অস্থিরতা । অসমে আন্দোলনের জেরে নেট পরিসেবা বন্ধ । পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আতঙ্ক । সারা দেশেই ছড়াচ্ছে আতঙ্কের তরঙ্গ । দিল্লির জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অশান্তি ছড়িয়েছে দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে । দেশের মানুষের শান্তি বিঘ্নিত হয়নি ! কারণ শান্তি নামের শব্দটাই তো হারিয়ে গেছে মানুষের জীবন থেকে ।
এখনও অফিস টাইমের সময় হয়নি । তাতেই লোকে লোকারণ্য স্টেশন চত্বর । ভিড়ের মধ্য থেকে মাঝবয়সী একজন মহিলা মাথায় একটা বস্তা নিয়ে দেবেশের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে । রোগা, হাড় জিরজিরে চেহারা । সর্বাঙ্গে শুধু দারিদ্রের খোলস নয়, দারিদ্র আর অনাহার গিলে খেয়েছে মহিলাকে । এমন চেহারার কোন মহিলাকে তার চেনার কথা নয় তবু দেবেশের মনে হল মহিলাকে কোথায় যেন দেখেছে আগে । মনে করতে পারছে না । বয়স হলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায় শুনেছে । তাই হয়ত হবে । আবার অনেক সময় অচেনা লোককেও চেনা চেনা মনে হয় । এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই মহিলা এগিয়ে এল । বিবাহিত, বিধবা না সধবা বোঝার উপায় নেই । মাথায় রুক্ষ চুলের মাঝে খরখরে চওড়া সিঁথি ধূলিধূসরিত গ্রামের রাস্তার মতোই শূন্য । হাতে শাঁখা বা নিদেন পক্ষে একটা চুড়িও নেই । “ভালো আছেন দাদা ?”
সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারল । মমতাজ ! “তুই এখানে ? ভালো আছিস ?” দেবেশ একরাশ বিস্ময় নিয়ে দেখছে মেয়েটাকে । সেদিনের মমতাজের শরীরে সময় ছোবল মারলেও মুখের হাসিটা যেন একইরকম আছে। তেমনি আছে ওর সরল চাউনিটা ।
ছেলের স্কুলে যাতায়াতে ঈশিতার খুব অসুবিধা হত বলে গড়িয়ার ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটা ছেড়ে পোদ্দার নগরে নতুন বাসা ভাড়া করে চলে এসেছিল দেবেশরা । অনেকদিন ছিল পোদ্দারনগরে । অনেকবার বাসা বদল করতে হয়েছে । ছেলে যখন কলেছে ভর্তি হল তখন নরেন্দ্রপুরে কেনা জমিতে বাড়ি বানিয়ে উঠে এসেছে ওরা ।
“ভাইয়া কেমন আছে ? আপনি তো বুড়ো হয়ে গেছেন ! চিনতে পারিনি প্রথমে । কোথায় থাকেন এখন ? কতদিন পরে দেখলাম আপনাকে !” অনেক প্রশ্ন করে যায় মমতাজ ।
“তুই কেমন আছিস বল । বিয়ে হয়েছে কোথায় ?” দেবেশের কথায় উত্তর না দিয়ে সে এদিক ওদিক তাকায় মমতাজ । কাউকে যেন খুঁজছে । তার ফাঁকেই বলল, “ভালো আছি দাদা । দুটো বোনের বিয়ে দিয়েছি । আর একটাকে তো বাঁচাতেই পারলাম না । বাবা চলে যাওয়ার পর ফতিমাও চলে গেল । এখন মা আর আমি থাকি । মায়ের বয়স হয়েছে । দেখা শোনা করার একজন লোক তো চাই ।”
দেবেশ বুঝতে পারল মেয়েটার বিয়ে হয়নি । কেই বা বিয়ে করত অমন টিবি রুগীর মতো চেহারার মেয়েকে ! তবু জানতে ইচ্ছে করছে অনেককিছু । মেয়েটা বাবাইকে বড্ড ভালবাসত । “তোরা এখনও ওখানেই আছিস ?” জিজ্ঞেস করে সে ।
মমতাজ চোখ কপালে তুলে বলে, “আপনি জানেন না, নাহ ! ওখানে এখন বড় বড় ফ্যালাট হয়েছে । কাছেই মেট্রো ইস্টিশন । কিছু টাকা পেয়েছিল আব্বা । সেটা দিয়ে মল্লিকপুরে একটুকরো জমি কিনে ছোট একটা বাড়ি করেছিল । বাড়ি করতে করতেই আব্বা চলে গেল । ফতিমাও চলে গেল । আমি কী আর করি ? ফুলের ব্যবসা ধরলাম । পেটগুলো চালাতে হবে তো । আব্বা যেখানে ফল বিক্রি করত সে জায়গায়ই বসি ।”
“তাই ! তোর মাথায় ফুলের বোঝা না ? নামিয়ে রাখ না । কষ্ট হচ্ছে না ? ট্রেন যে কখন চলবে কে জানে !”
“না দাদা । ট্রেন না চললে আমাকে বাসে করে যেতে হবে । আমার কিছু বাধা কাস্টমার আছে তাদের ফুল না দিলে চলবে না । বৌদি- ভাইয়া কেমন আছে বললেন না তো ! ভাইয়া অনেক বড় হয়ে গেছে না ?”
“বৌদি আছে একরকম । বয়স হয়েছে তো । ভাইয়া ভালই আছে । আয় না একদিন আমাদের বাড়ি । তোর তো যাতায়াতের পথেই পড়ে । মোবাইল আছে তোর ?”
একহাতে মাথার বোঝা ধরে রেখে কোমরের এক কোণা থেকে সস্তার একটা মোবাইল বের করে দেবেশের হাতে দিয়ে বলল, “আপনার নম্বরটা সেভ করে দেন । আমি ফোন করে যাব ।”
দেবেশ ওর মোবাইলে নিজের নম্বরটা সেভ করে একটা মিস কল করে ওকে ফিরিয়ে দেয় মোবাইলটা । নিজেও সেভ করে নিল মমতাজের নম্বরটা ।
মোবাইলটা বেজে উঠল দেবেশের । ঈশিতার ফোন । “চারদিকে গণ্ডগোল হচ্ছে । তুমি কোথায় ?”
“আমি স্টেশনে । ট্রেন চলছে না । দাঁড়িয়ে আছি ।” দেবেশ জানায় । অপর প্রান্তে উদ্বেগ । “তুমি ট্যাক্সি করে চলে এসো না । আমার ভয় করছে ।”
“দেখছি”- বলে ফোনটা কেটে দিয়ে মমতাজের দিকে ফেরে । “আমি ভাবছি ট্যাক্সি করে চলে যাই । তুইও যেতে পারিস আমার সাথে ।” মমতাজকে খুব আপন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ।
“না দাদা, আমি বাসে চলে যেতে পারব । আপনি কিছুক্ষণ দেখুন তারপর না হয় ট্যাক্সিতে যাবেন । অনেক ভাড়া পরে যাবে ।” মমতাজ খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেল ।
মেয়েটা ওর বাবার অসুস্থতার সময় এক হাজার টাকা ধার চেয়েছিল । চেষ্টা করলে দিতে পারত কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেনি । একশ’ টাকা দিয়ে বলেছিল, “আমার হাতে এখন একদম টাকা নেই রে । এর বেশি দিতে পারছি না ।”
অপস্রিয়মাণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখটা জলে ভরে উঠল আজ । মনে হল এরা বেঁচে থাকার জন্য কষ্ট করে আর অনেক মানুষই এখন বেঁচে থাকার জন্য কষ্ট পায় । ক’দিন আগে একটা ধর্ষণকাণ্ডে দেশ উত্তাল হয়েছিল ।  আবার নতুন একটা সমস্যার মুখে পড়ে দেশ উত্তাল । বৃত্তটা কবে যে সম্পূর্ণ হবে !
উত্তরবঙ্গের বাড়িটাতে ভাইয়েরা আছে । ভাইদের সংসার আছে । অনেকদিন যাওয়া হয় না । ছেলে হায়দ্রাবাদে । ঈশিতাদের পরিবারটাও ছড়িয়ে গেছে । ওদের অনেকেই এখন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডাসহ অনেক দেশে শাখাপ্রশাখা মেলেছে ।
সয়ে গেছে সব । শুধু স্কুল, কলেজের বন্ধুদের খুব মিস করে দেবেশ । নরেন্দ্রপুরে বরিষ্ঠ নাগরিকদের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । একে অন্যের খোঁজ নেয় । ব্যস ! পাড়ার ছেলেছোকরার দল আসে চাঁদা নেবার সময় আর ভোটের আগে । আপন বলতে, বন্ধু বলতে কেউ নেই এখানে । এটা যে তার দেশ নয় । বাসাবাড়ি ।
……………

Let us enjoy every day as a new year. This site calls for everyone to be in the realm of creation which can be anything- writing, gardening, drawing, origami even some items created for home decoration that gives you satisfaction and makes the day a new year. That gives meaning to life. Let us share our creations on this page.

View Comments

There are currently no comments.
Next Post