“নিজেরে হারায়ে খুঁজি” –
শঙ্কর গাঙ্গুলী
-জন্মের পরেই বাচ্ছারা কাঁদে কেন বলতো শিবু ?
-খিদে পায় বোধহয় … না না ও টি র ওই বিরাট আলোতে চোখে কষ্ট হয় নিশ্চয়ই।
– ধুস …. তুই সবসময় আমি যা বলতে যাবো তার উল্টো বলিস।
হো..হো.. করে হেসে নিয়ে একটু থেমে বললো বিপ্রদাস দা। খুব মজার লোক। কয়েক বছর হলো পাড়ার কামাল দের বাড়ি ভাড়া এসেছে। সরকারি অফিসের কর্মচারী। যখন যেরকম ইচ্ছে হয় থাকে… খায় .. .. বই পড়ে … ঘুরে বেড়ায়। এক কথায় পাগলাটে মানুষ। বিপ্রদাস নাম এখন চালাচ্ছে। মাস তিন আগে আবির নাম নিয়েছিল। অফিসের বাইরে ও মুক্তিনাথ নামটা ব্যবহার করে না। সব সময় একনাম নিয়ে চলতে ওর ভালো লাগে না। যখন খুশি নাম পাল্টে ফেলে। সাদা কাগজে রীতিমতো ওর নিজের এজলাসে এফিডেভিট করে নাম পাল্টে লিখে দেয় – আজ হইতে আবির চট্টরাজ। ….বিপ্রদাস চট্টরাজ নামে পরিচিত হইলেন।আমরা যারা ওর ভক্ত ওই কাগজ দেখে নিজেরা অভ্যেস পাল্টে ফেলি।
– আসলে কি জানিস বাচ্চা হলেও বুঝতে পারে -এই ঝামেলার দিন শুরু হয়ে গেলো। সেই চিন্তায় ফার্স্ট ল্যান্ডিং এ সবাই ইমোশনাল হয়ে পড়ে।
আমি এবার না হেসে পারলুম না। হেসে ফেলে বিপ্রদার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম কেস খেয়ে গেলাম। চপ মুড়ি থেকে আমার নাম কাটা যাওয়ার রিস্ক নিয়ে ফেলেছি।
এই এক সমস্যা। ওর প্রতি টান কি বিকেলের ঘুগনি -চপের টানে জানি না , এসময়টা প্রতিদিন একটা চোখ বিপ্রদার ( এখন অন্য নামে ডাকা যাবে না ) জানালার দিকে আমাদের থাকে। যেদিন লিস্টে যার যার নাম ওঠে তারা ওর সঙ্গে খেতে যায়। তবে মিথ্যে বলবো না খুব কম দিনই আমার নাম কাটা যায়। আজকে মেনু গোবিন্দর দোকানের মাংসের চপ আর মুড়ি।
-না রে শিবু আমি প্রায় ভাবি। আচ্ছা কেমন হতো বলতো যদি মানুষ প্রথম বারই হো হো করে হাসতে পারতো ! চুপ করে আমার মাথার পেছনের একফালি জানালাটার ফাক দিয়ে দেখা পাওয়া এক চিলতে আকাশটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো সে।
বিপ্র দা মানে মুক্তিনাথ চট্টরাজের বাড়ি শুনেছি বাঁকুড়া জেলায়। না এর বেশি কিছু কখনোই বলে নি। জিজ্ঞাসা করার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি বাবা একদিন দেখা করতে বলেছিলো- কিন্তু বাবার এই স্বাভাবিক প্রশ্ন টার কোনো উত্তর দেয় নি। আমার লোকটাকে ভীষণ ভালো লাগে -কেমন যেন একটা টান আছে। অনেক সময়ই পাগলাটে প্রশ্ন করে। অনেক গল্প টল্প করে। কিছু বুঝি.. কিছু বঝি না। কিছু কথা ভীষণ ভালো লেগে যায়। যদিও তার মধ্যে কেমন চেনা অথচ অচেনা একটা রহস্যের গন্ধ লেগে থাকে। ঠিক যেমন মা তার পুরোনো তোরঙ্গটা খুলে বছরের কোজাগরী লক্ষী পুজোর জিনিস যখন বার করে তখন গন্ধটা আসে। এটা নাকি আমাদের দেশের বাড়ির থেকে আনা। দেশটা আমার কোনোদিন দেখা হয় নি। মা-বাবা -দাদুর কাছে শুনে শুনে এখন এতো চেনা হয়ে গেছে যে চোখ বুজলেই আমি ইচ্ছে মত ঘুরে আসি চন্ডী মন্ডপ , মঠ বাড়ী.. কাসেম আলীর খড়ের দাওয়া তে দু দন্ড জিরিয়ে নিয়ে খাল দিয়ে ছিপ নৌক চড়ে সোজা বকুল মাসির বাড়ি।
-কি রে আর কেউ এলো না যে ! বিপ্রদা আমাকে যেন ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। বিপ্রদার ছোয়া লেগে আমিও কি হারিয়ে যাই আজকাল !
পরীক্ষা শেষ। ক্লাস নাইন হবে। একটু একটু করে বড়ো হচ্ছি। শরীরে মনে তার ইশারা। মুক্তিদা তখন নজরুল চট্টরাজ। সকাল বিকেল যখনই যাই শুধু নজরুল। নজরুলের অসম্ভব প্রাণশক্তি…. তার হৈ হৈ হাসি…. তার কবিতা ।বিদ্রোহী আবৃত্তি শুনে শুনে বিদ্রোহ করব করব ভাবছি। তখন একদিন শুনলাম মুক্তিদার সুন্দর মোহিত করে দেওয়া কণ্ঠস্বরে – “আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে ..” আমাকে যেন কে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। এ তো আমারই কবিতা যেন নজরুল লিখে দিয়ে গেছেন। কদিনেই কবিতা টা মুখস্থ হয়ে গেলো। উল্লাসের চোটে বাড়ি -পাশের বাড়ির নারায়ণ কাকু,অন্তু দা তাড়া করবে করবে এমন অবস্থা হয়ে গেলো। মুক্তিদা ততদিনে এস্টাব্লিশড পাগলা। আর বাচ্চা ছেলেদের পাগল বানানোর কারখানার মালিক – খ্যাতি পেয়ে গেছে।
নজরুল চট্টরাজ একদিন জিজ্ঞাসা করলো –
-আচ্ছা বলতো -গাধার বাচ্চা কে কি বলে ?
-কেন গাধা।
আবার প্রশ্ন -ছাগলের বাচ্চা ?
– ছাগল।
কুকুর বাচ্চা।
-কুকুর।
এবার বলতো মানুষের বাচ্চা কে কি বলে ?
– ওহ: এ কি ঝামেলায় পড়লুম। আমি বিরক্ত। মানুষের বাচ্চা তো মানুষই না কি ?
-মানুষের বাচ্চা যদি মানুষ হয় তাহলে তোর মা কেন রোজ রোজ বলে – শিবু ভালো করে পড়াশোনা করে মানুষ হ !
আমি পিচের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে রান আউট হয়ে গেলাম। সত্যি তো কালই মা বলছিলো -ওই পাগলটার কাছে সময় নষ্ট না করে এবার একটু পড়াশোনায় মন দে।
বেশ কাটছিলো মুক্তি দার সাথে। প্রথম প্রথম ভ্যাবলা,পল্টু, খোকন রা আসলেও কিছুদিন পরে দেখি মুক্তিদার ক্লাবে আমিই সেক্রেটারি, .জয়েন্ট সেক্রেটারি ..একমাত্র সাধরণ মেম্বার।
মাধ্যমিক পরীক্ষা কাছে চলে এলো। মুক্তিদা কে বললাম কয়েকটা বাংলা রচনা লিখে দিতে। হাসতে লাগলো সে।
– সে কি রে রচনা আবার মুখস্ত করবি কি রে ! নিজের ভাষায় নিজের মনের কথা লেখাই তো রচনা।
-ধ্যাৎ , তা বললে হয় নাকি ! বেশ কয়েকটা কোটেশন , কিছু ভালো ভালো কথা তো জুড়তে হবে; না কি বলো। তবেই তো রচনায় নম্বর দেবে।
-এই তো ভুল বললি। তোদের এই এক বড় বদ অভ্যেস। যে কথা বিশ্বাস করিস না সারা জীবন সেই কথাগুলো আউড়ে যাস নিজের জ্ঞান জাহির করতে। সেই কথাই বলবি যেটা জীবনে পালন করতে পারিস। অনেক বড় বড় কথা জানার দরকার নেই। দুটো তিনটে ভালো কথা জানলেই হবে , শুধু জানলে হবে না , সেগুলো বিশ্বাস করতে হবে। আর সেগুলো নিজের জীবনে পালন করতে হবে। বাঙালি যাদের নিয়ে গর্ব করে সেই রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ -এদের সম্পর্কে সবচেয়ে কম জানে। আসলে জানতে চায় না। কারণ এদের জীবন অনেকটাই খুব কঠিন দুঃখ ,যন্ত্রনায় পরিপূর্ন। সেই সব কিছুর মধ্যেও তারা জীবনকে মহান করে তুলেছেন। আর আমরা তাদের সেই সংগ্রামকে এড়ানোর জন্যই তাদের বেদিতে বসিয়ে পুজো করি। তাহলে অনুসরণ করা টা এড়ানো যায়। না রে কোটেশন দিতে হবে না। বিষয় টা সম্পর্কে সঠিক ধারণ তৈরী কর আর তারপর নিজের মতো চলো। এটা পরীক্ষার রচনা না জীবন রচনা। বুঝলি পাগলা। চুপটি করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো মুক্তি দা।
আমি তখন কলেজে। মান্না দে র গানের শশীকান্ত নাম টা পছন্দ হয়ে মুক্তিদা যথারীতি শশীকান্ত হয়ে রয়েছেন। একদিন বললে-
– আমি শশীকান্ত কেন বলতো ?
– আসরটা কে করলে মাটি , আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিজের মুখ নিজে চেপে ধরলে কি হবে ! বেরিয়ে গেছে তো।
আমার গায়ে পরম স্নেহের হাত রেখে মুক্তিদা বললো -এতদিনে ঠিক মতো একটা কথা বললি।
মুক্তিদার চোখ টা কি ভিজে ভিজে লাগছে ! দিনের শেষ আলোতে ঠিক দেখলুম কি !
আমি এখন একাউন্টেন্সি তে অনার্স নিয়ে পাস করে চাকরি..সংসার নিয়ে, চিটে গুড়ের স্বাদে মোহিত। মুক্তিদা এখন কি নামে আছেন… কোথায় আছেন বলতে পারবো না। আবার হয়তো শশীকান্ত হয়ে কোনো আসরকে মাটি করার খেলায় মেতে গেছেন -কে জানে !
View Comments
লক্ষ্যভেদ
শঙ্কর গাঙ্গুলী -জন্মের পরেই বাচ্ছারা কাঁদে কেন বলতো শিবু ? -খিদে পায়...